পাবজি এবং গেমিং ডিজঅর্ডার
পাবজি এবং গেমিং ডিজঅর্ডার - ছবি সংগৃহীত
পৃথিবীর ৫২ দশমিক ২০ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এদিক থেকে বাংলাদেশের মানুষও সামনের সারিতেই রয়েছে। এই প্রযুক্তি আমাদের অনেক কল্যাণে লাগলেও কেড়ে নিচ্ছে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। পৃথিবীজুড়েই চলছে প্রযুক্তির অপব্যবহার। বিনোদনের নামে অনৈতিকতার অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে তরুণসমাজ। শুধু তরুণ নয়, শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার কাছেই এটি এখন কৌতূহল ও আকর্ষণের বিষয়ে পরিণত। বিনোদনের এমনই এক উপকরণ হলো ডিজিটাল গেমিং। এটা আজ রোগে পরিণত হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে গেমিং ডিজঅর্ডার।
ডিজিটাল বা ভিডিও গেম আবিষ্কার হয় গত শতকের চল্লিশের দশকে যুক্তরাষ্ট্রে। আশির দশকে জনপ্রিয়তা পায়। সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত বাণিজ্যিক গেমসের নাম ছিল ‘কম্পিউটার স্পেস’। এর পর আটারি কোম্পানির বিখ্যাত গেম ‘পং’। ক্রমান্বয়ে কোলেকো, নিনটেনডো, সেগা ও সনির মতো কোম্পানিগুলো বিচিত্র ধরনের গেমস উদ্ভাবন ও প্রচার চালিয়ে বিশ্বের সর্বত্র পৌঁছে দেয় আধুনিক এই বিনোদন পণ্য। ২০০৯ সালে দেখা যায়, প্রায় ৬৮ শতাংশ মানুষ ভিডিও গেমসে জড়িয়ে পড়ে। কালক্রমে ভিডিও গেম পরিণত হয় বিশ্বের অন্যতম লাভজনক ও দ্রুত বর্ধনশীল শিল্পে। মহামারীর মতো বিশ^ব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে এটি। সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা যায়, বিশ্বের প্রায় ২২০ কোটি মানুষ নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে ভিডিও গেমস খেলে। এদের বেশির ভাগই শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণী।
জনপ্রিয় গেমসের মধ্যে কিছু রয়েছে প্রচলিত ক্রিকেট ও ফুটবল খেলার মতো। বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে এ খেলা খেলতে হয়। এতে রয়েছে হার-জিত। শিশু-কিশোররা এতে এতই নেশাগ্রস্ত হয়ে উঠেছে যে, তাদের সবকিছুরই সর্বনাশ হচ্ছে। এক ধরনের গেম রয়েছে যেখানে প্রচ- গতিসম্পন্ন গাড়ি নিয়ে পথ চলতে হয়। পথ চলতে গিয়ে প্রতিযোগীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হয়। তার গাড়ি বা মোটরসাইকেল ছিনিয়ে নেয়া হয়, কখনো গাড়ির নিচে মানুষকে পিষে মারা হয়। ট্রাফিক আইনের তোয়াক্কা না করে বাজার, রাস্তা, বাড়িঘর ভেঙে দ্রুতগতিতে সামনে অগ্রসর হয়। পুলিশ ধাওয়া করলে তার সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকা হলো গেমসের আকর্ষণীয় দিক। এভাবে যে যত বেশি অন্যায়, অবিচার ও ভাঙচুর করে টিকে থাকতে পারে; সে তত বেশি পয়েন্ট অর্জন করে। আরেক রকম গেমের সর্বত্র রয়েছে মারামারি, দখল, যুদ্ধ, হিংস্রতা ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। শত্রু নিধনের জন্য বাঙ্কার খুঁড়ে ওৎ পেতে বসে থেকে প্রতিযোগী বা কথিত শত্রুকে শেষ করা হয়। এভাবে যত বেশি জঘন্য ও হিংস্র্র হওয়া যায়; তত বেশি পয়েন্ট অর্জিত হয়। গেমারের সামনে ভেসে ওঠে প্রচণ্ড এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধাবস্থা। বন্দুক, কামান, গ্রেনেড, গোলাবারুদ ইত্যাদি নিয়ে সে চরমভাবে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। গুঁড়িয়ে দিচ্ছে শত্রু শিবির। পার হচ্ছে লাশের স্তূপের মধ্য দিয়ে। কখনো লাশের পকেট থেকে ছিনতাই করছে অর্থকড়ি। আর তা দিয়ে কিনছে ড্রাগ। খেলতে গিয়ে শিশু-কিশোররা মানুষ মারার নেশায় বিভোর হচ্ছে। মারছে একের পর এক মানুষ। কখনো ইটের উপর মাথা রেখে মাথা থেঁতলে দিচ্ছে, কখনো বা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে মাথা ভাঙছে। কী এক বীভৎস চিত্র!
বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় ডিজিটাল গেমের নাম ‘প্লেয়ার আননোনস ব্যাটেল গ্রাউন্ডস’। সংক্ষেপে বলা হয় ‘পাবজি’। ব্লুহোল কোম্পানির এই গেম তৈরি করেন আইরিশ ওয়েব ডিজাইনার ব্রেন্ডান গ্রিন এবং প্রকাশ করে পাবজি করপোরেশন। প্রতি মাসে পৃথিবীর প্রায় ২২৭ মিলিয়ন মানুষ এ খেলায় মত্ত থাকে। প্রতিদিন খেলে প্রায় ৮৭ মিলিয়ন মানুষ। বাংলাদেশের এক কোটি ৪০ লাখ মানুষ প্রতিদিন এ খেলা খেলে। পাবজি খেলার নিয়ম হলো- প্রথমত ১০০ জন মানুষ একটি পরিত্যক্ত দ্বীপে অবস্থান করে।
প্যারাসুটের মাধ্যমে তারা সেখানে পৌঁছে। সারাক্ষণ যুদ্ধ করে অন্যকে শেষ করে সেখানে টিকে থাকতে হয়। এতে ব্যবহৃত হয় অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র। অংশগ্রহণকারীরা অনলাইনে শলাপরামর্শ করে অন্যকে হত্যার কৌশল শিখে নেয়। শেষে যারা জীবিত থাকে তারাই বিজয়ী। শিশু-কিশোররা মোবাইল, ট্যাব বা কম্পিউটারের মাধ্যমে পাবজি গেমসে এতটাই মত্ত ও নেশাগ্রস্ত থাকে যে, বাস্তব জীবনের প্রতি তারা উদাসীন হয়ে পড়ে। ভিডিও গেমসের এ হত্যাযজ্ঞ কখনো বাস্তবেও প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।
এই পাবজি গেমই কিন্তু ভিডিও গেমের সূচনা নয়। এর আগেও প্রচলিত ছিল ক্ল্যাশ অব ক্ল্যান, ভাইস সিটি, মনস্টার হান্টার ওয়ার্ড, ডটা টু এবং হাঙ্গার গেমসসহ অসংখ্য গেম, যেগুলোতে শিশু-কিশোরদের চরম আকর্ষণ ছিল। কিশোর গেমার কল্পনার জগতে প্রবেশ করে গেমের প্রধান চরিত্র বা নায়কের সাক্ষাৎলাভের জন্য ২৪ তলা ভবনের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। টানা ২৪ ঘণ্টা লাইভ গেম খেলতে খেলতে ২২ ঘণ্টার মাথায় যুবকের মৃত্যু ঘটেছে। ১৩ বছরের ভিয়েতনামী কিশোরী গেম খেলার টাকা সংগ্রহ করতে না পেরে ৮১ বছরের বৃদ্ধাকে রাস্তায় শ্বাসরোধ করে মেরে তার মানিব্যাগ ছিনতাই করেছে। লাশ মাটিচাপা দিয়েছে। গেম কেনার অর্থ জোগাড়ে এক চীনা দম্পতি নিজেদের তিন সন্তানকে ৯ হাজার মার্কিন ডলারে বিক্রি করে দিয়েছে। গেমের নেশা কতটা ভয়াবহ হতে পারে এসব ঘটনা তার প্রমাণ। সম্প্রতি ভারতের মহারাষ্ট্রে রেললাইনে বসে এ খেলায় মত্ত দুজন তরুণকে ট্রেন পিষে দিয়েছিল। মধ্য প্রদেশে এক যুবক এ খেলায় এমনই মগ্ন ছিল যে, পানির বদলে এসিড পান করে। জম্মুর এক যুবক টানা ১০ দিন পাবজি খেলার ফলে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ খেলায় গেমাররা চরম আসক্ত হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে দেখা দেয় হিংস্ত্র ও ধ্বংসাত্মক মনোভাব। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, এ খেলা মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ধ্বংসাত্মক মনোভাবকে সামনে টেনে আনে। এ ছাড়া পাবজির নেশার কারণে অনেকেই মা-বাবার সাথে খারাপ আচরণ করছে, সামান্যতেই অস্থির ও ধৈর্যহীন হয়ে পড়ছে। আচরণ হচ্ছে মারমুখী, মানুষ হারাচ্ছে চাকরি, বাড়ছে বিয়ে বিচ্ছেদ। মনোবিজ্ঞানীরা ইলেকট্রনিক ডিভাইস সম্পৃক্ত এ আসক্তি ও নেশার নাম দিয়েছেন ‘ডিজিটাল মাদক’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও সম্প্রতি ভিডিও গেমের নেশাকে এক বিশেষ মানসিক অসুস্থতা হিসেবে তুলে ধরেছে। নামকরণ করা হয়েছে ‘গেমিং ডিজঅর্ডার’।
ইংল্যান্ড, জার্মানি ও চীনের মতো আধুনিক ও উন্নত দেশগুলোতে ভিডিও গেমের আসক্তি থেকে মুক্ত রাখার জন্য স্বতন্ত্র চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। চিকিৎসাসেবা, কাউন্সেলিং ইত্যাদির মাধ্যমে গেমারদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এ গেম যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে তাতে বিশে^র সব দেশেই এ ধরনের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র খুলতে হতে পারে। গেমিং ডিজঅর্ডারের পরিণতি অত্যন্ত জঘন্য ও ভয়াবহ। এটা মানুষের সময়, সম্পদ, মেধা ও সুস্থতাসহ অনেক কিছুই কেড়ে নেয়। ডিজিটাল গেমস খেলার কারণে সবচে বেশি ক্ষতি হয় শরীরের। চিকিৎসকদের মতে, ইলেকট্রনিক ডিভাইস তথা মোবাইল ফোন প্যান্টের পকেটে থাকলে পুরুষের শুক্রাণুর ক্ষতি হওয়া, বুক পকেটে থাকলে হার্টের সমস্যা দেখা দেয়া, আঙ্গুল ও ঘাড়ে ব্যথা করা, শ্রবণশক্তি দুর্বল হয়ে পড়া এবং ডিভাইসের ডিসপ্লে থেকে ব্যাকটেরিয়ার জীবাণু ছড়িয়ে পড়াসহ অসংখ্য শারীরিক ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। ভিডিও গেম খেলার কারণে দৃষ্টিশক্তির দুর্বলতা এখন একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। ভিডিও গেমের উদ্ভাবক ও বড় বাজার হচ্ছে চীন। সে দেশের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা চোখের সমস্যায় ভুগছে। তাই তারা খেলায় অংশগ্রহণকারীদের বয়সভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ করছে। একটানা গেম খেলা এবং মোবাইল, ট্যাব ও কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার কারণে অনেকেরই অল্প বয়সে চোখের সমস্যা দেখা দেয়। শিশু-কিশোররা এ সমস্যায় বেশি আক্রান্ত।
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কনসালট্যান্ট ডা: খায়ের আহমদ চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে বলেন, প্রতিদিন এ প্রতিষ্ঠানে গড়ে আমরা প্রায় ২৫০ জন রোগী দেখি। এর মধ্যে ক্ষীণ দৃষ্টি বা ‘মায়োপিয়া’ আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা গড়ে ৫০ জন। বাংলাদেশ আই হসপিটাল কর্তৃপক্ষের মতানুসারে প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদের ৮০ শতাংশ শিশু ‘মায়োপিয়া’ সমস্যা নিয়ে আসছে। তাদের এখনই রোধ করা না গেলে পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের দূরদৃষ্টিজনিত সমস্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাবে এবং তা ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে উন্নীত হবে, যা গোটা জাতির জন্য ভয়াবহ বার্তা বহন করছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনরা।
