ইসরাইল কেন বারবার গাজায় হামলা চালায়?

মহসীন উদ্দীন আহমেদ | May 20, 2021 03:29 pm
গাজা সিটিতে ইসরাইলি হামলা

গাজা সিটিতে ইসরাইলি হামলা - ছবি : আল জাজিরা

 

থিয়োডর হার্জেলের হাতে ১৮৯০ সালে যে জায়োনিজম সাংগঠনিক রূপ লাভ করে, ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ফিলিস্তিনের বুক চিড়ে ইসরাইলের জন্মের মধ্য দিয়ে তার সাফল্য শুরু হয়। সেই থেকে নিয়ে গত ৭৩ বছরে ইসরাইল যেমন একদিকে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, সেই সাথে জায়োনিজম গোটা দুনিয়ায় শেকড় গেড়েছে প্রতিটা সেক্টরে। আর অন্যদিকে আরবদের রক্তস্রোত ফিলিস্তিনের মাটি শুষ্ক হতে দেয় না কখনো।

ফিলিস্তিনে এখন যে রক্তপাত চলছে, বছরে একবার-দুবার অথবা কয়েক বছর পর পর এরকম অবস্থা দেখা যায়। কিন্তু মাঝের দিনগুলোতে কী ঘটে আর নতুন করে সংঘর্ষ তৈরি কেন হয়, এটা অনেকেই খোঁজ রাখে না। এটা না জানলে এই সমস্যার আগা-গোড়া কিছুই বোঝা যাবে না।

মূলত ইসরাইল ও ফিলিস্তিন আলাদা দুটি রাষ্ট্র না। ফিলিস্তিন এখনো একটা ধারণা বা স্বপ্ন বলা যায়- স্বীকৃত কোনো রাষ্ট্র নয়। রাষ্ট্র ওখানে একটিই- ইসরাইল। পুরো এলাকাই ইসরাইল নিয়ন্ত্রিত। শুধু গাজা ও পশ্চিম তীরের কিছু অংশ শর্তসাপেক্ষে 'ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ' নামে একটা স্বায়ত্তশাসিত কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেয়া হয়েছে ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির শর্তানুযায়ী। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নামকাওয়াস্তে কিছু আর্থিক ও নাগরিক সুবিধা-সম্পর্কিত ক্ষমতা আছে। কিন্তু এর বাইরে নিরাপত্তা, সামরিক বিষয়াদি, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, গণযোগাযোগ, টিভি, রেডিও, আকাশপথ, মোবাইল নেটওয়ার্ক, বাইরের দেশের সাথে যোগাযোগ- সবকিছু ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে।

একটা বিষয় এখানে স্পষ্ট যে ইসরাইলের মূল চাহিদা হলো ভূমি। আর এই সংঘাতের মূলেই রয়েছে ভূমি; এটা মূলত কোনো ধর্মীয় সংঘাত নয়। ইসরাইলের ভূমি দরকার মূলত দুটি কারণে। প্রথম কারণ হলো- ইসরাইলের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হলো পরাশক্তি হওয়া। আর সেজন্য অনেক সামরিক গবেষণাগার ও স্থাপনা প্রয়োজন। সামরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য জন শূন্য ফাঁকা জায়গা প্রয়োজন, সেটা ইসরাইলের বর্তমানে নেই। এজন্য ইসরাইলের আরো ভূমি দরকার। দ্বিতীয় কারণ হলো, দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে ইসরাইলে আসা নতুন নতুন ইহুদির আবাসনের ব্যবস্থা করার জন্য ভূমি দরকার।

