৩০ মের সেনা বিদ্রোহের বিচার : কিছু কথা

চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নিহত হন প্রেসিডেন্ট জিয়া - ছবি সংগৃহীত
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুটি ছিল, চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অবস্থানকারী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি অংশ কর্তৃক পরিচালিত বিদ্রোহের পরিণতি (ইংরেজি পরিভাষায় : আফটার ইফেক্ট অব এ মিউটিনি কন্ডাক্টেড বাই অ্যা পার্ট অব দ্য বাংলাদেশ আর্মি লোকেটেড ইন চিটাগং ক্যান্টনমেন্ট)। বিদ্রোহকে সামরিক-ইংরেজি পরিভাষায় ‘মিউটিনি’ বলা হয়। ১৯৮১ সালের ৩০ মে সঙ্ঘটিত চট্টগ্রাম সেনা বিদ্রোহের বা মিউটিনির বিচার হয়েছিল; কিন্তু আজ অবধি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান হত্যার কোনো বিচার হয়নি। মিউটিনির বা বিদ্রোহের বিচার হয়েছিল, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আইনের (ইংরেজি পরিভাষায় : বাংলাদেশ আর্মি অ্যাক্ট) ৩১ ধারা মোতাবেক। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আইন মোতাবেক, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য ব্যারিস্টার অ্যাডভোকেট তথা আইনজীবী অথবা সেটা সম্ভব না হলে সামরিক অফিসারদের মধ্য হতে আত্মপক্ষ সমর্থনকারী কর্মকর্তা (সামরিক আইনের ইংরেজি পরিভাষায় : ডিফেন্ডিং অফিসার) পাওয়ার অধিকার রাখতেন। ২৯ জন অভিযুক্ত ব্যক্তির মধ্যে ২৫ জনই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা অফিসার বা মুক্তিযোদ্ধা জুনিয়র কমিশনড অফিসার। অতএব, স্বাভাবিকভাবেই ওই ২৯ জনের আবেদন ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসারগণের মধ্য থেকেই যেন, কাউকে না কাউকে, আত্মপক্ষ সমর্থনকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৮১ সালের জুন মাসে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষ, মোট ৩ জন আত্মপক্ষ সমর্থনকারী কর্মকর্তা নিযুক্ত করতে সম্মত হন।
১৯৮১ সালের জুন মাসের জ্যেষ্ঠতার ক্রম অনুসারে ওই তিনজন ব্যক্তি ছিলেন : (এক) ১৯৭৩-৭৪ সালে পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত আর্টিলারি কোরের অফিসার, ব্রিগেডিয়ার (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) আনোয়ার হোসেন, (দুই) মুক্তিযোদ্ধা, কর্নেল (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) মোহাম্মদ আইনুদ্দিন বীর প্রতীক, (তিন) মুক্তিযোদ্ধা, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক, তথা এই কলামের লেখক। পাঠক যেন মনে না করেন যে, এই তিনজন ব্যক্তির দায়িত্ব ছিল প্রেসিডেন্ট হত্যা সমর্থন করা। এই তিন জন অফিসারের দায়িত্ব ছিল ২৯ জন অভিযুক্ত ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থন করা; তথা এটা প্রমাণে সহায়তা করা যে, তারা বিদ্রোহের জন্য দায়ী নন বা তারা বিদ্রোহ করেননি। কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে অভিযুক্তদের বিচার হয়েছিল; সেনাবাহিনী আইন (অর্থাৎ বাংলাদেশ আর্মি অ্যাক্ট) মোতাবেকই কোর্ট মার্শালের রায় বাস্তবায়ন হয়েছিল। কিন্তু সেই কোর্ট মার্শাল সম্বন্ধে, সেই কোর্ট মার্শালের পরিচালনা সম্বন্ধে, সেই কোর্ট মার্শালের নিরপেক্ষতা সম্বন্ধে আমার ব্যতিক্রমী মতামত আছে যেটি আমার বই-এ লিখেছি (দ্রষ্টব্য ‘মিশ্র কথন’, প্রকাশক অনন্যা, ২০১১ সাল। বইটি এখন ই-বুক হিসেবে পাঠকের জন্য উন্মুক্ত)। স্থানের অভাবে এখানে লিখছি না। কোর্ট মার্শাল (তথা আদালতটি) বসেছিল এবং চলেছিল চট্টগ্রাম মহানগরের লালদীঘির পাড়ে অবস্থিত, কারাগারের অভ্যন্তরে। ওই কারাগারেই অভিযুক্ত ২৯ জন বন্দী ছিলেন।
ওই ২৯ জনের আত্মপক্ষ সমর্থন করতে হলে, ঘটনা সম্বন্ধে জানতেই হবে। জানার নিমিত্তে ওই ২৯ জন অভিযুক্তের সাথে আমরা নিবিড়ভাবে আলাপ করেছিলাম, ওই ২৯ জনের মধ্যে বেশির ভাগেরই পিতা-মাতা, স্ত্রী, ভাইবোন প্রমুখের সাথেও আমরা কথা বলেছিলাম। আমাদের তিনজনের মধ্যে ব্রিগেডিয়ার আনোয়ার একটু কম জড়িত হয়েছিলেন; কর্নেল আইনউদ্দিন এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইবরাহিম বেশি জড়িত হয়েছিলেন; বেশি কথা শুনেছিলেন; বেশি খবর জেনেছিলেন। আলাপের কারণে তাৎক্ষণিক ঘটনা প্রসঙ্গে এবং তার আগেরও অনেক ঘটনা প্রসঙ্গে, আমাদের জানার সুযোগ হয়েছিল। এটা ছিল অত্যন্ত বিরল সুযোগ। আশ্চর্যজনক মনে হলেও বাস্তবতা হলো : ভীতিকর পরিস্থিতিতে আমরা কোনো লিখিত নোট রাখতে পারিনি, যা কিছু জমা রাখার সেটা জমা রেখেছিলাম স্মৃতির মনিকোঠায়। অপ্রিয় বাস্তবতা হলো, কালের পরিক্রমায় অনেক কিছুই আমার স্মৃতিশক্তি থেকে ছুটে যাচ্ছে।
মহা দুর্ঘটনার দায়-দায়িত্ব
সেনাবাহিনীতে চাকরি করার কারণে, সক্রিয় চাকরি জীবনে, এই ধরনের মিউটিনি ও কোর্ট মার্শাল ইত্যাদি বিষয়ে লেখালেখি কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত ছিল। কিন্তু ঘটনার তিরিশ বছর পর (১৯৮১-২০১১) আমি ‘মিশ্র কথন’ নামক বইটি লিখেছি। বইটি লেখার সময় অনেক কথা যেগুলো অভিযুক্তদের কাছ থেকে জেনেছিলাম সেগুলো উল্লেখ করতে পারিনি। কারণ সেগুলো গবেষকের দৃষ্টিতে বা আইনজীবীর দৃষ্টিতে প্রমাণ করা কষ্টকর; কিন্তু আমার নিকট অতি বিশ্বাসযোগ্য। প্রখ্যাত সাংবাদিক মরহুম মাহফুজ উল্লাহ দীর্ঘদিন গভীর ও বিস্তৃত গবেষণার পর তার বই লিখেছেন, ইংরেজি ও বাংলা ভাষায়। ইচ্ছাকৃতভাবে অনেক ঘটনা আমার বইয়ে আলোচনায় আনিনি; মাহফুজ উল্লাহ তার বইয়ে এনেছেন।
সারমর্ম : তৎকালীন (১৯৭৮-মে ৮১) চট্টগ্রাম সেনানিবাসের পদাতিক ডিভিশনের জিওসি, তৎকালীন মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর বীর উত্তম চাচ্ছিলেন জিয়াউর রহমানকে কাবু করতে; জেনারেল মঞ্জুরকে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও সুনির্দিষ্ট-পরোক্ষভাবে উৎসাহ জোগাচ্ছিলেন ঢাকায় অবস্থানকারী কয়েকজন ভিভিআইপি বা ভিআইপি ব্যক্তিত্ব এবং বাংলাদেশের বাইরের কেউ না কেউ। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের দু-একটি পত্রিকায় এবং অন্যান্য দেশের পত্রিকায়, প্রকাশিত বিশ্লেষণমূলক সংবাদে এবং অনেক বাংলাদেশী লেখকের গ্রন্থে এই ধরনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত আছে।
তিনটি উদাহরণ; (১) বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব এবং ১৯৯১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা জনাব ইমাম উদ্দিন আহমদ চৌধুরী লিখিত আত্মজীবনীমূলক পুস্তক; (২) প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘনিষ্ঠ সহচর এবং ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ঘনিষ্ঠ সরকারি সহকর্মী কর্নেল অলি আহমদ বীর বিক্রম কর্তৃক লিখিত পুস্তক; (৩) মরহুম মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী বীর বিক্রম কর্তৃক লিখিত পুস্তক। তারা তাদের লেখা বইয়ে বা কলামে বা ইন্টারভিউতে এই ধরনের ইশারা দিয়েছেন।