ইসরাইলের শেষের সূচনা?
ইসরাইলের শেষের সূচনা? - ছবি সংগৃহীত
গাজায় যে হামলা ও ইহুদি বর্বরতা চালানো হচ্ছে, সেটি হয়তো হতে পারে ফিলিস্তিনের শার্পেভিল গণহত্যা। এটি হয়তো ইসরাইলি বর্ণবাদ অবসানের পথ খুলে দিতে পারে।
২০১৯ সালে আল-জাজিরায় একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম, সেটিতে আমি পুনর্ব্যক্ত করেছিলাম, আমরা গাজার ফিলিস্তিনিরা ইতোমধ্যে আমাদের পছন্দ নির্ধারণ করে ফেলেছি। লিখেছিলাম : ‘আমরা ধীরে ধীরে ও অসম্মানজনকভাবে মৃত্যুবরণ করব না। আমরা আমাদের হত্যাকারীদের এ জন্য ধন্যবাদ জানাই যে, তারা আমাদেরকে আত্মপ্রবঞ্চনা ও ছলনার মাধ্যমে দখলদারদের কাছে আমাদের শ্রমসাধ্য কাজকে দাসত্ব হিসেবে চিত্রিত করছে। আমাদের সংগ্রাম কোনো গোষ্ঠীর জন্য নয়। মানবাধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক ঘোষণার মৌলিক নীতির ভিত্তিতেই আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। পশ্চিমা মিডিয়া ভণ্ডামি ও কপটতার মাধ্যমে সত্যকে ধামাচাপা দেয়ার যত চেষ্টাই করুক না কেন- আমাদের সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রয়াস অব্যাহত থাকবে। এখন বর্ণবাদী ইসরাইল পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা গাজা ভূখণ্ডে বোমা বর্ষণ ও বিমান হামলার মাধ্যমে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। এই বর্বর হামলার শিকার হচ্ছে নির্দোষ বেসামরিক ব্যক্তিরা, শিশু, নারী ও পুরুষ। এরই মধ্যে দুই শতাধিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৬৪ জন শিশুও রয়েছে। গত ১৫ মে গাজা শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত কেবল আল ওয়েহদা স্ট্রিটেই গণহত্যা চালিয়ে বহু ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে।
এমনকি হাসপাতালের কর্মচারীদেরও রেহাই দেয়া হয়নি। ১৬ মে আল-শিফা মেডিক্যাল কমপ্লেক্সের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের প্রধান ড. আইমান আবু আলুফকেও তার পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যের সাথে হত্যা করা হয়। আমেরিকার তৈরি এফ-১৬ যুদ্ধবিমানের সাহায্যে ইসরাইল বোমা হামলা চালিয়ে বহু আবাসিক ভবন ও শত শত বাড়িঘর মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স ও সিভিল ডিফেন্সের ক্রুরা কয়েক দিন ধরে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া ফিলিস্তিনিদের উদ্ধার করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়াদের কেউ কেউ বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা হিসেবে তাদের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সহায়তার আকুতি জানাচ্ছেন। আমাদের কাছে এই বার্তাটি অত্যন্ত পরিষ্কার, ইসরাইল বেসামরিক লোকদের হত্যা করছে।
বর্ণবাদী ইসরাইল বারবার তাদের দীর্ঘমেয়াদি ‘দাহিয়া ডকট্রিন’ উপস্থাপন করছে। ইসরাইলি সেনাবাহিনীর উত্তরাঞ্চলীয় ডিভিশনের প্রধান গাদি আইমেনকট ২০০৬ সালে লেবাননে ইসরাইলি যুদ্ধের পর গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর এ পরিকল্পনা করেছিলেন।
তখন ৩৪ দিনব্যাপী ব্যাপক বোমা হামলার মাধ্যমে বৈরুতের পাশের দাহিয়াতে ব্যাপক হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর আইমেনকট ঘোষণা করেছিলেন, ‘২০০৬ সালে বৈরুতের দাহিয়া কোয়ার্টারে যেটি ঘটেছিল, ইসরাইলের ওপর যেখান থেকে গোলা ছোড়া হয়েছিল সেই প্রতিটি গ্রামেও সে ধরনের ঘটনা ঘটবে। আমাদের কাছে এগুলো বেসামরিক গ্রাম নয়- এগুলো হলো সামরিক ঘাঁটি।’ অন্যভাবে বলতে গেলে, গাজার প্রত্যেক অধিবাসী এমনকি এক দিনের শিশুও ইসরাইলের বৈধ সামরিক টার্গেট।
ইসরাইলিদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো, ফিলিস্তিনিদের ওপর নৃশংসতা চালিয়ে তাদেরকে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করার মাধ্যমে তাদের যেকোনো ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা নস্যাৎ করে তাদের নিজেদের ভূখণ্ডের যেকোনো দাবি পরিত্যাগ করানো। ২০০২ সালে ইসরাইলের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশে ইয়ালোন যেমন বলেছিলেন, ‘ইসরাইলি সেনাবাহিনীর বিজয়ের জন্য ফিলিস্তিনি ও আরব চেতনাকে নিঃসাড় তথা বিকল করে দিতে হবে।’ তা হলে ‘সন্ত্রাসবাদ ও সহিংসতা (প্রতিরোধ) আমাদেরকে পরাজিত করতে পারবে না।’
আগের গণহত্যার মতোই এ সময়ে আবার ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিদেরকে নির্যাতনকারী তথা জালেম এবং নির্যাতিত তথা মজলুমকে একটি যুদ্ধ ও সঙ্ঘাতের দু’টি সমান পক্ষ হিসেবে চিত্রিত করা হচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় বৈধ প্রতিরোধ শক্তিকে একটি বর্বর অবৈধ দখলদারিত্বে সাথে একই পর্যায়ে গণ্য করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, বর্ণবাদী ইসরাইলের নিজেদের রক্ষা করার অধিকার আছে। সত্যটা হলো ইসরাইলের একটি সত্যিকারের নিয়মিত সেনাবাহিনী রয়েছে- তাদের রয়েছে বৃহৎ অস্ত্রভাণ্ডার। তাই স্বাভাবিকভাবে দখলদার শক্তি অন্যদের প্রতি উম্মত্ততা প্রকাশ করে চলেছে। তাই উভয়পক্ষের মৃত্যুর সংখ্যায় বিরাট পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। জো বাইডেন, বরিস জনসন, অ্যাঞ্জেলা মের্কেল এবং অন্যান্য পশ্চিমা নেতারা এবং তাদের ‘হাউজ আরবরা’ ফিলিস্তিনিদের মানবতা দেখতে অক্ষম।
সব ধরনের প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও এটি যে দখলদারিত্ব, তারা তার স্বীকৃতি দিচ্ছে না। ইসরাইলি কলোনিকে বৈধতা প্রদান এবং সেটি জোরদার করার জন্য তারা গোটা আদিবাসিন্দা বা স্বদেশী জনগোষ্ঠীকে জাতিগতভাবে মূলোৎপাটন করতে চায়। এ জন্য তারা দখলদার ঔপনিবেশিক শক্তিকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। গাজায় এখন ‘নিরাপত্তা অভিযান’ নয়, ব্যাপক গণহত্যা চালানো হচ্ছে। তৎসত্ত্বেও ফিলিস্তিনিদের ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে বলা হচ্ছে। কোনো ধরনের বিদ্রোহ না দেখিয়ে লক্ষ্যহীন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, প্রতিরোধ গড়ে তুলে মৃত্যুবরণ করলে সেটি হবে তাদের নিজেদের ভুল।
এখন ফিলিস্তিনিদের মনে যে প্রশ্নের সৃষ্টি হচ্ছে সেটি হলো, বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের পতনের ২৭ বছর পর কেন এটা ঘটতে দেয়া হচ্ছে? আমরা জানি, কেন ইসরাইল এটি করছে- আমরা অনাকাঙ্ক্ষিত শরণার্থী, যাদের উপস্থিতি ১৯৪৮ সালে যে পাপ করা হয়েছিল তার অবিরত ও নির্ভরযোগ্য স্মারক। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের জাতিগতভাবে নির্মূল করার জন্য পূর্বপরিকল্পিতভাবে অপরাধ করা হয়েছিল। দুঃখজনকভাবে উল্লেখ করতে হয়, গাজার দু’-তৃতীয়াংশ ফিলিস্তিনি এখন শরণার্থী। তবে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের ১৯৪ নম্বর প্রস্তাবে তাদেরকে তাদের ভূখণ্ডে ফিরে আসার অধিকার দেয়া হয়েছে।
