ফিলিস্তিন মুসলিমদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?
ফিলিস্তিন মুসলিমদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? - ছবি সংগৃহীত
মানুষ তার জীবন পরিচালনায় রাষ্ট্রীয় নীতি বা রাজনীতির আশ্রয় নেয়। আন্তর্জাতিক পরিম-লেও প্রয়োগ করে কিছু নিয়মনীতি, আচরণ ও আইন। রাষ্ট্রের নিয়মনীতি বা রাজনীতি যেমন নাগরিকের জীবনকে প্রভাবিত করে, তেমনি আন্তর্জাতিক নীতি বা রাজনীতিও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাষ্ট্রীয় আচরণে প্রভাব রাখে। মাঝে মাঝে দেখা যায়, স্থানীয় রাজনীতির প্রভাবে অনেককে পরিবার-পরিজনহীন হতে, দেউলিয়া ও অস্তিত্বহীন হতে। তেমনিভাবে আন্তর্জাতিক নীতি বা রাজনীতির প্রভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও অনেক রাষ্ট্র ও জাতিকে ঐতিহ্য হারিয়ে অস্তিত্বহীন হতে দেখা যায়। আমাদের নিকটবর্তী আরকানের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের এক সময় অনেক সুপ্রতিষ্ঠিত অস্তিত্ব, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ছিল। আন্তর্জাতিক নীতি, আচরণ বা আইনের প্রভাবে সেখানকার সেই বাসিন্দারা আজ উদ্বাস্তু ও অন্য দেশে আশ্রিত। দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে এই নিয়মগুলো মানুষের তৈরি মানুষের প্রয়োজনে। মানুষের তৈরি এই নিয়মনীতি বা আইনই মানুষের সুন্দর ঐতিহ্য আর অস্তিত্ব নিষ্ঠুরভাবে ধ্বংস করে, আর জনগণকে করে ভূমিহীন, রাষ্ট্রহীন উদ্বাস্তু।
রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে একজন নাগরিকের মতো, একটি রাষ্ট্রও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সঙ্কটে পতিত হয়। রাষ্ট্রীয় এই সঙ্কট ব্যক্তি সঙ্কটের চেয়ে অনেক বড়। নব্বই দশকের পর থেকে অনেক অন্যায়, অত্যাচারের কথা শোনা যাচ্ছে মুসলমানদের উপর। চেচনিয়া, বসনিয়া, ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, আফগান, ফিলিস্তিন, ইরাকসহ আরো অনেক দেশেই। বিশ্বের বহু দেশের এই আন্তর্জাতিক তথা রাষ্ট্রীয় সঙ্কট কিছুটা মীমাংসা হলেও দুর্ভাগ্যবশত ফিলিস্তিন সঙ্কটে আজও বিশ্ববাসী নীরব। আন্তর্জাতিক নীতি, আচরণ ও আইনের করাল গ্রাসে ও প্রভাবে ফিলিস্তিনীরা আজ অসহায় ও অত্যাচারিত।
মানবাধিকার নিয়ে ঢোল বাজানো বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্রসমূহও এ বিষয়ে নিশ্চুপ। মনে হয় সবাই ফিলিস্তিনিদের আত্মরক্ষার সংগ্রামের দৃশ্য দেখে একটা দুর্দান্ত থ্রিলার মুভি উপভোগ করে যাচ্ছে যুগ যুগ ধরে। পশ্চিমা বিশ্ব যেমন কখনো তাদের বন্ধু হতে পারেনি, তেমনি উন্নত মুসলিম বিশ্বও তাদের এই দৈন্যদশা নীরবে দেখে যাচ্ছে বহুকাল ধরে। মুসলমানদের আন্তর্জাতিক সংগঠন আরব লীগ, ওআইসি ফিলিস্তিনিদের এই সঙ্কট উত্তরণের জন্য আজো দৃশ্যমান ও উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখেনি। শুরু থেকে এককভাবে নিরস্ত্র অসম যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে নিরীহ ফিলিস্তিনবাসী। একদিকে কামানের গোলা আর অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার আর অন্যদিকে শুধু ইট, পাথর আর কঙ্কর নিক্ষেপ। এতটা নির্যাতিত হয়েও দেশটির জনগণের কোনো অভিযোগ বা হাউকাউ নেই। পৃথিবীতে জন্মই যেন তাদের যুদ্ধের জন্য। মিডিয়ায় তাদের নির্যাতনের ছবির দৃশ্য দেখে দূর থেকে ইহুদিদের প্রতি আসে শুধু ঘৃণা আর ভাবতেও অবাক লাগে একটি জাতি কীভাবে এতটা হিংস্ত্র, বীভৎস হতে পারে? কোনো কারণ ছাড়াই আক্রমণ যেন হিটলারের ওই বাক্যটিকে বারবার স্মরণ করে দেয় ‘আমি সব ইহুদি মেরে ফেলতাম, কিছু সংখ্যক বাঁচিয়ে রেখেছি যেন বিশ্ববাসী ইহুদিদের চিনতে পারে।’
বিশ্বজুড়ে মুসলিম সম্প্রদায় বিগত এক মাস সিয়াম সাধনা শেষে পবিত্র ঈদ উদযাপনে ব্যস্ত। বিশ্বের মুসলমানরা যখন বাহারি ইফতার আয়োজন ও রসনা বিলাসে ব্যস্ত, তখন ফিলিস্তিনিরা ব্যস্ত আগ্রাসী ইহুদির আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার্থে। বিশ্বের মুসলমানরা যখন ঈদ-শপিংয়ে ব্যস্ত তখন ফিলিস্তিনিরা ব্যস্ত তাদের বোমার আঘাতে ভেঙে যাওয়া ঘরটা মেরামত করে বা কোনোমতে রাত্রি যাপনে। অথচ এই ফিলিস্তিনিদের মতো সুন্দর অতীত কারোই ছিল না। বিপরীতে এই ইহুদি জাতির একসময় কোনো রাষ্ট্র ছিল না, ছিল না কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ড। ফিলিস্তিনের পাশেই তাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছিল মাত্র। আর আশ্রিত ইসরাইলের সেই ইহুদি জনগণ আজ নির্বিচারে মেরে যাচ্ছে ফিলিস্তিনিদের।
ফিলিস্তিন শুধু একটি মুসলিম রাষ্ট্র নয়। এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে মুসলমানদের ধর্মীয় ঐতিহ্য ও গুরুত্ব এবং কুরআন, সুন্নাহর অনেক ভবিষ্যদ্বাণীও। মুসলমানদের আদি কিবলা ‘মসজিদুল আকসা’ এই ফিলিস্তিনে অবস্থিত। এ ছাড়াও এখানেই রয়েছে ১. হজরত ইব্রাহিম আ: এবং মূসা আ:সহ অসংখ্য নবী রাসূলের কবর। ২. এখানেই রাসূল সা: সব নবী রাসূলকে এবং ফেরেস্তাদের নিয়ে নামাজ পড়েছিলেন। সেই জামাতের ইমাম ছিলেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: এবং এই জামাতে মতান্তরে প্রায় ২৪ হাজার নবী রাসূল ছিলেন। ৩. এখান থেকেই মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: বোরাকে করে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন। ৪. এই মসজিদের নির্মাণের সাথে জড়িয়ে আছে হজরত আদম আ: এবং সুলাইমান আ:-এর নাম। ৫. এর সাথে জড়িয়ে আছে খলিফা হজরত উমর রা:-এর সেই বিখ্যাত উটের বিরল ঘটনা। ৬. এর সাথেই জড়িয়ে আছে দ্যা গ্রেট সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর অসংখ্য স্মৃতি। ৭. এই মসজিদের পাথরের গায়ে লেখা রয়েছে সম্পূর্ণ সূরা ইয়াসিন। ৮. এই মসজিদের জন্য জিনদের দ্বারা পাথর উত্তোলন করা হয়েছে গহিন সাগরের তলদেশ থেকে। যা কিনা কোন মানুষের পক্ষে অসম্ভব! ৯. এই মসজিদে ২ রাকাত নামাজ আদায় করার জন্য একজনের আমল নামায় ২৫ হাজার রাকাআত নামাজের সমপরিমাণ সওয়াব লিখা হবে। ১০. পবিত্র কুরআনের সবচেয়ে মধ্যখানেই মহান আল্লাহ এই মসজিদ নিয়ে আলোচনা করছেন।
আজ বিশ্বে সংখ্যার দিক থেকে মুসলমানরা একেবারে কম নয়। কিন্তু মুসলমানদের মাঝে একতা ও ঐক্যের বড়ই অভাব। এই সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছে দুশমন দলরা। আমাদের দেশের মতো বহুদলীয় গণতান্ত্রিক দেশ ফিলিস্তিন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত, হেফাজতে ইসলামের মতো সেখানেও রয়েছে বহুদল ও এলায়েন্স। কিন্তু জাতীয় ইস্যু ও মসজিদুল আকসা হেফাজত প্রশ্নে তাদের একটি দল, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। ফিলিস্তিনি দল হামাস প্রধান এবারের আক্রমণে হুংকার দিয়ে বলেছেন, পাথর আর কঙ্কর নিক্ষেপে আত্মরক্ষার দিন শেষ। গোলা বারুদের জবাব গোলা বারুদেই দেয়া হবে।
