শিশুর থ্যালাসেমিয়া : সহজে চেনার উপায়
শিশুর থ্যালাসেমিয়া : সহজে চেনার উপায় - ছবি : সংগৃহীত
আমাদের আশপাশে অনেক শিশুই কিন্তু থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। এদের চেহারার অন্যদের থেকে একটু আলাদা, গোলগাল মুখ, নকটা চ্যাপ্টা, পেটটা বড় ফোলা ফোলা ও চাকা দেখা যায়। এদের মাসে কয়েকবার করে রক্ত পরিসঞ্চালন করতে হয়। এদের রক্তের জন্য মা-বাবার অনুরোধ অনেকেই শুনেছেন। থ্যালাসেমিয়া একটি রক্তরোগ। জন্মগতভাবে এটি দেখা দেয়। বাবা ও মা দুজনই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে সন্তান থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। কোন একজন পুরোপুরি সুস্থ থাকলে সন্তান এ রোগ দেখা দেয় না। পুরোপুরি প্রতিরোধ যোগ্য এ রোগ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন শুধুই সচেতনতা। ৮ মে পালিত হয় বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে বিশ্বে থ্যালাসেমিয়া মারাত্মক আকার ধারণ করবে। আজকের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপের জায়গা দখল করে নিবে এটি। আমাদের দেশেও এটি একটি জাতীয় সমস্যায় পরিণত হবে। কিন্তু তার পরও এ ব্যাপারে কারোই নেই মাথাব্যথা। নেই কোনো উদ্যোগ। বর্তমানে দেশে এ রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থা অপ্রতুল, চিকিৎসার জন্য বাইরের দেশ থেকে আনা একমাত্র ওষুধের ওপর নির্ভর করতে হয়। এমনকি রোগ নির্ণয় ব্যবস্থাও নেই ঢাকা শহরের বাইরের শহরগুলোতে। এ রোগীদের জন্য নেই প্রয়োজনীয় রক্তের সংস্থান। এ রোগ সচেতনতায় নেই কোনো উদ্যোগ। এ অবস্থায় রোগটিকে জাতীয় সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করে এ রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিজ্ঞানীরা দেখতে পান যে এ রোগের প্রাদুর্ভাব মেডিটেরিয়ান (ভূমধ্যসাগরীয়) অঞ্চলে বেশি। এটির নামকরণও কিন্তু হয়েছে এ অঞ্চলের নামানুসারে। সিসিলি, মালাটা, সারডিনিয়া, সাইপ্রাস অঞ্চল খুব বেশি পরিমাণে থ্যালাসেমিয়া রোগী পাওয়া যেত। ইউরোপের মধ্যে গ্রিস ও ইতালিতে এ রোগ মোটামুটি দেখা যায়। দিন দিন দক্ষিণ এশিয়ায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। বর্তমানে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাহক মালদ্বীপে মোট জনসংখ্যার ১৮ ভাগ। এরপরই সাইপ্রাস ১৬ ভাগ। বাংলাদেশে প্রায় ৭ ভাগ। দেশে প্রায় প্রতি বছর ৫-৭ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মায়। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও মনে করা হয় দেশে প্রায় চার লাখ রোগী আছে। বাহক আছে এক কোটির বেশি। বাংলাদেশকে মনে করা হয় থ্যালাসেমিয়ার মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। কিন্তু সে হিসেবে নেই প্রচারণা, নেই সচেতনতার সৃষ্টির চেষ্টা। নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা, এমনকি রোগ নির্ণয় করার ব্যবস্থাও অপ্রতুল। নেই জাতীয় কোনো প্রোগ্রাম। রোগ নিশ্চিত করে নির্ণয়ের জন্য হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস করা যায় ঢাকার হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে। সরকারিভাবে এটি দু-একটি প্রতিষ্ঠানে করা সম্ভব হয়। ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে এ রোগ নির্ণয়ের জন্য নেই কোন ব্যবস্থা।
এ রোগীদের নিয়মিত রক্ত পরিস লন করতে হয়। বর্তমানে দেশে প্রতিবছর প্রায় ৫ লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হলেও রক্তের প্রাপ্যতা কম। রক্ত দিতে না পারায় রোগীদের অবস্থা দিন দিন খারাপ হয়ে যায়। এমনকি অনেকে মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। দেশে এখনো ১৩ ভাগ ডোনার হেপাটাইটিস বি ও সি-তে আক্রান্ত। রক্ত না পাওয়ায় এ ডোনারদের রক্ত দেহের নিতে বাধ্য হয় রোগীরা। ফলে এরা আক্রান্ত হয় হেপাটাইটিস বি ও সি-এর মতো প্রাণঘাতী রোগে। রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করতে সাধারণ জনগণের মধ্যে নেই কোনো প্রচারণা। রক্তদান এখনো সাধারণ জনগণের কাছে একটি ভীতিকর ব্যাপারে পরিগণিত। অথচ যে কোনো সুস্থ লোক প্রতি চার মাস পরপর রক্ত দিতে পারেন। এ প্রচারণার অভাব খুব বেশি। এজন্য গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণার প্রয়োজন।
দেশে হাজার হাজার প্রকার ওষুধ তৈরি হলেও এ রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত চিলেশন থেরাপির ওষুধও কিন্তু এদেশে তৈরি হয় না। দেশে আন্তর্জাতিক মানের ওষুধ কারখানা থাকলেও এ ওষুধ কেন তৈরি হয় না তা জানে না কেউ। এ রোগের চিকিৎসায় পুরোপুরি বাইরের দেশের ওপর নির্ভর করতে হয়। ফলে ওষুধের দাম পড়ে বেশি। তবে সরকার এ ওষুধের ওপর শুল্ক বাদ দেয়ায় রোগীদের কিছুটা হলেও উপকার হয়েছে। খুবই ব্যয়বহুল বলে গবির রোগীদের মোটামুটি মরতে হয় বিনা চিকিৎসায়। এক হিসেবে দেখা গেছে এ রোগের চিকিৎসায় বছরে ৫০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়।
গবির জনগোষ্ঠীর পক্ষে এটি বহন করা কল্পনাতীত। সরকার চিলেশনে ব্যবহৃত ওষুধ গরিবদের মধ্যে বিনামূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা করলে রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় অনেকাংশে কমে যাবে। সেই সাথে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা ব্যবস্থা সহজলভ্য করতে হবে। প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এ রোগীদের রেজিস্টার করে হিসাব রাখতে হবে ও হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিসের ব্যবস্থা সহজলভ্য করতে হবে।
শুধু সচেতনতার মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ করা গেলেও এখন পর্যন্ত এ রোগ নিয়ে কোন ধরনের প্রচারণা দেখা যায় না। বিয়ের আগে বাহক নির্ণয়ে স্ক্রিনিং পরীক্ষার জন্য নেই সরকারি পদক্ষেপ। ফলে এদিন দিন দেশে এ রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। আর দেরি নয় মহামারী হওয়ার আগেই পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। এজন্য শুধু সরকার নয় এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সবাইকেই।