করোনায় সাইটোকাইন ঝড়? ডেকে আনছে বিপদ
করোনায় সাইটোকাইন ঝড়? ডেকে আনছে বিপদ - ছবি : সংগৃহীত
আজকাল আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে সাথে পৃথিবী জুড়েই দেখা যাচ্ছে ঝড়ের ঘনঘটা। কখনো পুয়ের্তো রিকোতে হারিকেন মারিয়া, কখনো পশ্চিমবঙ্গে আমফান। এইরকম সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়া ঝড় শহর গ্রাম দুমড়ে মুচড়ে ফেলে রেখে যায় সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ। ঠিক সেইরকম, এই করোনাভাইরাসের আক্রমণে অনেক রোগীর শরীরের অভ্যন্তরেই সৃষ্টি হয় এক প্রলয়ঙ্কর ঝড়ের। এই ঝড়ে হাওয়া থাকে না, থাকে সাইটোকাইন (cytokine storm) নামের রাসায়নিক আর এই ঝড়ে গাছ উপড়ে যায় না, তছনছ হয় আমাদের দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। করোনাতে যতই তরুণ রোগীদের প্রাণহানির খবর বাড়ছে, ততই বিজ্ঞানীদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে এই সাইটোকাইন ঝড়।
সাইটোকাইন স্টর্ম নিয়ে আলোচনা করতে হলে মূল যে বিষয়টি বুঝতে হবে, সেটি হলো ইমিউনিটি। এর মানে হলো আমাদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা। প্রতিদিন কোটি কোটি জীবাণু আমাদের অজান্তেই আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে। কিন্তু এরা যে রোগ সৃষ্টি করতে পারছে না, তার কারণ এই ইমিউনিটি। প্রাচীন কালে দুর্গ রক্ষা করতে যেমন প্রথমে পরিখা কাটা হতো, তারমধ্যে থাকত কুমির, তার পরে থাকত উঁচু প্রাচীর আর সবশেষে থাকত সেনাবাহিনী, তেমন আমাদের শরীর রক্ষা করতে থাকে টি সেল, বি সেল নামের কোষ, অ্যান্টিবডি, সাইটোকাইন, অক্সিজেন ফ্রি র্যাডিক্যালস ইত্যাদি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম। এবার ভাবুন সেই দুর্গের পরিখার কুমির যদি পাড়ে উঠে দুর্গের অধিবাসীদেরই আক্রমণ করে, কেমন হবে?
করোনা ভাইরাস ইনফেকশনের পর স্বভাবতই আমাদের শরীরের এইসব ডিফেন্স সিস্টেম সক্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এই ভাইরাসের উপস্থিতিতে এইসব ম্যাক্রোফাজ, টি সেল ইত্যাদি কোষ অতিসক্রিয় হয়ে যায়। আবার ওই দুর্গের তুলনা টেনে বলি, মনে করুন শত্রুসেনার প্রবেশ আটকানোর জন্য দুর্গের বাইরে পরিখার পানির স্তর বাড়িয়ে দেয়া হলো। কিন্তু এমন বেশি বাড়ানো হলো যে ওই পানি দুর্গে ঢুকে বন্যা হয়ে গেল। ঠিক ওই রকম, করোনা মোকাবিলা করতে গিয়ে শরীর এত বেশি সাইটোকাইন তৈরি করে ভাসিয়ে দেয় যে ওই সব বিষাক্ত রাসায়নিক শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ক্ষয় করা শুরু করে। ফুসফুসে এইরকম হলে ফুসফুসের জালিকা ফুলে পচে যায় (lung fibrosis), তখন ফুসফুসে যে অসংখ্য হাওয়া ভর্তি পকেট থাকে, তার মধ্যে বাঁধভাঙ্গা বন্যার পানির মতো ঢুকে পড়ে তরল দ্রবণ। তাহলে আর অক্সিজেন বিনিময় হওয়ার স্থান থাকে কী? একেই বলে এ আর ডি এস। দু’দিন আগে সুস্থ তরুণ যে হঠাৎ করেই প্রবল শ্বাসকষ্ট নিয়ে চলে যায় আইসিইউতে, ওই ঘটনার রহস্য এটাই।
আমাদের দেশ রক্ষা করার জন্য যে সব বোমা, কামান, বন্দুক বা বারুদ মজুত করা থাকে, সেগুলো কিন্তু আদতে মারণাস্ত্র। যদি, মনে করুন, কামানের গুদামে আগুন লাগে, ওই বিস্ফোরণে কিন্তু নিজেদের সেনা ছাউনিই ভস্মীভূত হবে। সে রকম আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষার জন্য মজুত সাইটোকাইনের স্তূপে যদি হঠাৎ বিস্ফোরণ হয়, তাহলে কিন্তু তার চারপাশের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিধ্বস্ত হবে। এই সব সাইটোকাইন, যেমন আই এল ৬ বা আই এল ২ কিন্তু সবাই এক একটি আণবিক বোমা। এদের কাজ শত্রুপক্ষের ওপর ধ্বংসলীলা চালানো। কিন্তু ওই কাজের বদলে এরা যদি আমাদের শরীরের ভেতরেই বিস্ফোটিত হয়, তাহলে সমূহ বিপদ। আজকাল আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়ার প্রযুক্তি অনেক উন্নত। উমপুন যে আসছে, সে কথা আমরা আগে থেকেই জানতাম। কিন্তু তাও এক এক সময়ে টর্নেডো দেখা দেয়, যার কথা কেউ ভাবতেও পারেনি। সেরকমই, করোনার এত রোগীর মধ্যে কখন কার শরীরে যে সাইটোকাইন ঝড় আসবে, বলা খুব মুশকিল। কিন্তু একবার এলে বাঁধভাঙ্গা জলের মত সব ডুবিয়ে নিয়েই তাণ্ডবনৃত্য দেখাবে। তাই সবসময় করোনা রোগীকে নজরে রাখতে হয়। সামান্য সমস্যার বিষয় চোখ এড়ানোর জায়গা থাকে না। তাই বয়স যতই কম হোক না কেন, করোনা আক্রান্ত হলে হেলাফেলা করবেন না। চিকিৎসকের পরামর্শ কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে।
সূত্র : বর্তমান