‘হামাসের কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ’
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু - ছবি সংগৃহীত
রকেট হামলা চালিয়ে ইসরাইলের তেমন কোনো ক্ষতি করতে না পারলেও হামাস এই যুদ্ধে বিজয় দাবি করেছে। কিভাবে এটিকে ‘বিজয়’ হিসাবে দেখা যেতে পারে? আসুন, দেখে নিই, কেন তারা এটিকে ‘বিজয়’ বলছেন। ১১ দিনের হামলা শেষে নেতানিয়াহু বা ইসরাইলের মন্ত্রিসভা যখন যুদ্ধবিরতি মেনে নিলো তখন হাজার হাজার ফিলিস্তিনি সেই মধ্যরাতেই রাজপথে ছুটে আসে। তারা রাতভর উল্লাস করেছে। জঙ্গিবিমানের নির্বিচার হামলা, মৃত্যুর মুখোমুখি ১১টি নিদ্রাহীন রাতের পরও ২১ মে’র সেই রাতটিও নিদ্রাহীন কাটে তাদের। তবে এই নির্ঘুম রাতযাপন ছিল বাঁধভাঙা উল্লাসের, আনন্দের। কারণ সাধারণভাবে সব ফিলিস্তিনিই এটিকে তাদের বিজয় হিসাবেই দেখছিলেন এজন্য যে, ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু একেবারে নিঃশর্তভাবে যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন; যদিও তিনি দাবি করেছেন, তার বিমানবাহিনী হামাসকে ‘শিক্ষা’ দিয়েছে, তাদের সুড়ঙ্গপথের নেটওয়ার্ক ও রকেট কারখানা ধ্বংস করেছে এবং ২৫ জন সিনিয়র নেতাসহ ২০০ হামাস যোদ্ধাকে খতম করেছে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনি নেতারা বলছেন, তারা দুটি শর্ত মেনে নিতে ইসরাইলকে বাধ্য করেছেন। হামাস নেতা আবদেল লতিফ আল-কানো বলেছেন, দুটি শর্ত হলো, আল আকসায় পুলিশ মোতায়েন করা যাবে না এবং শেখ জাররাহ থেকে কোনো ফিলিস্তিনি পরিবারকে জোর করে উচ্ছেদ করা যাবে না। এই শর্তারোপ করতে পারাই তাদের বিজয় দাবির মূল কারণ নয়। যে কারণে তারা বিজয় দাবি করেছেন সেটি হলো, ফিলিস্তিনি জনগণের সুদৃঢ় ঐক্যের প্রতিফলন ঘটেছে এবারের প্রতিরোধে। আর গোটা বিশ্ব ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি হামলার বিষয়ে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি সোচ্চার হয়ে উঠেছে।
হামাসের বিজয় দাবির অনুকূলে এটাই সবচেয়ে বড় প্রমাণ যে, এই বিজয়ের ব্যাপারে ফিলিস্তিনিদের মনে কোনো সন্দেহ নেই। তারা ঈদুল ফিতরের এক সপ্তাহ পর গত শুক্রবার সকালে সমবেতভাবে ঈদুল ফিতরের দোয়া পাঠ করেছেন এবং খুৎবা দিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করেছেন। এরপর সবাই মিষ্টিমুখ করেছেন, মিষ্টি বিতরণ করেছেন। বিমান হামলার কারণে তারা এবার ঈদের জামাত পড়তে বা উৎসব পালন করতে পারেননি। অন্যদিকে নেতানিয়াহুর পরাজয় এখানেই যে, তার জনগণ এটিকে বিজয় মনে করছে না। বরং নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতি মেনে নেয়ার ঘটনাকে তারা পরাজয় হিসাবেই দেখছে। শুনুন ইহুদি জঙ্গিবাদীদের মন্তব্য। ইসরাইলের নিউ হোপ পার্টির নেতা গিডিওন সা’র বলেছেন, এই যুদ্ধবিরতি ‘বিব্রতকর’। বলেছেন, বিশ্বের সেরা গোয়েন্দা সংস্থা ও বিমানবাহিনী ব্যবহার করেও নেতানিয়াহু হামাসের কাছ থেকে কেবল একটি ‘শর্তহীন যুদ্ধবিরতি’ আদায় করতে পেরেছেন। ইসরাইলের সংসদ বা নেসেটের চরমপন্থী সদস্য ইতামার বেন গবির বলেন, এই বিব্রতকর যুদ্ধবিরতি হলো ‘হামাসের কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ’।
গাজায় পরাজয়ের কথা স্বীকার করে ইসরাইলের অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল আইজ্যাক ব্রিক একটি রেডিওকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, প্রমাণিত হয়েছে, তেলআবিব কয়েকটি ফ্রন্টে একসাথে যুদ্ধ করতে গেলে মহাবিপর্যয়ের মুখে পড়বে। তিনি বলেন, যখন হিজবুল্লাহও যুদ্ধে নামবে, তখন আমরা কীভাবে তা মোকাবেলা করব?
সুতরাং, হামাস যে বিজয় দাবি করেছে, সেটি নিঃসংশয়। গাজার ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক বিশ্লেষক আদনান আবু আমের বলেন, এবারের যুদ্ধে হামাস সামরিক ও রাজনৈতিক উভয় দিক দিয়েই বিজয়ী হয়েছে বলে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সাধারণভাবে ঐকমত্য দেখা গেছে। কারণ ইসরাইলের বস্তুগত ক্ষতি খুব একটা করতে না পারলেও গোটা বিশ্বের সামনে ইসরাইলের ভাবমূর্তিতে মারাত্মকভাবে আঘাত করতে পেরেছে। এবারই ইসলামী, আরব ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের বৃহত্তম অংশ ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং তার সরকার ইসরাইলের সমর্থনে আগের মতোই ন্যক্কারজনক ভূমিকা পালন করেছেন যা লজ্জাজনক। কিন্তু মার্কিন কংগ্রেসে এবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে ইসরাইলকে বাড়তি সামরিক সাহায্য দেয়ার একটি উদ্যোগ। দুজন সদস্য এই সহায়তা বন্ধ করার দাবিতে বেসরকারি বিল জমা দিয়েছেন। এতে সাহায্যদান বন্ধ হবে কিনা সেটি পরের কথা; কিন্তু এটি ইসরাইলের প্রতি মার্কিন জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে ভূমিকা রাখবে, সন্দেহ নেই।
যুদ্ধবিরতি পর একে স্বাগত জানিয়ে বিশ্বের বহু দেশ শান্তির লক্ষ্যে কাজ করার জন্য উভয় পক্ষের প্রতি আহবান জানিয়েছে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো শান্তিপ্রক্রিয়া আদৌ নেই। একমাত্র তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে ফিলিস্তিনিদের জীবন ও সম্পদের বিপুল ক্ষতি সাধনের জন্য ইসরাইলকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ও বিচার করতে হবে। আর ইরান গত চার দশক ধরেই ইসরাইলের বিরুদ্ধে সোচ্চার। আশা করা যায়, অন্যান্য মুসলিম দেশ ও আরব বিশ্ব এ বিষয়ে সোচ্চার হলে একদিন সেই সময়ও আসবে যখন ইসরাইলকে সন্ত্রাসী, যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার দুশমন হিসেবে হাতেনাতে পাকড়াও করা যাবে।
ই-মেল : mujta42@gmail.com