করোনা ও মোদির বিপর্যয়
মোদি - ছবি : সংগৃহীত
ভারতের করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরিস্থিতি কত বিপজ্জনক পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হয়েছে, তা বর্ণনা করা খুবই কঠিন। দেশের মানুষ তাদের পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবদের কাছে হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠিয়ে ব্যাপকভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। কেন্দ্রীয় সরকার কিভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে, তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসংখ্য পোস্ট দেয়া হচ্ছে।
হাসপাতালগুলোতে এক দিকে যখন রোগী ভর্তির বেড ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে এবং অক্সিজেনের অভাব দেখা দিয়েছে মারাত্মকভাবে; অন্য দিকে তখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার মন্ত্রিসভা এই ভয়াবহ পরিস্থিতি এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল নিয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ‘বিশ্ব মহামারীর মধ্যখানে রয়েছে’ বলে ঘোষণা দেয়ার তিন মাস পর ভারত সরকার অবস ও অচল হয়ে যাওয়া চলৎশক্তিহীনভাবে পশুর মতো হেডলাইটের দিকে তাকিয়েছিল। অন্যান্য দেশ যখন তাদের টিকাদান কর্মসূচি নিয়ে ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন ভারত সরকার পেছনে পড়ে রয়েছে এবং মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ অথবা তৃতীয় একটি ঢেউ কখন ভারতের জনগণের ওপর ব্যাপকভাবে আছড়ে পড়ে, তা প্রত্যক্ষ করার জন্য অপেক্ষা করছে। ২১ এপ্রিল বুধবার, দেশে ২৪ ঘণ্টায় তিন লাখ ১৫ হাজার করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এটি ব্যতিক্রমধর্মী একটি অস্বাভাবিক উচ্চ পরিসংখ্যান। মনে রাখতে হবে, চীনে যখন করোনা শনাক্ত হয় তখন মোট রোগী শনাক্তের সংখ্যা এক লাখেরও কম ছিল। করোনার এই ‘স্পাইক’ প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। এটি কি একটি নতুন ভ্যারিয়েন্ট অথবা এটি কি চলতি বছরের কুম্ভমেলা যেখানে ৩০ লাখ লোক জমায়েত হয়েছিল, সেটিও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ বন্ধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় এবং যথেষ্ট লোককে টিকাদান সম্পন্ন করতে না পারার ফলে কি এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে?
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার কর্তৃক এই মহামারীকে গুরুত্ব দিয়ে এর মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হওয়ার জন্যই আজকের পরিস্থিতি। সারা বিশ্বের দিকে একনজর তাকালে দেখা যাবে, যেসব সরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কবাণীকে গুরুত্ব দেয়নি, সেসব দেশে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে এবং জনগণ বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোর প্রতি মৌলিক স্বাস্থ্যবিধি- হাতধোয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পরা এবং এরপর কোভিড-১৯ পরীক্ষা করার ও সোস্যাল আইসোলেশন তথা সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকার পরামর্শ দিয়েছিল।
প্রথম পর্যায়ের পরামর্শগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য পর্যাপ্ত সম্পদের প্রয়োজন পড়ে না। উদাহরণস্বরূপ, ভিয়েতনাম সরকার এসব পরামর্শকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করে তাৎক্ষণিকভাবে রোগের বিস্তার ঘটাকে ধীর করতে সক্ষম হয়েছে। এ ভাইরাসজনিত রোগটির বিপদ ও ভয়াবহতার প্রমাণ পাওয়ার পরও ভারত সরকার সতর্কতা অবলম্বনের ব্যাপারে ধীর নীতি গ্রহণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাকে ‘মহামারী’ হিসেবে ঘোষণা দেয়ার আগেই ২০২০ সালের ১০ মার্চের মধ্যে ভারত সরকার দেশে কোভিড-১৯ এ সংক্রমিত হওয়ার ৫০টি ঘটনার কথা তথা ৫০ জনের সংক্রমিত হওয়ার বিষয় জানতে পারে। আর পরবর্তী ১৪ দিনে এই ইনফেকশন দ্বিগুণ হয়ে যায়। মহামারীর বিরুদ্ধে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর প্রথম বড় ধরনের তৎপরতা ছিল ১৪ ঘণ্টার ‘জনতা কার্ফু’। এই কার্ফু নাটকীয় হলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শগুলোর অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে এই নিষ্ঠুর লকডাউন কার্যকর করতে গিয়ে হাজার হাজার অভিবাসী শ্রমিককে তাদের বাড়ির পথে শূন্য হাতে পাঠানো হয়। কেউ কেউ পথের ধারেই মারা যায়, অনেকে তাদের শহরে ও গ্রামে ভাইরাস বহন করে নিয়ে গেল। মোদি তার নিজের সরকারি কর্মকর্তাদের পরামর্শ না নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই এই লকডাউন কার্যকর করেছেন। সরকারি কর্মকর্তাদের পরামর্শ নিয়ে কাজ করলে এ ধরনের ক্ষতি, অনভিপ্রেত পরিস্থিতি ও অপ্রয়োজনীয় কার্যক্রম এড়ানো যেত।
২০২০ সালের মে ও জুন মাসে লকডাউন বাড়ানো হয়। ভারতের লাখ লাখ কর্মজীবী মানুষের কাছে এই লকডাউন অর্থহীন হলেও তা বাড়ানো হয়েছে। অথচ এসব মানুষকে তাদের প্রতিদিনের খাবার জোগাড় করে বেঁচে থাকার জন্য ঘর থেকে বের হতে হয়েছে। এক বছরের মহামারীতে ভারতে এক কোটি ৬০ লাখের মতো লোকের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ইতোমধ্যে এক লাখ ৮৫ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। মহামারীর সংবাদ প্রকাশ করতে গিয়ে বলা হচ্ছে, ভাইরাস ‘শনাক্ত’ হয়েছে, ‘নিশ্চিত’ মৃত্যু হয়েছে। কারণ ভারত মহামারীতে মৃত্যুর যে সংখ্যা বা পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হচ্ছে তা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।
ভারতে বেসরকারি খাতের স্বাস্থ্যসেবা এবং তহবিলের অভাবে পাবলিক হেলথ বা সরকারি স্বাস্থ্যসেবা নির্মম নিষ্ঠুর পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। কয়েক বছর ধরে সরকারি স্বাস্থ্য খাতে অধিক আর্থিক বরাদ্দের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এসব পরামর্শ ও আহ্বান শোনার কেউ নেই।
ভারত সরকার ২০১৮ সালে জিডিপির মাত্র ৩.৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করে। এই পরিসংখ্যান খুবই কম। এক দশক ধরে দেশটি স্বাস্থ্য খাতে একই বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছে। ২০১৮ সালে ভারতের স্বাস্থ্য ব্যয় জনপ্রতি ক্রয়ক্ষমতা ২৭৫ দশমিক ১৩ মার্কিন ডলার। এটি কিরবাতি, মিয়ানমার ও সিয়েরা লিওনের সমান। কিন্তু ভারতের মতো একটি শিল্প ক্ষমতার অধিকারী দেশের জন্য এই ব্যয় হার খুবই কম। অথচ দেশটির সম্পদ কম নয়। গত বছরের শেষের দিকে ভারত সরকার স্বীকার করে যে, প্রতি এক হাজার ভারতীয়ের জন্য ০.৮ জন ডাক্তার এবং প্রতি এক হাজার ভারতীয়ের জন্য ১.৭ জন নার্স রয়েছে।
পরিস্থিতি খুবই খারাপ। ভারতে প্রতি ১০ হাজার লোকের জন্য হাসপাতালের শয্যা মাত্র ৫ দশমিক ৩টি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- অন্য দিকে একই সংখ্যক মানুষের জন্য চীনের শয্যা সংখ্যা হচ্ছে ৪৩ দশমিক ১। ভারতে প্রতি এক লাখ লোকের জন্য ক্রিটিক্যাল কেয়ার বেডের সংখ্যা হচ্ছে মাত্র ২ দশমিক ৩। তুলনামূলকভাবে, এ ক্ষেত্রে চীনের বেডের সংখ্যা হচ্ছে ৩ দশমিক ৬টি। আর ভারতের কাছে আছে মাত্র ৪৮ হাজার ভেন্টিলেটর, যেখানে চীনের উহান প্রদেশেই আছে ৭০ হাজার ভেন্টিলেটর।
সম্পূর্ণভাবে বেসরকারীকরণের কারণেই মেডিক্যাল অবকাঠামোর ক্ষেত্রে ভারতের এই দুর্বলতা। আর বেসরকারি খাতের হাসপাতালগুলো প্রিন্সিপল অব ম্যাক্সিমাম ক্যাপাসিটি সিস্টেমে পরিচালিত হয়ে থাকে। এসব হাসপাতালের অতিরিক্ত রোগীর চিকিৎসা দেয়ার মতো কোনো সক্ষমতা নেই। কোনো প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজ অতিরিক্ত বেডের ব্যবস্থা করে না। তারা রোগীদের কল্যাণে অতিরিক্ত ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থাও স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে করে না। তাই এই মহামারীর কারণে দেশটিতে চিকিৎসা ক্ষেত্রে সঙ্কট অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। যেকোনো সমাজে যেকোনো কিছুর স্বল্পতা বা ঘাটতি একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু মহামারীর সময়ে ভারতে মৌলিক মেডিক্যাল পণ্যের স্বল্পতা কলঙ্কজনক।
ভারত দীর্ঘ দিন ধরে ‘বিশ্বের ফার্মাসি’ হিসেবে পরিচিত। ভারতের ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি বা ওষুধ প্রস্তুতকারী শিল্প জেনেরিক ড্রাগ বা ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে দক্ষ হয়ে উঠেছে বহু আগে। দেশটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ফার্মাসিউটিক্যাল ম্যানুফেকচারার তথা ওষুধ প্রস্তুতকারী। ভারতের ৬০ শতাংশ বৈশ্বিক টিকা উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে- যেখানে ৯০ শতাংশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ম্যানলেস ভ্যাকসিনের ব্যবহার রয়েছে। এ ছাড়াও ভারত আমেরিকার বাজারের জন্য বৃহত্তম ‘পিল’ উৎপাদনকারী। কিন্তু এসব কিছুই কোভিড-১৯ সঙ্কটে সহায়ক হয়নি। অতি প্রয়োজনের সময় ভারতীয়দের জন্য কোভিড-১৯ টিকা পাওয়া যাচ্ছে না।
২০২২ সালের নভেম্বরের আগে ভারতীয় নাগরিকদের টিকাদান সম্পন্ন হবে না। সরকারের নতুন নীতির কারণে টিকা উৎপাদনকারীরা টিকার দাম বাড়াতে পারবে; কিন্তু তারা প্রয়োজন পূরণের জন্য যথেষ্ট দ্রুততার সাথে টিকা উৎপাদন করতে পারবে না। ভারতের সরকারি খাতের টিকা কারখানাগুলো অলস পড়ে রয়েছে।
দ্রুততার সাথে বিপুল পরিমাণ টিকা সংগ্রহ করার কোনো কার্ড দেশটির হাতে নেই। ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) পক্ষ থেকে, যথেষ্ট পরিমাণ মেডিক্যাল অক্সিজেন সরবরাহ করার লক্ষ্যে সক্ষমতা তৈরি করার কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। অক্সিজেনের ক্ষেত্রে দেশের মজুদ ফুরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পরও সরকার অক্সিজেন রফতানি করেছে। এমনকি, ভারত সরকার মূল্যবান রিমডেসিভার ইঞ্জেকশনও রফতানি করেছে।
২০২০ সালের ২৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, কোডিভ-১৯ এর বিরুদ্ধে মহাযুদ্ধে তিনি ১৮ দিনে ‘মহাভারত’ জয় করবেন। এই প্রতিশ্রুতির পর ৫৬ সপ্তাহেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। ভারতবাসী রক্তস্নাত কুরুক্ষেত্রই দেখতে পাচ্ছে যেখানে হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে।
লেখক : ভারতের একজন ঐতিহাসিক,
সম্পাদক ও সাংবাদিক। তিনি গ্লোবেটরোটের প্রধান সংবাদদাতা
এশিয়া টাইমস থেকে ভাষান্তর মুহাম্মদ খায়রুল বাশার