করোনায় ব্ল্যাক ফাংগাস কেন এত ভয়ঙ্কর

ডা: মো: ছায়েদুল হক | May 25, 2021 02:49 pm
করোনায় ব্ল্যাক ফাংগাস কেন এত ভয়ঙ্কর

করোনায় ব্ল্যাক ফাংগাস কেন এত ভয়ঙ্কর - ছবি সংগৃহীত

 

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে শুরু হওয়া করোনা মাঝখানে একটু স্তিমিত হয়ে এখন দ্বিতীয় ঢেউয়ের কবলে অনেক দেশ। প্রথম দিকে করোনার অনেক কিছুই অজানা ছিল। বিজ্ঞানীরা ধীরে ধীরে করোনা সংক্রমণের অনেক কিছুই উদঘাটন করতে সমর্থ হচ্ছেন। তার মধ্যে চিকিৎসায় অক্সিজেনের গুরুত্ব, রক্ত জমাট বাঁধার মতো করোনার জটিলতা, এন্টিভাইরাস জাতীয় ওষুধের তেমন একটা সফলতা না পাওয়ার বিষয় ইত্যাদি অনেক বিষয় আমরা জানতে পারছি। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি কোমর্বিডিটি থাকা বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর ঝুঁকি অধিকতর। করোনা সেরে গেলেও অনেকেই দীর্ঘমেয়াদি অনেক জটিলতায় ভুগতে দেখা যাচ্ছে। সর্বশেষ যে বিষয়টি খুব আলোচিত হচ্ছে সেটি হলো- ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা মিউকরমাইকোসিস। ভারতের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মাঝে বিভিন্ন প্রসঙ্গের সাথে নতুন যে বিষয়টি আলোচনায় এসেছে সেটি এই করোনা রোগীদের ক্ষেত্রে এক ধরনের ফাঙ্গাসের সংক্রমণ যেটি অন্ধত্ব ও মৃত্যুঝুঁকি হিসেবে দেখা দিয়েছে।

ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা মিউকর মাইকোসিস কি?

মিউকরমাইকোসিস হলো এক ধরনের ছত্রাক বা ফাঙ্গাস। অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ, আর্দ্রতাপ্রবণ ও নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া ছত্রাকের অনুকূল পরিবেশ। জৈব পদার্থ যেমন- খাবার ইত্যাদিতে এরা খুব সহজেই জন্মাতে পারে। ৩০-৫০ শতাংশ আর্দ্রতায় যেমন সহজেই জন্মায় তেমনি চার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে অর্থাৎ রিফ্রিজারেটরে এরা কমই জন্মাতে পারে। এটি দেখতে গাছের ডালপালার মতো বিন্যস্ত থাকে এবং এদের গায়ে এক ধরনের স্পোর বা গুঁটির মতো থাকে। যদিও এটি খালি চোখে দেখা যায় না, তবে এক জায়গায় বংশ বৃদ্ধি করে অনেক পরিমাণে বিস্তৃত হলে তখন খালি চোখে দেখা যায়। দেখতে কালো রঙের। স্পোর হলো এক ধরনের সুক্ষè গুটির মতো অংশ যেটি বংশ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। স্পোরগুলো আসলে ছত্রাকের প্রজনন অঙ্গ। এই স্পোরগুলো ফুলে রেণুর মতো বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারে। আলট্র্রাভায়োলেট বা অতিবেগুনি রশ্মিতে এগুলো নষ্ট হয় না।

সংক্রমণ প্রক্রিয়া : মিউকর মাইকোসিসের স্পোরগুলো যখন বাতাসে ভেসে বেড়ায় তখন নিঃশ্বাসের সাথে শ্বাসনালীতে প্রবেশ করে। প্রাথমিক অবস্থায় হয়তো হালকা একটু এলার্জি বা প্রদাহের সৃষ্টি করে। তবে দীর্ঘসময় এমনটি বিদ্যমান থাকলে এবং দেহের ইমিউনিটি কম থাকলে এটি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে থাকে। স্পোরগুলো শাখা-প্রশাখার মতো বিস্তার লাভ করে ক্রমান্বয়ে অগ্রসর হতে থাকে এবং একসময় নাকের সাইনাস, চোখ অথবা চক্ষুকোটরের গভীরে ছড়িয়ে পড়ে। ফাঙ্গাসটির ভয়াবহ দিক হলো- এটি রক্তনালীর গায়েও বিস্তার লাভ করতে পারে এবং এক পর্যায়ে রক্তনালীকে ব্লক বা বন্ধ করে দেয়। এতে রক্তসঞ্চালন বঞ্চিত কোষ বা টিস্যু ধ্বংস বা নেক্রোসিস হয়ে যায়। এই ধ্বংসযজ্ঞে মিউকর মাইকোসিস নিঃসৃত এক ধরনের টক্সিন বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। এই নেক্রোসিস বা ক্ষয় হওয়ার বিষয়টি এতটাই ভয়ঙ্কর যে তা চোখ, চোখের পাতার মতো নরম অংশ তো বটেই এমনকি চক্ষুকোটর, নাক ও চোয়ালের হাড়কেও ক্ষয় করে দিতে পারে। চক্ষুকোটর থেকে সরাসরি এটি মস্তিষ্ককে সংক্রমিত করতে পারে। সর্বশেষে মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটাতে দেখা যায়, যদিও চূড়ান্তভাবে মৃত্যুর কারণটি এখনো রহস্যাবৃত।

উপসর্গসমূহ :
ষ এলার্জির উপসর্গ- প্রাথমিক অবস্থায় সর্দি, হাঁচি কাশি, চুলকানি ইত্যাদি দেখা দেয়।
ষ প্রদাহজনিত উপসর্গ- সাইনোসাইটিসের লক্ষণ যেমন- মাথা ব্যথা, নাক বন্ধ বা নাক দিয়ে পানি ঝরা ইত্যাদি প্রকাশ পায়।

ষ টিস্যুতে ইনফেকশন- চোখ আক্রান্ত হলে চোখ ফোলে যাওয়া বা চোখ লাল, দৃষ্টি সমস্যা ইত্যাদির সাথে চোখের গভীরে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। ফুসফুস আক্রান্ত হলে শ্বাসকষ্ট, সাইনাসের জটিলতায় নাকে রক্ত ঝরার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। অনেক সময় চোখের পাতা বা নাকের উপরিভাগের ত্বকে কালো ক্ষত দেখা দেয়।
ষ নেক্রোসিস বা টিস্যু ক্ষয়- এর প্রভাবে অঙ্গহানির মতো বিভৎস অবস্থার সৃষ্টি হয়।

করোনায় মিউকর মাইকোসিসের ভয়াবহতা :
এই ছত্রাকটি স্বাভাবিক অবস্থায় খুব একিটা স্বাস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়। যাদের দেহে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি কম যেমন এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তি, ডায়াবেটিস আক্রান্ত, ক্যান্সার চিকিৎসাধীন, অর্গান ট্র্যান্সপ্লান্ট বিশেষ করে কিডনি ও লিভার ইত্যাদি সংযোজন করা ব্যক্তি, সর্বোপরি স্টেরয়েড ব্যবহারকারী ব্যক্তি হলো এই মিউকর মাইকোসিসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি কেউ করোনা আক্রান্ত হলে দেহে ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার আরো দুই ধাপ অবনমন ঘটে। প্রথমেই করোনাভাইরাস দেহের ইমিউনিটিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে। দ্বিতীয়ত করোনার চিকিৎসায় বিভিন্ন মাত্রায় এবং মেয়াদে স্টেরয়েড ব্যবহারের কারণে আরো একধাপ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটির অবনমন ঘটে। ফলে খুব সহজেই মিউকর মাইকোসিসের সংক্রমণটি ভয়াবহ রূপ নেয়ার সুযোগ পায়।

সতর্কতা :

ষ করোনা চিকিৎসায় স্টেরয়েড ব্যবহারে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
ষ করোনা রোগীর চোখের বা নাকের আশেপাশে কালো সংক্রমিত স্পট, নাকে রক্তক্ষরণ, চোখ বা নাকের আশেপাশের ত্বকে টিস্যু ক্ষয় দেখা দিলে বা হঠাৎ দৃষ্টিশক্তি কমে গেলে বা চোখে ফোলাভাব হলে মিউকর মাইকোসিসকে আমলে নিতে হবে। প্রয়োজনে একজন নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ ও একজন চক্ষুবিশেজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

ষ আক্রান্ত বা ক্ষতস্থান থেকে টিস্যু সেম্পল নিয়ে বায়োপসি করে মিউকর মাইকোসিস শনাক্তকরণের বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়।
ষ মিউকর মাইকোসিস শনাক্ত হলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে হবে। এর চিকিৎসা হলো- এমফেটারিসিন-বি যা শিরায় প্রয়োগ করতে হয়।
ষ করোনা চিকিৎসাধীন রোগীর বিছানাপত্র যথাসম্ভব পরিষ্কার রাখতে হবে এবং একই সময়ে পরিবেশের উপর নজর রাখতে হবে।

লেখক : এমবিবিএস, এফসিপিএস (চক্ষু), এমএস (চক্ষু)
চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও সার্জন

সাবেক সহযোগী অধ্যাপক- জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল এবং কনসালটেন্ট- আইডিয়াল আই কেয়ার সেন্টার, ৩৮/৩-৪ রিং রোড , আদাবর, ঢাকা


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us