মরিয়মের হাসি এবং ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ

হামিদ মীর | May 17, 2021 07:58 pm
মরিয়ম আফিফি

মরিয়ম আফিফি - ছবি : সংগৃহীত

 

গোটা বিশ্ব দেখল। একজন একাকী তরুণীর বিজয়সুলভ হাসি জালিম রাষ্ট্রের অহমিকাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। যখন ওই নিরস্ত্র তরুণীর হাতে কড়া পরিয়ে তা কোমরের পেছনে বাঁধা হয়, তখন তিনি না কেঁদেছেন, না চিৎকার করেছেন, না অনুনয় বিনয়ে ছেড়ে দেয়ার জন্য প্রার্থনা করেছেন। বরং তিনি জালিম সেনাদের দিকে তাকিয়ে হাসতে শুরু করে দেন। আর দূর থেকে কোনো এক ক্যামেরার চোখ ওই তরুণীর হাসি ধারণ করে নেয়।

এরপর এই হাসি টুইটার, ফেসবুক, ইউটিউব, টেলিভিশন পর্দা ও পত্রিকার মাধ্যমে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তেই ক্ষমতাধরদের ভবনগুলোতে কম্পন শুরু হয়ে যায়। তাদের কাছে নিজেদের বন্দুক, ট্যাংক ও যুদ্ধজাহাজগুলোকে এক নিরস্ত্র তরুণীর হাসির সামনে অকার্যকর মনে হতে থাকে। নিজের একটি হাসির মাধ্যমে জালিমের পরাজয়ের ঘোষণা দানকারী ওই তরুণীর নাম মরিয়ম। রমজানুল মুবারকের শেষ দশকে জালিম ইসরাইলি রাষ্ট্রের দখলদার বাহিনী অধিকৃত ফিলিস্তিনের অসহায় ও অপারগ মুসলমানদের ইবাদতে হস্তক্ষেপ শুরু করলে ওই মুসলমানরা প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ শুরু করেন। এমনই এক প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ পূর্ব জেরুসালেমের শেখ জাররাহ অঞ্চলেও হচ্ছিল। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর অন্যতম চিকিৎসক শেখ জাররাহর নামে এলাকাটির নামকরণ করা হয়েছে।

শেখ হুসামুদ্দীন আল-জাররাহ জেরুসালেম বিজয়ের পর সালাহুদ্দীন আইউবীর সাথে ফিলিস্তিনে এসেছিলেন। মসজিদে আকসার প্রতি গভীর ভালোবাসার কারণে তিনি এখানকারই বাসিন্দা হয়ে যান। যে অঞ্চলে তাকে কবরস্থ করা হয়, সে অঞ্চলকেই বর্তমানে ‘শেখ জাররাহ’ বলা হয়। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল জেরুসালেমের পশ্চিম অঞ্চল দখল করে নিলে এখানকার বহু মুসলমান ঘরবাড়ি ছেড়ে পূর্ব জেরুসালেমের শেখ জাররাহ অঞ্চলে চলে আসেন, যা জর্দানের তত্ত্বাবধানে ছিল। ১৯৬৭ সালে এই অঞ্চলও ইসরাইল দখল করে নেয়। গত কয়েক বছরে ইসরাইলি রাষ্ট্র এখানকার মুসলমানদের কাছ থেকে তাদের ঘরবাড়ি ও বাজার ছিনিয়ে নিতে শুরু করে দিয়েছে এবং শেখ জাররাহতে ইহুদিদের বসতি গড়ে তোলা হচ্ছে। শেখ জাররাহর মুসলমানরা জোরপূর্বক বিতাড়নের আগে থেকেই দুশ্চিন্তায় ছিলেন। এরই মধ্যে ২৭ রমজানুল মুবারক ঘনিয়ে এলে ইসরাইলি বাহিনী মসজিদে আকসায় তারাবিহ নামাজে বিশৃঙ্খলা শুরু করে দেয়। এই বাহিনীর হামলার বিরুদ্ধে শেখ জাররাহতেও মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে আসেন।


মসজিদে আকসার লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে শেখ জাররাহতে বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকলে ইসরাইলি সিক্যুরিটি ফোর্স তাদের অশ্ববাহিনীর দলকে ওই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর লেলিয়ে দেয়। অশ্ববাহিনীর হামলায় পলায়নরত এক ফিলিস্তিনি শিশুকে ইসরাইলি বাহিনী ধরে ফেলে। তারা তাকে বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারতে থাকে। ওই শিশুকে মারতে দেখে মরিয়ম থেমে গেলেন। তিনি ফিলিস্তিনি শিশুকে নির্যাতন থেকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করেন। এ সময় এক ইসরাইলি সেনা মরিয়মকে তার মাথার হিজাব ধরে টান মারে এবং তাকে মাটিতে ফেলে দেয়। তিন-চারজন সেনা তাকে নিজেদের থাবায় নিয়ে রাস্তাতেই মারতে শুরু করে দেয়। তাকে ছেঁচড়িয়ে নিজেদের বর্ম আচ্ছাদিত গাড়ির দিকে নিয়ে যায়। যখন তাকে রাস্তায় ছেঁচড়ানো হচ্ছিল, তখন একজন সাংবাদিক তার ওপর নির্যাতনের ছবি তোলা অবস্থায় তার নাম জানতে তাকে প্রশ্ন করে ছিলেন। তিনি বলেন, আমি মরিয়ম। কিছুক্ষণের মধ্যে এলাকার মানুষেরা জানান, এ হচ্ছে মরিয়ম আফিফি। মরিয়মকে গ্রেফতার করে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে আগে থেকে কয়েকজন ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীকে কোমরের পিছে হাতকড়া লাগিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছিল।

