কোন পথে নতুন মধ্যপ্রাচ্য

মাসুম খলিলী | May 25, 2021 05:12 pm
কোন পথে নতুন মধ্যপ্রাচ্য

কোন পথে নতুন মধ্যপ্রাচ্য - ছবি সংগৃহীত

 

ইসরাইল-ফিলিস্তিন ১১ দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি কোন পথে, তা নিয়ে নতুন মূল্যায়ন শুরু হচ্ছে। বিগত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সময় ‘শতাব্দীর সেরা চুক্তি’ আরব-ইসরাইল সম্পর্কে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। এই পরিবর্তনের মূল কেন্দ্রবিন্দু ফিলিস্তিন। এর আগ পর্যন্ত আরব-ইসরাইল সম্পর্কের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু বা বিবেচ্য ছিল ফিলিস্তিন-ইসরাইল সম্পর্ক।

ট্রাম্পের ইসরাইলমুখী আগ্রাসী মধ্যপ্রাচ্য কূটনীতির ফলে ফিলিস্তিন ইস্যুটিকে এড়িয়ে গিয়ে আরব-ইসরাইল সম্পর্ক উন্নয়নের একটি প্রবণতা তৈরি হয়। আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান ও মরক্কো ইসরাইলের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। তদুপরি সৌদি আরব, ওমান, আলজেরিয়া ও মালিসহ আফ্রো-এশিয়ার আরো বেশ কিছু মুসলিম রাষ্ট্র ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে মর্মে জল্পনা ছড়িয়ে পড়ে।
মসজিদুল আকসায় এবার শবে কদরের দিনে নামাজিদের ওপর হামলা ও শেখ জাররাহ থেকে ফিলিস্তিনিদের বসতি উচ্ছেদের ফলে সৃষ্ট আরব-গাজা যুদ্ধ সে আবহকে একেবারেই পাল্টে দিয়েছে, যেটি যুক্তরাষ্ট্রে জো বাইডেন সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর কিছুটা থমকে দাঁড়িয়েছিল।

যুদ্ধবিরতি নিঃশর্ত নয়
এবারের ইসরাইল গাজা যুদ্ধবিরতি আসলে নিঃশর্ত নয়। হামাসের দুটি দাবি মেনে নিয়ে এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। এই দুটি দাবি ছিল শেখ জাররাহতে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ বন্ধ করা এবং আল-আকসাহ মসজিদে হামলা থেকে বিরত থাকা। মিসরের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতির এ শর্তে ইসরাইল ‘সম্মত হয়েছে’ বলে উল্লেখ করা হচ্ছে; যদিও যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার দিনই আল-আকসা মসজিদে ইসরাইলি পুলিশ টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করেছে।

ইসরাইলের সরকারি স্বীকৃতি অনুসারে, এবার হামলায় ১২ জন ইসরাইলি নিহত হয়েছে। কিন্তু হামাসের সূত্র অনুসারে, এর বাইরেও ৩২ জন ইসরাইলি সেনা নিহত হয়েছে যাদের মধ্যে, একজন পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। যে সামরিক যানের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তারা নিহত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হচ্ছে ইসরাইলিদের দাবি, সেই যানবাহনে সেনাসদস্য কেউ ছিল না।

প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) কমান্ডাররা হামাসের রকেট মজুত ও হামলার ব্যাপারে যে ধারণা করেছিলেন বাস্তবে তা ছিল এর চেয়ে অনেক বেশি। হামাস ৩০০ ডলার ব্যয়ে যে রকেট নিক্ষেপ করেছে সেটি ধ্বংস করতে ইসরাইলকে ব্যবহার করতে হয়েছে তিন লাখ ডলারের ‘আয়রন ডোম’। এ ছাড়া আয়রন ডোমের প্রতিরক্ষা দেয়াল ভেদ করে যেসব রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের রাজধানী তেলআবিব, অর্থনৈতিক স্থাপনা ও অন্যান্য স্থানে আঘাত করেছে, তাতে ইসরাইলের নাগরিকদের জন্য যে নিরাপত্তা তৈরির অহঙ্কার দেশটির নেতারা করে আসছিলেন তা ভেঙে গেছে। ইসরাইলের সর্বত্র নাগরিকদের মধ্যে সৃষ্ট আতঙ্কে অনেকেই নিরাপদ জীবনের সন্ধানে তাদের মূল দেশে ফিরে যেতে শুরু করেছে।

নেতানিয়াহু ও তার উপদেষ্টারা চেয়েছিলেন, আরো সপ্তাহ দুয়েক যুদ্ধ অব্যাহত রেখে বিমান হামলায় গাজার উল্লেøখযোগ্য সব অবকাঠামো ধ্বংস করে স্থল অভিযানে নামতে। কিন্তু আগের বারের স্থল অভিযানে তাদের সেনাবাহিনীর যে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ঘটে যায় তার পুনরাবৃত্তি তাদের ভীত করে তোলে। অন্য দিকে পেন্টাগনে তথ্য ছিল যে, যুদ্ধ চলতে থাকলে এর সাথে লেবাননের হিজবুল্লাহ ইরাকি শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠী এবং আনসারুল্লাহ তথা ইরানের সব প্রক্সিযোদ্ধা যুক্ত হয়ে পড়বে। একই সাথে আরব দেশগুলোও এর সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়ে গেলে এটি ভয়ানক আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপ নিতে পারত; যার সাথে চীন ও রাশিয়াও যুক্ত হয়ে যাবার লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল।

ফলে নেতানিয়াহু যুদ্ধ বিলম্বিত করতে চাওয়ার পরও পেন্টাগন থেকে ইসরাইলের সেনা কমান্ডার এবং কাতারের মাধ্যমে হামাসের কমান্ডারদের কাছে কড়া বার্তা পাঠানো হয়। শেষ পর্যন্ত দু’পক্ষ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রথম দিকে ইসরাইলকে একতরফা সমর্থন করার পর তার দল এবং দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তিনি চাপে পড়ে যান। এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে একদিকে নিজ দেশে ও দলে বাইডেন বৈরী জনমতের মুখে পড়েন, অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার কৌশলগত প্রতিপত্তি হুমকির মুখে পড়ে যায়।

জয় হয়েছে কার?
এবারের ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধে জয় আসলে কার হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরপরই গাজায় ফিলিস্তিনিদের জয়ের উৎসব শুরু হয়ে যায়। ইসরাইলের ধ্বংসলীলা এবং ২৪৩ জন ফিলিস্তিনির মৃত্যুর শোকের মধ্যে ফিলিস্তিনি তরুণ ও হামাস নেতাদের উল্লসিত আনন্দে যুদ্ধের মধ্যে হারানো এবারের ঈদ উৎসবের প্রকাশ লক্ষ করা গেছে।

অন্য দিকে ইসরাইলের সামরিক বাহিনী দাবি করছে, হামাস-ইসলামী জিহাদের ডজন খানেক কমান্ডারকে তারা হত্যা করতে পেরেছে। ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে গোপন সামরিক টানেল। এর পরও হামাসের প্রতিরোধ সক্ষমতা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে না। এখনো তাদের হাতে আট হাজার রকেটের মজুত রয়ে গেছে বলেও উল্লেখ করছে খোদ ইসরাইলি মিডিয়া।

ইসরাইলি পত্রিকাতেই বলা হচ্ছিল- শেখ জাররাহ এলাকায় ফিলিস্তিনি বাড়িঘর উচ্ছেদ এবং আল-আকসায় নামাজিদের ওপর হামলা থেকে ফিলিস্তিনিদের সাথে যুদ্ধ শুরু হবে সেটি জেনেই বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার ব্যক্তিগত অ্যাজেন্ডা থেকেই এই কাজ শুরু করেছেন। তিনি ভেবেছেন, এই যুদ্ধের মাধ্যমে যদি হামাসের প্রতিরোধ ক্ষমতা গুঁড়িয়ে দেয়া যায় তাহলে তিনি যে সরকার গঠনে ব্যর্থ হয়েছেন সেই সুযোগ আবার তার হাতে ফিরে আসবে এবং ডানপন্থী ইহুদি দলগুলো তাকে ইসরাইলের নিরাপত্তার স্বার্থে আবার সমর্থন দেবে।

এই লক্ষ্য অর্জন করতে তিনি প্রথমেই গাজার অবকাঠামো ও পরিষেবা ধ্বংস করে হামাসের মনোবল দুর্বল করা এবং এসব ফুটেজ টিভিতে দেখিয়ে ইসরাইলিদের সমর্থন পেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হামাস ও ইসলামী জিহাদের আনগাইডেড রকেটের পাশাপাশি গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত ইসরাইলের রাজধানী তেলআবিবসহ সর্বত্র আতঙ্ক তৈরি করেছে। ইসরাইলি পত্রিকা দাবি করেছে, নিক্ষিপ্ত রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্রের প্রায় ৯০ ভাগ তাদের আয়রন ডোম দিয়ে আকাশেই ধ্বংস করা হয়েছে। কিন্তু ফিলিস্তিনি সূত্রের তথ্য অনুসারে, ২৮ ভাগ রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে।

হামাসসহ ছোট বড় যে ১১টি প্রতিরোধ সংগঠন এবার ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তাদের প্রতি ফিলিস্তিনিদের সমর্থন ও আস্থা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রতিরোধ সংগ্রামের বিরোধিতাকারী আল আকসার ইমামকেও বিদায় নিতে হয়েছে। ইসরাইলের সাথে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক রেখে আলোচনার মাধ্যমে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত ব্যর্থতা এবং তাদের বাড়িঘর ও অতীব সংবেদনশীল আল আকসা মসজিদে হামলায় প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রতি ফিলিস্তিনিদের আস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে। হয়তো এ কারণেই ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের নির্বাচন ইসরাইলের পরামর্শে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এবার বাতিল করে দিয়েছেন।

অন্য দিকে, মুসলিম দেশের সরকারগুলোর মধ্যে এতদিন যারা একতরফাভাবে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করত এবং গাজার হামাস সরকারকে এড়িয়ে চলত, তাদের অনেকেই হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়ার সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছেন এবার। গাজার পুনর্গঠনে তারা সহায়তার হাত বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন। এভাবে হামাস ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে এবং মুসলিম দেশসমূহে বড় স্বীকৃতি লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। এটি ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ সংগ্রামের জন্য অনেক বড় বিজয়। এই বিজয়ের পথ ধরে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ক্রমেই উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে।

চীন-রাশিয়া ও নতুন মেরুকরণ
আরব ইসরাইল সঙ্ঘাতে এবার চীন ও রাশিয়ার ভূমিকা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে ছিল ব্যতিক্রম। নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়ার পরিবর্তে দুই দেশই ইসরাইলকে দায়ী করেছে এই সঙ্ঘাতের জন্য। চীনের গ্লোবাল টাইমসের মন্তব্যটি ছিল এরকম, ‘গাজা উপত্যকায় রক্তক্ষরণ হচ্ছে, জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ নীরব। এই জটিল সময়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সংস্থাটিকে পঙ্গু করার অধিকার নেই যার দায়িত্ব শান্তি বজায় রাখা এবং দুর্দশা দূর করা। বাইডেন প্রশাসন যখন মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার প্রতি তার বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করে, তখন আমরা কিছুই করতে পারি না। তবে জাতিসঙ্ঘকে ন্যায়বিচার বহাল রাখতে কেউ বাধা দিতে পারে না। একবিংশ শতাব্দীতে এমন একটি সময় আসা উচিত নয় যখন মানবতা প্রকাশ্যে এ ধরনের গণহত্যা সহ্য করে।’

চীনের এই সরকারি মুখপত্র আরো বলেছে, ‘ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব সমাধানের লক্ষ্যে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানকে সমর্থন করার জন্য কয়েক বছর ধরে জাতিসঙ্গের নিরাপত্তা পরিষদ একাধিকবার প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সমাধানটি বাস্তবায়নের জন্য বাস্তবে অগ্রসর হয়নি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপকে অস্বীকার করে ট্রাম্প প্রশাসন মার্কিন দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুসালেমে স্থানান্তরিত করেছে, যা দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের চেতনা থেকে আরো দূরে সরে যায়। পূর্ববর্তী প্রশাসন যা করেছিল তাতে সম্মতি জানায় বাইডেন প্রশাসন। আমেরিকা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মধ্য প্রাচ্যে শান্তির লক্ষ্যে কোনো ইতিবাচক কাজ করেনি। মার্কিন মনোযোগ পুরোপুরি বৃহৎ শক্তির প্রতিযোগিতায় স্থানান্তরিত হয়েছে। স্পষ্টতই, ওয়াশিংটন মুসলমানদের পছন্দ করে না। তা সত্ত্বেও, দেশটি চীনের জিনজিয়াং অঞ্চলে মুসলমানদের প্রতি বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছে। মার্কিন বিবেচনার মান বিকৃত হয়ে গেছে।’
রাশিয়ার অবস্থানও চীনের মতোই। যুদ্ধবিরতির আগে গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ অব্যাহত রাখার ব্যাপারে কড়া হুঁশিয়ারি ব্যক্ত করেছে ক্রেমলিন। ফিলিস্তিনের ‘দুই রাষ্ট্র’ সমাধান ও প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রতি রাশিয়া সমর্থন ব্যক্ত করে। এর পরই পেন্টাগনকে যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে কঠোর হতে দেখা যায়।

মানতে হবে ফিলিস্তিনকে
ইসরাইলকে নিজ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে ফিলিস্তিনকে মানতে হবে। চীন রাশিয়ার কঠোর অবস্থানে শেষ পর্যন্ত ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতের দ্বি-জাতি সমাধানের পক্ষেই মত দিয়েছেন বাইডেন। তিনি বলেছেন, ইসরাইল-ফিলিস্তিনের সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতির পর ‘এটাই একমাত্র সমাধান’। পাশাপাশি, বিধ্বস্ত গাজা পুনর্গঠনে বড় আকারের সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা উপত্যকায় শনিবার থেকে পৌঁছাতে শুরু করেছে সাহায্য। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সাহায্য পাঠানোর আশ্বাস দিয়েছেন। তবে এই সাহায্য গাজার নিয়ন্ত্রণে থাকা হামাসের কাছে নয়, পাঠানো হবে ইসরাইলের দখলকৃত পশ্চিম তীরস্থ কর্তৃপক্ষের কাছে।

বাইডেন অবশ্য বলেছেন, “ইসরায়েলের নিরাপত্তার প্রশ্নে দায়বদ্ধতার কোনো বদল হবে না।’ যতক্ষণ পর্যন্ত না ইসরাইলের অস্তিত্বকে ‘সর্বাত্মকভাবে’ এই অঞ্চলে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে না।” ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের দ্বিজাতিভিত্তিক সমাধান নিয়ে বহু বছর ধরেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনা চলছে। সর্বশেষ সঙ্ঘাতের পর এই সমাধানটি নিয়েই আবার নতুন করে কথা বলল যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ; ট্রাম্প-নেতানিয়াহু যেটিকে বিবেচনা থেকে একবারে বিদায় করতে চেয়েছিলেন। এবারের যুদ্ধে এর মধ্যে এই অঞ্চলের ভারসাম্য অনেকখানি পাল্টে গেছে।

মধ্যপ্রাচ্যের নতুন মেরুকরণে ইসরাইলপন্থীরা আঞ্চলিক অবয়ব দানের ক্ষেত্রে গুরুত্ব হারিয়েছে। হামাসের সাথেই যেখানে ইসরাইল জয়ী হতে পারেনি, সেখানে এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রক হওয়ার স্বপ্নও তেলআবিবের বাস্তবায়ন হবে না বলে বিশ্বাস জন্মেছে। ট্রাম্পের সাথে এক তরীতে চড়ে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ভারসাম্য নষ্ট করেছেন নেতানিয়াহু। তিনি ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ সংহতি যেমন নষ্ট করেছেন তেমনিভাবে পররাষ্ট্র্র কৌশলের ভারসাম্য ভেঙে ফেলেছেন। ফলে এবার গাজার ওপর হামলায় যুক্তরাষ্ট্র্র ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো বিশ্ব শক্তির সমর্থন পাননি নেতানিয়াহু।
চীন এবং রাশিয়া এবারের মতো ইসরাইলবিরোধী কঠোর সতর্কবাণী আগে কখনো উচ্চারণ করেনি। ইসরাইল গাজায় হামলা অব্যাহত রাখলে এই সঙ্ঘাতে দ্বিমুখী হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। লেবাননের হিজবুল্লাহ ফ্রন্ট দিয়ে ইরান এবং তার মিত্ররা আর জর্দান ফ্রন্ট দিয়ে তুরস্ক পাকিস্তান ও মিত্র বলয়ের হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। আর এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে যাচ্ছিল যেখানে নিষ্ক্রিয় ওআইসিও প্রথমবারের মতো সক্রিয় হওয়ার রেকর্ড সৃষ্টি হতে যাচ্ছিল।

এবারের যুদ্ধের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো ফিলিস্তিন অ্যাজেন্ডাকে বিসর্জন দেয়ার যে আয়োজন চলছিল, সেটি আরো জোরালোভাবে ফিরে এসেছে। সামনে দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানে সময়ক্ষেপণের অবকাশ ইসরাইলের জন্য কমে যাবে। আর ফিলিস্তিনে আপসকামীরা কোণঠাসা হবে, ফিলিস্তিন স্বার্থের প্রকৃত ধারকরা জাতির নেতৃত্বে চলে আসবে।

যুদ্ধের পর-
ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট এবারের যুদ্ধ নিয়ে নেতানিয়াহুর উদ্দেশ্য সম্পর্কে আগাগোড়াই সন্দেহ প্রকাশ করে আসছেন। ওলমার্টের মতে, এই লড়াইয়ে দু’জন বিজয়ী রয়েছেন : বহু ইসরাইলির মধ্যে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতার মাত্রা জাগিয়ে তুলতে পেরে হামাস জয়ী হয়েছে; আর বিবি নেতানিয়াহু, যিনি প্রথম মুহূর্ত থেকেই জানতেন যে হামাসের পতন ঘটবে না, তবে লড়াইয়ের মুখোমুখি হয়েছিলেন এই কারণে যে যুদ্ধটি তার নিজস্ব ব্যক্তিগত অ্যাজেন্ডা বদলে দেবে।

নেতানিয়াহুর ‘ব্যক্তিগত অ্যাজেন্ডা’ আসলেই বদলেছে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এই যুদ্ধ থেকে সরকার গঠনে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন লাভের যে প্রত্যাশা নেতানিয়াহু করেছিলেন, সেটি বাস্তবে পাবেন না। অধিকন্তু তিনি শেখ জাররাহসহ পূর্ব জেরুসালেম থেকে মুসলিম বসতি উচ্ছেদ করে ইহুদিদের পুনর্বাসনের যে পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন তাতে বাধার মধ্যে পড়বেন। এই প্রথমবারের মতো লড়াইয়ে সব সেক্টরেই নেতানিয়াহ বৈরিতার মুখে পড়েছেন। এর আগে ইসরাইলি আরবদের তাদের বসতি থেকে উচ্ছেদের ঘটনায় আরব নাগরিকদের মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ফলে তারা ইসরাইলের অভ্যন্তরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। এমনকি কোনো কোনো স্থানে আরব-ইহুদি দাঙ্গায় অগ্নিসংযোগ ভাঙচুর ও নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, যা ইসরাইলের অভ্যন্তরে অবিশ্বাস ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে। গাড়ি চালানো, ছোটখাটো ব্যবসা বাণিজ্য ও শারীরিক শ্রমের কাজ আরবরা করার কারণে অনেক স্থানে তাদের উপর নির্ভরতা তৈরি হয়েছে ইসরাইলি সমাজের। এবারের ঘটনায় তাদের মধ্যে ক্ষোভের প্রকাশ ঘটায় তার প্রভাব ইসরাইলি সমাজে পড়েছে।

জেরুসালেম ও পশ্চিম তীরের অধিকৃত অঞ্চলে ইসরাইলের প্রত্যক্ষ নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে। সেখানে ফিলিস্তিনি পুলিশ দিয়ে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর উচ্ছেদের প্রতিবাদকারীদের ধরে এনে ইসরাইলিরা নির্যাতন করে আসছিল। পশ্চিম তীরের ইহুদি বসতিগুলোতে ইসরাইলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এবং ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন ভঙ্গের ফলে ফাতাহ আন্দোলন ও ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের (পিএ) ওপর সাধারণ ফিলিস্তিনিরা আস্থা হারিয়ে ফেলেছে।
এর ফলে এবার আল আকসা ও শেখ জাররাহের ঘটনার পর পুরো পশ্চিম তীরজুড়ে গাজার প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রতি অভূতপূর্ব সমর্থন লক্ষ করা গেছে। যুদ্ধ চলাকালে ফিলিস্তিনিরা পুরো ফিলিস্তিন ভূখণ্ডজুড়ে ধর্মঘট পালন করেছে। বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদের পাশাপাশি ইসরাইলি সেনা ও পুলিশ কর্তৃক ধর্ষণের মতো কিছু জঘন্য ঘটনা ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

এবারের যুদ্ধে ইসরাইলের অনেক ক্ষতি সরাসরি সামনে চলে এসেছে। প্রথমত, ইসরাইলের শক্তিমত্তা ও নিরাপত্তা সক্ষমতার ব্যাপারে যে ধরনের অতিলৌকিক ধারণা তৈরি হয়েছিল তা ভেঙে গেছে। হামাসের মতো একটি অরাষ্ট্রিক শক্তির সামনে যেভাবে ইসরাইলি নিরাপত্তা ভেঙে পড়েছে তাতে অন্য আরব রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধানে তারা বড় কিছু করতে পারবে, এমন আশা এখন আরব রাষ্ট্রগুলো খুব বেশি করতে পারবে না।

দ্বিতীয়ত, ইসরাইলের নাগরিকদের প্রতি এতদিন রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধানের ব্যাপারে যে নিশ্চয়তা প্রদানের আশ্বাস দিয়ে আসা হয়েছিল, তার সাথে বাস্তবতার বড় ধরনের ব্যবধান তারা প্রত্যক্ষ করেছে। ফলে ইসরাইলি সমাজে এর মধ্যে ভাঙন দেখা গেছে যার কারণে দুই বছরে চারটি নির্বাচন করার পরও টেকসই সরকার গঠন সম্ভব হচ্ছে না। এই অবস্থার আরো অবনতি ঘটে ভেতর থেকে ইসরাইল রাষ্ট্র দুর্বল হতে থাকবে।

তৃতীয়ত, ইসরাইলের বিরুদ্ধে একটি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মেরুকরণ তৈরি হতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় মার্কিন নীতি উদ্যোগের সাথে একেবারেই একাত্ম হয়ে, চীন ও রাশিয়ার বেশ কিছু স্বার্থে ইসরাইল আঘাত করেছে। কাশ্মির ফ্রন্টে ইসরাইল সরাসরি চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে সহায়তা করেছে। দিল্লিকে যথেচ্ছ প্রতিরক্ষা সহায়তা দিয়েছে। সিরিয়ায় ক্রেমলিনের কথা না শুনে ইসরাইল আঘাত করেছে যা ইরানের সাথে মস্কোর সহযোগিতাকে ইসরাইলবিরোধী ক্ষেত্র পর্যন্ত বিস্তৃত করেছে। আমেরিকার গোয়েন্দা তথ্য অনুসারে যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে চীন ও রাশিয়া দুই বিশ্ব শক্তিই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এর সাথে যুক্ত হয়ে পড়তো। একই সাথে তুরস্কের নেতৃত্বাধীন মধ্যপন্থী মুসলিম দেশগুলোও ধীরে ধীরে ফিলিস্তিনি সঙ্ঘাতের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান কূটনৈতিকভাবে এই ইস্যুতে অনেক দূর এগিয়েও গিয়েছিলেন।

চতুর্থত, ইসরাইলের সাথে যে আরব দেশসমূহের সম্পর্ক স্বাভাবিক করা হয়েছে, সেসব দেশের জনমত, এবারের যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি আলজাজিরা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারের ফলে, তীব্রভাবে বৈরী হয়ে উঠেছে। ফলে এসব দেশ ইসরাইলের সাথে সহযোগিতাকে বিস্তৃত করতে নানা ধরনের শঙ্কার মধ্যে থাকবে। নতুন কোনো দেশ আর ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে বেশি আগ্রহ বোধ করবে না।

mrkmmb@gmail.com

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us