কেন শেখ জাররাহ
শেখ জাররাহ - ছবি : সংগৃহীত
শেখ জাররাহে উচ্ছেদের প্রশ্নটি অনেক ফিলিস্তিনিদের কাছে স্পষ্টতই ফ্ল্যাশ পয়েন্টে পরিণত হয়েছে। কারণ ইসরাইলি আইন তাদের মৌলিক অধিকার দেয় না। ইহুদিরা ১৯৪৮ সালের আগে কোনো এক সময় মালিক থেকে থাকলে সেই জমি পুনরায় দাবি করতে পারে, তবে ফিলিস্তিনিরা এখনো পর্যন্ত যে জমিতে বাস করছে তা-ও আইনত দাবি করতে পারে না। এটি স্পষ্টতই রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্ন। কার্যত এতে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়, ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার অধিকার নেই এবং তারা কাজ করতে বা শান্তিতে থাকতে পারবে এমন কোনো আশা নেই। এটি অব্যাহত অস্থিরতারই একটি ‘রেসিপি’ বলে সবাই ধরে নিয়েছে।
ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা ছিল একেবারেই পরস্পরবিরোধী। এতে প্রকাশ্যে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়, আর ইসরাইলকে বসতির জন্য পশ্চিম তীরের বেশির ভাগ প্রদান করা হয়। এটি করে ফিলিস্তিনিদেরকে কেবল একটি ক্ষুদ্র এলাকা দেয়া হয় যেটি ইসরাইল দ্বারা বেষ্টিত এবং নিয়ন্ত্রিত থাকবে। এতে অবাক হওয়ার মতো কিছু ছিল না, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে ব্যক্তিগত সম্পর্ক রক্ষাকারী ট্রাম্পের ইহুদি জামাতা কুশনার সৎ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করার চেষ্টা করেননি। এর মাধ্যমে মূলত ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’ ফর্মুলার ইতি ঘটানো হয়েছে।
বাইডেন প্রশাসনের কাছে এখন এক-রাষ্ট্রীয় সমাধানের দিকে এগিয়ে যাবার কথা বলা হচ্ছে। ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের সমাধান প্রশ্নে সাংবাদিক পিটার বাইনার্ট বলেন : ‘নাগরিক সাম্য প্রতিষ্ঠা এখন বিচ্ছিন্নতার লক্ষ্যের চেয়ে বাস্তবসম্মত।’ প্রশ্ন হলো, সেটিও কি সম্ভব যেখানে বংশপরম্পরায় বসতি করা বাড়িঘর থেকে বের করে দিয়ে দখলে নেয়া হচ্ছে। এমনকি, প্রকাশ্যে বোরখা না খোলার জন্য গুলি করে ফিলিস্তিনি কিশোরীকে হত্যা করা হচ্ছে।
শেখ জাররাহ জেরুসালেমের ওল্ড সিটির উত্তরে অবস্থিত, এই অঞ্চলের নামটি মুসলিম সেনাপতি গাজি সালাউদ্দিনের ব্যক্তিগত চিকিৎসকের নামে, যিনি ক্রুসেডারদের কাছ থেকে জেরুসালেম অধিকার করেছিলেন। এটি ফিলিস্তিনি পরিবারের বহু প্রজন্মের বাসস্থান। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে কয়েক লাখ ফিলিস্তিনিকে বাস্তুচ্যুত করা হয়। তাদের মধ্যে অনেকে জর্দানের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলে পালিয়ে যায়। ১৯৫৬ সালে, জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা জর্দান ও ইউএনআরডাব্লিউর সহায়তায় ২৮টি ফিলিস্তিনি শরণার্থী পরিবার শেখ জাররাহে চলে যায়। ১৯৬৭ সালে ইসরাইল শেখ জাররাহসহ বাকি পূর্ব জেরুসালেম দখল করে নেয়। এরপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এটাকে ‘দখলকৃত অঞ্চল’ হিসেবে বিবেচনা করে যেখানে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অনুসারে, ইসরাইলের আইন চলে না। আর এই জেরুসালেমকে ফিলিস্তিনিরা তাদের ভবিষ্যতের রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে কল্পনা করে।
ইসরাইল ১৯৭০ সালের ‘সম্পদ আইন’ পাস করার কয়েক দশক পরে, যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক নাহালাত শিমন সংগঠনসহ ইহুদিপন্থী বন্দোবস্তকারীরা শেখ জাররাহে জমি দাবি করার জন্য একের পর এক মামলা শুরু করে। এ কারণে জাতিসঙ্ঘের অনুমান, পূর্ব জেরুসালেমজুড়ে প্রায় এক হাজার ফিলিস্তিনি উচ্ছেদের ঝুঁকিতে রয়েছে।
ফিলিস্তিনি বাসিন্দারা বলেছেন যে, ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীরা এই শহরে উদ্দেশ্যমূলকভাবে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দখল করতে আসা এক ইহুদি বাড়ির অধিবাসী ফিলিস্তিনি মহিলাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি যদি আপনার বাড়ি চুরি না করি, তবে অন্য কেউ এটি চুরি করবে।’ অধিকার গোষ্ঠীগুলো বলেছে, শেখ জাররাহে যা ঘটছে তা ফিলিস্তিনিদের সাথে বৈষম্যমূলক ইসরাইলি ভূমি দখল অনুশীলনের প্রতীক। জাতিসঙ্ঘ গত সপ্তাহে ইসরাইলকে সতর্ক করে, ফিলিস্তিনিদের স্থানান্তর আন্তর্জাতিক মানবিক আইনে নিষিদ্ধ এবং এটি যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসওম্যান ইলহান ওমর, ইন্ডিয়ানার আন্দ্রে কারসন এবং মিশিগানের রাশিদাত লাইব এক বিবৃতিতে বলেছেন, কয়েক দশক ধরে, আমরা একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের জন্য লিপ সার্ভিস দিয়েছি; ভূমি দখল, বসতি সম্প্রসারণ এবং জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি অব্যাহত রেখে ফিলিস্তিনিদের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
ইসরাইল শেখ জাররাহ থেকে প্রায় এক মাইল দূরে আল-আকসা মসজিদে পবিত্র রমজান মাসে ধর্মীয় সমাবেশে অপ্রয়োজনীয় বিধিনিষেধ আরোপ করে এবার। ইসরাইলি পুলিশ আল আকসায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গ্রেনেড এবং রাবার বুলেট ব্যবহার করেছে। ফিলিস্তিন রেড ক্রিসেন্টের মতে শত শত লোককে ইসলামের এই তৃতীয় পবিত্রতম স্থানে আহত করা হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় হামাস গাজা উপত্যকা থেকে ইসরাইলে রকেটের একটি ‘ব্যারেজ’ নিক্ষেপ করে সাড়া ফেলে দেয়।
ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলন ‘হামাস’ ফিলিস্তিনের সাম্প্রতিক নির্বাচন বাতিল করার সিদ্ধান্তে এমনিতেই ক্ষুব্ধ। এরপর আল আকসায় হামলা আর শেখ জাররাহের ভূমি দখলের বিরুদ্ধে তারা সরব হয়। হামাস রকেট হামলা করে পূর্ব জেরুজালেমের ঘটনার ব্যাপারে বার্তা দেবার চেষ্টা করেছে। হামাসের সরব হবার জন্য এমন একটি পরিস্থিতি নেতানিয়াহু ইচ্ছা করেই সৃষ্টি করেছেন বলে মনে হচ্ছে।