ফিলিস্তিনে চীন-রাশিয়ার লাভ

চীন-রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট - ছবি সংগৃহীত
এবারের ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধে জয় আসলে কার হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরপরই গাজায় ফিলিস্তিনিদের জয়ের উৎসব শুরু হয়ে যায়। ইসরাইলের ধ্বংসলীলা এবং ২৪৩ জন ফিলিস্তিনির মৃত্যুর শোকের মধ্যে ফিলিস্তিনি তরুণ ও হামাস নেতাদের উল্লসিত আনন্দে যুদ্ধের মধ্যে হারানো এবারের ঈদ উৎসবের প্রকাশ লক্ষ করা গেছে।
অন্য দিকে ইসরাইলের সামরিক বাহিনী দাবি করছে, হামাস-ইসলামী জিহাদের ডজন খানেক কমান্ডারকে তারা হত্যা করতে পেরেছে। ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে গোপন সামরিক টানেল। এর পরও হামাসের প্রতিরোধ সক্ষমতা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে না। এখনো তাদের হাতে আট হাজার রকেটের মজুত রয়ে গেছে বলেও উল্লেখ করছে খোদ ইসরাইলি মিডিয়া।
ইসরাইলি পত্রিকাতেই বলা হচ্ছিল- শেখ জাররাহ এলাকায় ফিলিস্তিনি বাড়িঘর উচ্ছেদ এবং আল-আকসায় নামাজিদের ওপর হামলা থেকে ফিলিস্তিনিদের সাথে যুদ্ধ শুরু হবে সেটি জেনেই বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার ব্যক্তিগত অ্যাজেন্ডা থেকেই এই কাজ শুরু করেছেন। তিনি ভেবেছেন, এই যুদ্ধের মাধ্যমে যদি হামাসের প্রতিরোধ ক্ষমতা গুঁড়িয়ে দেয়া যায় তাহলে তিনি যে সরকার গঠনে ব্যর্থ হয়েছেন সেই সুযোগ আবার তার হাতে ফিরে আসবে এবং ডানপন্থী ইহুদি দলগুলো তাকে ইসরাইলের নিরাপত্তার স্বার্থে আবার সমর্থন দেবে।
এই লক্ষ্য অর্জন করতে তিনি প্রথমেই গাজার অবকাঠামো ও পরিষেবা ধ্বংস করে হামাসের মনোবল দুর্বল করা এবং এসব ফুটেজ টিভিতে দেখিয়ে ইসরাইলিদের সমর্থন পেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হামাস ও ইসলামী জিহাদের আনগাইডেড রকেটের পাশাপাশি গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত ইসরাইলের রাজধানী তেলআবিবসহ সর্বত্র আতঙ্ক তৈরি করেছে। ইসরাইলি পত্রিকা দাবি করেছে, নিক্ষিপ্ত রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্রের প্রায় ৯০ ভাগ তাদের আয়রন ডোম দিয়ে আকাশেই ধ্বংস করা হয়েছে। কিন্তু ফিলিস্তিনি সূত্রের তথ্য অনুসারে, ২৮ ভাগ রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে।
হামাসসহ ছোট বড় যে ১১টি প্রতিরোধ সংগঠন এবার ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তাদের প্রতি ফিলিস্তিনিদের সমর্থন ও আস্থা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রতিরোধ সংগ্রামের বিরোধিতাকারী আল আকসার ইমামকেও বিদায় নিতে হয়েছে। ইসরাইলের সাথে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক রেখে আলোচনার মাধ্যমে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত ব্যর্থতা এবং তাদের বাড়িঘর ও অতীব সংবেদনশীল আল আকসা মসজিদে হামলায় প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রতি ফিলিস্তিনিদের আস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে। হয়তো এ কারণেই ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের নির্বাচন ইসরাইলের পরামর্শে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এবার বাতিল করে দিয়েছেন।
অন্য দিকে, মুসলিম দেশের সরকারগুলোর মধ্যে এতদিন যারা একতরফাভাবে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করত এবং গাজার হামাস সরকারকে এড়িয়ে চলত, তাদের অনেকেই হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়ার সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছেন এবার। গাজার পুনর্গঠনে তারা সহায়তার হাত বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন। এভাবে হামাস ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে এবং মুসলিম দেশসমূহে বড় স্বীকৃতি লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। এটি ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ সংগ্রামের জন্য অনেক বড় বিজয়। এই বিজয়ের পথ ধরে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ক্রমেই উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে।
চীন-রাশিয়া ও নতুন মেরুকরণ
আরব ইসরাইল সঙ্ঘাতে এবার চীন ও রাশিয়ার ভূমিকা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে ছিল ব্যতিক্রম। নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়ার পরিবর্তে দুই দেশই ইসরাইলকে দায়ী করেছে এই সঙ্ঘাতের জন্য। চীনের গ্লোবাল টাইমসের মন্তব্যটি ছিল এরকম, ‘গাজা উপত্যকায় রক্তক্ষরণ হচ্ছে, জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ নীরব। এই জটিল সময়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সংস্থাটিকে পঙ্গু করার অধিকার নেই যার দায়িত্ব শান্তি বজায় রাখা এবং দুর্দশা দূর করা। বাইডেন প্রশাসন যখন মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার প্রতি তার বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করে, তখন আমরা কিছুই করতে পারি না। তবে জাতিসঙ্ঘকে ন্যায়বিচার বহাল রাখতে কেউ বাধা দিতে পারে না। একবিংশ শতাব্দীতে এমন একটি সময় আসা উচিত নয় যখন মানবতা প্রকাশ্যে এ ধরনের গণহত্যা সহ্য করে।’
চীনের এই সরকারি মুখপত্র আরো বলেছে, ‘ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব সমাধানের লক্ষ্যে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানকে সমর্থন করার জন্য কয়েক বছর ধরে জাতিসঙ্গের নিরাপত্তা পরিষদ একাধিকবার প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সমাধানটি বাস্তবায়নের জন্য বাস্তবে অগ্রসর হয়নি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপকে অস্বীকার করে ট্রাম্প প্রশাসন মার্কিন দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুসালেমে স্থানান্তরিত করেছে, যা দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের চেতনা থেকে আরো দূরে সরে যায়। পূর্ববর্তী প্রশাসন যা করেছিল তাতে সম্মতি জানায় বাইডেন প্রশাসন। আমেরিকা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মধ্য প্রাচ্যে শান্তির লক্ষ্যে কোনো ইতিবাচক কাজ করেনি। মার্কিন মনোযোগ পুরোপুরি বৃহৎ শক্তির প্রতিযোগিতায় স্থানান্তরিত হয়েছে। স্পষ্টতই, ওয়াশিংটন মুসলমানদের পছন্দ করে না। তা সত্ত্বেও, দেশটি চীনের জিনজিয়াং অঞ্চলে মুসলমানদের প্রতি বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছে। মার্কিন বিবেচনার মান বিকৃত হয়ে গেছে।’
রাশিয়ার অবস্থানও চীনের মতোই। যুদ্ধবিরতির আগে গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ অব্যাহত রাখার ব্যাপারে কড়া হুঁশিয়ারি ব্যক্ত করেছে ক্রেমলিন। ফিলিস্তিনের ‘দুই রাষ্ট্র’ সমাধান ও প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রতি রাশিয়া সমর্থন ব্যক্ত করে। এর পরই পেন্টাগনকে যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে কঠোর হতে দেখা যায়।