চীন যেভাবে বদলে দিতে পারে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সমীকরণ
চীন যেভাবে বদলে দিতে পারে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সমীকরণ - ছবি সংগৃহীত
কারো দিন একই রকম যায় না। দিন বদলায়। তবু দেখা যায়, ন্যায়-অন্যায় ইনসাফবোধ ভুলে গিয়ে কেউ কেউ সাময়িক সুখে বুঁদ হয়ে থাকতে চায়। আবার, জুলুম করার সুযোগ পেলে সেটাকেও চিরদিনের মনে করে বসে। যে কারণেই সম্ভবত ওই প্রবাদ যে, ‘মানুষ সুখ পেয়ে আল্লাহ’ ভুলে যায়। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল তার জন্ম থেকে নিয়মিত ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা, হত্যা আর নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে যাচ্ছে। আর প্রত্যেকবার নতুন হামলার পেছনে অন্যান্য ঘটনা বা ইস্যুর সাথে নতুন করে কোথাও না কোথাও ভূমি দখলের উপাদানও সংশ্লিষ্ট থাকেই। যেমন অন্য কিছুর সাথে এবার সংশ্লিষ্ট ছিল ‘শেখ জাররাহ’ এলাকার ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করে নতুন করে তাদের ভূমি জবরদখল।
এবারের সঙ্ঘাতের মাঝামাঝি লিখেছিলাম, ‘ফিলিস্তিনিদেরও দিন বদলাবেই।’ জুলুম চিরস্থায়ী হতে পারে না। কথাটা বলেছিলাম অবশ্য ‘স্পিরিচুয়াল’ অর্থে। কারণ মনে হয়েছিল, সময়ে স্পিরিচুয়ালিটিই মানুষকে যৌথভাবে দ্রুত ন্যায়ের পথে শক্তি ও সাহস নিয়ে উঠে দাঁড়াতে উপযুক্ত উপায় হয়ে দাঁড়ায়। অতএব আমারও তাই করা উচিত। সে কারণে, স্পিরিচুয়াল অর্থে এমন কয়েকটা বাক্যের একটা প্যারাগ্রাফ কখনো আগে লিখিনি, এমন হলেও তা করেছি। তবুও ওখানে পরে ‘বস্তুগত’ অর্থে মানে, ‘আধুনিক’ অর্থে রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করেও দেখিয়েছিলাম, কেন ইসরাইল হেরে যাবেই।
কেন ইসরাইল হারবে আর দিন বদলে যাবেই? কারণ আমেরিকা গ্লোবাল নেতৃত্ব হারাতে যাচ্ছে ক্রমশ চীনের কাছে। আমেরিকান স্টাডি-গবেষণা রিপোর্টও বলছে যে এটা আসন্ন। এ সংক্রান্ত প্রথম রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৮ সালে। তাদের ভাষায় ‘গ্লোবাল নেতৃত্ব পশ্চিম থেকে পুবে এশিয়ায় চলে যাচ্ছে এবং তা স্থায়ীভাবেই। আমেরিকার গ্লোবাল নেতৃত্বের পতনের পূর্বাভাস দেয়া শুরু তখন থেকে। এ বছরও একই মূল পূর্বাভাস দিয়েছে। কিন্তু মজার কথা, পরে ২০১১ সালেও, ওবামা আয়ারল্যান্ড সফরে পূর্বপুরুষের ঘরবাড়ি দেখতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে, বক্তৃতায় বলেছিলেন, আমরাই (পশ্চিমারা) দুনিয়াকে শাসন করে যাবো- মিথ্যা হলেও এমন আশ্বাস দিয়ে তিনি বক্তৃতা করেছিলেন।
প্রাসঙ্গিক কথাটা হলো, নিয়মিত অত্যাচারী আর ভূমি দখলকারী ইসরাইলকেই এই আমেরিকা সমর্থন দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে; তাতে ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান যে দলের প্রেসিডেন্টই ক্ষমতায় থাকুন। গত ১৯৪৮ সালে ইসরাইলের জন্ম ও জাতিসঙ্ঘের সদস্যপদ প্রাপ্তিসহ সবকিছুতে স্বীকৃতি আদায় করে নেয়া ঘটেছিল প্রধানত আমেরিকার কারণে, যখন সে গ্লোবাল নেতা। সেই থেকে যে অন্যের ঘরবাড়ি লুট ও হত্যাকারী, তারই আবার ‘আত্মরক্ষার অধিকার’- এই নির্লজ্জ কথার উপর দাঁড়িয়ে আমেরিকা ইসরাইলের পক্ষে সাফাই জোগাড় করে গেছে ও যাচ্ছে।
অতএব গ্লোবাল নেতৃত্ব অবস্থান থেকে আমেরিকার পতন মানেই ইসরাইলের পতন। মানে, জায়নবাদী ইসরাইল রাষ্ট্রের পতন বা ভেঙে পড়া। বলাই বাহুল্য, এতেই ফিলিস্তিনিদের জীবনের উপর জুলুম ঘটবে। প্রায় নিয়মিত নির্যাতন অত্যাচার আর ভূমি দখল হয়ে যাওয়ার অবসানের দিন ফিরে পেতে পারে ফিলিস্তিনিরা।
এদিকে, এবারের সঙ্ঘাতের পর আপাতত এক যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। কিন্তু এর চেয়েও বড় কথা, এরপর থেকেই আরেক তথ্য বিশ্লেষণে গ্লোবাল মিডিয়া উপচে উঠেছে। আর তাতে এর চেয়েও বেশি খুশির খবর হলো, এবারের সঙ্ঘাত ও আত্মত্যাগ থেকে বিনিময়ে বেশ কিছু ইতিবাচক উন্নতির কথা শোনা যাচ্ছে। বিশেষ করে যেটা বলেছিলাম, চীনের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে খুব নির্ধারক হবে।
জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে জাতিসঙ্ঘের সর্বোচ্চ ফোরাম। এর মোট ১৫ সদস্যের মধ্যে পাঁচ স্থায়ী ও ১০ অস্থায়ী। মানে, অস্থায়ীরা দুবছরের রোটেশনাল যা পাঁচ মহাদেশ থেকে ঘুরে ঘুরে বাকি জাতিসঙ্ঘ সদস্যদের মধ্য থেকে নির্বাচিতদের নেয়া হয়। কিন্তু এদের ১৫ সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা সবাই এক মাস করে ঘুরে ঘুরে এ পরিষদের সভাপতিত্ব করেন। সেই বিচারে, চীন এবারের মে মাসের সভাপতি। না, সভাপতি হয়েছে বলে তাতে বিশেষ উত্তেজনা অনুভব করার কিছু নেই। কারণ সভাপতি হিসেবে (চীনা স্থায়ী প্রতিনিধি অথবা বিশেষ পরিস্থিতিতে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উপস্থিত থাকলে) তিনি কী বলবেন, তা আগেই স্ক্রিপ্ট করে এবং প্রয়োজনীয় সময় বরাদ্দসহ সবকিছুই সব সদস্য মিলে আগাম নির্ধারিত করে থাকেন। তবে কেবল নিজ দেশের অবস্থান তুলে ধরার জন্য আলাদা যে, সবার সমান বরাদ্দ সময় তখন প্রত্যেকে নিজের কথা বলতে পারেন; যা কারিশমা তা তখনই।
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবার উপস্থিত ছিলেন। তিনি উপস্থিত থেকে এবার দুটি প্রসঙ্গে আমেরিকানদের খুবই দুরবস্থায় ফেলেছিলেন। প্রথমত, পরিষদের সদস্যদের যৌথবিবৃতি পাস করাতে চেয়েছিল চীন যেটা হলে, ইসরাইলের নিন্দা থাকত তাই আমেরিকা এতে ভেটো দেয়। কারণ গ্লোবাল পাবলিক সেন্টিমেন্ট এখন প্রধানত আমেরিকার বিপক্ষে। তার উপর আবার এমন সময়ই ইসরাইলকে অস্ত্র বিক্রির পক্ষে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।
দ্বিতীয়ত, নিজের প্রস্তাব ও অবস্থান তুলে ধরতে গিয়ে তার দুটি বাক্য আমেরিকা তো বটেই, ইসরাইলকেই খুবই বেকায়দায় ফেলেছিল। সেটাতে চীনা ভাষ্য ছিল, ‘টু-স্টেট সলিউশনের’ মাধ্যমে এক শান্তিপূর্ণ সমাধানে যেতে হবে যার সোজা ব্যবহারিক মানে হলো- বর্তমান ইসরাইল স্টেট, এটা তো প্রায় ঘোষিত এক জায়নিস্ট (ইহুদিবাদী) স্টেট; এই জায়নিস্ট রাষ্ট্র ভেঙে দিয়ে দুটি সম-অধিকারভিত্তিক আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম দিতে হবে। মানে কেবল ইহুদিদের জন্য একটা রাষ্ট্র (তাতে অন্যদের দুর্দশার শেষ নেই) রয়েছে যা চরম বৈষম্যমূলকভাবে তৈরি হয়েছে। কারণ অন্য কোনো ধর্মের লোকের উপরে ইহুদি নাগরিকের বিশেষ সুবিধা বা কথিত ‘অধিকার’ দিয়ে তৈরি করা এটা। এ ছাড়া অনবরত এটা ফিলিস্তিনিদের জায়গাজমি দখল করে তাতে সরকারি অনুদানে আবাসিক এলাকা বানিয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে বা অভ্যন্তর থেকেই ইহুদি হলেই তাকে ওই বাড়ি বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। অথচ ইসরাইল রাষ্ট্র এভাবে ভূমি দখলের অথবা, রাষ্ট্রের আয়তন বৃদ্ধির বিরুদ্ধে তো নয়ই বরং পক্ষে ও সহায়ক। তাদের এ কাজের পক্ষে সাফাই হলো, বিভিন্ন ধর্মীয় স্ক্রিপ্ট ও সেটা নিয়ে ‘রাব্বি’দের ইচ্ছামতো ব্যাখ্যা যে, একটা জায়নবাদী রাষ্ট্র গড়তেই হবে। এমনিতেই কোনো ইচ্ছামতো তাফসির জমির দলিলের উৎস হতে পারে না। এটা ভয়ঙ্কর!
তাই চীনের সরাসরি টু-স্টেট সলিউশনের কথা তোলার মানে হলো, প্রথমত এটা বর্তমান ইহুদিবাদী রাষ্ট্রের ভেঙে দেয়ার প্রস্তাব। ফলে তা ইহুদিবাদ ধারণার বিরুদ্ধেই সরাসরি আঘাত। এ ছাড়া, অন্যের হক মেরে এনে সেটা ইহুদিদের দেয়ার এই বিশেষ ও চরম বৈষম্যমূলক রাষ্ট্র- ইহুদিবাদের প্রাণভোমরাকেই বিনাশ করে দেয়া হবে এতে। দেখা গেছে, যে লোকটা ইহুদি ধর্ম বা তা পালন নিয়েও সিরিয়াস নয়; অথচ সে এই ইহুদিবাদ বা জায়নিস্ট রাষ্ট্রটাকেই টিকিয়ে রাখার প্রবলভাবে পক্ষে।
এছাড়া চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আরেকটা বক্তব্য জায়নিস্টদের মনে খুবই চোট দিয়েছে বা বলা উচিত, তাদের ভীত করেছে। তা হলো, বক্তব্যের শুরুতেই তার প্রথম বাক্য হলো, ‘ফিলিস্তিন প্রশ্ন হলো, সারা মধ্যপ্রাচ্যের সব সমস্যার মূল ইস্যু।’ আর এ কথাতেই বহু সাধারণ ইহুদিবাদীও বিরাট বিপদ দেখেছেন। কেন? তাদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান সমস্যা নাকি ‘শিয়া-সুন্নি বিরোধ’। যেমন- সৌদি আরব আর ইরান ঝগড়া। আসলে তারা চাচ্ছেন, মুসলমানদের মধ্যকার স্বাভাবিক ভিন্নতাগুলোকে যত প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখানো যাবে ততই এ কারণে নিজেদের জায়নিস্ট রাষ্ট্রের প্রতি মানুষের নজর তত কম যাবে। গত দুদিনে এমন যত লেখা পড়েছি, তাতে এই ব্যক্তির লেখাটাই তুলনায় সবচেয়ে নরম ভাষায় লেখা। অথচ তার লেখাটাই প্রবল জাতশ্রেষ্ঠত্ববাদী রেসিজমে ভরপুর।
যেমন তারা আরো বলছেন, আমেরিকা যে মধ্যপ্রাচ্যে আরব স্প্রিংয়ের আন্দোলন চালিয়েছিল (বুঝাচ্ছেন বিশেষত মিসর, তিউনিশিয়ায়) সেটা আরো চালানো উচিত। কেন? কারণ সেটাই নাকি মধ্যপ্রাচ্যের ‘মূল’ সমস্যা। কী সেটা? তারা নরম ভাষায় ইঙ্গিতে বুঝাচ্ছেন, মুসলমানরা হলো জঙ্গি, খালি মানুষ মারে। এ জন্যই আমেরিকা ‘আরব স্প্রিং’ শিখিয়ে তাদের শান্তির পথে এনেছিল।’ অথচ পাঠক লক্ষ্য করুন, এই ভাষ্যের মাধ্যমে লেখক যে ভরপুর বিদ্বেষে মুসলমানরা সব জঙ্গি ফলে নিচা- এই ধরে নেয়া নিচু-মানুষ বলে ঘৃণা ছড়িয়ে ফেলছেন, সেদিকে খবরই নেই। এই হলো জায়নবাদীসহ সব ধরনের জাতবাদী, জাতশ্রেষ্ঠত্ববাদীর সবচেয়ে বিপজ্জনক এবং কমন ‘অসুখ’ ও অসুস্থতা।
লক্ষ করুন, হাতে অস্ত্র ধরা মানেই জঙ্গি- তা-ও চরম নেতিবাচক ও খারাপ জাতের লোক এই হলো তাদের বিদ্বেষের মূল কথা। এর মানে, বাংলাদেশে আমরা খুবই খারাপ লোক ও খারাপ জাতের মানুষ তাহলে। কারণ আমরা তো একাত্তরে অস্ত্র হাতে নিয়েই যুদ্ধ করেছিলাম! সূক্ষ্মভাবে খেয়াল না করলে মুসলমানবিদ্বেষী বা জাতশ্রেষ্ঠত্ববাদীদের ধরতে পারা খুব কঠিন।
এক কথায় বললে, চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের ওই দুই পয়েন্টে, এতে জায়নবাদী মন ভীষণ বিপদ দেখেছে ও ভয় পেয়েছে। কারণ জন্ম থেকেই যায়নবাদকে ভিত্তি করে তৈরি করা ইসরাইলকে আমেরিকা সুরক্ষা দিয়ে গেছে। কখনোই জায়নবাদের গায়ে ফুলের টোকাও লাগতে দেয়নি। অথচ আমেরিকার দিন গিয়ে চীন উঠে আসছে ক্রমশ; যাতে, আমেরিকান কর্তৃত্ব যা এতদিন জায়নবাদকে প্রটেক্ট করে রেখেছিল, তা নিজেই ভেঙে পড়ছে। আর এতেও জায়নবাদ বা ইহুদিবাদ প্রমাদ গোনা শুরু করেছে। এ জন্যই তারা চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য পছন্দ করেননি।
কিন্তু সাবধান! এতক্ষণ বর্ণনা যেভাবে করা হয়েছে তাতে কি চীন আমাদের ত্রাতা, তাই চীনকে আমাদের ‘দেবতার আসনে’ বসাতে হবে? দয়া করে এই অর্থ করে কেউ আত্মঘাতী হবেন না। তাহলে, কীভাবে দেখব?
অবশ্যই চীনের এই অবস্থান ফিলিস্তিনিদের পক্ষে এবং তা তাদের জন্য এক বিরাট সুবাতাস আনার ইঙ্গিত। কিন্তু কোনোভাবেই এটা চীনের ফিলিস্তিনি ভালোবাসা অথবা চীন মহান, চীন অমুক তমুক বিশাল বীর- না। এসব করা যাবে না। চীনের নিজের স্বার্থেই তার অবস্থান ফিলিস্তিনিদের পক্ষে। এখানে ফিলিস্তিনিরা মজলুম না কোনো জুলুমবাজ সে বিচারের ভিত্তিতে এখানে চীন অবস্থান নেয়নি। আমেরিকা-চীন গ্লোবাল পুরান আর নতুন নেতার দ্বন্দ্বে চীন নিজের অবস্থান নিলেই তাতে নিজেকে স্বাভাবিকভাবে দেখাতে হবে সে আমেরিকার চেয়ে বেটার আর আমেরিকার বিরোধীদের সাথেই তো চীনের হাত মিলবে। আর এতে এতদিন ধরে যারা চাপা পড়ে থাকা সব কণ্ঠ ও জনগোষ্ঠী এই প্রথম ৭৫ বছর পরে তারা নতুন সম্ভাব্য পরিস্থিতির কারণে সুযোগ পাবেই, পরিস্থিতিটা সে না চাইলেও তার পক্ষেই আসবে। আর এই সুযোগ তাকে বুদ্ধিমানের মতো উঠিয়ে নিতে হবে।
কিন্তু তাই বলে চীন কি এতই খারাপ, যার কোনো নৈতিক অবস্থান একেবারেই নেই? না, এমন বলাটাও অবিচার হবে। এখানে যে ইহুদি টেকনিক্যাল এক্সপার্ট লোকের এক লেখার বরাতে অনেক কথা বলেছি, তিনি আসলে চীনের সাথে কাজ করা একজন টেকনিক্যাল এক্সপার্ট। তিনি সাক্ষ্য দিয়ে লিখছেন, ইসরাইল মাওয়ের বিপ্লবের আগেই, ১৯৪৮ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হয়েছে। তাই সে আগের চিয়াং কাইশেকের চীনকে এবং পরে আবার মাও সেতুংয়ের বিপ্লবের (১৯৪৯) চীনকেও স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু তাতে মাও ইসরাইলকে পালটা স্বীকৃতি দেননি। বরং সোভিয়েত সহায়তায় ইসরাইল বিরোধী যে আরব জোট তৈরি করা হয়েছিল তাদেরকেই সাহায্য সমর্থন দিয়ে গেছেন। ১৯৯২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরই চীন ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তাও এর কারণ ওই এক্সপার্ট ব্যাখ্যা করছেন। তিনি বলছেন, ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির পরে, আর সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশ (১৯৮৯-৯৩) ১৯৯১ সালে ‘মাদ্রিদ সম্মেলন’ ডেকেছিলেন আরব-ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনি নেতাদেরকেও দাওয়াত দিয়ে সবাইকে হাত মিলিয়ে দেয়ার জন্য। মূলত এরপরে ইসরাইলকে স্বীকৃতি না দেয়ার জন্য চীনের হাতে কোনো কারণ ছিল না। তবে এরপরে আজো দু’দেশের সম্পর্ক কেবল অর্থনীতির ভেতরেই সীমাবদ্ধ, কোনো রাজনৈতিক দিকে যা গড়ায়নি। এমনকি ইসরাইল চীনের বেল্ট-রোড প্রোগ্রামের সদস্য হলেও নয়। অর্থাৎ সার কথায়, তার লেখাটা চীনকে বুঝিয়ে বলা ধরনের পারসুয়েসিভ। যদিও তার জায়নিস্ট রেসিজমের ইসলামবিদ্বেষ তিনি লুকাতে পারেনি।
উপরে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের দুটা পয়েন্ট উল্লেখ করে দেখিয়েছি; যা জায়নিস্টদের আঘাত করেছে। কিন্তু এসবের চেয়েও আরেক বড় আঘাতের আরেক পয়েন্ট তৈরি হয়েছিল যেটা তৈরি হয়েছিল চীনের সরকারি সিসিটিভি চ্যানেলের অধীনের পরিচালিত আরেক সরকারি টিভি নেটওয়ার্ক ‘সিজিটিএন’ টিভিতে। সেখানে অ্যাঙ্কর এক ব্যক্তির সাথে তার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন। আমার করা ওর বাংলা অনুবাদ অংশটা দিচ্ছি। তবে আমি বাংলা করছি ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় ছাপা হওয়া ভাষ্যটা থেকে।
“গত ১৮ মে সিজিটিএন টিভিতে প্রচারের হোস্ট ছিলেন ঝেং জুনফেং। তিনি প্রশ্ন করেন, ইসরাইলকে আমেরিকার সমর্থন করে যাওয়া, এটা কি সত্যিকারের (পশ্চিমা) গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চার উপরে দাঁড়ানো- বিষয়টাকে প্রশ্ন করে এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, আমেরিকার প্রো-ইসরাইলি এই পলিসি আসলে তৈরি হয়েছে ধনী আমেরিকান ইহুদিদের প্রভাবে এবং আমেরিকার বিদেশনীতি যারা তৈরি করেন তাদের উপর ইহুদি লবির প্রভাবে।’ এরপরে ঝেং আরো স্পষ্ট করে ইংরাজিতে বলেন, ‘আমেরিকার ফাইন্যান্স ও ইন্টারনেট সেক্টর ইহুদি আধিপত্যে আছে।’ তাই অনেকে বলেন, শক্তিশালী লবি এখানে আছে, এটা সম্ভব।”
এই হলো মোটামুটি মূল কথাগুলো। কিন্তু এতেই পিকিংয়ে ইসরাইলি দূতাবাস এবং ভারতসহ বহু দেশের পত্রিকা যারা ইসরাইলকে ফেভার করে বা ব্যবসায়িক সম্পর্কে লিপ্ত এমন দেশের বিভিন্ন মিডিয়া চীনকে ‘অ্যান্টি সেমেটিক’ বলে নিন্দার ঝড় তুলে ফেলেছিল।
এখন অ্যান্টি সেমেটিক মানে কী? প্রথমত এই শব্দটা তৈরিই হয়েছে জায়নিস্ট বিশেষ চোখ দিয়ে দেখা থেকে। আক্ষরিক অর্থে সেমেটিক মানে আভিধানিক অর্থে, হিব্রু, আরবি, আরামিক, আমহারিক ইত্যাদি ভাষা অথবা এই ভাষাগুলোর সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর কালচার- একে সেমেটিক ভাষা বা সেমেটিক কালচার বলা হয়। আরেক অর্থে বাইবেলে যেসব ভাষা বা কালচারের রেফারেন্স বা উল্লেখ আছে বা পাওয়া যায়, ‘সেমেটিক’ বলতে সে সবই বুঝায়।
কিন্তু এটা তো সেমেটিক শব্দের সাধারণ অর্থ। তবে এটাকেই জায়নবাদীরা আরেক বিশেষ মানে দিয়েছে আর সবাইকে সেই মানে মানতে বাধ্য করতে চায়। তার মূলকথা হলো, যেন আমি ভিক্টিম; তাই আমাকে বিশেষ খাতির করো। এই দাবি করা।
আমেরিকান সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদ বা মোদির হিন্দুত্ববাদ যেমন- এরকম এরা সবাই বাদে সবাই জার্মানির হিটলারকে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় জাতিবাদী, শ্রেষ্ঠত্ববাদী, রেসিজমের নায়ক মনে করে। কারণ তিনি জার্মান নীল চোখের আর্য জাতির শ্রেষ্ঠত্ববাদের অধীনে সবাইকে নিতে চেয়েছিলেন। আর এতে সবচেয়ে বেশি হিংসা ও আর ঘৃণার চর্চা তিনি করেছেন জার্মানি ইহুদিদের ওপর। গ্যাসচেম্বারে ঢুকিয়ে পুড়িয়ে মারাসহ সব নৃশংসতা, গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করাসহ সব।
এ ছাড়া ইউরোপের যেসব দেশে ইহুদিরা বাস করত সেসব দেশে হিটলার বা তার যুদ্ধজোট লড়তে গেলে সেখানেই ইহুদিরা নৃশংসভাবে খুন হয়ে গেছে। তাই এতে এক বড় প্রতিক্রিয়া হলো, আমরা ভিক্টিম- এই দাবি বা এই সহানুভূতিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের প্রচেষ্টা। এরই পরিণতিতে হিটলার যে কারণে শ্রেষ্ঠত্ববাদী সেই বিভিন্ন দেশের ইহুদিরা ইসরাইলে জড়ো হয়ে সেটাই এবার রপ্ত করেছে। হিটলারকে কপি করা তাদের এই নব্য শ্রেষ্ঠত্ববাদ- এটাই ইহুদিবাদ বা জায়নবাদ। এটা অরিজিনালি সরাসরি হিটলারকে কপি করতে তারা গিয়েছিল; তা আর নেই। বরং যখন তারা আবার উঠে দাঁড়ানোর জন্য বর্তমান রাষ্ট্রে জড়ো হয়, এবার তারা ভিক্টিম, এই সহানুভূতি বিক্রি করে দাঁড়াতে চাইল তখনই আরো ভয়াবহ এক হিটলারি চিন্তা- এই প্রতিহিংসা তাদের পেয়ে বসেছিল।
তা হলো, তারা আবার উঠে দাঁড়াতে চাইলে তাদেরকে- ১. ভিকটিমহুড বিক্রি করতে জানতে হবে; ২. অন্য সব জাতি-জনগোষ্ঠীর উপরে চড়ে তাদের শাসন মানাতে হবে। এবার এর সাথে তাদের প্রত্যেকের মনে চাপা পড়ে থাকা হিটলারি নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা আগ্রহকে তারা প্রশ্রয় দেয়া শুরু করে। ব্যতিক্রম বা সচেতন যারা এদের কথা বাদ দিলে তারাই জায়নবাদী- যারা হিটলারের আরেক কপি যা অবচেতনে তারা হয়ে উঠেছিল প্রতিহিংসার নেশায়। কিন্তু মনকে তারা সান্ত্বনা দিয়েছিল বিরূপ দুনিয়ায় আবার টিকে, বেঁচে উঠতে গেলে তাদের এমন নিষ্ঠুর পাল্টা-হিটলার হয়ে উঠতে হবেই। তাই কী করা... আর সেকারণে যে সহানুভূতি দেখাতে আসবে তাকেও তারা বধ করবে, শিকার বানিয়ে ফেলবে।
এ কারণে তাদের কেউ যদি ইহুদি বলে (যেমন মুসলমানকে কেউ বা সে নিজেও অবলীলায় ‘মুসলমান’ বলেই ডাকে) তবে সে ক্ষেত্রে সে মনে করবে যে, এটা হিটলার যেভাবে তাদের ‘ঘৃণার মুডে’ ইহুদি বলে ডেকেছিল, এটা তাই। কাজেই একালে হলেও তারাও ইহুদিদেরকে ‘নীচু’ দেখানো লোক। কিন্তু কী অভিযোগ দেবে, যে ওরা আমাকে ইহুদি বলেছে? না এটা ভালো জমবে না। তাই এক অদ্ভুত শব্দ চালু করে যে, আমাকে ‘সেমেটিক’ বলেছে।
এখন যদিও সেমেটিক কোনোই খারাপ বা নেতিবাচক শব্দ নয়। আর সেমেটিক বলতে আরবদেরও তো বুঝায়। ইথিওপিয়ান আমহারা প্রদেশের আমহারিক, এদেরকেও বুঝায়। কেবল ইহুদি একচেটিয়া নয়। তবু এটাই জিদ করে মানে যে, ইহুদি- সেমেটিক, আর সেমেটিক মানে যেন কেবল ইহুদিদের জন্য এই অর্থ চালু রয়েছে। এটাই আসলে যে সহানুভূতি দেখাতে আসবে তাকেও তারা অভিযুক্ত করার কৌশল চালু করে। আর সাফাইটা হলো, তাদের বাঁচতে হবে তো! অন্য কেউ তো তাদের দেখবে না।
তাহলে বলতে হয়, হিটলার তো মুসলমান নয়। অথচ ইউরোপ যুদ্ধ পরবর্তীকালে ইহুদিদেরকে কৌশলে মুসলমানদের ওপর ডাম্প করে দিলে তখন তারা বুঝে যায় মুসলমানদের দাবড়েই তাদের টিকে থাকতে হবে। ফলে একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের দুনিয়ায় হিটলারি চিন্তার বিরুদ্ধে এবং তা রোধ করতে দুনিয়ায় আন্তর্জাতিক আইন কনভেনশন তৈরি করা হয়েছে। আর ততই জায়নবাদী চিন্তায় তারা পুরানা হিটলারি শ্রেষ্ঠত্ববাদকে আঁকড়ে ধরে উঠে দাঁড়াতে চেয়েছে। জায়নবাদ বুঝেই নাই যে, সারা ইউরোপ এক হিটলারের কারণে তা যেন ফিরে নিজ নিজ দেশে কোথায় না জাগে, তাই তারা ‘নেশন স্টেট’-এর কাঠামো ভেঙে দিয়ে, অধিকারভিত্তিক নতুন রাষ্ট্র গড়ে নিয়েছিল, এক সাথে এক সম্মেলনের মাধ্যমে ১৯৫৩ সালে। অথচ দুনিয়ার এই শিক্ষা নেয়া পরিবর্তনটা সম্পর্কে একেবারেই বেখবর আরেকটা বড় রাষ্ট্র- ভারত। সম্ভবত সে কারণেই কংগ্রেসের ‘ছুপা’ হিন্দু নেশন-স্টেট পরে মোদির জন্য হিন্দুত্ববাদী ভারত, এই নেশন স্টেট হওয়ার জন্য উপযোগী হয়ে উঠেছে। এখন আসন্ন চীনা নতুন নেতৃত্বের দুনিয়া কি জায়নবাদসহ সব শ্রেষ্ঠত্ববাদকে কবর দিতে পারবে?
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com