সাবধান, প্যারাসিটামলে ক্ষতিও হতে পারে!
প্যারাসিটামল - ছবি সংগৃহীত
বাড়ি বাড়ি প্যারাসিটামল ট্যাবলেট সবসময়ই থাকে। তবে করোনাভাইরাস সঙ্কটের মধ্যে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই গুচ্ছগুচ্ছ প্যারাসিটামল মজুত হয়ে গেছে। সামান্য গা ছ্যাঁকছ্যাঁক করলেও বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়াই গিলে ফেলা হচ্ছে এই ওষুধ। তবে, এ ওষুধটি এবং ওষুধের ডোজ সম্পর্কে বেশির ভাগ মানুষেরই কোনো ন্যূনতম ধারণা নেই। আর অসচেতনভাবে এই ওষুধ খেতে থাকলে লিভার, কিডনিসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অনেক ক্ষেত্রে যথেচ্ছভাবে প্যারাসিটামল খাওয়ার ফলে ক্রনিক কিডনি ডিজিজ, কিডনি ফেলিওর পর্যন্ত হতে পারে। এক্ষেত্রে ছোটদের ক্ষতির আশঙ্কা বড়দের তুলনায় বহুগুণ বেশি। ছোটদের লিভার যথেষ্ট পরিমাণে এনজাইম তৈরি করতে পারে না। ফলে এই ওষুধটি বেশি ব্যবহারে বাচ্চাদের জন্ডিস হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই অবশ্যই ওষুধটি সম্বন্ধে কিছুটা জেনে রাখাই ভালো।
একনজরে প্যারাসিটামল
প্যারাসিটামল হল এনএসএআইডি (নন স্টেরয়েডাল অ্যান্টিইনফ্লেমেটরি ড্রাগস) গোত্রের ওষুধ। এ ওষুধটির তিনটি গুণ রয়েছে— ১. অ্যান্টিপাইরেটিক, অর্থাৎ জ্বর কমায়। ২. অ্যানালজেসিক, অর্থাৎ ব্যথা কমায়। ৩. অ্যান্টিইনফ্লামেটরি, অর্থাৎ প্রদাহ কমায়।
ওষুধটির জ্বর কমানোর ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। এরপর রয়েছে ব্যথা কমানোর ক্ষমতা। মূলত এই দুই ক্ষেত্রেই এর ব্যবহার বেশি। ইনফ্লামেশন বা প্রদাহ কমানোর ক্ষেত্রে এই ওষুধের তেমন সক্রিয়তা দেখা যায় না। ফলে প্রদাহ কমাতে এর ব্যবহারও কম।
অবশ্য বর্তমানে এই ওষুধের চাহিদা আকাশ ছোঁয়া পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ার নেপথ্যে রয়েছে ওষুধটির জ্বর কমানোর ক্ষমতাই।
জ্বর কমায় কীভাবে?
মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস নামক জায়গাটি শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এবার শরীরে জীবাণু প্রবেশ করলে, প্রদাহ তৈরি হলে বা শরীরের অভ্যন্তরীণ কোনো সমস্যা থেকে হাইপোথ্যালামাসে প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিনস নামক রাসায়নিক বেড়ে যায়। হাইপোথ্যালামাসে এই রাসায়নিক বাড়ার ফলেই শরীরের তাপমাত্রা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় না। বেড়ে যায় শরীরের তাপমাত্রা। একদম সহজভাবে বললে, এই প্রক্রিয়াতেই শরীরে জ্বর আসে। এবার প্যারাসিটামলের কথায় আসা যাক। প্যারাসিটামল খাওয়ার পর পেটের মধ্যে গিয়ে তা গুলে যায়। এরপর শরীর ওষুধটিকে শোষণ করে পৌঁছে দেয় রক্তে। এবার রক্তের মাধ্যমে সমগ্র দেহে ওষুধটি ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামসে পৌঁছে যায় প্যারাসিটামল। হাইপোথ্যালামাসে পৌঁছে সেখানে উপস্থিত প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিনসের বিরুদ্ধে কাজ করে তাকে নিরস্ত্র করে দেয় ওষুধটি। এর ফলেই শরীরের তাপমাত্রা কমে স্বাভাবিক হয়।
কখন প্যারাসিটামল
গা ছ্যাঁকছ্যাঁক করছে, অস্বস্তি লাগছে, গা-হাত-পায়ে ব্যথা করছে, অকারণে শীত শীত করছে- এই ধরনের একটি বা একাধিক উপসর্গ দেখা দিলে শরীরের তাপমাত্রা মাপতে হবে। থার্মোমিটারে তাপমাত্রা ৯৯ ডিগ্রি ফারেনহাইটের উপর উঠলেই বুঝতে হবে জ্বর রয়েছে। তবে তাপমাত্রা ৯৯-এর উপরে উঠলেই প্যারাসিটামল খাওয়ার দরকার নেই। কারণ ওষুধ মাত্রই তার কমবেশি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। তাই প্রাথমিক অবস্থায় এই কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে- দরজা-জানলা খুলে দিন, ফ্যান চলুক, তিন-চারবার মুখ-হাত-ঘাড়-পা ধুয়ে নিন, পায়ের তলা-হাতের তালু গামছা ভিজিয়ে মুছে নিতে পারেন, বেশি সমস্যা হলে ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানি বের করে মাথায় ফেট্টি দেয়া যেতে পারে, পরিমিত পরিমাণে পানি পান করতে হবে। এসবের মাধ্যমেই শরীরের তাপমাত্রা সাধারণত কমে যায়। তবে এরপরও জ্বর না কমলে প্রথম প্যারাসিটামলটি খাওয়া যেতে পারে।
কোন ডোজে?
একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ ৫০০ মিলিগ্রাম প্যারাসিটামল দিনে তিনবার খেতে পারেন। আবার প্রয়োজনে ৬৫০ মিলিগ্রামের প্যারাসিটামল দিনে চারবার খাওয়া যায়। তবে মনে রাখতে হবে, প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে মোট প্যারাসিটামলের ডোজ দিনে চার গ্রামের বেশি যেন না ছাড়ায়।
ছোটদের সাধারণত সিরাপের মাধ্যমে প্যারাসিটামল দেয়া হয়। এক্ষেত্রে প্যারাসিটামলের ডোজ ওজন, বয়স এবং বডি সারফেস অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। তাই বাচ্চাদের অবশ্যই একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের বলে দেওয়া ডোজেই এই ওষুধটি খাওয়াতে হয়। তবে আপৎকালীন ক্ষেত্রে বয়স অনুযায়ী ছোটদের এই ডোজে প্যারাসিটামল দিতে পারেন-
চার বছর বয়স পর্যন্ত- এক্ষেত্রে সারাদিনে ৮০ থেকে ১৬০ মিগ্রা প্যারাসিটামল দিতে পারেন। এই ৮০ থেকে ১৬০ মিগ্রাকে তিন-চারভাবে ভাগ করে নিন। অর্থাৎ ১০০ মিগ্রা সারা দিনে খাওয়াতে চাইলে ২৫ মিগ্রা করে চারবার খাওয়ান।
চার থেকে আট বছর- এই বয়সের বাচ্চাদের সারা দিনে মোট ২৫০ থেকে ৩৫০ মিগ্রা দেয়া যায়। এক্ষেত্রেও মোট ডোজকে তিন-চারভাগে ভাগ করে নিন।
নয় থেকে ১২ বছর- এই বয়সে সারা দিনে মোট ৪০০ মিগ্রা থেকে এক গ্রাম পর্যন্ত এই ওষুধ দেয়া যায়। আর অবশ্যই মোট ডোজকে তিন বা চারভাগে ভাগ করে খাওয়ান।
বয়স ১২ পেরলেই প্রাপ্তবয়স্কদের ডোজেই প্যারাসিটামল দিতে হবে।
কতবার?
একবার এই ওষুধটি খেয়ে জ্বর ছেড়ে যাওয়ার পর শরীর গরম না হলে আর একটাও প্যারাসিটামল নয়।
চিকিৎসকের পরামর্শ
জ্বর আসার পর প্যারাসিটামল খেতেই পারেন। কিন্তু তারপর অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। তিনিই ওষুধের ডোজ ঠিক করে দেবেন।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ফার্মাকোলজি, কোচবিহার সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল
সূত্র : বর্তমান