আইনস্টাইন ও ইসরাইল প্রতিষ্ঠা
আইনস্টাইন - ছবি : সংগৃহীত
নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক কিংসলে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে এবার রমজান মাসের প্রথম রাত ১৩ এপ্রিল শুরু হওয়া সঙ্ঘাতের কারণ জানিয়েছেন। জেরুসালেমের বিখ্যাত আল-আকসা মসজিদে ঢুকে পড়ে ইসরাইলি পুলিশের একটি দল। তারা কেটে দেয় মসজিদের লাউড স্পিকারের তারগুলো। ওই দিন ছিল ইসরাইলের ‘মেমোরিয়াল ডে’। মসজিদের কাছাকাছি ওয়েস্টার্ন ওয়ালে ইসরাইলি প্রেসিডেন্টের বক্তব্য দেয়ার কথা। আজানের কারণে ইসরাইলি প্রেসিডেন্টের বক্তব্যে বিঘ্ন ঘটতে পারে, তাই তার কেটে দেয়া হয়। জেরুসালেমের গ্র্যান্ড মুফতি শেখ একরিমা সাবরির মতে, সংঘর্ষের শুরুটা ওই ঘটনা থেকেই। ‘আগুনে ঘি’ ঢেলেছিল আল-আকসা মসজিদে পুলিশের এই অভিযান। কেবল আল-আকসা মসজিদে পুলিশের অভিযানের কারণেই নয়, ফিলিস্তিনি ছয় পরিবারকে বাড়ি থেকে উৎখাত করার পর তরুণ ফিলিস্তিনিরা বিক্ষোভ করেছিলেন।
অবরুদ্ধ ছিটমহলে ফিলিস্তিনিরা রমজান শেষে বৃহস্পতিবার সকালে জেগে উঠতে যাচ্ছে ঈদ পালনের জন্য। আর তখনই ইসরাইলি জঙ্গি বিমান গাজা উপত্যকার উঁচু টাওয়ার ভবন এবং অন্যান্য লক্ষ্যবস্তুতে প্রচণ্ড বিমান হামলা চালায়। হামাসও রকেট ছুড়ছে। শনিবার ইসরাইলি বাহিনী গাজায় ১৩ তলা একটি ভবন গুঁড়িয়ে দেয়। ওই ভবনে বার্তা সংস্থা এপি এবং কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল-জাজিরার কার্যালয় ছিল। একই দিনে গাজার পশ্চিমাঞ্চলে শরণার্থীশিবিরেও হামলা চালায় ইসরাইল। এতে এক পরিবারের ১০ সদস্য নিহত হয়েছে। গুরুতর আহত হয় পাঁচ মাসের এক শিশু। প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে এমন ঘটনা। রয়টার্সের হিসাব অনুযায়ী, সংঘর্ষে ১৬ মে পর্যন্ত ১৪৮ জন নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪১টি শিশুও রয়েছে। আহত আরো এক হাজারের বেশি লোক।
ইসরাইল সরকার আধিপত্য বজায় রাখতে একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে- বিশ্লেষকদের মন্তব্য। আর ইসরাইলের চোখে সন্ত্রাসী দল হামাস ফিলিস্তিনি আন্দোলনে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে চাইছে। ইসরাইল প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই এই উত্তেজনা ছিল। তবে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তার দীর্ঘ শাসনামলে এই উত্তেজনাকে জিইয়ে রেখে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণ করে চলেছেন।
ইসরাইল রাষ্ট্র কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দেখা যাক। ব্রিটিশ বাহিনী প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯১৪-১৯১৮) তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য দখল করে নেয় এবং এটিকে কয়েকটি রাজনৈতিক অঞ্চলে বিভক্ত করে। ১৯১৭ সালে বালফোর ঘোষণার পরে উপনিবেশবাদীরা ফিলিস্তিনে রাষ্ট্রবিহীন ইউরোপীয় ইহুদিদের বসতিস্থাপন করতে সহায়তা করে। এর ফলে ৯০ শতাংশ মুসলিম এবং মাত্র ৩ শতাংশ ইহুদি অধ্যুষিত ফিলিস্তিনের বাস্তবতাকে নির্মমভাবে উপেক্ষা করা হয়। পশ্চিমা শক্তি দ্বারা দখলকৃত ভূমি/অঞ্চল ইউরোপীয় ইহুদিদের দেয়া হল। প্রকৃতপক্ষে এভাবে ফিলিস্তিনিরা বঞ্চিত হয়েছে। অধিকৃত অঞ্চলে ইউরোপীয় ইহুদিদের (পরবর্তীকালে সব ইহুদি) স্থানান্তরিত করার সময় লাখ লাখ লোককে তাদের পৈতৃক বসতভিটা এবং সম্পত্তি থেকে বিতাড়িত করা হয়। ঘোষণাপত্র এবং এর কার্যকরকরণ দ্বারা ফিলিস্তিনি জনগণকে ঠকানো মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমান সঙ্ঘাতের কারণ, যা গত সাত-আট দশক ধরে চলছে।
ইউরোপীয় খ্রিষ্টান ক্রুসেডার এবং নাৎসিদের দ্বারা সেখানকার ইহুদিদের ওপর অত্যাচারের কারণে সৃষ্ট সহানুভূতির ফলাফল ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্রের জন্ম। পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালে ইসরাইল বেশ কয়েকটি আরব দেশ, জেরুসালেম, সিরিয়ার গোলান হাইটস এবং মিসরের সিনাই উপদ্বীপসহ বেশ কয়েকটি আরব দেশের বিশাল অঞ্চল দখল করে। ফিলিস্তিনিদের সাথে ইসরাইলের আচরণ সম্পর্কিত জাতিসঙ্ঘের সুরক্ষা কাউন্সিলের ৬৯টি প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। ইসরাইলের জন্মের পর থেকে আমেরিকা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং শীতল যুদ্ধের পরে সবচেয়ে শক্তিশালী জাতি হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের নীতি রূপায়ণ করছে যেখানে ফিলিস্তিনিদের অধিকারকে অমানবিকভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইলিরা পূর্ব জেরুসালেম দখল করে নেয়। এরপর থেকে তারা জেরুসালেমকে তাদের ‘রাজধানী’ বলে গণ্য করে। কিন্তু এর কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই। ফিলিস্তিনিরা চায় ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের আগে যে সীমান্ত ছিল, সেই সীমানার ভিত্তিতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হবে। ইসরাইল এটা মানতে নারাজ।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল যেসব ফিলিস্তিনি এলাকা দখল করে নিয়েছিল, সেখানে তারা অনেক ইহুদি বসতি গড়ে তুলেছে। আন্তর্র্জাতিক আইনে এসব বসতি অবৈধ। কেবল পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুসালেমেই এমন বসতি গড়েছে পাঁচ লাখের বেশি ইহুদি। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখান থেকে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে এসেছিল লাখ লাখ ফিলিস্তিনি। তারা ইসরাইলের ভেতর তাদের বাড়িঘরে ফিরে যাওয়ার অধিকার দাবি করে আসছে। কিন্তু ইসরাইল এই অধিকারের স্বীকৃতি দিতে চায় না।
ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্মলাভের পর চরমপন্থী ইহুদিদের সন্ত্রাস বন্ধ হয়নি। অদ্যাবধি মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত ফিলিস্তিনিদেরই আক্রমণের লক্ষ্য করা হচ্ছে। নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত ও অধিকারহীন ফিলিস্তিনিদের ওপর পৌনঃপুনিক ইসরাইলি মিসাইল আর বিমান হামলা কিংবা ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামীদের আত্মঘাতী বোমা হামলায় বেসামরিক লোকজনই বেশি হতাহত হয়েছে। এখানে প্রথমোক্তটি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সন্ত্রাস এবং পরেরটি ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কর্তৃক সন্ত্রাসী ঘটনা।
বিশ্ব মোড়ল আমেরিকার কারণে জাতিসঙ্ঘও বহু বছর ধরে ঘটা এসব হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ থামাতে পারেনি। আরব নিউজের মতে, বুশ প্রশাসন থেকে শুরু করে সবাই আজ অবধি ‘আত্মরক্ষার অধিকার’-এর দোহাই দিয়ে ইসরাইলের সব অপকর্মকে অন্ধভাবে সমর্থন করছে। আবার এ ধরনের কাজ অন্য কোনো দেশ করলে তাদের নিন্দা জানাতে যুক্তরাষ্ট্র খুবই উচ্চকণ্ঠ। কিন্তু ইসরাইলের জন্য বিবেচনার পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন। ইসরাইলের সব অপরাধের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র চরম ভণ্ডামির পরিচয় দিয়ে এসেছে নির্বিকারভাবে। ফলত পৃথিবীর অগণিত মানুষ যুক্তরাষ্ট্রকে অবিশ্বাস ও ঘৃণা করে। এতে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, মানুষ এখন ইসরাইল ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে সমার্থক মনে করে। গাজায় পরিচালিত কঠিন অত্যাচার অবশ্যই রাজনৈতিক উদ্দেশে প্রণোদিত সন্ত্রাস।
ফিলিস্তিনে সাত-আট দশক ধরে ইহুদিদের দ্বারা সংঘটিত অসংখ্য নির্মমতার মধ্যে মাত্র কয়েকটির দিকে তাকালেই তাদের বর্তমান বর্বরতার বিষয়ে কিছুটা আঁচ করা যাবে।
বহু বছর থেকে ঘটে আসা ইসরাইলিদের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে বুলেট ও মিসাইল ব্যবহার, ফিলিস্তিনিদের অধিকারের কোনো তোয়াক্কা না করে দখলকৃত ভূখণ্ডে বসতি স্থাপন, ফিলিস্তিনিদের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ, ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ও ক্ষেত-খামার ধ্বংস করা, জাতিসঙ্ঘের অনেক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ধারাবাহিক উপেক্ষা, ইত্যাদি ঘটনা ফিলিস্তিনিদের ক্ষোভকে উসকে দেয়। ফলে হামাসসহ অন্যান্য সংগঠনের প্রতিবাদ সশস্ত্র প্রতিরোধের রূপ নেয়।
বন্দী ইসরাইলি সেনা করপোরাল গিলাদ শালিতকে মুক্ত করার জন্য ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট ২০০৬ সালে গাজা উপত্যকায় দীর্ঘ ও ব্যাপক সামরিক অভিযানের নির্দেশ দেন। ‘আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই। আমরা সবার কাছেই পৌঁছাব, তিনি যেই হোন না কেন। কেউই রেহাই পাবে না’ Ñ২৭ জুন ২০০৬ সালে তিনি সদম্ভে ঘোষণা করেন। ইউরোপে ইহুদিদের বিরুদ্ধে নাৎসিরা এই ভাষাতেই কথা বলত। ‘কথিত সেই অভিযানে তারা দানবিক তাণ্ডব ঘটায়। তারা আটজন হামাস মন্ত্রীসহ, সংসদের স্পিকার এবং ৩৪ জন এমপিকে গ্রেফতার করে, বোমা মেরে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও ব্রিজ উড়িয়ে দেয় এবং নিরীহ ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। এই সব কাজ কোনো দায়িত্বশীল রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একজন বন্দী সেনার মুক্তির জন্য সদিচ্ছা নয়, বরং নিছক বর্বরতা ও দস্যুতা। সেনাকে মুক্ত করার জন্য তারা আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীর সহায়তা চাইতে পারত। কিন্তু তা নয়, কোনো সমঝোতা বা কূটনৈতিক প্রচেষ্টা নয়, বরং কঠিনতম সন্ত্রাসই তারা পছন্দ করল। ব্রিটিশ কর্তৃত্বাধীন ফিলিস্তিনে সশস্ত্র ইহুদি গ্রুপ ইরগুন, তাদের সার্বিক কৌশল হিসেবে ‘নগর সন্ত্রাসবাদ’ অন্তর্ভুক্ত করেছিল। ইসরাইলি দখদারিত্বের প্রতিরোধে পিএলও এমন একটি সংগঠন। তবে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করার লক্ষ্যে, ১৯৮৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে পিএলও সহিংসতার পথ প্রত্যাখ্যান করে।
বিংশ শতাব্দীতে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব যাদের কেউ কেউ পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তারা সন্ত্রাসের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। আইজাক শামির পরিচালিত ‘দ্য স্টার্ন গ্যাং’ ১৯৪৪ সালে কায়রোতে অ্যাডওয়ার্ড লর্ড ময়িনকে হত্যা করেছিল। উইনস্টন চার্চিল, যিনি ছিলেন আইজাক শামিরের প্রশংসায় উচ্চকণ্ঠ, এ ঘটনায় খুবই ক্ষুব্ধ হন। এই গ্যাং ১৯৪৮ সালে জেরুসালেমে জাতিসঙ্ঘ মধ্যস্থতাকারী কাউন্ট বার্নাডোটকে গোপনে হত্যা করে। শামির তখন প্রচার করছিলেন, ‘ইহুদি নৈতিকতা ও ইহুদি ঐতিহ্য কোনোটিই সন্ত্রাসকে রণনীতির পরিপন্থী মনে করে না। জাতীয় সংগ্রাম নিয়ে ব্যস্ততার মুহূর্তে আমরা নৈতিক দ্বিধাগ্রস্ততা বহু দূরে ছুড়ে ফেলে রাখি। সর্বাগ্রে, আমাদের জন্য সন্ত্রাস হলো, রাজনৈতিক যুদ্ধের অংশ যা বর্তমান পরিস্থিতিতে খুবই যথার্থ।’
১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ সালে চিহ্নিত ইহুদি সন্ত্রাসী কর্তৃক কাউন্ট ফোক বার্নাডটের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর ড. বাঞ্চের নির্দেশে একটি রিপোর্ট তৈরি করা হয়। উল্লেখ্য, বার্নাডটের পর বাঞ্চ ফিলিস্তিনে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ওই রিপোর্টে বলা হয়Ñ ৬ নভেম্বর ১৯৪৪ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ সাল- এই চার বছর সময়ের মধ্যে প্রায় ২৫৯টি চিহ্নিত হামলা পরিচালিত হয়েছে। আইজাক শামিরের নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসী ইহুদি সংগঠন স্টার্ন গ্যাং এসব হামলায় মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ আবাসিক মন্ত্রী (৬ নভেম্বর ১৯৪৪), কাউন্ট বার্নাডটসহ (১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮) অনেক ব্রিটিশ, আমেরিকান ও আরব নাগরিককে হত্যা করে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর, ব্রিটিশ পররাষ্ট্র অফিস এবং বিভিন্ন মার্কিন ও ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এই রিপোর্ট সঙ্কলিত হয়।
১৯৫৩ সালে অ্যারিয়েল শ্যারন ফিলিস্তিনের কিবিয়া গ্রামে শত শত গ্রামবাসীকে গণহত্যা করেন। একই ব্যক্তি সাবরা ও শাতিলা উদ্বাস্তু শিবিরে হাজার হাজার লোককে খুন করেন, যা ’২০ শতকের অন্যতম ঘৃণ্য গণহত্যা হিসেবে বিবেচিত। ১৯৫৬ সালে ‘কাফর কাসেম’ গণহত্যা ইসরাইলি নির্মমতার আরেকটি বড় দৃষ্টান্ত। ওয়াশিংটন পোস্ট এই সংবাদের ক্যাপশনে লেখে- ‘ইসরাইলের কালো অতীতের পাতা উন্মোচন’। ইহুদি সন্ত্রাসী বারুচ গোল্ডস্টেইন হেবরনে মসজিদের অভ্যন্তরে হামলা চালিয়ে ২৯ জন মুসলমানকে হত্যা করেছিল। এ ঘটনায় আহত হন ১৫০ জন মুসল্লি। ইসরাইলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিরাও সন্ত্রাসী ভাষায় প্রতিউত্তর দিচ্ছে। অপরদিকে, ইসরাইলিরা আজো তাদের ‘তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের’ হত্যা অব্যাহত রেখেছে। জাতিসঙ্ঘে আরব লিগের সাবেক দূত ক্লভিস মাকসুদ বলেন, ‘ইসরাইলি সন্ত্রাস শুরু হয় বেগিন ও শামিরের নেতৃত্বে, পরবর্তীতে শ্যারন তা অব্যাহত রাখেন। ব্রিটেন শাসিত ইসরাইল এবং ইসরাইল দখলকৃত ফিলিস্তিনের সমস্যা যে অভিন্ন ও অনুরূপ, এই কথাটি ইসরাইলিরা কিভাবে অস্বীকার করবে।’
মেনাচিম বেগিনের পার্টি ইরগুন ১৯৪৮ সালের এপ্রিলে কিং ডেভিড হোটেল উড়িয়ে দেয় এবং দির ইয়াসিনে ফিলিস্তিনি গ্রামবাসীর ওপর গণহত্যা চালায়। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনসহ অনেক বিশিষ্ট মার্কিন ইহুদি মেনাচিম বেগিনকে ইসরাইলি নাৎসি রূপে অভিহিত করে নিউইয়র্ক টাইমসে চিঠি লেখেন। চিঠিটি ভাষান্তর করে দেয়া হলো-
আলবার্ট আইনস্টাইন এবং ১৮ জন বিশিষ্ট ইহুদি কর্তৃক ইসরাইলি নাৎসিদের নিন্দা জ্ঞাপন (নিউইয়র্ক টাইমসকে লেখা চিঠি, ৪ ডিসেম্বর, ১৯৪৮) -‘আমাদের সময়ের সবচেয়ে বিব্রতকর রাজনৈতিক বিষয়গুলোর অন্যতম হচ্ছে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসরাইল রাষ্ট্রে ‘ফ্রিডম পার্টির ঞহঁধঃ ঐধযবৎঁঃ আত্মপ্রকাশ, যা সংগঠন, পদ্ধতি, রাজনৈতিক দর্শন এবং সামাজিক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নাৎসি ও ফ্যাসিস্ট পার্টির অনুরূপ। এটি ডানপন্থী উগ্র দেশপ্রেমিক সন্ত্রাসী সংগঠনের ওৎমঁহ তারধ খবঁসর ছায়া সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
পার্টির নেতা মেনাচিম বেগিনের সাম্প্রতিক আমেরিকা সফরের উদ্দেশ্য হচ্ছে আসন্ন ইসরাইলি নির্বাচনে তার দলের প্রতি মার্কিন সমর্থন স্পষ্ট করা এবং যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল জায়নবাদীদের সাথে তাদের সম্পর্ক সুদৃঢ় করা। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বেশ কিছু বিশিষ্ট মার্কিন নাগরিক স্বনামে তার যুক্তরাষ্ট্র সফরকে স্বাগত জানিয়েছেন। যারা বিশ্বজুড়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সবসময় উচ্চকণ্ঠ তারা মেনাচিম বেগিনের রাজনৈতিক ইতিহাস ও পরিপ্রেক্ষিত সঠিকভাবে জানার পরও কিভাবে তার নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের সমর্থন ও সহায়ক হতে পারলেন, তা একান্তই দুর্বোধ্য বিষয়।
বেগিনের পক্ষে প্রকাশ্যে জনমত সৃষ্টি করা, তাকে আর্থিক সহায়তা করা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে ফিলিস্তিনিদের মনে এই ধারণা সৃষ্টি হবে যে, মার্কিনিদের একটি বড় অংশ ইসরাইলি ফ্যাসিস্ট শক্তির সহায়ক। সুতরাং এই অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাওয়ার আগে মার্কিন জনগণকে বেগিনের ইতিবৃত্ত এবং তার দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুনির্দিষ্টভাবে অবহিত করতে হবে।
বেগিনের পার্টির প্রকাশ্য ও প্রকৃত চরিত্র এক নয়। আজ তারা স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের পক্ষে তথা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বলছেন বটে, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়েও তারা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে প্রকাশ্যে জনমত সৃষ্টি করছিলেন। মূলত কর্মকাণ্ডের মধ্যেই ফ্যাসিস্ট দলের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশিত হয়ে পড়ে এবং তাদের অতীত কর্মসূচি থেকেই এটি বোধগম্য হবে যে, ভবিষ্যতে তাদের প্রকৃত রূপ কী হবে।
আরব গ্রাম দির ইয়াসিনে তাদের আচরণ এই পার্টির নির্মমতার এক হৃদয়বিদারক দৃষ্টান্ত। প্রধান সড়ক থেকে দূরে ইহুদি ভূমিবেষ্টিত এই গ্রামবাসী কোনো যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়নি, বরং আরব গোষ্ঠীর যারা এই গ্রামকে তাদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল তাদের তারা তাড়িয়ে দিয়েছে। সন্ত্রাসী দল ৯ এপ্রিল এই শান্তিকামী গ্রামবাসীর ওপর আক্রমণ করে। এরা কোনোভাবেই যুদ্ধের প্রয়োজনে কোনো সামরিক লক্ষ্য ছিল না। এই হামলায় গ্রামের বেশির ভাগ অধিবাসী (২৪০ জন) নিহত হন এবং জেরুসালেমের রাস্তায় বন্দী হিসেবে হটিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের কয়েকজনকে বাঁচিয়ে রাখা হয়। বেশির ভাগ ইহুদি সম্প্রদায় এই জঘন্য ঘটনায় আতঙ্কিত হয় এবং ইহুদি এজেন্সিগুলো জর্দানের বাদশাহ আবদুল্লাহর কাছে এই ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়ে টেলিগ্রাম পাঠায়। কিন্তু সন্ত্রাসীরা এই বর্বরোচিত ঘটনার জন্য লজ্জিত হওয়া তো দূরের কথা, এই ন্যক্কারজনক ঘটনায় তারা গর্ববোধ করে, এটি ব্যাপকভাবে প্রচার করে এবং দেশে উপস্থিত সব বিদেশী সংবাদ সংস্থাকে দির ইয়াসিনে তাদের কৃত ধ্বংসযজ্ঞ ও লাশের স্তূপ দেখার আমন্ত্রণ জানায়।
ইতিহাসের চাকা ঘোরে, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে কিন্তু কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। হিটলার ইউরোপের ইহুদিদের হুমকিসহ নির্যাতন-হত্যার মহড়া দিতেন। আর এখন ইহুদিরাই ক্ষমতার দম্ভে ফিলিস্তিনিদের উপর নাৎসি কৌশল অবলম্বন করছে।’
লেখক : সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম