মসজিদুল আকসা কেন মুসলিমদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ
মসজিদুল আকসা - ছবি সংগৃহীত
মসজিদুল আকসা, যা বায়তুল মুকাদ্দাস নামেও পরিচিত। জেরুসালেমে অবস্থিত মুসলমানদের প্রথম কিবলা। একে ঘিরে মুসলমানদের অন্তরে রয়েছে অপ্রতুল ভালোবাসার অভূতপূর্ব নিদর্শন। মুসলমানমাত্রই মহান আল্লাহ তায়ালার পবিত্র এ ঘরটিকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে মনের গহিন থেকে। তাই তো যুগ যুগ ধরে এর উপর বয়ে যাওয়া সব প্রতিকূলতার সাথে সংগ্রাম করে শত্রুর হাত থেকে একে রক্ষা করতে সচেষ্ট ছিল মুসলিমরা। অনেক রক্ত ঝরেছে পবিত্র এ মসজিদটিকে কেন্দ্র করে।
মুসলমানদের কাছে আল-আকসা নামে পরিচিত এ মসজিদটি ইহুদিদের কাছে ‘টেম্পল মাউন্ট’ নামে পরিচিত। বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদ এবং তার আশেপাশের এলাকা বহু নবী-রাসূলের স্মৃতি বিজড়িত স্থান, এখানে রয়েছে অসংখ্য নবী-রাসূলের মাজার। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘আল কুদসের (জেরুসালেম) এমন কোনো জায়গা খালি নেই যেখানে একজন নবী সালাত আদায় করেননি বা কোনো ফেরেশতা দাঁড়াননি।’ (জামে তিরমিজি) মুসলমানদের কাছে জেরুসালেম শহরটি ‘আল কুদস’ নামেও পরিচিত।
মসজিদুল আকসার মোট সাতটি নাম রয়েছে। একটি হচ্ছে মসজিদুল আকসা। ‘আকসা’ শব্দের অর্থ দূরবর্তী। মসজিদুল আকসার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে- দূরবর্তী মসজিদ। মক্কার মসজিদুল হারাম থেকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর মিরাজের সূচনা হয়। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাজিলকৃত পবিত্র কুরআনের সূরা ইসরায় ‘মসজিদুল আকসা’ শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয়। সম্ভবত মক্কা থেকে এটি দূরে বলে আল্লাহ তায়ালা এ মসজিদকে ‘দূরবর্তী মসজিদ’ বা মসজিদুল আকসা বলে অভিহিত করেন। আগে এর নাম ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস বা বায়তুল মাকদিস। এর অন্য নামগুলো হচ্ছে- আল কুদস, মসজিদে ইলিয়া, সালাম, উরুশলেম ও ইয়াবুস।
মসজিদুল আকসা হচ্ছে ইসলামের প্রথম কিবলা। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: মদিনায় হিজরত করার পর প্রথম ১৬ মাস মসজিদুল আকসার দিকে মুখ করে সালাত আদায় করেন। পরবর্তীতে মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে মুসলমানদের কিবলা মক্কার দিকে পরিবর্তিত হয়। হিজরি দ্বিতীয় সনের শাবান মাসের মাঝামাঝি সময়ে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: কিছু সাহাবায়ে কিরামসহ মদিনার অদূরে মসজিদে বনু সালামায় জোহর মতান্তরে আসর নামাজ আদায় করেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাকাতের মাঝামাঝি সময়ে মহান আল্লাহর নির্দেশে মহানবী সা: ও সাহাবায়ে কিরাম চার রাকাতবিশিষ্ট নামাজের বাকি দুই রাকাত মক্কায় অবস্থিত পবিত্র কাবা শরিফের দিকে ফিরে আদায় করেছিলেন বলে ইসলামের ইতিহাসে মসজিদটি মসজিদে কিবলাতাইন বা দুই কিবলার মসজিদ হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত। বায়তুল মুকাদ্দাস হচ্ছে মক্কা ও মদিনার পর তৃতীয় পবিত্র স্থান। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: মক্কার মসজিদুল হারাম, মদিনার মসজিদে নববী ও বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদের উদ্দেশে সফরকে বিশেষভাবে সাওয়াবের কাজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যা অন্য কোনো মসজিদ সম্পর্কে করেননি। এ সম্পর্কে মহানবী সা: ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোনো মসজিদে বিশেষ সাওয়াবের উদ্দেশ্যে পরিভ্রমণ করো না। ওই তিনটি মসজিদ হলো- মসজিদুল হারাম, মসজিদে নববী এবং মসজিদুল আকসা।’ (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম) মহানবী সা: আরো ইরশাদ করেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি তার ঘরে এক রাকাত সালাত আদায় করলে এক রাকাত সালাতের সওয়াবই পাবে। আর মসজিদে আদায় করলে ২৫ রাকাতের সওয়াব পাবে এবং জুমার মসজিদে আদায় করলে ৫০০ রাকাতের সওয়াব পাবে। আর মসজিদে নববীতে ও মসজিদুল আকসায় আদায় করলে ৫০ হাজার রাকাতের সওয়াব পাবে এবং মসজিদুল হারামে আদায় করলে এক লাখ রাকাতের সওয়াব পাবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)
আল্লাহর রাসূল সা:-এর পবিত্র মিরাজ জান্নাতি বাহন বোরাকে চড়ে শুরু হয়েছিল এই বায়তুল মুকাদ্দাস থেকেই। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে- ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাতের বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত- যার চারিদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাঁকে আমার কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত-০১) এ আয়াতে কারিমায় মসজিদুল আকসার চারদিক বলতে জেরুসালেমকেই বোঝানো হয়েছে। জেরুসালেম শহরের নদী-নালা, মিষ্টি পানি ও ফল-ফলাদি হচ্ছে সেই জিনিস, যার দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তায়ালা এ শহরকে বরকতময় বলেছেন।
এ ছাড়াও যুগ যুগ ধরে ইতিহাসের সিঁড়ি বেয়ে যেখানে বহু নবী-রাসূল ও আউলিয়ায়ে কিরাম শায়িত আছেন, তাদের মত পুণ্যময় লোকদের জীবন-মৃত্যুর স্থান অবশ্যই বরকতময়।
মসজিদুল আকসার নির্মাণ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। একদল ইতিহাসবিদ মনে করেন, মসজিদুল আকসা মূলত হজরত আদম আ:-এর মাধ্যমেই তৈরি হয়। যা পরবর্তী নবীরা পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার করেন। আবার অনেকে মনে করেন, হজরত সুলায়মান আ: এ মসজিদ নির্মাণ করেন। তবে সঠিক বক্তব্য হচ্ছে, হজরত ইবরাহিম আ: কর্তৃক কাবাগৃহ নির্মাণের ৪০ বছর পর হজরত ইয়াকুব আ: আল-আকসা মসজিদ নির্মাণ করেন। একটি হাদিস থেকে জানা যায়, হজরত আবুজর গিফারি রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- আমি আল্লাহর রাসূল সা:কে জিজ্ঞাসা করি, হে আল্লাহর রাসূল! সর্বপ্রথম কোন মসজিদ নির্মিত হয়েছে? তিনি বলেন, ‘মসজিদুল হারাম। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, তারপর মসজিদুল আকসা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, উভয়ের মধ্যে ব্যবধান কত বছরের? তিনি বললেন, ৪০ বছরের ব্যবধান।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ) আরেক বর্ণনায় বলা হয়েছে, ‘পৃথিবীতে প্রথম মসজিদ হচ্ছে মসজিদুল হারাম, যা হজরত ইবরাহিম আ: নির্মাণ করেছেন। আর মসজিদুল আকসা হচ্ছে দ্বিতীয় মসজিদ, যা মসজিদুল হারাম নির্মাণের ৪০ বছর পর হজরত ইয়াকুব আ: নির্মাণ করেন।’
হজরত ইয়াকুব আ:-এর উপাধি ছিল ইসরাইল। তাঁর দিকে সম্বোধন করে তাঁর বংশধরকে বনি ইসরাইল বলা হয়। হজরত ইয়াকুব আ: তাঁর বংশ বনি ইসরাইলসহ জেরুসালেম বসবাস করতেন। কিন্তু তার শেষ বয়সে বনি ইসরাইল হজরত ইউসুফ আ:-এর আহবানে মিসর প্রবেশ করেন। হজরত ইউসুফ আ: হজরত ইয়াকুব আ:-এর সন্তান ও আল্লাহর নবী ছিলেন। পরবর্তীতে বনি ইসরাইল মিসরে ফিরাউনের দ্বারা নির্যাতিত হয়। হজরত মুসা আ:-এর যুগে তাঁর সাহায্যে বনি ইসরাইল মিসর ত্যাগ করে। ফলে পুনরায় তাদের জেরুসালেমের পবিত্র স্থানে ফিরে আসার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু জেরুসালেমের জালেম অধিবাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা তারা হারিয়ে ফেলে। তাদের ভীরুতা ও কাপুরুষতার জন্য আল্লাহ তয়ালা সিনাই মরু প্রান্তরের তিহ ময়দানে তাদেরকে ৪০ বছর মরু জিন্দেগি যাপনের শাস্তি দেন। বনি ইসরাইল সিনাই মরুভূমির কঠিন পানিশূন্য তিহ প্রান্তরে পানির পিপাসায় অস্থির হয়ে হজরত মুসা আ:-এর কাছে পানি প্রার্থনা করে।
হজরত মুসা আ: আল্লাহর কাছে পানির আবেদন করলেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে নিজ লাঠি দিয়ে একটি পাথরে আঘাত করার নির্দেশ দেন। ফলে ১২ গোত্রে বিভক্ত বনি ইসরাইলের জন্য ১২টি ঝর্ণাধারা ফুটে উঠে। সেই পানি থেকে তারা সবাই প্রয়োজন পূরণ করত।
এরপর তাদের খাদ্য সমস্যা দেখা দিলো। তারা হজরত মুসা আ:-এর কাছে খাবার চেয়ে বসল। হজরত মুসা আ: আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর দোয়া কবুল করলেন এবং বনি ইসরাইলের জন্য ‘মান্না ও সালওয়া’ নামক খাদ্য পাঠিয়ে দেন। কিছুদিন পর বনি ইসরাইল হজরত মুসা আ:-এর কাছে ফরিয়াদ করে- ‘হে মুসা আ:! আমরা একই প্রকার খাবারের উপর বিরক্ত হয়ে পড়েছি। তুমি তোমার রবের কাছে প্রার্থনা করো, যেন আমাদেরকে জমিনের উৎপাদিত সবজি-তরকারি, সিম, ডাল ও পেঁয়াজ দান করেন।’ এতে হজরত মুসা আ: রাগ করেন এবং প্রশ্ন করেন, ‘তোমরা কি নিকৃষ্ট জিনিসের জন্য উৎকৃষ্ট জিনিসের পরিবর্তন কামনা করো? যদি তাই চাও তাহলে তোমরা শহরে ছড়িয়ে পড়ো এবং সেখানে তোমরা যা চাইবে তাই পাবে।’ এদিকে হজরত মুসা আ: আল্লাহ তায়ালার সাথে নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী ৩০ দিনের জন্য তুর পাহাড়ে গমন করেন।