মরিয়ম সুযোগ পাওয়ামাত্রই হিজাব ঠিক করে নেন। কিন্তু পর মুহূর্তেই তাকেও হাতকড়া লাগিয়ে দেয়া হয়। যখন তার হাত কোমরের পিছে বাঁধা হচ্ছিল, তখন তিনি হাসতে শুরু করে দিলেন। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একজন সাংবাদিক তার ক্যামেরায় এ দৃশ্য রেকর্ড করে নিয়েছেন। সাংবাদিক দেখেছেন, মরিয়মের হাসি ইসরাইলি বাহিনীকে বিস্মিত ও বিমর্ষ করে ফেলেছে। ওই সাংবাদিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বর্ম আচ্ছাদিত গাড়ির কাছাকাছি গিয়ে মরিয়মের ছবি তোলা শুরু করে দেন। মরিয়ম স্পষ্ট ইংরেজি ভাষায় ইসরাইলি বাহিনীকে প্রশ্ন করতে থাকেন, আমার অপরাধ কি শুধু এটা যে, আমি একজন শিশুকে তোমাদের নির্যাতন থেকে বাঁচাচ্ছিলাম? সেনারা নিশ্চুপ। মরিয়ম তাদের উদ্দেশে আবার বলেন, একটু ভাবো, যখন তোমরা শিশু ছিলে, তখন কি তোমরা এমনই হতে চেয়েছিলে, আজ যেমনটা হয়েছ? সেনারা নিশ্চুপ থাকে। মরিয়ম আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে বলেন, তোমরা জালিম। তোমাদের লজ্জা পাওয়া উচিত। সেনাদের মাথা নিচু হয়ে গেল। আর শেকলে বাঁধা মরিয়ম তাদের ওপর হয়ে গেলেন জয়ী।

এক ফিলিস্তিনি সাংবাদিক মরিয়মের এক বার্তাসহ এই ভিডিও আমার কাছে পাঠিয়েছেন। তিনি বার্তায় বলেছেন, ‘ভাইজান, ২০০৯ সালে আপনি গাজার ধ্বংস নিজ চোখে দেখেছেন। ইসরাইল ২০১৪ সালে গাজাকে দ্বিতীয়বার ধ্বংস করেছে। আর এখন ২০২১ সালে গাজা আবার ইসরাইলি বোমাবর্ষণে ধ্বংস হচ্ছে। ভাইজান, আমাদের এবারের ঈদ লাশ ওঠাতে আর দাফন করতে কেটে যাবে। কিন্তু আমাদের এক বোন মরিয়ম আফিফির এই হাসিকে দেখুন। এই হাসি ঘোষণা করছে, ‘শেষ বিজয় আমাদের হবে। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’

আমার ফিলিস্তিনি বন্ধুর বার্তা বারবার পড়লাম এবং মরিয়মের হাসি নিয়ে চিন্তা করলাম। ওই হাসির পেছনে আমি কোনো কল্পকাহিনী দেখতে পেলাম না। এই হাসি এক চরম বাস্তবতা। আজ ওই লোকেরা এই হাসির বাস্তবতা অনুধাবন করতে পারবে না, যারা শক্তির সামনে অস্ত্র সমর্পণকে বড় কৌশল মনে করে। এই হাসির রহস্য শুধু তারাই বুঝতে পারবেন, যারা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখেন। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের সূরা আলে ইমরানে (৫৪ নং আয়াতে) বলেন, ‘এবং তারা চক্রান্ত করেছে। আর আল্লাহও কৌশল অবলম্বন করেছেন। আর আল্লাহ হচ্ছেন সর্বোত্তম কৌশলী।’

২০২১ সালের রমজানুল মুবারকের শেষ দিনগুলোতে ইসরাইল ভেবেচিন্তে পরিকল্পিতভাবে মসজিদে আকসার লাঞ্ছনা করেছে, যাতে ফিলিস্তিনিদের মনোবল ভেঙে যায়। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা মরিয়ম আফিফিসহ অগণিত মজলুম ফিলিস্তিনিকে এ সাহস ও মনোবল দিয়েছেন যে, তারা ইসরাইলের বন্দুক ও ট্যাংকের সামনে অকুতোভয় সটান দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ইসরাইলি হামলার জবাবে হামাসও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করেছে। ওই হামলাতেও কিছু নারী-শিশুর ক্ষতি হয়েছে। হামলা যেই করুক, নারী-শিশুর ওপর জুলুম না হওয়া উচিত। মোট কথা, ইসরাইল এ বার্তা পেয়ে গেছে, তারা যতই মুসলিম দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করুক এবং ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যতই শক্তি ব্যবহার করুক না কেন, ফিলিস্তিনিদের মুক্তি আন্দোলন শেষ হবে না। ফিলিস্তিনিরা বিশ্বজুড়ে মজলুমদের প্রতিনিধিত্ব করছে। ফিলিস্তিন হচ্ছে কাশ্মির। আর কাশ্মিরও হচ্ছে ফিলিস্তিন। ফিলিস্তিনও জিতবে, কাশ্মিরও জিতবে। মরিয়মের হাসি তাদের সবার মুখে একটি থাপ্পড়স্বরূপ, যারা আমাদের ইসরাইলের সাথে বন্ধুত্বের পরামর্শ দেয়। মরিয়মের হাসি বিজয়ের ঘোষণা। এ ঘোষণা আজ আপনার কাছে কল্পকাহিনী মনে হবে; কিন্তু বাস্তবরূপ অবশ্যই প্রকাশ পাবে। তবে মরিয়ম জিতে গেল।

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ১৩ মে ২০২১ থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com

লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট; প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us