যেভাবে ইসরাইলকে হার মানতে বাধ্য করল হামাস
ইসরাইলকে যুদ্ধবিরতিতে যেতে বাধ্য করাই ছিল হামাসের জয়। যুদ্ধবিরতির পর আল আকসা কম্পাউন্ডে ফিলিস্তিনিরা মিষ্টিমুখও করে - ছবি সংগৃহীত
জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল সামরিক শক্তি হিসেবে বিশ্বে ৬ নম্বরে রয়েছে। এছাড়া তাদের রয়েছে পারমাণবিক বোমার ভাণ্ডার। ইসরাইল দরিদ্র দেশ নয়। তাও আমেরিকা প্রতি বছর মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াও তেল আবিবকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়ে থাকে।
কিন্তু এত শক্তিশালী ইসরাইল ছোট জনপদ গাজার সঙ্গে যুদ্ধে পেরে উঠল না। এবার ১১ দিন লড়াইয়ের পর গাজার সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে বাধ্য হলো ইসরাইল। হামাস নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন– ইসরাইল গাজার সঙ্গে যে যুদ্ধবিরতির কথা বলেছে তা শুক্রবারই পুরোপুরি কার্যকর হয়েছে।
এই ১১ দিনের যুদ্ধে কয়েকজন হামাস কমান্ডারকে হত্যা করতে পেরেছে ইসরাইলি সেনা বাহিনী। কিন্তু মূলত তারা হত্যা করেছে গাজার বেসামরিক লোকজনকে। তাও সম্মুখ যুদ্ধে নয়– অত্যাধুনিক ক্ষেপনাস্ত্র– বিমান থেকে ব্যাপক বোমা বর্ষণ এবং কামানের গোলা নিক্ষেপ করে। এখন পর্যন্ত যা হিসেব– তাতে গাজায় পুরুষ নারীসহ নিহতের সংখ্যা ২৪৩। এর মধ্যে রয়েছে ৬৬ জন নিরপরাধ শিশু ও ৩৯ জন নারী নিহত হয়েছেন। এছাড়া গাজা জনপদের প্রায় ১৯১০ জন ইসরাইলি সেনাবাহিনীর হামলায় আহত হয়েছে। ইসরাইলের বিমান হানা বিধ্বস্ত হয়েছে এই দারিদ্র পীড়িত– উন্নয়ন বঞ্চিত এবং অবরুদ্ধ জনপদের বহুতল বাড়ি– স্বাস্থ্যকেন্দ্র– স্কুল– বিদ্যুৎ ও খাবার পানির পরিকাঠামো ইত্যাদি।
যুদ্ধ বিরতির পর তাই প্রশ্ন– এই নৃশংস হামলা চালিয়ে ইসরাইল কি পেল হামাস নেতৃবৃন্দ যুদ্ধ বিরতির পর বলেছেন– ইসরাইল তাদের কোনো উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হাসিল করতে পারেনি। না তারা ছোট এই জনপদটির সঙ্গে লড়াইতে বিজয়ী হয়েছে– না গাজার যোদ্ধাদের বড় ধরণের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু তারা বলেছে– বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অবশ্য আকাশচুম্বি।
এর আগেও ২০১৪ সালে ইসরাইল ৭ সপ্তাহ ধরে তাদের আধুনিক স্থল– সেনা ও বিমান বাহিনীর দ্বারা গাজায় হামলা চালিয়েছিল। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও ইসরাইল বিজয় অর্জন করতে পারেনি। বরং যুদ্ধবিরতিতে বাধ্য হয়। এবার মাত্র ১১দিনে ইসরাইলি সেনারা যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হল। যদিও জায়নবাদী ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বড় গর্ব করে বলছিলেন– আমরা হামাসকে ধ্বংস না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাব।
স্বাভাবিকভাবেই গাজার অধিবাসীরা তাদের এই বিজয়ে খুশিতে আত্মহারা। শত শত গাজাবাসী ছুটে এসেছেন জেরুসালেমের পবিত্র মসজিদুল আকসায়। সেখানে ইবাদত ও আনন্দ প্রকাশের মাধ্যমে নিজেদের এই বিজয় তারা উদযাপন করেছেন। হামাস ভয় পায়নি ইসরাইলের বর্বর সেনাবাহিনীকে। যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও ইসরাইলি সেনারা মসজিদুল আকসায় শুক্রবারের নামাযে জন্য জড়ো হওয়া মুসল্লিদের উপর ফের নির্দয় হামলা চালিয়েছে।
কিভাবে শুরু হয়েছিল এবারকার রমযান মাসের সংঘাত। ১৯৬৭ সালে ইসরাইল এক যুদ্ধে পবিত্র শহর জেরুসালেমের বেশিরভাগ এলাকাসহ আরবদের এক বড় অংশ দখল কবে নেয়।
জাতিসঙ্ঘে বার বার প্রস্তাব পাশ হয়েছে যাতে ইসরাইল দখলকৃত জেরুসালেম ও আরব ভূমি ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু পাশ্চাত্যের বড় শক্তিগুলোর সাহায্যে ইসরাইল তার অবৈধ দখলদারি কায়েম রেখেছে। শুধু তাই নয়– তারা আরো অধিক আরবভূমিতে ইসরাইলিদের এনে বসতি করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ঐতিহাবাহী জেরুসালেমেও বেশ কিছু মুসলিম পরিবারকে তারা বাড়ি ঘর খালি করে দিতে বলেছে। সেখানে তারা ইহুদিদের বসাতে চায়। মূলত এই নিয়ে এবারের সংঘাতের শুরু। তার উপর রমজান মাসে ফিলিস্তিনিরা মসজিদুল আকসাতে ইবাদতের জন্য প্রবেশ করলে ইসরাইলি সেনারা তাদের উপর আক্রমণ চালায়। বুলেট ও বিহবল করে দেয়ার গ্রেনেড ছোড়ে। তারপর যখন ইসরাইলি সেনা গাজাবাসীদের উপরও হামলা প্রসারিত করল– তখনই হামাস পালটা হিসেবে ইসরাইলি এলাকায় তাদের নিজেদের তৈরি রকেট ছুড়তে শুরু করে। প্রথমে ইসরাইল ভেবেছিল এই রকেট তাদের খুব বেশি ক্ষতি করতে পারবে না। কারণ– তাদের রয়েছে আয়রন ডোম। এই আয়রন ডোম ক্ষেপণাস্ত্র– রকেট ইত্যাদি আগে থেকেই নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে। কিন্তু দেখা গেল হামাস প্রায় প্রতি মুহূর্তে রকেট ছুড়ছে। একদিনেই তারা এক হাজারের অধিক সংখ্যায় রকেট ছুড়তে আরম্ভ করে। আর অত্যাধুনিক আয়রন ডোম ভেদ করে তা আঘাত হানে বিভিন্ন ইসরাইলি এলাকায়। আর এতে ক্ষয়ক্ষতিও হতে থাকে বিস্তর। যদিও ইসরাইল তা মুখে খুব একটা স্বীকার করেনি। কিন্তু দেখা গেল– ইসরাইলি নাগরিকরাও নিহত হতে শুরু করেছে। আর তারা ভয় ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে নিরাপদ এলাকায় পালিয়ে যেতে আরম্ভ করে। এদিকে সারা বিশ্বে ইসরাইলি হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠতে থাকে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন যদিও বলেন– ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে।’ কিন্তু পালটা প্রশ্ন ওঠে– তাহলে কি গাজার অধিবাসীদের কেবল অসহায়ভাবে মৃত্যুর অধিকার ছাড়া আর কিছু নেই ইসরাইলি সেনাবাহিনী বুঝে যায়– এত সহজে গাজাকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। ফলে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু মুখে প্রথমে না না করলেও শেষ পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি মানতে বাধ্য হয়। স্বাভাবিকভাবে হামাস বলেছে–এ হচ্ছে ইসরাইলের আগ্রাসী নীতি ও অবিচারের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের এক বিশাল বিজয়।’ পর্যবেক্ষকরা বলছেন– হামাস ও গাজাবাসীর আত্মত্যাগ– দৃঢ়তা ও অকুতোভয় পালটা লড়াই ইসরাইলিদের হার মানতে বাধ্য করেছে।
সূত্র : পুবের কলম