ভিডিও গেমের নেশায় শিশু-কিশোররা ইলেকট্রনিক ডিভাইস, স্মাটফোন, কম্পিউটার বা ইন্টারনেটে সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করছে। এতে তাদের মস্তিষ্কে রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটছে, বাড়ছে হতাশা ও উদ্বেগ। দক্ষিণ কোরিয়ার একটি গবেষক দল কিশোর-কিশোরীদের মস্তিষ্ক পরীক্ষা করে এমন প্রমাণ পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য, নিউরোসার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়–য়া বলেন, বিরতিহীনভাবে প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে শিশুদের চোখ ও মস্তিষ্কের মধ্যে চাপ পড়ে। ফলে ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি কমে যায়, মস্তিষ্ক সঠিকভাবে কাজ করে না এবং তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
শিশু-কিশোররা এখন আর আগের দিনের শিশুদের মতো মাঠে গিয়ে খেলাধুলা করছে না, গল্পের বই পড়ছে না এবং মন খুলে কারো সাথে কথাবার্তাও বলছে না। এ অবস্থা দিন দিন বেড়েই চলছে। শিশু-কিশোররা ঘরের দরজা বন্ধ করে ডুবে থাকছে মোবাইল, ট্যাব অথবা কম্পিউটার নিয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তৈরি করছে নিজেদের একটি বলয়। পরিণামে দূরত্ব বাড়ছে মা-বাবা ও আত্মীয় স্বজনদের মাঝে। একাকিত্ব এবং যান্ত্রিক জীবনই তাদের সঙ্গী হচ্ছে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তাদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ। তারা বাস্তব জীবন থেকে বের হয়ে এক কল্পনাজগতে বসবাস শুরু করে। জীবনের সফলতা-ব্যর্থতা খুঁজে ফেরে ভার্চুয়াল জগতে। স্নেহ-মমতা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসার মতো গুণগুলো হারিয়ে যেতে থাকে তাদের মধ্য থেকে। নিজেকে ছাড়া পরিবারের, সমাজের সদস্যদের প্রতি তাদের দায়িত্ববোধ লোপ পায় এবং নিজেদের অজান্তেই আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর হয়ে ওঠে।
ডিজিটাল গেমসের মাধ্যমে নষ্ট হয় অনেক সময়। এটা ক্ষতি করে অর্থ, স্বাস্থ্য, মানসিকতা ও নৈতিকতার। এ বিষয়ে ইসলামের রয়েছে সুস্পষ্ট নীতিমালা ও বিধানাবলি। সময় ও স্রোতে কারো জন্য বসে থাকে না। প্রতিটি মুহূর্ত এবং কাজের জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তাই মানুষ জবাবদিহিতার ভয়ে অনর্থক কাজে ব্যস্ত থাকতে ও সময় নষ্ট করতে পারে না। আল-কুরআন ঘোষণা করছে, ‘মানুষের মধ্যে এমন লোক রয়েছে যারা অজ্ঞতাবশত আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিচ্যুত করার জন্য এমন সব বেহুদা ও অনর্থক কথা খরিদ করে (যা আল্লাহ সম্পর্কে উদাসীন করে দেয়) এবং তারা ওই অনর্থক কাজকে হাসি-ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে। তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর আজাব।’
(আল-কুরআন, ৩১:৬) অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মুমিন তো তারাই যারা অনর্থক কথাবার্তা শোনা থেকে বিরত থাকে এবং বলে, আমাদের আমল আমাদের জন্য, আর তোমাদের আমল তোমাদের জন্য। তোমাদের প্রতি সালাম। আমরা অজ্ঞদের সাহচর্য চাই না।’ (আল-কুরআন, ২৮ : ৫৫)। অনর্থক কাজের বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘ব্যক্তির ইসলামের সৌন্দর্য হচ্ছে যা কিছু অনর্থক তা বর্জন করা।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান-১৯৮৮, ১/৪৬৬, ২২৯) আর ভিডিও গেমগুলো আক্ষরিক অর্থেই অনর্থক কাজ। এগুলো দুনিয়া-আখিরাতের কোনো উপকারে তো আসেই না; বরং উভয় জগতের জন্য অসংখ্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই এ খেলা পরিত্যাজ্য।
ডিজিটাল গেমসের কারণে বিপুল পরিমাণ কর্মশক্তি নষ্ট হচ্ছে। এগুলো মানুষকে অনেকটা সন্ত্রাস, উগ্রতা ও পাশবিকতা শেখায়। ইসলাম মানব হত্যা, অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা এবং ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা কোনোভাবেই সমর্থন করে না। নাশকতা, নৈরাজ্য, পাশবিকতা, বিশৃঙ্খলা, সঙ্ঘাত, উগ্রতা ও সহিংসতা ইসলামে নিষিদ্ধ। যেসব গেমের মাধ্যমে এগুলো শেখানো হয় বা উসকানি দেয়া হয় তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
গেমগুলো অশ্লীল মিউজিক ও গানে ভরপুর। অধিকন্তু এগুলোতে নগ্নতা, যৌনতা ও অশ্লীলতার ছড়াছড়ি। ফলে বেহায়াপনা ও অশ্লীলতার মতো কর্মকা-ে শিশু-কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে এবং এগুলোকে খুব হালকা বিষয় হিসাবে নিচ্ছে।
ভিডিও গেমগুলো ইসলামী সংস্কৃতি, সভ্যতা, আচার-আচরণ, পোশাক, ইত্যাদির প্রতি বিদ্বেষ ছড়ায়। ইসরাইলে এমন সব পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে যেখানে মুসলিম লেবাসধারী ডামি বা ছবিকে মারা বা হত্যা করার নেশায় মেতে ওঠে দর্শনার্থীরা। মারা হচ্ছে, তাদের কথিত সন্ত্রাসী আরব অথবা ফিলিস্তিনিকে। এসব দেখে বিশ্ব-মুসলিমের প্রতি আমাদের কোমলমতি শিশু-কিশোরদের মানসিকতা বিরূপ হচ্ছে। তাদের ঈমান-আকিদা ধ্বংস হচ্ছে।
ডিজিটাল গেমের নেশায় বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু-কিশোরদের লেখাপড়া। অপচয় হচ্ছে তাদের অর্থ, সম্পদ ও মূল্যবান সময়। জাতি হারাতে বসেছে তার সুস্থ-স্বাভাবিক, সহৃদয় ও যতœবান ভবিষ্যৎ বংশধর। তাই প্রতিটি ব্যক্তি, মা-বাবা, অভিভাবক, শিক্ষক, দায়িত্বশীল এবং দেশের সরকারকে এখনই ডিজিটাল গেমিং নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে এ জাতির ভবিষ্যৎ অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হবে।
লেখক : অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়