কেন ও কিভাবে হয়েছিল আব্রাহাম চুক্তি
কেন ও কিভাবে হয়েছিল আব্রাহাম চুক্তি - ছবি সংগৃহীত
সাম্প্রতিক সময়ে গাজা উপত্যকা ইসরাইলি হামলাকে কেন্দ্র করে। ঘটনাটির শেষের দিক থেকে যদি বলি, এটা এক গভীর গোপন পরিকল্পনা যা রচিত হয়েছিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হাতে আর তা প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সাথে বুদ্ধি করে। আসলে এটা পুরো বিষয়টিই নেতানিয়াহুর মাধ্যমে করা এক জায়নিস্ট পরিকল্পনা। আর তিনি এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ট্রাম্পকে রাজি করানোর কাজটা করেছিলেন ট্রাম্পের জামাই ক্রুজনারের মাধ্যমে ট্রাম্পকে কব্জা করে। এদিকে আরবদের দিক থেকে একাজে দুই প্রধান হলেন দুবাই ও সৌদির দুই প্রভাবশালী যুবরাজ। আনুষ্ঠানিকভাবে এই অসৎ পরিকল্পনাটার নাম হলো 'আব্রাহাম চুক্তি' (আব্রাহাম একর্ড)। এটি অবয়ব পায় হোয়াইট হাউজে বসে ট্রাম্প, নেতানিয়াহু আর সাথে দুবাইয়ের ও বাহারাইনের দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী- এই চারজনের এক চুক্তি স্বাক্ষরে। এটা ঘটেছিল ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর।
এর উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিনিদের কোন্ঠাসা ও উপেক্ষা করে জায়নিস্ট আর বাদশাদের একসাথে কাজ করা। এটিকেই তারা আব্রাহাম চুক্তি বলে চালাতে চেয়েছে।
২০২০ সালের ওই চুক্তি এখন ট্রাম্প পেরিয়ে বাইডেনের আমলে পৌঁছেছে। কিন্তু বাইডেন এত দিন এই চুক্তির প্রতি মনোযোগ না দিয়ে ফেলে রেখেছিলেন। কিন্তু বাইডেন ইতোমধ্যেই তার কাজের প্রায়োরিটি বদল নিয়েছেন। এখন তিনি ওই চুক্তির কারণে যেসব ক্ষতি হয়ে গেছে বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে ওইসবের ক্ষত সারাতে উঠে পড়ে লেগেছেন। এ কাজেরই এক প্রধান অংশ ছিল এবারের গাজায় ইসরাইলি হামলায় ইসরাইলকে যুদ্ধবিরতিতে যেতে বাধ্য করা। তাছাড়া আমেরিকার আগের প্রতিশ্রুত যেসব ত্রাণ ও পুনর্বাসনের তহবিল আমেরিকা গাজায় দিত, যার পুরোটাই ট্রাম্প বন্ধ করে দিয়েছিলেন, সেসব আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছেন বাইডেন। আর মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্কগুলো যা ট্রাম্পের কথিত আব্রাহাম চুক্তির কারণে এলোমেলো হয়ে গেছে- সেগুলোকে ফিরিয়ে আনার জন্য সেক্রেটারি অব স্টেটের এক লম্বা সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
আর বাইডেনের এই নতুন অবস্থানে আসা বা আমেরিকাকে হুঁশে ফিরিয়ে আনার কাজটি কারা করলেন? বলা হচ্ছে, এরা হলেন ডেমোক্র্যাট দলের মধ্যে নতুন যারা তুলনামূলক তাদের ভাষায় ‘প্রগ্রেসিভ’ (আমেরিকান অর্থে প্রগ্রেসিভ যারা রক্ষণশীলের উল্টা, আমাদের মতো দেশের অর্থে প্রগেসিভ মানে কমিউনিস্ট তারা নন), যারা বাকি ডেমোক্র্যাটদের চেয়ে তুলনায় ফিলিস্তিনিদের পক্ষে বেশি প্রো-একটিভ। আর এদের প্রতিনিধি বলতে তিন নারীর কথা বেশি সামনে এসেছে। এদের একজনের সাথে বাইডেন-কমলা বিমানে উঠার আগে টারম্যাকে আন্তরিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলাপ করছেন, এমন একটা ছবি অনেক জায়গায় ঘুরছে।
মূল কথাটা হলো, এনিয়ে রয়টার্সের একমাত্র এক এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট ছাপা হয়েছে গত ২১ মে। সেখানে বহু প্রসঙ্গে ডিটেইলড বর্ণনা আছে। যার শিরোনাম হলো, গাজা কনফ্লিক্ট ফোর্সেস রিঅর্ডারিং অব বাইডেন’স পলিসি প্রায়োরিটিস। এককথায় বললে, বাইডেন ট্রাম্প-নেতানিয়াহুর শয়তানি পরিকল্পনার ‘আব্রাহাম একর্ড’ ভেঙ্গে আমেরিকাকে বের করে আনতে সচেষ্ট হয়েছেন।
কিন্তু এর সাথে আমাদের পাসপোর্ট ইস্যুর কী সম্পর্ক?
হ্যাঁ, সেটাই সবচেয়ে মজার। আব্রাহাম একর্ড স্বাক্ষরের পরে ওই সময় এর বাস্তবায়নের দায় পড়ে মূলত দুই যুবরাজের (দুবাই, সৌদি) ওপর। এই চুক্তিতে দৃশ্যত সৌদি আরব নেই। কিন্তু পশ্চাদ-পটভূমিতে সর্বত্র আছে। এছাড়া আর পাইপলাইনে ছিল (আছে বলতে পারছি না) আরো দুই দেশ ওমান, সুদান ইত্যাদি।
কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। প্রশ্ন হলো, এই আব্রাহাম একর্ড কেন তারা করেছিলেন? কেন পক্ষগুলো এর দরকার অনুভব করেছিল? সেটাই মূল ঘটনার আরেক দিক। সে মূল ঘটনা হলো, ইরান। মানে চীন-ইরান ২৫ বছরের চুক্তি। ইরানের এই উত্থানে ইসরাইল ভীত। আবার জিসিসির বাদশাহ-দেশগুলো মধ্যে সম্ভবত কাতার ছাড়া সব বাদশাহ-রাষ্ট্র ও বিশেষ করে দুই যুবরাজের (দুবাই, সৌদি)- তারাও ভীত। এখানে ইসরাইলের ভয় যে এই (চীনের) ইরান এখন আরো বড় ক্ষমতা ও প্রভাব নিয়ে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে দাঁড়াবে। এছাড়া আমেরিকার সাথে পারমাণবিক ইস্যুতে আর ফিরে চুক্তিতে বাধা পড়তেও চাইবে না। এগুলোই ইসরাইলের মূল শঙ্কা। ওদিকে ইরানের প্রভাব বেড়ে গেছে আর তাতে সে মধ্যপ্রাচ্যে বাদশাগিরিই রাখবে না- এই অবস্থান নিতে পারে এই হলো তাদের মূল শঙ্কা। আর চীন গ্লোবাল নেতা হয়ে গেলে, তাতে আমেরিকান প্রভাবের পতনে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদিদের ভূমিকাটি নিয়ে বসবে ইরান। এই হলো তাদের শঙ্কা। একারণে, নেতানিয়াহু জামাই ক্রুজনারের মাধ্যমে শ্বশুর ট্রাম্প (ও তার দল রিপাবলিকানদের) কব্জা করে আমেরিকান মধ্যস্থতায় এই আব্রাহাম একর্ড করে নিয়েছিলেন। তা আসলে ইরান-চীনবিরোধী এবং ইরানি উত্থানে ভীত আরব বাদশাহ আর ইসরাইলিদের কমন এনিমি ইরানের বিরুদ্ধে তাদের জোট। এই যুবরাজদের ভরসা এখন ইসরাইল। তাদের মতে, ইসরাইলই তাদেরকে ইরানের হাত থেকে বাঁচাতে পারে।
একারণে আব্রাহাম একর্ডের বাস্তবায়ন মানে যুবরাজেরা ইসরাইলের জন্য মুসলমানপ্রধান রাষ্ট্রগুলো থেকে ইসরাইলকে স্বীকৃতি এনে দিক। আর ওই কাজে যুবরাজের অন্য অনেকের মতো পাকিস্তানের ওপরে চাপ সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু ইমরান যেকোনো মূল্যে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করলে দুবাই পাল্টা ব্যবস্থায় সমস্ত পাকিস্তানিকে দুবাই থেকে বের করে দেয় বা প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু করোনা আমল বলেও অনেকে ধরে নেয়, ধারণা করা হয় যে এটি ওই কারণে হচ্ছে বোধহয়।
এছাড়া আরো দিক আছে। ইতোমধ্যে দুবাইয়ের সাথে চীনের সম্পর্ক কিছু উন্নতি হয়েছে বলতে হবে। আর এর প্রকাশ হলো দুবাই করোনা টিকা ইস্যুতে পুরাপুরি চীনা টিকা-নির্ভর। সম্ভবত এটাতে তাদের কথা বলার পথ খুলেছে।
আবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইরানের পিছনে চীনের সমর্থন আছে বলে এই নতুন ইরান সে আর যাই করুক মধ্যপ্রাচ্যে বাদশাহদের রাষ্ট্র-এর ওপর হাত ঢুকাবে, সরকার বদলাবে কী রাষ্ট্রপদ্ধতি বদলে দিবে– এটা একেবারেই কাম্য নয়। এটা হতে পারে না। দুবাই বা সৌদি আরবে আভ্যন্তরীণভাবে কী হবে তা তার অভ্যন্তরীণ জনগণই নির্ধারণ করবে– এই নীতির বাইরে আমরা কেউ যেতে পারি না। আমরা জুনিয়র বুশ হয়ে যেতে পারি না।
কাজেই দুবাইয়ের সাথে চীনের কত দূর কী আলাপ হয়েছে আমরা জানি না। তবে দুবাই অন্তত এখন অনেক আশ্বস্ত তাই আমরা লক্ষ্য করছি। কারণ অন্তত আগের ইসরাইলকে ত্রাতা জ্ঞান করার দুবাই অনেকটাই এখন শীতল বলে মনে হয়।
তবে চীনকে অবশ্যই নীতিগত অবস্থানে শক্ত হতে হবে, আর চীন-ইরান চুক্তি হয়েছে বলে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন বিশৃঙ্খলা কাম্য নয়। তা চীনেরও পক্ষে যাবে না। একমাত্র নীতিগত অবস্থান ধরে দাঁড়ানোই চীন দায়িত্ববান গ্লোবাল নেতার ভূমিকা স্বাগত লাভ করতে পারে।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com