ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরাইলি আচরণের কিছু নমুনা
ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরাইলি আচরণের কিছু নমুনা - ছবি : সংগৃহীত
ফিলিস্তিনে সাত-আট দশক ধরে ইহুদিদের দ্বারা সংঘটিত অসংখ্য নির্মমতার মধ্যে মাত্র কয়েকটির দিকে তাকালেই তাদের বর্তমান বর্বরতার বিষয়ে কিছুটা আঁচ করা যাবে।
বহু বছর থেকে ঘটে আসা ইসরাইলিদের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে বুলেট ও মিসাইল ব্যবহার, ফিলিস্তিনিদের অধিকারের কোনো তোয়াক্কা না করে দখলকৃত ভূখণ্ডে বসতি স্থাপন, ফিলিস্তিনিদের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ, ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ও ক্ষেত-খামার ধ্বংস করা, জাতিসঙ্ঘের অনেক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ধারাবাহিক উপেক্ষা, ইত্যাদি ঘটনা ফিলিস্তিনিদের ক্ষোভকে উসকে দেয়। ফলে হামাসসহ অন্যান্য সংগঠনের প্রতিবাদ সশস্ত্র প্রতিরোধের রূপ নেয়।
বন্দী ইসরাইলি সেনা করপোরাল গিলাদ শালিতকে মুক্ত করার জন্য ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট ২০০৬ সালে গাজা উপত্যকায় দীর্ঘ ও ব্যাপক সামরিক অভিযানের নির্দেশ দেন। ‘আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমরা সবার কাছেই পৌঁছাব, তিনি যেই হোন না কেন। কেউই রেহাই পাবে না’ -২৭ জুন ২০০৬ সালে তিনি সদম্ভে ঘোষণা করেন। ইউরোপে ইহুদিদের বিরুদ্ধে নাৎসিরা এই ভাষাতেই কথা বলত। ‘কথিত সেই অভিযানে তারা দানবিক তাণ্ডব ঘটায়। তারা আটজন হামাস মন্ত্রীসহ, সংসদের স্পিকার এবং ৩৪ জন এমপিকে গ্রেফতার করে, বোমা মেরে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও ব্রিজ উড়িয়ে দেয় এবং নিরীহ ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। এই সব কাজ কোনো দায়িত্বশীল রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একজন বন্দী সেনার মুক্তির জন্য সদিচ্ছা নয়, বরং নিছক বর্বরতা ও দস্যুতা। সেনাকে মুক্ত করার জন্য তারা আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীর সহায়তা চাইতে পারত। কিন্তু তা নয়, কোনো সমঝোতা বা কূটনৈতিক প্রচেষ্টা নয়, বরং কঠিনতম সন্ত্রাসই তারা পছন্দ করল। ব্রিটিশ কর্তৃত্বাধীন ফিলিস্তিনে সশস্ত্র ইহুদি গ্রুপ ইরগুন, তাদের সার্বিক কৌশল হিসেবে ‘নগর সন্ত্রাসবাদ’ অন্তর্ভুক্ত করেছিল। ইসরাইলি দখদারিত্বের প্রতিরোধে পিএলও এমন একটি সংগঠন। তবে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করার লক্ষ্যে, ১৯৮৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে পিএলও সহিংসতার পথ প্রত্যাখ্যান করে।
বিংশ শতাব্দীতে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব যাদের কেউ কেউ পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তারা সন্ত্রাসের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। আইজাক শামির পরিচালিত ‘দ্য স্টার্ন গ্যাং’ ১৯৪৪ সালে কায়রোতে অ্যাডওয়ার্ড লর্ড ময়িনকে হত্যা করেছিল। উইনস্টন চার্চিল, যিনি ছিলেন আইজাক শামিরের প্রশংসায় উচ্চকণ্ঠ, এ ঘটনায় খুবই ক্ষুব্ধ হন। এই গ্যাং ১৯৪৮ সালে জেরুসালেমে জাতিসঙ্ঘ মধ্যস্থতাকারী কাউন্ট বার্নাডোটকে গোপনে হত্যা করে। শামির তখন প্রচার করছিলেন, ‘ইহুদি নৈতিকতা ও ইহুদি ঐতিহ্য কোনোটিই সন্ত্রাসকে রণনীতির পরিপন্থী মনে করে না। জাতীয় সংগ্রাম নিয়ে ব্যস্ততার মুহূর্তে আমরা নৈতিক দ্বিধাগ্রস্ততা বহু দূরে ছুড়ে ফেলে রাখি। সর্বাগ্রে, আমাদের জন্য সন্ত্রাস হলো, রাজনৈতিক যুদ্ধের অংশ যা বর্তমান পরিস্থিতিতে খুবই যথার্থ।’
১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ সালে চিহ্নিত ইহুদি সন্ত্রাসী কর্তৃক কাউন্ট ফোক বার্নাডটের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর ড. বাঞ্চের নির্দেশে একটি রিপোর্ট তৈরি করা হয়। উল্লেখ্য, বার্নাডটের পর বাঞ্চ ফিলিস্তিনে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ওই রিপোর্টে বলা হয়- ৬ নভেম্বর ১৯৪৪ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ সাল- এই চার বছর সময়ের মধ্যে প্রায় ২৫৯টি চিহ্নিত হামলা পরিচালিত হয়েছে। আইজাক শামিরের নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসী ইহুদি সংগঠন স্টার্ন গ্যাং এসব হামলায় মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ আবাসিক মন্ত্রী (৬ নভেম্বর ১৯৪৪), কাউন্ট বার্নাডটসহ (১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮) অনেক ব্রিটিশ, আমেরিকান ও আরব নাগরিককে হত্যা করে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর, ব্রিটিশ পররাষ্ট্র অফিস এবং বিভিন্ন মার্কিন ও ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এই রিপোর্ট সঙ্কলিত হয়।
১৯৫৩ সালে অ্যারিয়েল শ্যারন ফিলিস্তিনের কিবিয়া গ্রামে শত শত গ্রামবাসীকে গণহত্যা করে। একই ব্যক্তি সাবরা ও শাতিলা উদ্বাস্তু শিবিরে হাজার হাজার লোককে খুন করে, যা ’২০ শতকের অন্যতম ঘৃণ্য গণহত্যা হিসেবে বিবেচিত। ১৯৫৬ সালে ‘কাফর কাসেম’ গণহত্যা ইসরাইলি নির্মমতার আরেকটি বড় দৃষ্টান্ত। ওয়াশিংটন পোস্ট এই সংবাদের ক্যাপশনে লিখে- ‘ইসরাইলের কালো অতীতের পাতা উন্মোচন’। ইহুদি সন্ত্রাসী বারুচ গোল্ডস্টেইন হেবরনে মসজিদের অভ্যন্তরে হামলা চালিয়ে ২৯ জন মুসলমানকে হত্যা করেছিল। এ ঘটনায় আহত হন ১৫০ জন মুসল্লি। ইসরাইলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিরাও সন্ত্রাসী ভাষায় প্রতিউত্তর দিচ্ছে। অপর দিকে, ইসরাইলিরা আজো তাদের ‘তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের’ হত্যা অব্যাহত রেখেছে। জাতিসঙ্ঘে আরব লিগের সাবেক দূত ক্লভিস মাকসুদ বলেন, ‘ইসরাইলি সন্ত্রাস শুরু হয় বেগিন ও শামিরের নেতৃত্বে, পরবর্তীতে শ্যারন তা অব্যাহত রাখেন। ব্রিটেন শাসিত ইসরাইল এবং ইসরাইল দখলকৃত ফিলিস্তিনের সমস্যা যে অভিন্ন ও অনুরূপ, এই কথাটি ইসরাইলিরা কিভাবে অস্বীকার করবে।’
মেনাচিম বেগিনের পার্টি ইরগুন ১৯৪৮ সালের এপ্রিলে কিং ডেভিড হোটেল উড়িয়ে দেয় এবং দির ইয়াসিনে ফিলিস্তিনি গ্রামবাসীর ওপর গণহত্যা চালায়। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনসহ অনেক বিশিষ্ট মার্কিন ইহুদি মেনাচিম বেগিনকে ইসরাইলি নাৎসি রূপে অভিহিত করে নিউইয়র্ক টাইমসে চিঠি লিখেন। চিঠিটি ভাষান্তর করে দেয়া হলো-
আলবার্ট আইনস্টাইন এবং ১৮ জন বিশিষ্ট ইহুদি কর্তৃক ইসরাইলি নাৎসিদের নিন্দা জ্ঞাপন (নিউইয়র্ক টাইমসকে লেখা চিঠি, ৪ ডিসেম্বর, ১৯৪৮) -‘আমাদের সময়ের সবচেয়ে বিব্রতকর রাজনৈতিক বিষয়গুলোর অন্যতম হচ্ছে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসরাইল রাষ্ট্রে ‘ফ্রিডম পার্টির Tnuat Haherut আত্মপ্রকাশ, যা সংগঠন, পদ্ধতি, রাজনৈতিক দর্শন এবং সামাজিক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নাৎসি ও ফ্যাসিস্ট পার্টির অনুরূপ। এটি ডানপন্থী উগ্র দেশপ্রেমিক সন্ত্রাসী সংগঠনের Irgun Zvia Leumi ছায়া সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
পার্টির নেতা মেনাচিম বেগিনের সাম্প্রতিক আমেরিকা সফরের উদ্দেশ্য হচ্ছে আসন্ন ইসরাইলি নির্বাচনে তার দলের প্রতি মার্কিন সমর্থন স্পষ্ট করা এবং যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল জায়নবাদীদের সাথে তাদের সম্পর্ক সুদৃঢ় করা। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বেশ কিছু বিশিষ্ট মার্কিন নাগরিক স্বনামে তার যুক্তরাষ্ট্র সফরকে স্বাগত জানিয়েছেন। যারা বিশ্বজুড়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সবসময় উচ্চকণ্ঠ তারা মেনাচিম বেগিনের রাজনৈতিক ইতিহাস ও পরিপ্রেক্ষিত সঠিকভাবে জানার পরও কিভাবে তার নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের সমর্থন ও সহায়ক হতে পারলেন, তা একান্তই দুর্বোধ্য বিষয়।
বেগিনের পক্ষে প্রকাশ্যে জনমত সৃষ্টি করা, তাকে আর্থিক সহায়তা করা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে ফিলিস্তিনিদের মনে এই ধারণা সৃষ্টি হবে যে, মার্কিনিদের একটি বড় অংশ ইসরাইলি ফ্যাসিস্ট শক্তির সহায়ক। সুতরাং এই অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাওয়ার আগে মার্কিন জনগণকে বেগিনের ইতিবৃত্ত এবং তার দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুনির্দিষ্টভাবে অবহিত করতে হবে।
বেগিনের পার্টির প্রকাশ্য ও প্রকৃত চরিত্র এক নয়। আজ তারা স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের পক্ষে তথা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বলছেন বটে, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়েও তারা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে প্রকাশ্যে জনমত সৃষ্টি করছিলেন। মূলত কর্মকাণ্ডের মধ্যেই ফ্যাসিস্ট দলের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশিত হয়ে পড়ে এবং তাদের অতীত কর্মসূচি থেকেই এটি বোধগম্য হবে যে, ভবিষ্যতে তাদের প্রকৃত রূপ কী হবে।
আরব গ্রাম দির ইয়াসিনে তাদের আচরণ এই পার্টির নির্মমতার এক হৃদয়বিদারক দৃষ্টান্ত। প্রধান সড়ক থেকে দূরে ইহুদি ভূমিবেষ্টিত এই গ্রামবাসী কোনো যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়নি, বরং আরব গোষ্ঠীর যারা এই গ্রামকে তাদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল তাদের তারা তাড়িয়ে দিয়েছে। সন্ত্রাসী দল ৯ এপ্রিল এই শান্তিকামী গ্রামবাসীর ওপর আক্রমণ করে। এরা কোনোভাবেই যুদ্ধের প্রয়োজনে কোনো সামরিক লক্ষ্য ছিল না। এই হামলায় গ্রামের বেশির ভাগ অধিবাসী (২৪০ জন) নিহত হন এবং জেরুসালেমের রাস্তায় বন্দী হিসেবে হটিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের কয়েকজনকে বাঁচিয়ে রাখা হয়। বেশির ভাগ ইহুদি সম্প্রদায় এই জঘন্য ঘটনায় আতঙ্কিত হয় এবং ইহুদি এজেন্সিগুলো জর্দানের বাদশাহ আবদুল্লাহর কাছে এই ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়ে টেলিগ্রাম পাঠায়। কিন্তু সন্ত্রাসীরা এই বর্বরোচিত ঘটনার জন্য লজ্জিত হওয়া তো দূরের কথা, এই ন্যক্কারজনক ঘটনায় তারা গর্ববোধ করে, এটি ব্যাপকভাবে প্রচার করে এবং দেশে উপস্থিত সব বিদেশী সংবাদ সংস্থাকে দির ইয়াসিনে তাদের কৃত ধ্বংসযজ্ঞ ও লাশের স্তূপ দেখার আমন্ত্রণ জানায়।
ইতিহাসের চাকা ঘোরে, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে কিন্তু কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। হিটলার ইউরোপের ইহুদিদের হুমকিসহ নির্যাতন-হত্যার মহড়া দিতেন। আর এখন ইহুদিরাই ক্ষমতার দম্ভে ফিলিস্তিনিদের ওপর নাৎসি কৌশল অবলম্বন করছে।’
লেখক : সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম