যুক্তরাষ্ট্র সব যুদ্ধে হারে কেন?
বুশ - ছবি সংগৃহীত
এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বিস্ফোরক সব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সন্ত্রাস দমনের ব্রত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পেন্টাগন সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেনে বরং ‘সন্ত্রাসীদের’ হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে! ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার’ অভীষ্ট লক্ষ্য কি আসলেই ফাঁকা বুলি? বুলগেরিয়ার সাংবাদিক মিসেস দিলিয়ানা তার আরমস ওয়াচ ওয়েবসাইটে এসব তথ্য উপাত্তসহ প্রকাশ করেছেন। বলা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিভিন্ন দল-গোষ্ঠী যারা আল-কায়দা সমর্থিত ও মদদপুষ্ট তারাও অস্ত্র সহায়তা প্রাপ্তির তালিকায়। ইরান এক যুগ আগে এই অভিযোগ করে এলেও কেউ কান দেয়নি।
দিলিয়ানা ২০১৮ ও ২০১৯ সালে পুরোটা সময় অনুসন্ধান চালিয়ে পেন্টাগনের অস্ত্র সরবরাহের ‘মেকানিজম’ জনসমক্ষে প্রচার করেছেন। তিনি জানান, অস্ত্র সরবরাহের একটি বৈশ্বিক সিন্ডিকেট কাজ করছে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি কর্মকর্তারা ক্রেতা সাজেন, সেনাবাহিনীর পেশাদার ঠিকাদাররা সহায়তা করেন এবং শত শত এয়ার লাইন কার্গো কেরিয়ার সরবরাহের সাথে সংযুক্ত থাকে।
‘ডিপ্লোম্যাটিক ক্লিয়ারেন্স’ থাকায় এয়ারলাইন কোনো ঝামেলা করতে পারে না। লাখ লাখ অ্যাসল্ট রাইফেল, মর্টার, রকেট যুক্তরাষ্ট্রের আল-ইউদিদ এয়ার বেস থেকে গন্তব্যের দিকে চলে যায়। আল-ইউদিদ কাতারে অবস্থিত এক বিমান ঘাঁটি যেখানে রয়েছে কাতার এয়ার ফোর্স, যুক্তরাষ্টের বিমানবাহিনী, রয়েল এয়ার ফোর্স, গালফ ওয়ার কোয়ালিশনের এক্সপার্ট ও সম্পদ। ঘাঁটিটি ১৯৯৬ সালে তৈরি করা। এখানে কাতার আমিরি এয়ার ফোর্স অপারেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। অনুন্নত এসব অস্ত্র প্রায়ই বুলগেরিয়া, ক্রোশিয়া ও সার্বিয়া থেকে কেনা হয়। অস্ত্র সংগ্রহ, পরিবহন ও বিতরণে কোড নম্বর ব্যবহৃত হয়ে থাকে যা রীতিমতো গোয়েন্দা ফিল্মের মতো। এই নিবন্ধে এসব বিস্তারিত তথ্য লেখার পরিসর নেই। জন বোল্টন ও ট্রাম্পের নিরাপত্তা কাউন্সিলও এসব কাজে জড়িত বলে দিলিয়ানা দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পেন্টাগনের বিদেশনীতির বড় ধরনের মিথ্যাচার। কেননা, তারা গোপনে সন্ত্রাসবাদের দোসর।’
তিনি জানান, “সিরিয়ায় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আস্তানায় যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। আমেরিকার হেলিকপ্টারগুলো অস্ত্র ফেলেছে এবং কথিত সন্ত্রাসীদের পরিবহন করেছে। তুরস্ক এই কাজের জন্য পেন্টাগনের সমালোচনা করে ‘সেফ জোন’ পলিসি প্রয়োগ করে তুর্কি সেনাবাহিনীকে সিরিয়ায় ঢুকিয়েছে। সাবেক আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই ২০১৭ সালে ঘোষণা করেন, আইএস নেটওয়ার্কে যুক্তরাষ্ট্রের স্পেশাল ফোর্স অস্ত্র সরবরাহ করছে।” কারজাইয়ের বিদায়ের এটিও একটি কারণ। আফগানিস্তান ও সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের হেলিকপ্টারের সন্দেহজনক আচরণের জন্য রাশিয়ার ডিফেন্স মিনিস্ট্রি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের প্রক্সি ফোর্স হিসেবে, নিজেদের নিরাপত্তা ও যুদ্ধকৌশলের অংশ হিসেবে এসব দল-গোষ্ঠীকে সহায়তা করা হয়ে থাকে।
স্মরণ করা যেতে পারে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সিরিয়া থেকে চটজলদি সেনা প্রত্যাহার করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তা পারেননি। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন- বরং কিছু সেনা, কাগজে-কলমে ৪০০ জন, সিরিয়ায় থাকবে। গ্রাহাম লিন্ডসে, মার্কিন রিপাবলিকান সিনেটর, বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সেনা সিরিয়া ত্যাগ করলে ইরান শূন্যস্থান পূর্ণ করবে। গ্রাহাম মূলত ইসরাইলি স্বার্থরক্ষায় এমন কথা বলেছিলেন, আর ট্রাম্প ও বোল্টন চেয়েছিলেন যুদ্ধ। সেটি আরেক উপাখ্যান।
যুদ্ধের জন্য আরো এক উপযুক্ত স্থান হলো, ভেনিজুয়েলা। ট্রাম্প প্রশাসনের ‘নিউকন’রা এর পুরোধা। বুশ প্রশাসনের ইলিয়ট আব্রামসকে ভেনিজুয়েলায় বিশেষ প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়েছিলেন মাইক পম্পেও। নিকোলাস মাদুরোকে একহাত নেয়া ও ক্ষমতাচ্যুত করা, সেনা পাঠিয়ে যুদ্ধ করার সব প্রস্তুতি নেয়া হয়। বোল্টন চিৎকার দিয়ে বলেন, ‘গুয়ান্তানামো’ কারাগারে মাদুরোর জন্য কক্ষ নির্ধারিত আছে।’ মাদুরোকে টুইটে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা গাদ্দাফির ছবি পাঠানো হয়। ভেনিজুয়েলাকে সহায়তার জন্য ইরান ঢুকে পড়ে। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তেল রফতানি করে। ভেনিজুয়েলার রাজনীতির পট পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি।
বন্দর বিন সুলতান, সৌদি আরবের অন্যতম এক প্রিন্স, ইন্ডিপেনডেন্ট আরাবিয়ায় সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, দোহা নানাভাবে প্রতারিত; সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বেস রয়েছে কাতারকে রক্ষা করার জন্য। আসলে তিনি বলতে চেয়েছিলেন, লিবিয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় সামরিক বিমান ঘাঁটি থাকা সত্ত্বেও সে দেশের কিং ইদ্রিসকে সামরিক ক্যু থেকে ১৯৬৯ সালে রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। আমেরিকানরা বসে বসে দেখল, কিভাবে ইদ্রিসকে ছুড়ে ফেলা হয়েছিল। তখন বলা হয়, এটি লিবিয়ার অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। যা হোক, বন্দরের কন্যা প্রিন্সেস রিমাকে ওয়াশিংটনে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। বুশ পরিবারের সাথে সম্পর্ক থাকায় বন্দরকে ‘বন্দর বুশ’ বলেও ডাকা হতো। তিনিও ওয়াশিংটনে টানা ২২ বছর রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছিলেন!
ইসরাইলি মিডিয়া ফাঁস করে দেয় যে, ফিলিস্তিন-ইসরাইল ইস্যুটি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের হাত থেকে বাদশাহ সালমান নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছেন। সৌদি বাদশাহ পম্পেওকে জানান, মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা তিনি সমর্থন করেন না, ফিলিস্তিন স্টেট ছাড়া সৌদি আরব-ইসরাইল স্বাভাবিক সম্পর্ক হচ্ছে না। ওই সময় ক্রাউন প্রিন্স ট্রাম্প-জামাতা জ্যারেড কুশনারের সাথে কাজ করছিলেন এবং ফিলিস্তিনিদের শান্তি পরিকল্পনা গ্রহণ করাতে চাপ দিয়েছিলেন। ট্রাম্প প্রশাসন সৌদি আরবে পরমাণু টেকনোলজি বিক্রির চেষ্টা করেছিলেন। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এই প্রচেষ্টার ঘোরবিরোধী ছিলেন এবং জানান যে, বিক্রি বাতিল করা সম্ভব না হলে যেন রিঅ্যাকটরের সব খুঁটিনাটি ইসরাইলে সরবরাহ করা হয় এবং ‘ওয়েপনগ্রেড ইউরেনিয়াম’ সমৃদ্ধকরণ করতে না পারে।
ইসরাইল পরমাণু শক্তিধর দেশ, এতদঞ্চলে অন্য কোনো দেশ পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী হোক সেটি চায় না।
ইসরাইলের মারদাঙ্গা কার্যক্রম এ কারণেই বেশি সম্প্রসারিত হচ্ছে। ইরানের কথা বাদ দিলেও সৌদিআরব, আমিরাত ও তুরস্কের পরমাণু হাতিয়ার অর্জন ইসরাইল বা তেলআবিবকে সমস্যায় ফেলেছে। তেলআবিব মনে করে, এই দেশগুলোকে যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, মহামারীর ভেতর আটকে না রাখলে খুব দ্রত পরমাণু শক্তি তাদের হাতে চলে আসবে। ইরাক সবার আগে পরমাণু অস্ত্র বানানোর চেষ্টা করেছিল, তাই সাদ্দামসহ পুরো ইরাক এখন বড় গোরস্তান। ইরাক বিভক্তির আয়োজন চলছে। এর মাস্টারমাইন্ড হলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি এক দশক আগে ইরাক থেকে সেনা প্রত্যাহার এবং ইরাককে সুন্নি ইরাক, শিয়া ইরাক ও কুর্দি ইরাকে ভাগাভাগি করার মহাপরিকল্পনা পেশ করেছিলেন। অন্য দিকে, ইসরাইল মেধা ও শক্তি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিকে কাজে লাাগিয়ে আঞ্চলিক দেশগুলোকে দুর্বল করার শত পথ চিহ্নিত করে রেখেছে। সময় ও সুযোগমত ‘তরীর তীর’ ছেড়ে দেয়া হয়। ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি ‘অন্যের যুদ্ধে জড়িত হবেন না’, ‘সারা দুনিয়ার খবরদারি করার দরকার নেই’ ইত্যাদি। বাস্তবে এসব অর্জিত হয়নি।
পেন্টাগনের এই যুদ্ধ বিশ্ব পরিবেশের জন্যও অনেক ক্ষতির কারণ হয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, পরিবেশ দূষণে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্স বহুলাংশে দায়ী। যেকোনো দেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষতিকর বর্জ্য বেশি তৈরি হয়। কেমিক্যাল কোম্পানিগুলোর বর্জ্য থেকে পরিবেশ পাঁচগুণ দ্রুতগতিতে বিষাক্ত হয়ে ওঠে। ইউরেনিয়াম, তেল, জেট ফুয়েল, কীটনাশক-এসবের কারণে অস্বাভাবিক সন্তানও জন্মগ্রহণ করে থাকে। এর মধ্যে ভিয়েতনামে ব্যবহৃত ‘অ্যাজেন্ট অরেঞ্জ’ ও সিসা খুবই বিষাক্ত।
২০১৪ সালে মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্স স্বীকার করে, ৩৯ হাজার ইউনিট এলাকা যা যুক্তরাষ্ট্রের ১৯ মিলিয়ান একরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সেগুলো বিষাক্ত হয়েছে। ঘরে-বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ঘাঁটিগুলো দূষণের আখড়া মনে করা হয়। পেন্টাগন ৭০টি দেশে ৮০০ সামরিক বেস পরিচালনা করে। অপর দিকে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়া মিলে মাত্র ৩০টি বেস বা ঘাঁটি বিদেশে রয়েছে। হাওয়াই দ্বীপের পোহাকুলো মিলিটারি ট্রেনিং ক্যাম্পে আসল গোলাবারুদ, লাইভ অ্যামুনিশন ছুড়ে সেনারা প্রশিক্ষণ নেয়। স্নাইপার প্রশিক্ষণ, গ্রানাইড, মর্টার, রকেট লাঞ্চার, আর্টিলারি এসব দিন-রাত বর্ষিত হয়। এলাকার লোকেরা বহু দিন ধরে সামরিক দূষণ দূর করা এবং সুপেয় পানির আধার নষ্ট না করার জন্য দাবি জানিয়ে আসেছে।
যুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে ব্রিটিশ ফিল্ড মার্শাল স্যার উইলিয়াম স্লিম বই লিখেছেন ‘Defeat Into Victory’ বইটির প্রেক্ষাপট মিয়ানমার, দেখানো হয়েছে জাপান কিভাবে বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল। আমেরিকার অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলরা যদি অন্তহীন যুদ্ধের স্মৃতি লিখেন তবে শিরোনাম দিতে পারেন, ‘Victory Into Defeat’। অবশ্য মার্কিন লে. জেনারেল রিকার্ডোর লেখা Wiser in Battle: A Soldier's Story একটি উন্নত মানের সুন্দর বই।
আফগান যুদ্ধ নিয়ে একটু ভাবুন। যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ২০০১ সালে। আল-কায়দা ও তালেবানদের ওপর বড় ধরনের আক্রমণ যাকে যুদ্ধের ভাষায় ‘রেইড’ বলা হয়; এটি সাময়িক এক বিজয়, এ ঘটনা নিয়ে হলিউড চলচ্চিত্র নির্মাণ করে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বিদেশী সেনাদের আফগানিস্তানে অবস্থান দুঃস্বপ্নের বিভীষিকায় পরিণত হয়। অনেক সেনা বাড়িতে ফিরতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। স্ত্রী-সন্তান ও প্রেমিকার করুণ বার্তা অনেক সেনাকে মানসিক রোগীতে পরিণত করে। খোদ পেন্টাগনের রিপোর্টেই এসব তথ্য এখন জানা যাচ্ছে। এক এক করে ১৭ জন কমান্ডার সেখানে বদলানো হয়, নতুন কৌশল অবলম্বন করা হয়, গবেষণা করে নতুনভাবে ব্যুহ রচনা করা হয়।
তথাপি তালেবানে পরাজিত করা যায়নি। ভেবে দেখুন, এই তালেবান যুক্তরাষ্ট্রের প্রশিক্ষিত সেনা! রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য মার্কিন কমান্ডোরা তাদের আধুনিক কলা-কৌশল শিখিয়েছে বছরের পর বছর। সেই তালেবানকে পরাস্ত করতে অন্তহীন ২০ বছরের যুদ্ধ! যেভাবেই হোক তালেবান আফগানদের মন মগজে অনেকটা দখল করে আছে। মৌলবাদ ও সন্ত্রাসের কথা বলে একটি গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করা আধুনিক যুগে সম্ভব নয়। শুধু অ্যাসল্ট রাইফেল দিয়ে বোমা, ড্রোন, যুদ্ধবিমান এসবের বিরুদ্ধে লড়ে একটি সুপার পাওয়ারকে বিদায় করা সোজা কথা নয়।
ইরাকের বিষয়টি চিন্তা করুন। ২০০৩ সালের মে মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এয়ার ক্রাফট কেরিয়ারে বসে গরম কফিতে চুমুক দিয়ে বলেছিলেন ‘বিজয়ের মিশন শেষ হয়েছে’। ইরাক যুদ্ধের ওপর নয়া দিগন্তে এ লেখকের লেখা ‘১৮ বছরে ইরাক হলো শ্মশান’ বর্তমান অবস্থা জানার জন্য পড়তে পারেন। ইরাক যুদ্ধে ২০০৭ সালের বিজয়ের জন্য জেনারেল পেট্রিউসকে ওয়াশিংটনে ফুলের তোড়া দিয়ে সম্বধর্না দেয়া হয়। কিন্তু ইরাক যুদ্ধ কি শেষ হয়েছে? তা হলে বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ইরাক থেকে সব সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তটি কী? ২০১১ ও ২০১৪ সালে আইএসের সাথে যুদ্ধে প্রশিক্ষিত সেনারা পিছিয়ে পড়ে। প্রতি সপ্তাহে কয়েকবার সেনাঘাঁটিতে মিসাইল আক্রমণ হতে থাকে। ট্রাম্প ইরানের বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর কাশেম সোলেইমানি ও ইরাকি জেনারেলদের বোমা মেরে হত্যা করে মিডিয়ায় ঘোষণা দেন কেন? কেনই বা গেল বছর ইরাকি সংসদ বিদেশী সেনাদের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার আইন পাস করেছে? বুশ তার এক জেনারেলসহ তেলের ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। তা এক বিরাট প্রতিবেদন। সাদ্দাম কম দামে তেল দিতে না চাওয়ায় ইরাক আক্রান্ত হয়েছিল বলে এখন জানা যাচ্ছে। ইরাকে ১.৩ মিলিয়িন শিশুর ঘরবাড়ি নেই। মসুল ও রামাদি ধুলায় মিশে আছে, এসব কি বিজয়ের চিহ্ন? ওদিকে আফগান যুদ্ধে জয়ী না হওয়ায় ট্রাম্প জিম ম্যাটিসকে চাকরিচ্যুত করেন।
আরো দেখুন, ওবামা প্রশাসন ২০১১ সালে লিবিয়ায় হস্তক্ষেপ করে ছিলেন। তার বিজয়োল্লসিত সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি ক্লিনটন বলেন, ‘আমরা আসলাম, আমরা দেখলাম, সে মরল।’ মিসেস ক্লিনটন নিহত লিবীয় নেতা গাদ্দাফির কথাই বলছিলেন; গাদ্দাফির কী দোষ? তিনি আরব জাতীয়তাবাদকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। ফলে কিছু আরব দেশের শেখ ও প্রিন্সও লিবিয়া আক্রমণে পশ্চিমাদের মদদ দেন।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালে নির্বাচনী প্রচারণায় বলেছিলেন, ‘আমরা কোনো যুদ্ধে জিততে পারিনি’। আসলে একটি সত্য কথাই তিনি বলেছিলেন। যদিও তিনিও যুদ্ধ এড়াতে পারেননি। সোজা ভাষায় বলা যায়, এসব ডিপ স্টেটের কলাকৌশল। তিনি বলতেন, আমেরিকার জেনারেলদের চেয়েও তিনি মিলিটারি বিষয় ভালো জানেন। ২০১৭ সালে ইয়েমেনে রেইড ও নিরাপরাধ মানুষ মারা যাওয়ায় তিনি জেনারেলদের দোষারোপ করেছিলেন; যদিও ইয়েমেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি সৌদি আরবে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করেননি। তার মূল লক্ষ্য ছিল ইরানকে আঘাত করা। ওই বছরেই তিনি সিরিয়ায় ডজন ডজন ক্রুজ মিসাইল ছোঁড়েন।
জানা যায়, পেন্টাগন ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান ও সোমালিয়ায় মার্কিন সেনাদের অতিরিক্ত বেতন-ভাতা দেয়; এমন কি সেক্সের সুবিধাকে উৎসাহিত করে। যৌন অপরাধে কোনো বিচারের প্রতিবেদন এখনো গণমাধ্যমে আসেনি। শুধু উদ্বাস্তু শিবিরে চিকিৎসা ও খাবারের জন্য কোনো কোনো বিদেশী এনজিও সেক্সের বিনিময়ে খাবার ও চিকিৎসা সুবিধা দেয়ার রিপোর্ট ফাঁস হওয়ার পর তাদের প্রত্যাহার করা হয়েছে মর্মে জানা যায়।
নিক টারস এক প্রতিবেদনে জানান, বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের ৮০০ সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। এ গুলোর জন্য শুধু সাধারণ খরচ পড়ে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ান ডলার। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ৮০টি স্পটে যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে। ব্রাউন ইউনিভার্সিটি গবেষণা করে জানিয়েছে, নাইন-ইলেভেনের পর যুদ্ধের খরচ ছয় ট্রিলিয়ন ডলার যা দিয়ে তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব। মার্কিন বিশ্লেষকরা মনে করেন, আমেরিকা বিশ্বের পুলিশি দায়িত্ব পালন করার প্রয়োজন নেই।
এসব পরাজয়ের উপাখ্যানের ইতি কীভাবে হতে পারে? কীভাবে পেন্টাগন পরাজয়কে জয়ের অবস্থানে আনতে পারে? বিশ্লেষকরা মনে করেন, পেন্টাগনে ডলারের বস্তা ছুড়ে অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয়। নতুন পথ ও কৌশল প্রয়োগ করে আমেরিকাকে সম্মান ও মর্যাদা এনে দেয়া সম্ভব। সেটি এমন হতে পারে, যুদ্ধে লিপ্ত থাকার পরিবর্তে যুদ্ধ শেষ করে দেশে ফিরে আসা। বাইডেন আফগানিস্তান ও ইরাক থেকে সেনা প্রত্যাহার করছেন, এই চালে আমেরিকাকে কেউ দোষারোপ করছে না। বাইডেনকে কেউ বলছে না তিনি ঠিক করেননি। ট্রাম্পও বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন। হোয়াইট হাউসে তার ওভাল অফিস ছাড়ার আগে ইরানে সার্বিক হামলার একটি পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু তিনি তা করেননি। সন্ত্রাসী বানাতে হলে তার কারণ বের করতে হয়। যেমন- সাদ্দামের বেলায় ‘ওয়েপন অব মাস ডেসট্রাকশন’ বা ‘গণবিধ্বংসী অস্ত্র!’ অথচ সাদ্দামের হাতে তেমন কিছুই ছিল না। ‘বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এমন একটি ফ্রন্ট যা কোনোদিন শেষ হওয়ার নয়। মনে রাখা দরকার, মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত ইমারত নিরাপত্তা আনার পরিবর্তে হতাশা ও অর্থনৈতিক দুর্ভোগ ডেকে আনে মাত্র।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব, বাংলাদেশ সরকার