ধুমপানে অ্যাবরশন বাড়ে!
ধুমপানে অ্যাবরশন বাড়ে! - ছবি সংগৃহীত
বাংলাদেশের ১৫ কোটি মানুষের আড়াই কোটিই ধুমপায়ী। জর্দা, সাদা পাতা,গুল হিসেবে আনলে এ সংখ্যা ৪ কোটি ১৩ লাখ। উন্নত দেশগুলোতে সেখানে তামাক সেবন কমছে সেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তামাক সেবন ৩.৪% হারে প্রতি বছর বাড়ছে। ধুমপানের কারণে আকালেই ঝরে পড়ছে তাজা প্রাণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ১৯৮৭ সাল থেকে ধুমপানের ক্ষতিকর দিকগুলো বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরে বিশ্বকে ধুমপান মুক্ত করার অদম্য প্রচেষ্টা করে চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় পালিত হচ্ছে ৩১ মে ‘বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস’।
ধুমপানে স্বাস্থ্য ক্ষতি
শুধু ধুমপানে কারণেই আয়ুষ্কাল কমে যায় ১০-২০ বছর। বিশ্বে যত লোক মারা যায় তার দ্বিতীয় প্রধান কারণ ধুমপান। প্রতিবছর ৫৮ লাখের বেশি মানুষ মারা যায় ধুমপানের কারণে, প্রতি ১০ জনে একজন। মৃতদের শতকরা ৭০ ভাগই কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের। ধারণা করা হচ্ছে ২০৩০ সাল নাগাদ এর অবস্থা দাঁড়াবে ৬ জনের মধ্যে ১ জন। হু-এর মতে প্রতি বছর ১ কোটি লোক ধুমপানের কারণে অসুস্থ হয়।
ধারণা করা হচ্ছে ধুমপনের কারনে বিংশ শতাব্দীতে যা পরিমান মারা গেছে একবিংশ শতাব্দীতে তার ১০ গুণ মারা যাবে। সিগারেটের একটা টানে তিন হাজারেরও অধিক রকম রাসায়নিক পদার্থ ঢুকে যায় ধুমপায়ীর শরীরে। এর মধ্যে প্রধান হলো নিকোটিন। এই নিকোটিনই ধুমপান ছাড়তে দেয় না। এমন কোনো রোগ নেই যার কারণের মধ্যে ধুমপান নেই। তবে ধুমপানের কারণে সবচেয়ে ভয়াবহ রোগীটি হলো ক্যান্সার। সিগারেট-বিড়িতে ৬৫ রকমের বেশি ক্যান্সার সৃষ্টিকারী পদার্থ থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে ৩৩ ভাগ ক্যান্সারের কারণ ধুমপান। ধুমপানের ফলে সবচেয়ে বেশি হয় ফুসফুসের ক্যান্সার। প্রতিবছর বিশ্বে ১৩ লাখ লোক মারা যায় ফুসফুসের ক্যান্সারে, বাংলাদেশে মোট ক্যান্সার রোগীর ২৫ ভাগ। এ ক্যান্সারের শতকরা ৯০ ভাগ কারণ ধুমপান। এ কারণে হতে পারে মুখ, গলা, গলবিল, খাদ্যনালী, অগ্ন্যাশয়, পাকস্থলী, যকৃত, মুত্রথলি, বৃহদান্ত্র ও মলাশয়, স্তন ও জরায়ুমুখ ক্যান্সার। গবেষণায় দেখা গেছে, অধুমপায়ীদের চেয়ে ধুমপায়ীদের ফুসফুসে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা দশগুণ এবং মুখ, গলা, অন্ননালী, অগ্নাশয়, কিডনী, মুত্রথলি, জরায়ু মুখ ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেশ কয়েক গুন বেশি।
এছাড়াও ধুমপান করলে রক্তে মোট কোলস্টেরল ও খারাপ কোলস্টেরল (এলডিএল)-এর মাত্রা বেড়ে যায় এবং কমে যায় ভালো কোলস্টেরল এইচডিএলের মাত্রা। এতে করে রক্তনালীতে চর্বি জমে গিয়ে হতে পারে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন, পায়ে গ্যাংগ্রিন। গবেষণায় দেখা গেছে ধুমপায়ীদের ৪০ বছরের পর হার্ট অ্যাটাকের সম্ভবনা ৫ গুন বাড়ে। হৃদরোগ হওয়ার আশঙ্কা অধুমপায়ীদের চেয়ে দ্বিগুন। ধুমপানের কারণে হতে পারে সিওপিডি-এমফাইসেমা, ক্রোনিক ব্রোঙ্কাইটিস। শ্বাসনালীর ইনফেকশনও বাড়ায় ধুমপান। গবেষণায় দেখা গেছে ধুমপায়ীদের যক্ষা হওয়ার আশঙ্কা ২-৪ গুন বেশি। প্রতিবছর ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রামণে বেশি আক্রান্ত হয় এরা। এছাড়াও ঘন ঘন ফুসফুসের ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়। ধুমপানের ফলে মায়ের পেটের শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
গর্ভাবস্থায় ধুমপান করলে অ্যাবরশন হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। বাচ্চার ওজন কম হতে পারে, আক্রান্ত হতে পারে অ্যাজমায়। গবেষণায় দেখা গেছে শুধু মা-বাবার ধুমপানের আমেরিকার ২-৩ লাখ শিশু শ্বাসনালীর প্রদাহে আক্রান্ত হয়ে ১৫ হাজার হাসপাতালে ভর্তি হয়। এছাড়াও কোন কারণ ছাড়াই মারা যেতে পারে শিশু। আপনি হয়তবা ধুমপান করেন না। ভাবতে পারেন আপনি এ স্বাস্থ্য সমস্যা মুক্ত। আপনার আশেপাশের ধুমপায়ীদের ধোঁয়া আপনার ক্ষতি করে চলেছে আপনার অগোচরে। একে বলে সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোকিং। গবেষণায় দেখা গেছে ফুসফুসের ক্যান্সারের ১০ ভাগ রোগী কখনই ধুমপান করেন নি। এরা আক্রান্ত হয়েছেন সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোকিং থেকে। এছাড়াও এদের ক্ষেত্রে ক্যান্সারের ঝুঁকি ২০-৩০ ভাগ, হৃদরোগের ঝুঁকি ২০-৩০ ভাগ। তাই আপনার আশেপাশের ধুমপায়ী হতে সাবধান হোন।
অর্থনৈতিক ক্ষতি
দেশে প্রতিদিন একজন ধুমপায়ী কমপক্ষে ৫টি সিগারেট টানেন। মাসিক তার খরচ হয় ৪০০ টাকার বেশি। আমাদের মোট জিডিপির প্রায় দেড় ভাগই ক্ষয় হয় সিগারেট-বিড়ির পেছনে। বিশ্বে সার্বোচ্চ বিড়ি-সিগারেট উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় ২০ নম্বরে বাংলাদেশ।
শুধু সিগারেটের আগুনে জ্বলে বিশ্বব্যাপী ৪০ হাজার কোটি ডলার পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এ ব্যয়ের এক-তৃতীয়াংশই আসে উন্নয়নশীল দেশ থেকে। গবেষণায় দেখা গেছে নিু আয়ের মানুষেরা তাদের আয়ের ১০ শতাংশের বেশি খরচ করে ধুমপানের পেছনে। এ কারণে এরা খাদ্য, বস্ত্র, বসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মত মৌলিক চাহিদায় যোগান দেয়ার মত অর্থ থাকে না। পরিবারের সদস্যরা অপুষ্টিতে ভোগে। ধুমপায়ীরা বেশির ভাগ সময়ই বিভিন্ন রোগে অসুস্থ থাকে। ফলে তাদের আয় করার ক্ষমতা কমে যায়। এদের অসুখের জন্য বেড়ে যায় পরিবারের চিকিৎসা খরচ।
ধূমপান বন্ধ করার সুফল
ষ ২০ মিনিট পর ধূমপায়ীর রক্তচাপ, নাড়ীর গতি এবং দেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
ষ ৮ ঘন্টার মধ্যে ধূমপায়ীর রক্তের কার্বণ মনোঅক্সাইডের পরিমাণ স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
ষ ৩ দিনের মধ্যে হার্ট এ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে।
ষ শ্বাসকষ্ট এবং সিওপিডি অনেক ভালো হয়ে যাবে।
ষ ১ বছর পর হার্ট এ্যাটাক হওয়ার আশঙ্কা ৫০% কমে যাবে এবং ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যাবে।
ষ ১০ বছর পর হার্ট এ্যাটাক বা স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা এতটাই কমে যাবে তা অধূমপায়ীদের মত হয়ে যাবে।
ষ ধূমপানের কারণে যে অর্থ খরচ হয় সে অর্থ জমিয়ে অনেক প্রয়োজনীয় ভাল কাজ করা যেতে পারে।
ধুমপান ভালো কিছু বয়ে আনে না। নিয়ে আসে রোগ-বালাই, অশান্তি ও অর্থনৈতিক ক্ষতি। শুধু সাময়িক মানসিক প্রশান্তির আশায় আমরা ধ্বংস করে দিচ্ছি নিজেদের। পরিবারকে ঠেলে দিচ্ছি ঝুঁকির মধ্যে, অভিভাবকহীনতার নিরাপত্তহীনতায়। আসুন আজ আপনার নিষ্পাপ শিশু সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে প্রতিজ্ঞা করি ‘ধুমপান আর নয়’।