ইসরাইল গাজায় বোমা বর্ষণ ও বর্বরতা অব্যাহত রেখেছে। কারণ তারা আগেও যে গণহত্যা চালিয়েছে- সে জন্য তাদেরকে কখনো জওয়াবদিহি করতে হয়নি। জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আরব লিগ এবং কথিত ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়’ ফিলিস্তিনিদেরকে ব্যর্থ করে দিয়েছে এবং সেটিই তারা অব্যাহত রাখবে।
শত শত ফিলিস্তিনি শিশুর লাশের পরও বিশ্ব আর কী দেখতে চায়? ফিলিস্তিনি শিশুরা আজ যা দেখছে, সে ধরনের মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক দৃশ্য ইহুদি, হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান বা অন্য কোনো ধর্মাবলম্বী শিশুর দেখা উচিত হবে না।
তথাকথিত ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের’ কোনো নির্দেশনা ফিলিস্তিনিরা আর মেনে নেবে না। কারণ তারা অব্যাহতভাবে ইসরাইলের পক্ষাবলম্বন করে যাচ্ছে এবং তাদের যুদ্ধাপরাধকে ঢেকে রেখেছে। নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের অবস্থার উন্নতির জন্য যেকোনো আলোচনা হবে ইসরাইলি গণহত্যায় জীবনদানকারীদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা।
আমরা অতিসামান্য কিছু চাই না। আমরা আমাদের ভূখণ্ডে ফিরে যেতে চাই এবং সেখানে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, আমাদের পরিপূর্ণ অধিকার নিয়ে তাদের সাথে বসবাস করতে চাই। যারা প্রত্যেক ব্যক্তির স্বাধীনতায় বিশ্বাসী- গণহত্যা ও বর্ণবাদী ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটার বিষয় নিশ্চিত করা তাদের নৈতিক দায়িত্ব।
তাই আমরা এখন বলছি ইসরাইলকে বয়কট, প্রত্যাখ্যান এবং তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা কেবল সিভিল সোসাইটিগুলোর নয়- প্রত্যেক ব্যক্তির দায়িত্ব। আমরা ইসরাইলি পণ্য এবং ইসরাইলি প্রতিষ্ঠান বর্জন করতে পারি। ইসরাইলিদের সাথে ব্যবসা প্রত্যাখ্যান এবং ইসরাইলি সরকারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি জানাতে পারি। আমরা একত্রে যদি এই কাজ করতে পারি এবং এর সাথে সংহতি প্রকাশ করতে পারি, তা হলেই ইসরাইল ফিলিস্তিনে কী করছে তার পুনর্বিবেচনা তারা শুরু করতে পারে।
২০০৯ সালে গাজায় সংঘটিত যুদ্ধ তথা ইসরাইলি বর্বরতাকে দক্ষিণ আফ্রিকার ১৯৬০ সালের শার্পেভিল গণহত্যার সাথে তুলনা করা যায়। ওই সময় শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী পুলিশ নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিবাদকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করা হলে যে আন্দোলন শুরু হয়- তাতে বর্ণবাদের পতন ঘটেছিল। গাজায় ২০২১ সালে যে গণহত্যা চালানো হচ্ছে- সেটি একটি নতুন, অধিকতর গণতান্ত্রিক মধ্যপ্রাচ্য এবং একটি সেকুলার গণতান্ত্রিক ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটানোর শুরু হতে পারে- যেখানে ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব নাগরিকই সমান অধিকার ভোগ করবে।
লেখক : গাজার আল-আকসা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক
আলজাজিরার সৌজন্যে
ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার