মিসরকে যেভাবে চেপে ধরতে চাচ্ছে ইসরাইল
মিসর-ইসরাইল-ফিলিস্তিন - ছবি সংগৃহীত
ইথিওপিয়ার সুউচ্চ পর্বতমালার হ্রদ ও ঝর্ণা থেকে উৎপন্ন, নীল নদের প্রবাহের বড় অংশটি মিসরের উপর দিয়ে ভূমধ্যসাগরে পড়েছে। পানীয় জল ও কৃষির জন্য মিসরকে প্রধানত নীল নদের ওপর নির্ভর করতে হয়। এ নদের উৎসমূলে ‘রেনেসাঁ বাঁধ’ নামের এক বিশাল বাঁধ তৈরির কাজ শুরু করে ইথিওপিয়া ২০১১ সালে। আর এতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অর্থের জোগান দেয় ইসরাইল ও ইহুদি লগ্নিকারকরা। ইসরাইল এখানে বিনিয়োগ করায় সংযুক্ত আরব আমিরাতকে দিয়েও। এখানে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ইথিওপিয়াকে সমৃদ্ধ করলেও তা মিসর ও সুদানকে নীলের ন্যায্য পানি থেকে বঞ্চিত করবে। এ জন্য এ বাঁধ চালু করার আগেই মিসর ও সুদান দুই দেশই চেয়েছিল ইথিওপিয়ার সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে, যাতে দেশ দুটি নীল নদের প্রয়োজনীয় পানি থেকে বঞ্চিত না হয়।
বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই নদের পানির ওপর নির্ভর করে এগারোটি দেশ। তার মধ্যে রয়েছে বুরুন্ডি, কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, মিসর, ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, রুয়ান্ডা, সুদান, দক্ষিণ সুদান, তানজানিয়া এবং উগান্ডা। মিসরের মিষ্টি পানির ৯৬ শতাংশেরও বেশি নীল নদের মাধ্যমে আসে। সুদান ও মিসরের মধ্যে ১৯৫৯-এ স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির মাধ্যমে নীলের মিঠা পানির বরাদ্দ ঠিক করা হয়। এই চুক্তি অনুসারে মিসর ও সুদানকে যথাক্রমে প্রতি বছর যথাক্রমে ৫৫.৫ বিলিয়ন কিউবিক মিটার (বিসিএম) এবং ১৮.৫ বিসিএম পানি দেয়া হয়।
আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্যার সময়ে প্রধান নীল নদের পানির বেশির ভাগ অংশ ‘নাইল’ নীল এবং আটবারা হয়ে ইথিওপীয় মালভূমি থেকে আসে। ইথিওপিয়ার উপনদীগুলো নীল নদের পানি সরবরাহ করে প্রায় ৮৬ শতাংশ।
২০১১ সালে, ইথিওপিয়া সুদান থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরে এবং আদ্দিস আবাবার উত্তর-পশ্চিমে নাইল নীল নদের উপরে গ্র্যান্ড ইথিওপীয় রেনেসাঁ বাঁধের (জিইআরডি) নির্মাণ কাজ শুরু করে। বাঁধের জলাধারটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪০৪০ মিটার উপরে পূর্ণ সরবরাহ স্তরে ১৮৭৪ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলজুড়ে থাকবে ৭৪৪ বিসিএমের সক্রিয় জলাধার। এই বাঁধ নির্মাণ সম্পর্কে একটি বড় উদ্বেগ হলো, এর জলাশয় পূরণের সময়কালে নীল নদের পানি থেকে মিসর এর কত অংশ পাবে।
ইথিওপিয়া এর মধ্যে রেনেসাঁ বাঁধ স্থাপন করে প্রথম পর্যায়ের জলাধার ভরার কাজ সম্পন্ন করার পর দ্বিতীয় দফা জলাধার ভরতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে এ কারণে নীলের পানি প্রবাহ অনেকখানি কমে গেছে। মিসর ও সুদান দুই দেশই চেয়েছিল দ্বিতীয় দফা পানি প্রত্যাহারের আগে সংশ্লিষ্ট চুক্তি সম্পন্ন করার জন্য। আর এ জন্য আফ্রিকান ইউনিয়ন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতার প্রস্তাবও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ইথিওপিয়ার একগুঁয়ে মনোভাবের জন্য সব আলোচনাই ব্যর্থ হয়েছে।
অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র শক্তির দেশ হয়েও ইসরাইলের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ইথিওপিয়া পাল্টা হুমকি দিতেও কসুর করছে না। এই অবস্থায় মিসর এক সিদ্ধান্তকারী প্রান্তিক অবস্থায় পৌঁছে যায় আর সমঝোতা ছাড়া নীলের পানি প্রত্যাহার করলে শক্তি প্রয়োগের বিষয় বিবেচনায় আনতে শুরু করেছে। ইসরাইল সুকৌশলে বাঁধ নির্মাণের বিনিয়োগে আরব আমিরাতকেও সম্পৃক্ত করেছে।
সুয়েজের প্রাণ সংহার!
এ অবস্থাতেই ইসরাইল আরেকটি উদ্যোগ নিয়ে মিসরের অর্থনীতির জন্য ভয়ঙ্কর বার্তা দিতে শুরু করেছে। সুয়েজ খাল থেকে মিসর প্রতি বছর পাঁচ থেকে ছয় বিলিয়ন ডলার রাজস্ব আহরণ করে থাকে। সম্প্রতি সুয়েজ খালে একটি কার্গোবাহী জাহাজ আড়াআড়িভাবে আটকা পড়লে ছয় দিনের জন্য জাহাজ পারাপার বন্ধ হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় বিপুল জাহাজ জট। ঠিক এ সময়টাতে ইসরাইলের সুয়েজ খালের বিকল্প একটি খাল খননের প্রস্তাব আলোচনায় চলে আসে। ইসরাইল সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে যৌথ উদ্যোগে সিনাই উপত্যকার পাশ দিয়ে সুয়েজের বিকল্প হিসাবে জাহাজ আসা যাওয়ার একটি খাল খননের প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যেতে চাইছে।
সুয়েজ খালের বিকল্প হিসাবে ইসরাইলের লোহিত সাগরের বন্দর ইলাতকে ভূমধ্যসাগরে সংযুক্ত করার জন্য এই খাল খননের পরিকল্পনা করা হচ্ছে । একেবারে ‘ইউটোপিয়ান’ না হলেও ইসরাইল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন বেশ ব্যয়সাধ্য বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কয়েক শ’ মিটার উঁচু পাহাড় কেটে সিনাই উপদ্বীপের পূর্ব প্রান্তের প্রায় ২৫০ কিলোমিটার (১৫৫ মাইল) পূর্বদিকে খাল খনন করতে গেলে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। সুয়েজ খাল এই রুটের চেয়ে ১০০ কিলোমিটার (৬২ মাইল) ছোট এবং উচ্চতা মাত্র ১০০ মিটার (৩২৮ ফুট) পর্যন্ত। মিসর সুয়েজ খালের সমান্তরালে একটি নতুন খাল নির্মাণ করতে চাইলে ইসরাইল-সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রকল্প ব্যয়ের এক-তৃতীয়াংশে বিদ্যমান খালটিকে প্রসারিত করতে পারে।
আনুমানিক ১২ শতাংশ বিশ্ব সামুদ্রিক বাণিজ্য সুয়েজ খালের মধ্য দিয়ে পরিবহন করা হয়, তবে এই রুটটি একেবারে অনিবার্য নয়। ১৯৫৬ সালে ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং ইসরাইল এই খালটি দখল করার পর প্যাসেজ কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে গেলে বিকল্প পথে নৌবাণিজ্য অব্যাহত ছিল। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ইসরাইল যখন খালটি দখল করে, তখন আবার সুয়েজ পথ বন্ধ হয়ে যায় এবং এই পরিস্থিতি আট বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। তখনও বিকল্প পথে বাণিজ্য হয়েছে। তবে এই রুটের জন্য বেশি জ্বালানি ও সময় ব্যয় হয়, যদিও এতে বিশ্ব বাণিজ্যে কোনো সংকট সৃষ্টি হয় না।
ইসরাইলের প্রস্তাবিত এবং বিপুল ব্যয়ে গ্রহণ করা, সুয়েজ খালের এই বিকল্প ক্যানেল মিসরীয় অর্থনীতির জন্য এক ধরনের মৃত্যু পরোয়ানার সামিল।