ইসরাইল চাইলে গাজা, পশ্চিম তীর পুরোটাই রাতারাতি ইসরাইলের অন্তর্ভুক্ত করে নিতে পারে, সেটা করেছিলও ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময়, কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় এর অধিবাসীদের নিয়ে। ফিলিস্তিনি এলাকাগুলো বেশ ঘনবসতিপূর্ণ। এই এলাকা ইসরাইলের অন্তর্ভুক্ত করলে এর অধিবাসীদেরকেও ইসরাইলের নাগরিকত্ব দিতে হবে। সমস্যাটা সেখানেই। এত বিশালসংখ্যক আরব ফিলিস্তিনিকে নাগরিকত্ব দিলে ইসরাইলের মূল যে লক্ষ্য, ইহুদিবাদী রাষ্ট্র তৈরি করা, সেটি সম্ভব হবে না। বর্তমানে ইসরাইলের ৯২ লাখ জনসংখ্যার শতকরা ২০ ভাগ আরব। এদেরকে নানা কায়দায় দমন করে রাখা হয়েছে যেন এরা কখনো ইসরাইলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যেতে না পারে। কিন্তু গাজা, পশ্চিম তীর ও জেরুসালেমসহ জনসংখ্যা হিসাব করলে আরবদের সংখ্যা হবে আরব-ইসরাইলিদের বর্তমান সংখ্যার দ্বিগুণ, অর্থাৎ শতকরা ৪০ ভাগ। সেক্ষেত্রে প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি আরব জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কঠিন হবে। তাই ইসরাইল বিদ্যমান আরবদেরসহ গাজা, পশ্চিম তীর দখল করার চিন্তা কখনোই করবে না। বরং এমন সব দমন-পীড়ন চালাবে, যেন ফিলিস্তিনিরা তাদের বসতবাড়ি, জমি ফেলে অন্য কোন দেশে চলে যায়, তখন আস্তে আস্তে ওই এলাকাগুলো ইসরাইল তার অন্তর্ভুক্ত করে নেবে।

এবার মূল কথায় আসি। ইসরাইল তার ভূমি ব্যবস্থাপনাটা এমনভাবে সাজিয়েছে যেন ভূমির হস্তান্তর সবসময় একদিকে হয়। অর্থাৎ, আরব বাসিন্দারা ধীরে ধীরে ভূমি হারাতে থাকে আর সেগুলো ইহুদিদের হস্তগত হয়। এই প্রক্রিয়াটা চালানো হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে আর এই যে রক্তপাত- সেটিও এই প্রক্রিয়ারই অংশ। আর পুরো প্রক্রিয়াটা চালানো হচ্ছে সুপরিকল্পিত উপায়ে আইনি কাঠামোর মধ্যে দিয়েই। বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করলে বুঝতে সুবিধা হবে।

আরবদের ভূমি গ্রাস করার সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র হলো Absentee Property Law, 1950। এই আইন অনুযায়ী ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার সময় যেসব আরব তাদের জায়গা-জমি, বাড়ি-ঘর ছেড়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের সব সম্পত্তির মালিক সরকার। যেসব আরব পরে ফিরে এসেছিল, তারাও যেন তাদের বাড়ি-ঘর, জায়গা-জমি ফিরে না পায় সেজন্য এই আইনে 'Absentee' র সংজ্ঞা এভাবে দেয়া হয়েছে যে ২৯ নভেম্বর ১৯৪৭ থেকে ১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮-এর মধ্যে যারা অন্য দেশে চলে গিয়েছিল, কিন্তু পরে ফিরে এসেছে, তারাও Absentee, অর্থাৎ, তাদের জমিও এখন সরকারের।

এই আইনের মাধ্যমে বেশিরভাগ ফিলিস্তিনির জমিই সরকার গ্রাস করে নিয়েছে। আর এখনো সেটি চলমান আছে। প্রায়ই দেখা যায়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাস করা কোনো ফিলিস্তিনির জায়গাকে মিউনিসিপাল কর্তৃপক্ষ absentee property ঘোষণা করে দিয়েছে। অথবা নিজের পূর্বপুরুষদের জমিতে বাড়ি করার জন্য অনুমতি নিতে গিয়ে দেখা যায় ওই জমি Absentee property তালিকায় ঢুকে বসে আছে। সেক্ষেত্রে অনুমতি তো মেলেই না, কিছু দিন পর উচ্ছেদ নোটিশ নিয়ে অস্ত্রশস্ত্রসহ পুলিশ হাজির। বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে সেটি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়, জমি চলে যায় সরকারের খাতায়। এক নিমেষেই পথে বসতে হয়। এসব পরিবারের আশ্রয় হয় কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে না হয় সিরিয়া, জর্ডান, লেবাননের শরনার্থী শিবিরে। Absentee propertyগুলো অর্থ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে কোনো ডেভেলপারকে দেয়া হয় হাউজিংয়ের জন্য যা পরে ইহুদিদের আবাসনের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। Absentee propertyর তালিকা রাতারাতি পরিবর্তন হচ্ছে কিভাবে, সেই প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ নেই; আইনে আপিল করার বিধান থাকলেও সেটা কোনো দিনও গৃহীত হয় না। পশ্চিম তীর, রামাল্লা, পূর্ব জেরুসালেমে এই পদ্ধতিতে ফিলিস্তিনি জায়গা ধীরে ধীরে দখল করা হয়। আবার দেখা যায়, ইহুদি সেটেলাররা ভুয়া, জাল দলিল বানিয়ে কোর্টে মামলা করে দাবি করে যে সে এই জমি ৫০-৬০ বছর আগে কিনেছিল। এসব ক্ষেত্রে কোর্ট চোখ বুজে সেটেলারদের পক্ষে রায় দিয়ে দেয়।

পুরো ইসরাইলেই বাড়ি করার জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের বাড়ি নির্মাণের আবেদন নানা ছুতোয় বাতিল করে দেয়া হয়। অথবা ঝুলিয়ে রাখা হয় মাসের পর মাস। ফিলিস্তিনিরা বেশিরভাগই গরিব, তাদের জায়গাও খুব ছোট হয়। সন্তান যখন বড় হয়, বিয়ে করে, তাদের জন্য ঘর নির্মাণ আবশ্যক হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে অনন্তকাল অপেক্ষা না করে অনুমতি ছাড়াই নির্মাণ করতে হয়। অথবা কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিলেও এমনভাবে নকশা দেয় যে ছোট জায়গায় মোটেও নকশানুযায়ী বাড়ি করা সম্ভব হয় না। বাধ্য হয়ে নকশার বাইরে যেতে হয়। সেক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। বাড়ি বানানো শেষ হলে এসে বুলডোজার দিয়ে সেটি গুঁড়িয়ে দিয়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে জমিটা থাকলেও ওই পরিবার আর্থিক দিক দিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যায়। এরা জমি বেঁচে দিয়ে পালায়। আর ওই জমিগুলো কারা কিনে, সেটা আর না-ই বললাম।

ইসরাইলের ভেতরে প্রায় দেড় শ'র মতো আরব অধ্যুষিত গ্রাম আছে। এখানে বৈষম্যের পদ্ধতি একটু ভিন্ন। আরব গ্রামগুলো একদিকে আকারে ছোট, আর জনসংখ্যাও বেশি। এখানে বৈষম্যের হাতিয়ার হলো Planning And Building Law, 1965। আরব গ্রামগুলোর চারপাশ ইহুদি বসতি দিয়ে ব্লক করে দেয়া হয় যেন এর আয়তন আর ভবিষ্যতে বাড়ানো সম্ভব না হয়। তার ওপর আবার জমির শ্রেণী উল্লেখ করে দেয়া হয়। যেমন কৃষি জমিতে ঘর নির্মাণ করা যাবে না, বিশাল এক মাঠকে 'ওপেন স্পেস' ঘোষণা দিবে, আরেক পুকুরকে সংরক্ষিত জলাধার ঘোষণা করে দিবে, কিছু গাছপালা থাকলে বিশাল জায়গাকে বনাঞ্চল ঘোষণা দিয়ে বলবে- এসব জায়গায় বাড়ি করা যাবে না। এগুলো কিন্তু সরকারি জায়গা নয়, সব আরবদের ব্যক্তি মালিকানার জায়গা। আবার হয়তো আরব গ্রামের পাশ দিয়ে একটা গ্যাসের পাইপলাইন বসিয়ে ঘোষণা দিবে- এর ১৫০ মিটারের মধ্যে কোনো বাড়ি করা যাবে না। এর ফলে বাড়ি করার জন্য যে জায়গাগুলো অবশিষ্ট থাকে- সেটায় বস্তি ছাড়া আর কিছু হয় না। এখানেও পূর্বের মতোই নির্মাণ অনুমতি দেয় না সহজে। আর করলে করার পর এসে ভেঙ্গে দিয়ে যায়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫ সালের শুধু জুন মাসে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ ১৩৪৮টি ভবন ভাঙ্গার নির্দেশ দিয়েছে যার প্রায় সবগুলোই ফিলিস্তিনিদের। শুধু তা-ই না, ২০১৭ সালে আইন সংশোধন করে ভবন ভাঙ্গার সাথে জেল-জরিমানাও যুক্ত করেছে।

এসব বৈষম্যের বয়ান লিখে শেষ করা যাবে না। যতটুকু লিখলাম, এটা শুধু হিমশৈলের চূড়া। শুধু ভূমি নিয়ে দুয়েকটা কথা লিখেছি, এরকম রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে চরম বৈষম্যের মধ্যে দিয়ে বাস করে আরবরা।

সর্বশেষ রক্তাক্ত ঘটনার প্রেক্ষাপট হলো পুর্ব জেরুসালেমের শেখ জারাহ এলাকা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ নিয়ে। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ভাগের ব্রিটিশ পরিকল্পনায় শেখ জারাহ এলাকাটা আরবদের জন্য বরাদ্দ ছিল। ১৯৬৭ সালে যুদ্ধের সময় ইসরাইল এটা দখল করে নেয়। ২০০১ সালে ইহুদি সেটেলাররা সেখানে হামলা চালায়, দাবি করে এই জায়গার মালিক ইহুদিরা। আদালতে গড়ায় বিতর্ক। সেটেলাররা উসমানিয়া আমলের একটা ভুয়া দলিল হাজির করে দাবি করে যে তারা সেই জমি আরবদের থেকে কিনে নিয়েছিল। আরবরাও তুরস্কে রক্ষিত উসমানিয়া আর্কাইভ থেকে একটা চুক্তিপত্র উপস্থাপন করে দেখায় যে ওই জায়গা ইহুদিরা কেনেনি, বরং সরকারের কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছিল শুধুমাত্র। বলা বাহুল্য, আদালত সেটেলারদের পক্ষে রায় দেয়। উল্লেখ্য, Israeli Land and Property Law অনুযায়ী কোনো ইহুদি পূর্ব জেরুসালেমে ১৯৪৮ সালের পূর্বে কোনো জমি কিনে থাকলে তা সে যেকোনো সময় দাবি করতে পারবে, কিন্তু কোনো ফিলিস্তিনি অনুরূপ জমি কিনে থাকলে সেটা দাবি করতে পারবে না। যাহোক, এরপর ওখানে বাস করা ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে সেটেলাররা আসা শুরু করে একে একে।

প্রসঙ্গক্রমে আরেকটা বিষয় উল্লেখ্য, ওখানে বাস করা সব ফিলিস্তিনিরই ইসরাইলের অন্যত্র জমি ছিল যা পূর্বেই সরকার Absentee Law-এর মাধ্যমে দখল করে নেয়া হয়েছে। শেখ জারাহ থেকে উচ্ছেদের সময় তারা ওই জমি ফেরত চেয়েছে, কিন্তু সরকার সেটিও ফেরত দেয়নি। সর্বশেষ ০৯ মে শেখ জারাহ থেকে ১৩টি ফিলিস্তিনি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। আর ফিলিস্তিনিরা বিক্ষোভ শুরু করে যার ফলাফল এখন দৃশ্যমান।

আমরা শুধু সংঘর্ষ হলেই ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যু মিডিয়ায় দেখি। কিন্তু সংঘর্ষের প্রেক্ষাপট দেখি না বা জানি না। রাষ্ট্রের সীমাহীন বৈষম্য আর নিপীড়নই এর সূতিকাগার। রাষ্ট্রীয় ও আইনি কাঠামোর মধ্যে থেকেও যে নাগরিকদের উপর চরম নির্যাতন চালানো যায়, ইসরাইল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সরকার, সংখ্যাগুরু জনগণ, প্রশাসন, আদালত- সবই সেখানে নিপীড়নের একেকটা হাতিয়ার। বৈষম্যের শিকার হতে হতে মাঝে মাঝে যখন ফিলিস্তিনিরা প্রতিবাদমুখর হয়, রাষ্ট্র তখন অস্ত্রধারী উন্মাদ সেটেলার আর সৈন্যদের লেলিয়ে দেয়। আর পশ্চিমা মিডিয়া সুচতুরভাবে সেটাকে দুই পক্ষের 'সংঘর্ষ' দেখিয়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে অনেকটা জাস্টিফাই করে ফেলে।

দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের মধ্যেও এমন অনেকে আছে যারা ভাবে, হামাস রকেট হামলা করার কারণেই ইসরাইল পাল্টা হামলা করে। অর্থাৎ, তারাও সেই 'সংঘর্ষ' থিউরি ভালোই গিলেছে। আসলে রকেট হামলা হলো একটা অজুহাত মাত্র। হামাস গঠিত হয় ১৯৮৭ সালে, রকেট হামলা শুরু করে আরো অনেক পরে। ইসরাইলের দখলদারিত্ব আর নিপীড়ন চলছে সেই ১৯৪৮ থেকে। গাজা থেকে কোন রকেট হামলা না হলেও ইসরাইল একই আচরণ করতো। ইসরাইলের ভাষায় 'শান্তি'র অর্থ হলো নিজের ভূমি ইহুদিদের নিকট ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ অন্যত্র চলে যাওয়া। যতক্ষণ ফিলিস্তিনিরা ওখানে আছে, ততক্ষণ কোনো না কোনো অজুহাতে হামলা চালাতেই থাকবে। রকেট নিক্ষেপ না করলেও বিমান হামলা করে বলবে, তারা ইসরাইলে রকেট হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বিবিসি, ফক্স নিউজ, সিএনএন তো আছেই সেগুলো আমেরিকানদের গেলানোর জন্য।

একটা অপ্রিয় সত্য বলি। হামাসের প্রতিরোধ না হলে কি হতো জানেন? আমার বিশ্বাস, হামাসের প্রতিরোধ না থাকলে এত দিনে ফিলিস্তিনিরা অবশিষ্ট জমিগুলোও হারাত। কিভাবে বললাম? কারণ ইসরায়েলে বিশ্বের মোট ইহুদির মাত্র ৩০ ভাগ বাস করে। ৫১ ভাগ বাস করে আমেরিকায়। এমন অনেক ইহুদিই আছে যারা হামাসের হামলার কারণে ইসরাইলকে নিরাপদ মনে করে না বলে সেখানে যায় না। ফিলিস্তিনিদের দিক থেকে কোনো প্রতিরোধ না থাকলে তারা দলে দলে গিয়ে হাজির হতো ইসরাইলে। আর সরকার তাদের বাড়িঘর বানাতে ফিলিস্তিইনিদের বহু আগেই বিতাড়ন করতো নানা কায়দায়।

ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ কী? আমি নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করি মাঝে মাঝে। আমি রাজনৈতিক বিশ্লেষক বা ভবিষ্যৎ বক্তাও না। সাধারণ দৃষ্টিতে যতটুকু বুঝি তা হলো, ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্বিরাষ্ট্রিক সমাধান আদৌ কোনো দিন হবে না; ইসরাইল-আমেরিকা সেটা হতে দিবে না। বরং জমি গ্রাসের চলমান প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে, সাথে 'মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়া' নামক ড্রামা সিরিয়ালটাও চলতে থাকবে। মোটামুটি শিক্ষিত ফিলিস্তনিরা অন্যত্র চলে যাবে ধীরে ধীরে। রয়ে যাওয়া বাকিরা জমি হারাতে হারাতে আর গণহত্যার শিকার হতে হতে একসময় বুঝবে যে স্বাধীন ফিলিস্তিন কেবল একটা দিবাস্বপ্ন মাত্র। ইসরাইল তখন ফিলিস্তিনিদের দুঃখ কষ্টে ব্যথিত হয়ে তাদের ইসরাইলের নাগরিক হওয়ার প্রস্তাব দিবে। ইসরাইলের বন্ধু পেটমোটা আরব শেখেরা একে 'শান্তির অমিয় বার্তা' নাম দিয়ে এর বাস্তবায়নে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর ইসরাইলে ফিলিস্তিনিরা যে কত সুখে আছে তা প্রমাণ করার জন্য লুসি আহারিশ বা NAS Daily র নাসের হুসেইনের মতো কিছু আরব-ইসরাইলি জায়োনিস্ট এজেন্ট তো থাকবেই। এভাবে ফিলিস্তিন চিরকালের জন্য ইতিহাস হয়ে যাবে। তবে বিবেকবান মানুষের হৃদয়ে ফিলিস্তিন থেকে যাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। হয়তো তাদের আর্তি থেকেই স্রষ্টা পাঠাবেন পরবর্তী কোনো ত্রাণকর্তা।

থিয়োডর হার্জেল দিয়ে শুরু করেছিলাম, থিয়োডর হার্জেল দিয়েই শেষ করি। ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের কৌশল নিয়ে তার নিজের লেখা ডায়েরি আছে অনেকগুলো। এর মধ্যে ১৮৯৫ সালের একটা ডায়রিতে তার একটা লেখা এরকম-

'We shall endeavour to expel the poor population across the border unnoticed—the process of expropriation and the removal of the poor must be carried out discreetly and circumspectly.'


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us