টিকটকের স্টার বানানোর প্রলোভনে তরুণীদের প্রলুব্ধকরণ, অতঃপর

নিজস্ব প্রতিবেদক | Jun 03, 2021 06:55 am
প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি - প্রতীকী ছবি

 

টিকটকের স্টার বানানোর প্রলোভনে পাচার হওয়া ভারতফেরত তরুণী পাচারকারী ও নিপীড়কদের বীভৎস নির্যাতনের ভয়ঙ্কর তথ্য তুলে ধরেছেন পুলিশের কাছে। অন্য এক তরুণীকে নির্যাতনের ঘটনায় সম্প্রতি ভারতে গ্রেফতার মগবাজারের ‘টিকটক’ হৃদয় বাবু এই চক্রের সমন্বয়ক। এই চক্রের মাধ্যমে প্রায় দেড় হাজার নারী পাচারের শিকার হয়েছেন। ওই তরুণী ভারতে অবস্থান করার সময় আরো অনেক বাংলাদেশী তরুণীকে দেখেছেন। যারা বিভিন্ন সময়ে এই চক্রের মাধ্যমে পাচার হয়েছেন। ওই তরুণীর বরাত দিয়ে গতকাল সকালে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ।

এর আগে ভারতে শারীরিক নির্যাতন ও বিকৃত যৌন নির্যাতনের শিকার ওই বাংলাদেশী তরুণী ৭৭ দিন পর দেশে ফিরে গত মঙ্গলবার রাতে হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ আইনে ১২ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। এর মধ্যে পাঁচজন বর্তমানে দেশে অবস্থান করছে বলে তথ্য ছিল পুলিশের কাছে। পরে মঙ্গলবার রাতে সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী দাবকপাড়া কালিয়ানী এলাকা থেকে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলো- মেহেদী হাসান বাবু, মহিউদ্দিন ও আবদুল কাদের। ভারতে প্রায় এক হাজার নারীকে পাচারে সীমান্ত পার হতে সরাসরি সহায়তা করেছে বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে তারা।

এ দিকে, টিকটকের মডেল বানানো ও উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভনে নারী পাচারকারীচক্রের অন্যতম মূলহোতা আশরাফুল ইসলাম ওরফে বস রাফিসহ র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার চারজনের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে সম্প্রতি এক বাংলাদেশী তরুণীকে বর্বর নির্যাতন ও যৌন হয়রানির ঘটনায় মূল অভিযুক্ত সবুজ ভারতীয় পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছে বলে ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে তেজগাঁও বিভাগের ডিসি বলেন, ভারতফেরত ওই তরুণীর সাথে ২০১৯ সালে হাতিরঝিলে মধুবাগ ব্রিজে হৃদয় বাবুর পরিচয় হয়। টিকটক স্টার বানাতে চেয়ে ও ভালো বেতনের চাকরির অফার দিয়ে ভিকটিমকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে হৃদয় বাবু। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নারায়ণগঞ্জের অ্যাডভেঞ্চার ল্যান্ড পার্কে ৭০-৮০ জনকে নিয়ে টিকটক হ্যাংআউট এবং ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের আফরিন

গার্ডেন রিসোর্টে ৭০০-৮০০ জন তরুণ-তরুণীকে নিয়ে পুল পার্টির আয়োজন করে হৃদয় বাবু। ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ায় বাউল লালন শাহ মাজারে আয়োজিত টিকটিক হ্যাংআউটে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আন্তর্জাতিকভাবে সক্রিয় এই মানবপাচারকারী চক্রের অন্যান্য সহযোগীদের সহায়তায় কৌশলে ভিকটিমকে ভারতে পাচার করে হৃদয় বাবু।

ডিসি আরো জানান, পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ার পর থেকে পালিয়ে দেশে ফেরা পর্যন্ত তার লোমহর্ষক করুণ কাহিনী কল্পনাকেও হার মানিয়েছে। ভারতে পাচারের পর ভিকটিমকে ব্যাঙ্গালুরুর আনন্দপুর এলাকায় পর্যায়ক্রমে কয়েকটি বাসায় রাখা হয়। এ সময় ভারতে অবস্থানকালে হাতিরঝিল থানার অভিযোগকারী ভিকটিম এ চক্রের দ্বারা পাচারকৃত আরো কয়েকজন বাংলাদেশী ভিকটিমকে সেখানে দেখতে পান, যাদেরকে সুপার মার্কেট, সুপার শপ বা বিউটি পার্লারে ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা হয়েছে। ব্যাঙ্গালুরুতে পৌঁছার কয়েকদিন পরই ভিকটিমকে চেন্নাইয়ের একটি হোটেলে ১০ দিনের জন্য পাঠানো হয়। অমানবিক শারীরিক ও বিকৃত যৌন নির্যাতনে সামান্য দয়া ও করুণাও দেখায়নি চক্রের সদস্যরা। বরং কৌশলে নেশাজাতীয় দ্রব্য খাইয়ে কিংবা জোরপূর্বক বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করে পরিবারের সদস্য ও পরিচিতদের তা পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে জিম্মি করে রাখা হয় ভিকটিমকে। ভারতে পাচারের ৭৭ দিন পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল ভিডিওর ঘটনার ভিকটিম তরুণীর সহযোগিতায় হাতিরঝিল থানায় অভিযোগকারী ভিকটিমসহ আরো দুইজন বাংলাদেশী ভিকটিম এ চক্রের ব্যাঙ্গালুরুতে অবস্থিত আস্তানা থেকে পালিয়ে বাংলাদেশ আসতে সক্ষম হয়। ওই দুই তরুণীর বিষয়েও খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।

পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, মামলায় এজাহারনামীয় ১২ আসামির মধ্যে পাঁচজন বাংলাদেশে অবস্থান করছে বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য পাওয়া যায়। পরে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টায় সাতক্ষীরা জেলার সীমান্তবর্তী দাবকপাড়া কালিয়ানী এলাকা থেকে ভিকটিমকে ভারতে পাচারে জড়িত তিন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত আসামিদের হেফাজত থেকে ভিকটিমকে পাচারের ব্যবহৃত দুটি মোটরসাইকেল, একটি ডায়েরি, চারটি মোবাইল ফোন ও একটি ভারতীয় সিম কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে।

গ্রেফতারকৃত আসামি মেহেদী হাসান বাবু মামলার ভিকটিমসহ এক হাজারের বেশি নারী পাচারে জড়িত বলে স্বীকার করেছে। সে প্রায় ৭-৮ বছর ধরে মানবপাচারে জড়িত। তার কাছ থেকে উদ্ধারকৃত মোবাইল ও ডায়েরিতে হৃদয় বাবু, সাগর, সবুজ, ডালিম ও রুবেলের ভারতীয় মোবাইল নম্বর পাওয়া গেছে। পাশাপাশি তার কাছ থেকে উদ্ধারকৃত ডায়েরিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল ভিডিওর ঘটনার ভিকটিম জেসমিন মীমের আধার নম্বর ও ভারতে পাচারকৃত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভিকটিমের নাম ও মানবপাচারে জড়িত ব্যক্তিদের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে।
গ্রেফতারকৃত অপর দুই আসামি মহিউদ্দিন ও আব্দুল কাদের আলোচ্য ভিকটিমসহ পাঁচ শতাধিক ভিকটিমকে সীমান্তবর্তী এলাকায় পাচারের কাজে ব্যবহারের জন্য নির্মিত কক্ষে অবস্থানে সহায়তার পাশাপাশি মোটরসাইকেলযোগে সীমান্তের শেষ প্রান্তে ভারতীয় দালালের হাতে তুলে দেয়ার কথা স্বীকার করেছেন। এ চক্রের অন্য সদস্যদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান ডিসি শহীদুল্লাহ।

বস রাফিসহ রিমান্ডে ৪ : টিকটকের ফাঁদে নারী পাচারকারীচক্রের অন্যতম মূলহোতা আশরাফুল ইসলাম ওরফে বস রাফিসহ র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার চারজনের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। অপর তিন আসামি হলেন- বস রাফির অন্যতম নারী সহযোগী সাহিদা বেগম ম্যাডাম সাহিদা (৪৬), ইসমাইল সরদার (৩৮) ও আব্দুর রহমান শেখ ওরফে আরমান শেখ (২৬)। গতকাল তাদের ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হয়। এরপর মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাদের ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম বেগম ইয়াসমিন আরা প্রত্যেকের পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

এর আগে সোমবার দিবাগত রাতে ঝিনাইদহ ও যশোরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালিয়ে রাফিসহ চারজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। রাফিচক্রের মাধ্যমে পাঁচ শতাধিক নারীকে পাচার করা হয়েছে বলে জানায় র‌্যাব।
এ দিকে, ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে সম্প্রতি এক বাংলাদেশী তরুণীকে বর্বর নির্যাতন ও যৌন হয়রানির ঘটনায় মূল অভিযুক্ত পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন। এ সময় তাকে গ্রেফতার করতে গিয়ে ছুরির আঘাতে আহত হন দুই পুলিশ সদস্য। স্থানীয় সময় গতকাল সকাল পৌনে ৭টার দিকে আভালাহাল্লি এলাকার রামপুরা লেকের কাছে এ ঘটনা ঘটে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবর অনুসারে, ধর্ষণকাণ্ডে মূল অভিযুক্তের নাম সবুজ (৩০)। তার পায়ে গুলি লেগেছে এবং তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। জানা গেছে, তরুণীকে নির্যাতনের ঘটনার পর থেকেই পলাতক ছিল সবুজ। তাকে প্রথমে একটি আবর্জনার স্তূপের ভেতর থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তবে পুলিশের গাড়িতে ওঠানোর পরে প্রস্রাব করতে চান সবুজ। গাড়ি না থামালে এর ভেতরই প্রস্রাব করে দেবেন বলে হুমকি দেন তিনি।

পরে গাড়ি থেকে নামতেই পালানোর চেষ্টা করেন অভিযুক্ত যুবক। এ সময় দুই পুলিশ সদস্য তাকে ধরতে গেলে তাদের ছুরিকাঘাত করেন সবুজ। এতে দু’জনেরই হাতে জখম হয়। এরপর সবুজের পায়ে গুলি করে তাকে ফের গ্রেফতার করে পুলিশ। এর আগে, বাংলাদেশী এক তরুণীকে যৌন নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর গত বৃহস্পতিবার দুই নারীসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে ব্যাঙ্গালুরুর পুলিশ। গ্রেফতারের সময় পালাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে টিকটক হৃদয়সহ দু’জন গুলিবিদ্ধ হন।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us