দেইফকে কেন হন্যে হয়ে খুঁজছে ইসরাইল?

অন্য এক দিগন্ত | Jun 02, 2021 08:33 pm
দেইফ

দেইফ - ছবি : সংগৃহীত

 

গত মাসে এক ফিলিস্তিনি চরমপন্থী নেতার পাঠানো একটি অস্পষ্ট অডিও রেকর্ডিংয়ে ইসরাইলকে অশুভ পরিণতির হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছিল। এতে বলা হয়েছিল, হামাসের দাবি মানা না হলে ইসরাইলকে ‘চরম মূল্য’ দিতে হবে।

ফিলিস্তিনি অঞ্চল গাজা নিয়ন্ত্রণ করে মূলত হামাস।

এই অডিও রেকর্ডিংটি ছিল হামাসের সামরিক শাখার নেতা মোহাম্মদ দেইফের, যাকে ইসরাইলিরা কোনোভাবেই ধরতে পারছে না।

ইসরাইলের ফেরারি তালিকায় মোহাম্মদ দেইফের নাম সবার উপরে। গত সাত বছরের মধ্যে এই প্রথম তার কোনো কথা শোনা গেছে।

মোহাম্মদ দেইফের এই হুঁশিয়ারিকে ইসরাইলিরা পাত্তা দেয়নি। এরপর ইসরাইল এবং গাজার মধ্যে ১১ দিন ধরে চলেছে লড়াই, যার অবসান ঘটেছে এক যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে।

জাতিসঙ্ঘের হিসাবে গত ১০ মে থেকে ২১ মে পর্যন্ত এই লড়াইয়ে গাজায় অন্তত ২৪২ জন নিহত হয়। আর ইসরাইলে মারা যায় ১৩ জন।

জাতিসঙ্ঘ বলছে, গাজায় নিহতদের মধ্যে ১২৯ জনই হচ্ছে বেসামরিক মানুষ। তবে ইসরাইলের দাবি নিহতদের মধ্যে ২০০ জনই ছিল ‘উগ্রপন্থী’। গাজায় হামাসের নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার অবশ্য বলেছেন, লড়াইয়ে তাদের ৮০ জন যোদ্ধা নিহত হয়েছেন।


ইসরাইল এই লড়াইয়ের সময় মোহাম্মদ দেইফকেও হত্যার চেষ্টা করে, কিন্তু তাকে হত্যা করা যায়নি।

ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) মুখপাত্র হিডাই জিলবারম্যান নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ‘এই পুরো অভিযান চলার সময় আমরা মোহাম্মদ দেইফকে হত্যার চেষ্টা করেছি।’

আইডিএফের কর্মকর্তারা বিবিসির কাছে নিশ্চিত করেছেন যে মোহাম্মদ দেইফকে হত্যার জন্য অন্তত দুটি চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু এবারো ইসরাইলিদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়, মোহাম্মদ দেফ পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। বলা হচ্ছে, গত দুই দশকে ইসরাইল এ নিয়ে মোহাম্মদ দেইফকে হত্যার জন্য সাতবার বিফল চেষ্টা চালিয়েছে।

মোহাম্মদ দেইফকে নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে চলা এই ইঁদুর-বিড়াল খেলা নিয়ে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী হতাশ। সর্বশেষ লড়াইয়ের সময়েও তাদের লক্ষ্য ছিল হামাসের সব শীর্ষ সামরিক অধিনায়ককে হত্যা করা।

মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ম্যাথিউ লেভিট বলেন, ‘এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে হামাসের সামরিক সক্ষমতার পেছনে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তাদের একটা তালিকা ইসরাইলের কাছে আছে, এবং এই তালিকায় সবার উপরে আছে মোহাম্মদ দেইফ।’

মোহাম্মদ দেইফ সম্পর্কে আমরা যা জানি, তা মূলত ইসরাইলি এবং ফিলিস্তিনি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে। এসব রিপোর্ট অনুসারে, মোহাম্মদ দেইফের জন্ম ১৯৬৫ সালে গাজার খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে। গাজা তখন মিসরের দখলে।

জন্মের সময় তার নাম রাখা হয়েছিল মোহাম্মদ দিয়াব ইব্রাহীম আল-মাসরি। কিন্তু ইসরাইলি বিমান হামলা থেকে বাঁচতে তাকে যেভাবে সারাক্ষণ যাযাবরের মতো জীবন-যাপন করতে হয়, পরে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেন ‘দেইফ’ নামে, আরবিতে যার অর্থ ‘অতিথি’।

বহু দশক ধরে চলতে থাকা ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের মধ্যে কীভাবে তিনি বেড়ে উঠেছেন, সে সম্পর্কেও জানা যায় খুব কম।

হামাস যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন মোহাম্মদ দেইফ একজন তরুণ। ১৯৮০’র দশকের শেষে তিনি হামাসে যোগ দেন। হামাস ইসরাইলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চায়। হামাসের সামরিক শাখা ‘ইজেদিন আল-কাসাম ব্রিগেডে’ মোহাম্মদ দেইফ বেশ দ্রুত উপরের দিকে উঠতে থাকেন, তিনি বেশ বিখ্যাত হয়ে ওঠেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী উপদেষ্টা মিস্টার লেভিট বলেন, ‘তাকে বেশ কট্টরপন্থী হামাস কর্মকর্তা বলেই মনে করা হয়।’

তিনি জানান, মোহাম্মদ দেইফ হামাসের খুব কট্টরপন্থী কিছু অধিনায়কের বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এদের একজন হচ্ছেন ইয়েহিয়া আইয়াশ। তিনি ছিলেন বেশ দক্ষ এক বোমা প্রস্তুতকারক, তাকে লোকে চিনতো ‘ইঞ্জিনিয়ার’ নামে।

১৯৯০ এর দশকের শুরুতে ইসরাইলে বাসে অনেক কটি বোমা হামলার জন্য আইয়াশকে দায়ী করা হয়। ১৯৯৬ সালে ইসরাইল তাকে হত্যা করে। কিন্তু এর ঠিক পরেই ইসরাইলে বাসে আরো অনেক বোমা হামলা হয়।

মোহাম্মদ দেইফ ছিলেন আইয়াশের শিষ্য। অভিযোগ ওঠে, প্রতিশোধ হিসেবে তিনিই এসব হামলা পরিচালনা করেছেন।

এই ঘটনার পর মোহাম্মদ দেইফ হামাসের সামরিক শাখায় আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। ২০০২ সালে হামাসের সামরিক শাখার প্রতিষ্ঠাতা সালাহউদ্দীন শেহাদেহকে হত্যার পর নতুন প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন মোহাম্মদ দেইফ।

হামাসের যে বিখ্যাত ‘কাসাম রকেট’, সেটির পরিকল্পনা এবং তৈরির কৃতিত্ব দেয়া হয় মোহাম্মদ দেইফকে। গাজার ভূগর্ভে যেসব টানেল খনন করা হয়েছে, সেগুলোও নাকি মোহাম্মদ দেফের পরিকল্পনা। তিনি নাকি বেশিরভাগ সময় এসব টানেলের মধ্যে কাটান। ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর চোখ এড়িয়ে এখান থেকেই তিনি হামাসের সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন।


৯ বার প্রাণে বেঁচে গেছেন যেভাবে
ইসরাইলি নজরদারিকে ফাঁকি দেয়ার ওপরই নির্ভর করে মোহাম্মদ দেইফের জীবন। ২০০০ সালের পরবর্তী কয়েক বছরে তাকে হত্যার জন্য ইসরাইলিরা চার দফা চেষ্টা চালায়। এর মধ্যে কয়েকটি হামলায় তিনি আহত হলেও পালাতে সক্ষম হন। ইসরাইলি রিপোর্ট অনুযায়ী, তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেছে, শরীরের কয়েকটি অঙ্গ উড়ে গেছে।

২০০৬ সালে ইসরাইলের হামলায় মোহাম্মদ দেইফকে যে গুরুতর আহত হয়েছেন সেটা নিশ্চিত করেছেন আইডিএফের এক সাবেক গোয়েন্দা প্রধান।

তিনি বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘লোকে ভেবেছিল মোহাম্মদ দেইফ আর নেতা হিসেবে বা একজন সামরিক পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজ করতে পারবেন না। কিন্তু খুব দ্রুতই তিনি সেরে উঠেন।’

ইসরাইলের এসব হামলা ব্যর্থ হওয়ার পর মোহাম্মদ দেইফের খ্যাতি আরো বেড়ে যায়। তাকে তার শত্রুপক্ষ বর্ণনা করতে থাকে ‘৯ বারের জীবন পাওয়া বিড়াল’ বলে।

