খালেদা জিয়ার অপেক্ষায়
খালেদা জিয়া - ছবি সংগৃহীত
ঘর থেকে বের হয়ে রাজপথে এসেছেন দেশনেত্রী আপসহীন নেত্রী বাংলাদেশের গণমানুষের নন্দিত নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। যেদিন প্রিয় এই নেত্রী স্বাধীন বাংলাদেশে রাজপথে আসেন সেদিন ছিল সর্বব্যাপী সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দুর্যোগ। স্বৈরশাসনের অন্ধকারে নিমজ্জিত স্বদেশে তিনি হয়ে ওঠেন আলোকবর্তিকা, অন্ধকারের অমানিশা দূর করে আলোর পথযাত্রী। দীর্ঘ ৯ বছর অত্যাচার অবিচার, জেল জুলুম সহ্য করে, নিষ্ঠা ও সততা ও দক্ষতার সাথে বিরাট দল বিএনপির নেতৃত্ব দিয়ে তিনবার গণরায়ে অভিষিক্ত হয়ে সরকার গঠন করে রাষ্ট্র পরিচালনা যোগ্যতায় স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। ১৯৮১ সালে ৩১ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর জাতি যখন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিল, সেই দুঃসময়ে তিনি দলের হাল ধরেন। পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সামরিক শাসনের দুঃশাসনে নিপতিত। স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাতে তিনি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশে আজ ভোটের অধিকার নেই, গণতন্ত্র নেই। কথিত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সরকার স্বৈরাচারী আচরণ করছে। দেশের এ সঙ্কটকালে দেশবাসী তাকিয়ে আছে বেগম জিয়ার সংগ্রামী নেতৃত্বের প্রতি।
৩১ মে ১৯৮১ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানে চট্টগ্রামে নিহত হন। তার কিছুদিন পর নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের হাত থেকে ক্ষমতা দখল করলেন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ।
আশির দশকের মাঝামাঝি দেশের ছাত্রসমাজ প্রথমে শুরু করল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। কিছুদিনের মধ্যে তাতে যোগ দিলো বিভিন্ন দল আর শ্রমিক সংগঠনগুলো। কিন্তু এরশাদের চাতুর্য আর রাষ্ট্রীয় পেশিশক্তির সাথে তারা ঠিক পেরে উঠছিলেন না। তখনো বিএনপি নিজ দল গোছাতে ব্যস্ত। দলের অনেকেই এরশাদের সাথে আগেই হাত মিলিয়েছেন। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের কারণে দল ও সে আন্দোলন এগিয়ে যায় এবং তিনি আন্দোলনের মধ্যদিয়ে আপসহীন নেতৃত্ব হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হন। পরিণামে ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতন ঘটে।
১৯৯০ সালে ডিসেম্বরে এরশাদ একটি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। এই সরকারের একমাত্র কাজ ছিল একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা আর নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।
১৯৯১ সালে সরকার গঠন করেন বিজয়ী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তার সরকারের উল্লেখযোগ্য অর্জন ছিল দেশের শাসন ব্যবস্থা রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি থেকে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে যেতে সংবিধান সংশোধন এবং কৃষকের ২৫ বিঘা পর্যন্ত খাজনা মওকুফ করা। বেগম জিয়া কৃষিঋণ পাঁচ হাজার টাকা সুদ-আসল পর্যন্ত মওকুফ এবং ১০ হাজার টাকা সুদ মওকুফ করে দেন। বেগম জিয়ার নেতৃত্ব তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকার বিল পাস হলো। নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। যে কারণে ‘আমার ভোট আমি দিতে পেরেছি’। র্যাব গঠন করে জঙ্গিবাদের উত্থান ঠেকিয়েছিলেন, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হয়েছিল তখন। আজ দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সরকার মিথ্যা মামলা দিয়েছে এবং দণ্ডও দিয়েছে। বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন তিনি। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে তাকে সরকার দিচ্ছে না। দেশের মানুষ চায় বেগম জিয়ার মামলা প্রত্যাহার, জনগণ চায় তার দণ্ড মওকুফ, দেশের মানুষ বেগম জিয়ার জন্য দোয়া করছে তিনি যেন সুস্থ হয়ে দেশে গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে শরিক হতে পারেন।
বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতিতে আসা মানেই নতুন স্বপ্ন দেখা- কী সেই স্বপ্ন? জীবনানন্দের ভাষায়- এই পথে আলো জ্বেলে এ-পথেই বাংলাদেশের ক্রমমুক্তি হবে/সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ এ বাতাস কি পরম সূর্যকরোজ্জ্বল/প্রায় তত দূর ভালো মানব সমাজ। মানবসমাজের জন্য সেই মনীষীর কাজটা কি আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘আমার পথ’ প্রবন্ধে লিখেছেন- “মাভৈঃ বাণীর ভরসা নিয়ে জয় প্রলয়কর বলে ধূমকেতুকে রথ করে আমার আজ নতুন পথে যাত্রা শুরু হলো। আমার কর্ণধার আমি। আমার পথ দেখাবে আমার সত্য। আমি প্রথমে আমার যাত্রা শুরুর আগে আমার সত্যকে সালাম জানাচ্ছি। যে পথ আমার সত্যর বিরোধী সে পথ ছাড়া আর কোনো পথ আমার বিপদ নয়; রাজভয়-লোকভয় কোনো ভয়ই আমায় বিপথে নিয়ে যাবে না। আমি যদি সত্যি করে আমার সত্যকে চিনে থাকি, যদি আমার অন্তরে মিথ্যার ভয় না থাকে তাহলে বাইরের কোনো ভয়ই আমার কিছু করতে পারবে না। যার ভেতরে ভয় সেই তার ভয় পায়। আমার বিশ্বাস, যে নিজেকে চেনে তার আর কাউকে চিনতে বাকি থাকে না। অতএব, যে মিথ্যাকে চেনে, সে মিছামিছি তাকে ভয়ও করে না। যার মনে মিথ্যা সেই মিথ্যাকে ভয় করে। নিজেকে চিনলে মানুষের মনে আপনাআপনি এত বড় একটা জোর আসে যে, আপন সত্য ছাড়া আর কাউকে কুর্ণিশ করে না, অর্থাৎ কেউ তাকে ভয় দেখিয়ে পদানত রাখতে পারে না।”
বেগম খালেদা জিয়ার নতুন পথে যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেদিন থেকে রাজভয়-লোকভয়, কোনো ভয়ই তাকে বিপথে নিয়ে যেতে পারেনি। সেদিন নিজেকে নতুন করে চিনেছিলেন তিনি। আর তাই কাউকে চিনতে বাকি ছিল না তার। সত্যি করে তার সত্যকে চিনছিলেন বলেই তার অন্তরে মিথ্যার ভয় ছিল না। ফলে বাইরের কোনো ভয়ই তার কোনো অনিষ্ট করতে পারেনি। জীবনানন্দ দাশের কবিতার পঙ্ক্তির মতো তিনি আমাদের মতো ক্লান্ত ও ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে তুলে দিয়েছেন এক অসাধারণ উজ্জ্বল বাংলাদেশ। সেই দিনে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আমি যুগে যুগে আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু।’ তৎকালীন শাসকদের জন্য কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় শনি মহাকাল ধূমকেতু হয়ে তার আগমন ঘটেছিল। মহাপ্রলয়ের পরে মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলে সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রায় অভিযানে সব বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাওয়ার পথে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কথাগুলো প্রমাণিত হয়েছিল সেদিন। বাংলাদেশের অপরাজিত মানুষ সেদিন নতুন করে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পেতে জয়যাত্রা অভিযানে সব বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হওয়ার শপথ নিয়েছিল। প্রবল প্রতাপশালীরা এবং ক্ষমতা মদমত্ততাও আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় সেই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নতুন করে। এই যে সব বাধা অতিক্রম করে জয়যাত্রা অভিযান সূচিত হয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় বেগম জিয়া নব্বইয়ের ঐতিহাসিক গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দিলেন। আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালে ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয় এবং ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠন করেছিল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তখন প্রথমবারের মতো শপথ নেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- নীহারিকার মহা ক্ষেত্রে যেখানে জ্যোতিষ্ক সৃষ্টি হচ্ছে সেখানে মাঝে মাঝে এক-একটি তারা দেখা যায়, তারা স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, সমস্ত নীহারিকার বিরাট অন্তরে সৃষ্টি হোমহুতাশনের উদ্দীপনা।’ বেগম খালেদা জিয়া নীহারিকার মহা ক্ষেত্রে সে জ্যোতিষ্ক যিনি দেশবাসীর অন্তরে উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পেরেছেন। তার প্রতিটি কাজে প্রতিটি পদক্ষেপে প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে বাংলাদেশ। তিনি থাকবেন বাংলাদেশের মধ্যে। বাংলাদেশ তাকে নিয়ে গর্ব করে। ভবিষ্যতেও করবে।
লেখক : নব্বইয়ের সাবেক ছাত্রনেতা; সভাপতি, সাংবিধানিক অধিকার ফোরাম