ফিলিস্তিনিদের আত্মত্যাগ ও আত্মউৎসর্গ দেখলে মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে, জান্নাতে আমাদের জায়গা হবে তো? ফিলিস্তিনি একটি ছোট্ট শিশু আহত হলেও তার মুখে হাসি আবার ইহুদি সৈন্যের আঘাতে মারা গেলেও ওই হাসির কমতি নেই, একেবারে ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পর্যন্ত। যুদ্ধের ময়দান থেকেও কেউ পালিয়ে যায় না। ওদের দেখে ঈর্ষান্বিত মন মাঝে মাঝে ভাবে এত ঈমান ওরা কোথায় পায়? এর জবাব স্বয়ং কুরআনে আল্লাহ নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন ‘প্রকৃত ব্যাপার এই যে, আল্লাহ মুমিনদের থেকে তাদের প্রাণ ও ধন-সম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে এবং মারে ও মরে। তাদের প্রতি তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআনে(জান্নাতের ওয়াদা) আল্লাহর জিম্মায় একটি পাকাপোক্ত ওয়াদা বিশেষ। আর আল্লাহর চাইতে বেশী নিজের ওয়াদা পূরণকারী আর কে আছে? কাজেই তোমরা আল্লাহর সাথে যে কেনাবেচা করছ সেজন্য আনন্দ করো। এটিই সবচেয়ে বড় সাফল্য।’ (সূরা আত-তওবা : আয়াত : ১১১)। ‘বলো, আমার নামাজ, আমার ইবাদতের সব অনুষ্ঠান, আমার জীবন ও মৃত্যু সবকিছু আল্লাহ রব্বুল আলামিনের জন্য।’ (সূরা, আল-আনয়াম :আয়াত: ১৬২)
যত দিন এই পৃথিবী থাকবে তত দিন বিশ্বে সাদা-কালো, সুন্দর-অসুন্দর, ধনী-গরিব, উদ্বাস্তুÑ স্থানীয় এর ভেদাভেদ ও দ্বন্দ্ব থাকবে। পৃথিবীতে অসংখ্য পথ-প্রদর্শক বা নবী-রাসূলরা মহান সৃষ্টিকর্তা পাঠিয়েছেন শুধু মানুষের এই সঙ্কট নিরসনে ও মানবাধিকার নিশ্চয়তায়। স্থানীয় আইন প্রয়োগে বৈষম্যের মতো বৈষম্য থাকবে আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগে আন্তর্জাতিক পরিম-লে। তাই বৈষম্য যায় হোক না কেনো, ঈমানের দাবি থেকে নির্যাতিত ফিলিস্তিনি ও মাসজিদুল আকসার সম্মান রক্ষায় ফিলিস্তিনের পাশে থাকা প্রত্যেক বিশ্বাসী মুসলমানের জন্য একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য।
ফিলিস্তিনিদের ওপর ইহুদি গোষ্ঠীর বর্বর হামলার চিত্র দেখে মুসলিম বিশ্ব আজ কিছুটা জেগে উঠেছে। ইতোমধ্যে আমরা মুসলিম বিশ্বের উদ্বেগ দেখেছি। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান এককভাবে মুসলিম বিশ্বকে এক করার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও এ বিষয়ে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। ইতোমধ্যেই আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী ইসরাইলের আগ্রাসী ভূমিকায় ধিক্কার ও তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। এটা ইতিবাচক। ৫৭ টি মুসলিম রাষ্ট্রের মধ্যে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র সৌদি আরব, ইরানসহ সব রাষ্ট্র এক করার জন্য বাংলাদেশও ভূমিকা রাখতে পারে। বিশ্ব মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় নতুন জোট সৃষ্টি তথা ফিলিস্তিনের সঙ্কট উত্তরণে ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে। মাত্র দুদিন আগে মিডিয়ায় দেখা যাচ্ছিল হামাস, ফিলিস্তিন সংগঠন, মাত্র ৫ মিনিটে ১৩৭টি রকেট হামলা করেছে ইসরাইলে, কিছুটা বিধ্বস্ত হয়েছে ইহুদিগোষ্ঠী। তাছাড়া করোনা মহামারীতে পুরা বিশ্বে মুসলমানরা আজ কিছুটা হলেও সমাদৃত ও বিশ্ব সহানুভূতির জায়গায় স্থান পেয়েছে। এটাই এই জালিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মোক্ষম সময়। তাই আজ আরব লীগ, ওআইসির ব্যর্থতায় মুসলমানদের এগিয়ে নিতে গঠিত হোক নতুন সঙ্ঘ, International Organization of Muslim Ummah /International Organization for Muslims Security/Unity of Muslim Ummah যার একমাত্র ব্রত ও উদ্দেশ্যে হবে মুসলমানদের কল্যাণসহ, মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের নিরাপত্তা।
লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট