ইসরাইলি এজেন্ট এলি কোহেনের করুণ পরিণতির দিন
এলি কোহেন - ছবি : সংগৃহীত
আজ ১৮ মে। ১৯৬৫ সালের এই দিনে সিরিয়ার সরকার মোসাদ এজেন্ট এলি কোহেনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিল। দামেস্কের মারজাহ স্কয়ারে প্রকাশ্য দিবালোকে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। এখানেই শেষ হয়নি। তার লাশ ছয় ঘন্টা পর্যন্ত প্রদর্শনীর জন্য রেখে দেয়া হয়।
তার পুরো নাম এলি বিন শাওল কোহেন। তিনি অবশ্য এলি কোহেন নামেই বেশি পরিচিত। ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ইসরাইলি এই গুপ্তচর সিরিয়ায় ব্যাপকভিত্তিক গোয়েন্দা কার্যক্রম চালিয়েছিলেন। তার তথ্যের ভিত্তিতেই জর্দান নদীর উপকূলে সিরিয়ান সামরিক সরঞ্জাম ও সামরিক বাহিনীকে তছনছ করে দিয়েছিল ইসরাইল। ইসরাইলি বিমান বাহিনী নিখুঁতভাবে সিরিয়ার অভ্যন্তরে বিমান হামলা চালিয়েছিল।
এলি কোহেনের গোয়েন্দা ভূমিকা তার পরিবার, এমনকি তার স্ত্রীও জানতেন না। এলি কোহেন নিজেকে কামাল আমিন তাবেত নামে পরিচয় দিতেন। এই নামেই তার সমস্ত কাগজপত্র ইসরাইল আগেই প্রস্তুত করে রেখেছিল। তিনি একইসাথে আরবি, হিব্রু, স্প্যানিশ, ইংরেজি ভাষা জানতেন। বিভিন্ন দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করেছেন। আর্জেন্টিনা থেকে তিনি জন্মসূত্রে সিরিয়ান নাগরিক হিসেবে প্রবেশ করেন সিরিয়ায়। পরিচয় দিয়েছিলেন, তিনি বিরাট মাপের ব্যবসায়ী, সিরিয়ান মুসলিম।
সিরিয়ায় সামরিক অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসা প্রেসিডেন্ট আমিন আল হাফেজ ও তার দলের অন্যান্য নেতাকর্মী, সামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, মিডিয়া, সাংবাদিক ও সামাজিক সংগঠনের সাথে অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি গভীর বন্ধুত্ব স্থাপন করতে সক্ষম হন। তিনি বড় মাপের ডোনারও ছিলেন। নানা উপহার, উপকরণ ক্ষমতাবানদের স্ত্রীদের দিতেন। তার সাথে বন্ধুত্ব হয় জর্দান নদী খননকারী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মালিক লাদেনের। তিনি ওসামা বিন লাদেনের পিতা। তার কাছ থেকে জর্দান নদীর গভীরতা, প্রবাহ, নদী নিয়ে সিরিয়ার পরিকল্পনা জানতে পারেন।
উল্লেখ্য, জর্দান নদীর পানির ওপর নির্ভর করে ইসরাইল বেঁচে আছে। তাই জর্দান নদী ইসরাইল যেকোনো মূল্যে তার নিয়ন্ত্রণে রাখবেই। কিন্তু সিরিয়া হচ্ছে ইসরাইলের আজন্ম শত্রু। সিরিয়া কখনোই ইসরাইলের অস্তিত্ব স্বীকার করে না।
যাহোক, সিরিয়ার অভ্যন্তরে নিখুঁত হামলার পরই সিরিয়ান গোয়েন্দারা মোটামুটি নিশ্চিত হন, তাদের ভেতরে ইসরাইলের গোয়েন্দা আছে। এলি কোহেন প্রতিদিন একাধিকবার রেডিওর মাধ্যমে ইসরাইলে তথ্য পাঠাতেন। সমস্যা হলো সিরিয়ান গোয়েন্দা বাহিনী বিভিন্ন রেডিও সিগনালের ভিড়ে আলাদা করে কোনো গোয়েন্দা সিগন্যাল ধরতে পারছিল না।
সোভিয়েত থেকে সিরিয়ান সামরিক বাহিনীর জন্য কেনা কিছু রেডিও সিসটেম ও ডিটেক্টর নতুনভাবে সেট করে সিগন্যাল চেক করার জন্য সিরিয়ান সামরিক বাহিনীর সমস্ত রেডিও স্টেশন ২৪ ঘন্টার জন্য বন্ধ রাখে। সেই বন্ধ সময়েও এলি কোহেন ইসরাইলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিগন্যাল পাঠান। আর তা সোভিয়েত থেকে কেনা ডিটেক্টরে ধরা পড়ে। জায়গা ট্রেস করে দেখা যায়, সেটা এলি কোহেনের বেডরুম। সাথে সাথে কয়েকজন কমান্ডো অফিসার দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে এলি কোহেনের বেডরুমে। সারা রুমের এখানে সেখানে উচ্চ শক্তির রেডিও সিসটেম ও এন্টেনা সেট করা।
কমান্ডোরা এলি কোহেনকে গ্রেফতার করে বেদম টর্চার করে হাড়গোড় ভেঙে দেয়। কিন্তু মুখ থেকে কোনো তথ্য বের করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত এলি নিজেকেই মুসলিমই দাবি করে যান৷
প্রেসিডেন্ট আমিন আল হাফিজ নিজেই ছুটে যান কারাগারে এলি কোহেনের কাছে। তিনি সন্দেহ করেন, এলি নিশ্চিত ইহুদি ও সেইসাথে ইহুদি গুপ্তচর। কারাগারে এসে তিনি এলিকে ডাকেন। আহত এলি প্রেসিডেন্টের সামনে দাঁড়ান। প্রেসিডেন্ট তার চোখের দিকে শিকারী দৃষ্টি রেখে বলেন সুরা ফাতেহা পাঠ করো। এলি সুরা ফাতেহা জানেন তবে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে এলোমেলোভাবে সুরা ফাতেহা পাঠ করে বলেন, আমি স্কুলের পড়ে আর ওভাবে ধর্ম প্রাকটিস করিনি। এজন্য ভুলে গেছি।
হাফিজ নিশ্চিত হয়ে যান, কামাল আমিন তাবেত নামে তিনি যাকে চেনেন তিনি ইহুদি। সুরা ফাতেহার হাত থেকে এলি নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি।
এরপর বিশ্ব মিডিয়া, মানবাধিকার কমিশন, বার্ট্রান্ড রাসেল, বেলজিয়ামের রানী, ইইউ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, সিরিয়ান লিবারেল মিডিয়া সবাই এলির পক্ষে নাকি কান্না শুরু করে। তারা এলির মুক্তির বিনিময়ে সিরিয়াকে অনেক সুযোগ সুবিধা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
ইসরাইল এলির বিনিময়ে সিরিয়ার কৃষি ও চিকিৎসা বিভাগ উন্নয়নে যন্ত্রপাতিসহ কোটি কোটি ডলার সহযোগিতা করতে চায়। তারপর ইসরাইলের কারাগারে বন্দী ২১ সিরিয়ান গোয়েন্দাকে ফেরত দিতে চায় এলির বিনিময়ে। হাফিজের কাছে ক্ষমা চেয়ে অনুরোধ করে ইসরাইল।
সব বাতিল করে দেন আমিন আল হাফিজ। ইসরাইলের ব্যাপারে সিরিয়ার জিরো টলারেন্স এস্টাবলিশ করেন তিনি ১৯৬৫ সালের ১৮ মে। সিরিয়ার দামেস্কের মারজাহ স্কয়ারে প্রকাশ্য দিবালোকে ফাঁসি কার্যকর করে কয়েক ঘণ্টা রেখে দেয়া হয়।
আজ পর্যন্ত এলির লাশ তো দূরে থাক কবরের মাটি পর্যন্ত ফেরত দেয়নি সিরিয়া। কোনো দিন দেয়ার সম্ভাবনাও নেই। এলি কোহেন ইসরাইলের কাছে জাতীয় বীর। ইসরাইল তাকে নিয়ে অতিরঞ্জিতভাবে অপ্রতিরোধ্য গোয়েন্দা হিসেবে তুলে ধরেছেন।
সামগ্রিকভাবে যেটা বোঝা যায় তা হলো, সিরিয়ায় কোনো লিবারেল বাণিজ্যবান্ধব সরকার আশা করে ইসরাইল। কিন্তু সিরিয়ানরা জন্মসূত্রেই ইসরাইলবিরোধী। ইসরাইল যার শত্রু সেই হচ্ছে উম্মাহর বন্ধু আর ইসরাইল যার বন্ধু সে যত বড় কামেল হোক উম্মাহ তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেই।