তথ্যযুদ্ধ যেভাবে ইসরাইল থেকে ফিলিস্তিনের দিকে গেল

তথ্যযুদ্ধ যেভাবে ইসরাইল থেকে ফিলিস্তিনের দিকে গেল - ছবি : সংগৃহীত
ইসরাইলি আইডিএফ বাহিনীর গাজায় বোমা বর্ষণ আর হামাসের পাল্টা রকেট নিক্ষেপ যেমন রণাঙ্গনকে গরম করে রেখেছিল গত ১২ দিন, তেমন এর পাশাপাশি মিডিয়া জগতেও চলেছে তথ্যযুদ্ধ। এখানে নিউ ইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, ওয়াশিংটন পোষ্ট, সিএনএন, নিউজউইকের সিজন্ড আর ট্র্যাডিশনাল ইসরাইলের প্রতি পক্ষপাতিত্বপূর্ণ লেখালেখির মোকাবেলা করেছে টুইটার, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রামের লোকাল আর আন্তর্জাতিক এক্টিভিস্টদের লেখালেখি।
আমি খুব খেয়াল করে দেখছিলাম, নিউজ মিডিয়ার সাথে সোশ্যাল মিডিয়ার এই লড়াই। এবং একপর্যায়ে খেয়াল করেছি, এই লড়াইয়ে মানুষ ধীরে ধীরে সোশ্যাল মিডিয়াকেই বেশি বিশ্বাস করা শুরু করেছে। যারা আগে নিউ ইয়র্ক টাইমসের মরো পক্ষপাতপূর্ণ সংবাদ মাধ্যমের খবরের ভিত্তিতে মনে করত যে ফিলিস্তিনিদের সাফারিংসের জন্য হামাস ও ফিলিস্তিনিরাই দায়ী তারা টুইটারে ফিলিস্তিনিদের প্রকৃত অবস্থার ভিডিও দেখে, খবর পড়ে এই বড় বড় নিউজ মিডিয়ার কারসাজি ধরে ফেলেছে। এসব নিউজ মিডিয়া এখন আর মানুষকে আগের মনো ইসরাইলি কিংবা আমেরিকান সরকারের প্রো-ইসরাইলি গার্বেজ তথ্য গেলাতে সক্ষম হচ্ছে না।
আমার গত ১০ দিনের পোস্টগুলো আর তার কমেন্টে খেয়াল করবেন, একপর্যায়ে আমি বলতে শুরু করেছিলাম 'টাইডস আর টার্নিং'। একজন আমেরিকান সোশ্যাল মিডিয়া এক্টিভিস্টকে আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, ফলো হিম। কিভাবে আমেরিকার সাধারণ মানুষ মজলুম ফিলিস্তিনিদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে তা দেখার জন্য। যে দেশের জনগণ ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচন করে সেখানে জনগণের মতবাদ অত্যন্ত জোরালো ভূমিকা পালন করে।
দেখেছি যখনি কোনো আমেরিকান সরকারি মুখপাত্র ইসরাইলি হামলাকে ডিফেন্ড করেছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষ তার উপর হামলে পড়েছে, ইসরাইলি হামলা থামাতে বলেছে, ইসরাইলে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করতে বলেছে। ফিলিস্তিনিদের অধিকার নিয়ে জাগ্রত হয়েছে। বাইডেন যতবার বলেছে 'ইসরাইল হ্যাজ দ্যা রাইট টু ডিফেন্ড ইটসেলফ', মানুষ বাইডেনের মুখের উপর প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে, 'ফিলিস্তিনিদের বাঁচার অধিকার কোথায়?' সংবাদ মিডিয়ার বায়াসড টুইটে পাল্টা টুইট করেছে।
'ইসরাইল হ্যাজ দ্যা রাইট টু ডিফেন্ড ইটসেলফের' ওপর ভিত্তি করেই আমেরিকা ইসরাইলকে এত বছর ব্লাইন্ডলি সাপোর্ট করে গেছে, জাতিসঙ্ঢ়ে সারা বিশ্ব এক দিকে গেলেও আমেরিকা আরেক দিকে অবস্থান নিয়েছে। আমেরিকান জনগণের আইওয়াশ করেছে। এই প্রথমবার দেখলাম, আমেরিকান জনগণ তাদের ওই পুরনো বায়াসড প্রো-ইসরাইলি অবস্থান থেকে সরে আসতে শুরু করেছে। আর এর জন্য টুইটারের মনো সোশ্যাল মিডিয়া বিশাল ভূমিকা পালন করেছে।
যেহেতু আমেরিকা ডেমোক্র্যাটিক দেশ, এখানে জনগণের রায় আর মনোভাবের প্রভাব পরবর্তী নির্বাচনের উপর গিয়ে পড়বে। তাই রাজনৈতিক নেতারা জনগণের রায় মাথা পেতে নেন। রিপাবলিক্যান জনগণ সবসময় খেয়ে না খেয়ে প্রো-ইসরাইলি ছিল আর থাকবে। কিন্তু ডেমোক্রেটদের কথা ভিন্ন। এখানে আছে প্রোগ্রেসিভ ডেমোক্রেট থেকে শুরু করে রাইট সেন্ট্রিক ডেমোক্রেট। ইসরাইল ইস্যুতে যাদের অবস্থান পরিবর্তিত হতে শুরু করেছে। যার প্রভাব ডেমোক্র্যাটিক দলের হাউজ অফ রিপ্রেসেন্টেটিভ আর সিনেটরদের উপর পড়তে শুরু করেছে।
এখানে আছেন বার্নি স্যান্ডার্স্, এলেকজান্ড্রিয়া ওকাসিও-কর্টেজ, ইলহান ওমর, রাশিদা তাইয়েব প্রমুখ। রাশিদা ফিলিস্তিনি বংশদ্ভুত, ফিলিস্তিনিদের অধিকারে সোচ্চার। এরা প্রত্যেকেই গত দুই বছর ধরে প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইলের অবিচারের প্রকাশ্যে বিরোধিতা করছে। যাদের সাথে যোগ দিয়েছেন আরো একদল ডেমোক্র্যাটিক কংগ্রেসম্যেন-সিনেটর, আইনজীবী প্রমুখ। মেইন স্ট্রিম মিডিয়া এমএসএনবিসিতে আছে আল জাজিরার ভ্যাটার্ন সাংবাদিজ মেহেদি হাসান, যিনি গত ১২ দিন ফিলিস্তিনিদের প্রকৃত অবস্থান সমানে আমেরিকান জনগণের সামনে তুলে ধরেছেন, টুইট করেছেন। আর তা ফিলিস্তিনিদের জন্য কাজ হচ্ছে।
গাজা হামলার ২-১ দিনের মাথায় প্রোগ্রেসিভ ডেমোক্রেট থেকে শুরু করে সেন্টার রাইট ডেমোক্রেটিক সিনেটর আর কংগ্রেসম্যানেরা প্রকাশ্যে বাইডেনকে চাপ দিতে শুরু করেন যেন বাইডেন ইসরাইলকে হামলা থামাতে চাপ দেন। এই ব্যাপারে তারা হাউজ রেজ্যুল্যুশান পাস করে, ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের উপর যেসব আমেরিকান অস্ত্র ব্যবহার করে তার বিক্রিতে বাধা প্রধান করার জন্য বিল উত্থাপন করে।
এর উপর আছে জাতিসঙ্ঘর সিকিউরিটি কাউন্সিল আর জেনারেল এসেমব্লির সদস্য রাষ্ট্রগুলোর চাপ। বাইডেন ক্ষমতায় বসেন বিশ্বে মানবিকতা ফের ফিরিয়ে আনবেন এই অঙ্গিকারে, যাতে সিরিয়াসভাবে টান পরে ইসরাইলের প্রতি বাইডেনের অন্ধ সাপোর্টে। যে বাইডেন ১১ দিনে পরপর তিনবার ইসরাইলের হামলা থামাতে জাতিসঙ্ঘের সিকিউরিটি কাউন্সিলে বাধা দিয়েছে, ওই বাইডেন নিজ পার্টির নেতাদের আর সোশ্যাল মিডিয়ায় জনগণের প্রচণ্ড চাপে পড়ে অবশেষে ইসরাইলকে গাজা হামলা থামাতে বলতে বাধ্য হয়েছেন। ধোপে টিকেনি বাইডেনের 'ইসরাইল হ্যাজ এ রাইট টু ডিফেন্ড ইটসেলফ' ফিলোসফি। ইসরাইলের চারদিকে এখন সৌদি আরব, আরব আমিরাত, মিসর, বাহরাইনের মনো বন্ধু রাষ্ট্র।
সোশ্যাল মিডিয়া খুব ভালোভাবেই পশ্চিমা বিশ্বের বায়াসড নিউজ মিডিয়াকে টক্কর দিচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে মানুষ যেমন ফেইক নিউজ বিশ্বাস করে, তেমন সত্য খবরও মানুষের কাছে খুব দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে। আগে মানুষ তাদের খবর সংগ্রহ করত টেলিভিশন, রেডিও, সংবাদপত্র থেকে। এখন সংবাদ প্রদানে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখছে টুইটার। যে কারণে ট্র্যাডিশনাল সংবাদ মিডিয়াগুলোরও সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্ট আছে।
সোশ্যাল মিডিয়ার এই সময়ে মানুষকে আর বাতাবি লেবুর বাম্পার ফলনের সংবাদ দিয়ে বায়াসড রাখা যাবে না।