এক দিনেই আল আকসা মসজিদ মুক্ত করা সম্ভব...
আল আকসা মসজিদ কমপ্লেক্স - ছবি সংগৃহীত
এখন পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রের দাবিতে ফিলিস্তিনিরা ঐক্যবদ্ধ। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ-পূর্ববর্তী সীমান্ত অনুযায়ী পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুসালেম ও গাজা নিয়ে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র চান ফিলিস্তিনিরা। ১৯৬৭ সালের ছয়দিনের যুদ্ধের পর থেকে গাজা অবরোধ করে রাখে ইসরাইল। ইহুদিরা এত বেপরোয়া যে, আন্তর্জাতিক কোনো আইন-কানুনকে তারা তোয়াক্কা করে না। আজ পর্যন্ত জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইসরাইল বরাবর ৮৯টি প্রস্তাব রেখেছে। কিন্তু এর কোনোটিই বাস্তবায়ন করেনি ওরা। সাধারণ পরিষদ ২০০টি প্রস্তাব দিয়েছে তাদের বরাবর। কিন্তু এর একটাও পালিত হয়নি। তাদের চক্রান্তের পেছনে আছে যুক্তরাষ্ট্রসহ সাম্রাজ্যবাদী মিত্রশক্তি।
নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের মধ্যে চীন ও রাশিয়া ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়েছে। অস্থায়ী সদস্য দেশের মধ্যে এ তালিকায় রয়েছে- বসনিয়া-হারজেগোভিনা, ব্রাজিল, গ্যাবন, ভারত, নাইজেরিয়া, লেবানন ও দক্ষিণ আফ্রিকা। সাধারণ পরিষদের ১৯৩ সদস্যের মধ্যে ১২৭টিই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। গুটি কয়েক বাদে বাকি ৬৬ রাষ্ট্রেরও সমর্থন পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। কারণ দেশে দেশে নেতৃত্বের পরিবর্তন হলে আন্তর্জাতিক পলিসিও বদলায়। যেসব দেশ এ পর্যন্ত ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তাদের মোট জনসংখ্যা বিশ্বের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ (৫.২ বিলিয়ন)। আরো দেখা যায়, পশ্চিম ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকা ছাড়া সবাই কার্যত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকার করে নিয়েছে।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ইতিহাসের বাস্তবতা। শক্তির জোরে ফিলিস্তিনিদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। ৪৫০ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র্রের অস্তিত্ব ছিল। এমনকি দেশটির ছিল গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধ অতীত। ১৯৪৮ সালে জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে ষড়যন্ত্রকারীরা দেশটির অস্তিত্ব বিপন্ন করেছে। অতঃপর ইসরাইলের অব্যাহত আগ্রাসনে ফিলিস্তিনিরা স্বদেশচ্যুত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের কিছু দেশের ইহুদিপ্রীতি সত্ত্বেও স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য ফিলিস্তিনি জনগণ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদান স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেলে ফিলিস্তিনের পেতে বাধা দেয়া হবে কেন? এটা নিঃসন্দেহে একচোখা আচরণ। ফিলিস্তিনিদের প্রতি বিশ্বের বেশির ভাগ রাষ্ট্র্রের সমর্থন থাকায় একদিন জেরুসালেমে স্বাধীনতার সূর্য উঠবে, এ বিশ্বাস তারা লালন করে চলেছেন। পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে। যত দিন যাচ্ছে, ফিলিস্তিনিরা শক্তিশালী হচ্ছেন। ইতিহাস প্রমাণ করে, কোনো জাতির আত্মত্যাগ বৃথা যায় না। ইসরাইলি তাণ্ডব যত বৃদ্ধি পাবে, নতুন করে সৃষ্টি হবে ‘ইন্তিফাদা’ বা গণঅভ্যুত্থান। স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা যে কল্পনামাত্র তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ঈমানি চেতনাকে শাণিত করা গেলে, মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হলে এবং মুসলিম দেশে বৈশ্বিক মানের উন্নততর অস্ত্রশস্ত্র তৈরির কারখানা স্থাপন করতে পারলে একদিনেই মসজিদে আল-আকসা উদ্ধার করা যাবে, অন্যথায় এটা স্বপ্ন থেকে যাবে। মুসলমানদের মাঝে বিভেদের কারণে আজ ইহুদিরা মুসলমানদের প্রাণের নগরী জেরুসালেম দখল করে নিয়েছে। ইসরাইলের রাজধানী বানিয়ে ফেলেছে জেরুসালেমকে। মুসলমানরা যদি ঐক্যবদ্ধ না হয়, সেদিন বেশি দূরে নয় যে, তারা মসজিদে আল-আকসা গুঁড়িয়ে দেবে এবং কাবাগৃহও দখলের চেষ্টা করবে। মুসলমানরা ইহুদি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিজেরা সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়ছে; একে অপরকে হত্যা করছে। সঙ্কীর্ণতা পরিহার করে দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করতে হবে। দৃষ্টি বড় না করলে নেতৃত্ব দেয়া যায় না।
দেড় হাজার বছর আগে মহানবী সা: ঘোষণা করে গেছেন- ‘আলা ইন্নাল কুওয়াতা আর রামইউ। মান আলিমার রামইয়া ছুম্মা নাছিয়া ফালাইছা মিন্না।’ ‘জেনে রেখো, দূর নিক্ষেপণ হচ্ছে শক্তি। দূর নিক্ষেপণ প্রযুক্তি যে শিখল, অতঃপর ভুলে গেলো, সে আমার উম্মত নয়।’ রাসূলুল্লাহ সা:-এর বাণী অত্যন্ত তাৎপর্যবহ। বর্তমান বিশ্বে আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র যেসব দেশের আছে, সেসব দেশ ‘সুপার পাওয়ার’। বিশ্বখ্যাত মুফাসসিরে কুরআন শায়খ ইবনে কাছিরের ভাষ্যমতে, রাসূল সা: দু’জন সাহাবি- গায়লান ইবনে আসলাম ও উরওয়াহ ইবনে মাসউদ রা:কে দামেস্কে পাঠিয়েছিলেন ট্যাংক (দাব্বাবা) কিভাবে বানায়, হাতে-কলমে তার প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য। দীর্ঘদিন প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় হুনাইনের যুদ্ধে তারা অংশ নিতে পারেননি। সুতরাং উন্নততর অস্ত্র নির্মাণের প্রশিক্ষণ নেয়া সুন্নাতে রাসূল সা:। এ জন্য মুসলিম দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের এগিয়ে আসতে হবে। মুসলমানরা আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র ও দূরপাল্লার রকেট উদ্ভাবন করতে পারলে বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি হতে সময় লাগবে না। মুসলমানরা আমেরিকা-ব্রিটেন-ফ্রান্স থেকে অস্ত্র কিনে জেরুসালেম জয় করতে পারবে না, নিজেদেরকেই অস্ত্র তৈরি করতে হবে। আগ্রাসন প্রতিরোধ, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব সুসংহতকরণ এবং নিরবচ্ছিন্ন শান্তির জন্য সামরিক শক্তি অর্জন অপরিহার্য। সামরিক শক্তির কারণে মাত্র এক কোটি ইহুদি ২০০ কোটি মুসলমানকে পাত্তা দিতে চাচ্ছে না।
আমাদের মানতে হবে যে, কেবল সামরিক শক্তি থাকলেই বিজয় নিশ্চিত হবে এ কথাও সত্য নয়। মুসলমানদেরকে ঈমান ও আমলকে সুদৃঢ় করতে হবে। এটা পূর্বশর্ত। তাই বলে সামরিক শক্তির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। রাসূলল্লাহ সা: এবং সাহাবিরা আল্লাওয়ালা হওয়া সত্ত্বেও প্রতিটি যুদ্ধাভিযানে অস্ত্র হাতে নিয়েছেন। যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে সিজদাবনত হয়ে আল্লাহ তায়ালার দরবারে প্রার্থনা করে ছিলেন। মিনজানিক নামক অস্ত্র আবিষ্কার করেন। সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালার রহমতের ওপর ভরসা করেছেন। আল্লøাহ তায়ালার দয়া এবং সামরিক শক্তির সমন্বয় ঘটাতে পারলে বিজয় সুনিশ্চিত।
মুসলমানদের হতাশ হলে চলবে না। তাদের হাতে আছে দক্ষ ও অদক্ষ বিপুল মানবসম্পদ; তেল, গ্যাস, স্বর্ণ, লোহা, কয়লা, তামাসহ অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ। সৌদি আরব প্রাকৃতিক সম্পদের মজুদের দিক দিয়ে গোটা বিশ্বে দ্বিতীয়। এর মূল্য এখন ৩৪.৪ ট্রিলিয়ন ডলার। তুরস্কের রয়েছে কৃষ্ণসাগরজুড়ে তেল ও গ্যাসের মজুদ। গোটা দুনিয়ায় মোট ৮০ শতাংশ তেল ও গ্যাস, ৬০ শতাংশ কয়লা, ৬৫ শতাংশ স্বর্ণ, ৭৫ শতাংশ রাবার ও পাট এবং শতভাগ খেজুরের মজুদ মুসলিম দেশগুলোর হাতে। কেবল সম্পদ থাকলে হয় না। সম্পদকে ইতিবাচক পন্থায় কাজে লাগাতে হয়। মুসলমানরা যদি আল্লাহ তায়ালাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে প্রযুক্তির সাহায্যে প্রাকৃতিক সম্পদকে নিজেদের স্বার্থে এবং মুসলিম বিশ্বের কল্যাণে কাজে লাগায় এবং সামরিক শক্তি অর্জনে পাশ্চাত্য নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে পারে, সফলতা আসতে দেরি হবে না।
মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা দুনিয়ায় যেসব মুক্তিসেনা তাজা রক্তের বিনিময়ে নবীন প্রভাতের সূচনা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তাদের এগিয়ে আসতে হবে আগ্রাসন প্রতিরোধে। ফিলিস্তিনের শাহাদতপ্রাপ্ত নারী-পুরুষের প্রতিটি ফোঁটা রক্ত বুলেট হয়ে ইহুদি ও তাদের দোসরদের আঘাত হানবে, এটা কেবল সময়ের ব্যাপার। হামাস ও ফাতাহর বিভাজন রেখা মুছে ফেলতে হবে। ফিলিস্তিনের প্রতিরোধযোদ্ধাদের সাহস জোগাতে হবে; তুলে দিতে হবে তাদের হাতে রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। আল্লাহ তায়ালার সাহায্য সন্নিকটে। মুজাহিদিনদের কোরবানির বদৌলতে বদরের মতো গাজায় পরিস্থিতি-পরিবেশ আবার তৈরি হোক, এটাই শান্তিকামী মানুষের কামনা ও মুনাজাত।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com