২০১৪ সালে গাজায় ইসরাইলের সামরিক অভিযানের সময় তার ওপর পঞ্চম হামলাটি চালানো হয়।

গাজার শেখ রাদওয়ান এলাকায় একটি বাড়ির ওপর ইসরাইলিরা বিমান হামলা চালায়। হামলায় মোহাম্মদ দেফের স্ত্রী উইদাদ এবং তাদের শিশুপুত্র আলি নিহত হয়। ইসরাইলিরা ভেবেছিল তারা মোহাম্মদ দেফকেও হত্যা করতে পেরেছিল। কিন্তু তিনি আসলে তখন সেই বাড়িতে ছিলেন না।

এই হামলার পরপরই হামাস জানিয়েছিল, ‘মোহাম্মদ দেইফ এখনো বেঁচে আছেন এবং তিনিই হামাসের সামরিক অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।’

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোহাম্মদ দেইফ যে বারবার ইসরাইলি সামরিক বাহিনীকে ফাঁকি দিতে পারছেন তার কারণ তিনি আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার একেবারেই এড়িয়ে চলেন।

মিস্টার লেভিট বলেন, ‘যদি আপনি ফোন ব্যবহার না করেন, কম্পিউটার ব্যবহার না করেন, তাহলে আপনি কোথায় আছেন, সেই ধারণা পাওয়া আধুনিক গুপ্তচর সংস্থাগুলোর জন্য খুব কঠিন হবে।’

আর ইসরাইলের সাবেক গোয়েন্দা প্রধান বলছেন, মোহাম্মদ দেইফকে হত্যার চেষ্টা যে ব্যর্থ হচ্ছে তার অনেক কারণ আছে। হামাসের টানেলগুলো যেরকম গভীর এবং বিস্তৃত এবং তার সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য এত পুরনো, সেটা তাকে লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করছে। এছাড়া কিছু হত্যা প্রচেষ্টার সময় অস্ত্র ঠিকমতো কাজ করেনি।

অনন্য এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
ইসরাইল এবং গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার এক দিন আগে হামাসের এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে (এপি) জানিয়েছিলেন, গাজায় লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মোহাম্মদ দেইফ।

আর ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফের একজন কর্মকর্তা বিবিসিকে জানান, মোহাম্মদ দেইফর ব্যাপারে তাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। তবে এসব মিশন যেহেতু বেশ গোপনীয়, তাই তারা এর বেশি তথ্য দিতে পারছেন না।

ম্যাথিউ লেভিট বলেন, মোহাম্মদ দেফকে নিয়ে ইসরাইল যে এত বেশি মাথা ঘামাচ্ছে, সেটা তাকে অবাক করছে না। কিন্তু যেভাবে তিনি বার বার ইসরাইল হত্যা প্রচেষ্টা থেকে বেঁচে যাচ্ছেন, সেটা তাকে ঘিরে রহস্য আরো বাড়াবে।

তিনি বলেন, ‘ইসরাইল তার শেষ দেখতে আগ্রহী, কারণ তিনি হামাসের পুরনো ধারার একজন। হামাসের একেবারে শুরু থেকে যারা ছিলেন, তাদের গুটিকয় এখনো আছেন, তিনি সেই অল্প কজনের একজন। সেদিক থেকে তিনি অনন্য।’

মোহাম্মদ দেইফের জীবন নিয়ে রহস্য অনেক। গাজার রাস্তায় পর্যন্ত তাকে দেখে চিনতে পারবেন খুব কম মানুষ। যে চরমপন্থা তিনি বেছে নিয়েছেন, সেটার পক্ষে কথা বলার লোকও কম।

জরিপের তথ্য উল্লেখ করে ম্যাথিউ লেভিট বলেন, ‘হামাসের বেশিরভাগ নেতার ব্যাপারে আসলে ফিলিস্তিনিদের অত মোহ নেই বলেই মনে হয়।’

কিন্তু তা সত্ত্বেও যখন যুদ্ধবিরতির কথা ঘোষণা করা হলো, তখন কিছু ফিলিস্তিনিকে মোহাম্মদ দেইফের নামে শ্লোগান দেয়া থেকে বিরত রাখা যায়নি।

গাজার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে যখন তারা গান গেয়ে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা উদযাপন করছিলেন, তখন তারা বলছিলেন, ‘দেইফ, আমাদের আত্মা এবং আমাদের রক্ত দিয়েই আমরা তোমাকে মুক্ত করবো।’

সূত্র : বিবিসি


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us