কালাপানির কালাকানুন : আন্দামানের করুণ ইতিহাস

সাবিনা আহমেদ | May 17, 2021 07:36 pm
আন্দামানের কারাগার

আন্দামানের কারাগার - ছবি : সংগৃহীত

 

আমরা যদিও ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহকে প্রথম ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহ বলে গণ্য করি, কিন্তু আদতে ১৭৬৪ সাল থেকে ১৮৫০ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ বাহিনীর অভ্যন্তরে অন্তত ১৮টি সিপাহী বা সেনা বিদ্রোহ হয়েছিল। আর এসব সেনা বিদ্রোহের প্রথমটা করেছিল বাংলার সেনারা। বাংলা মানে কেবল বর্তমান বাংলাদেশ নয়- মোগল আমলে বাংলা সুবাহ বলতে যে অঞ্চল বোঝায় ওই অঞ্চল।

বলিউড আর ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে আজকাল আমরা কেবল ভগবৎ সিং, মঙ্গোল পাণ্ডে, সুভাষ বসু, গান্ধী, নেহরু, জিন্নাহ প্রমুখ ব্রিটিশবিরোধী নেতা কর্মীদের নাম জানি। এদিকে ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেছে নাম না জানা অনেক মুসলমান আলেম, সেনা, আর লোকজন।

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা বিদ্রোহীদের লোকালয় থেকে দূরে সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে করে তারা আর কোনো দিন ফের বিদ্রোহ করতে না পারে বা অন্যকে বিদ্রোহী বানাতে না পারে। এর জন্য তারা বেছে নেয় আন্দামান দ্বীপ।

দ্বীপান্তরিত হতভাগাদের অনেকেই ছিলেন মুসলমান। যাদের অনেকে ছিলেন আলেম, শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী, সমালোচক, আর্টিস্ট। তাদের সংখ্যা ৫-৬ হাজারের কম হবে না। যাদের জীবনের একাংশ এখানে কেটেছে অত্যাচার, ক্ষুধা আর নিঃসঙ্গতায়। বন্দীদের এখানে দাসের মতো কাজ করানো হতো। অনেকে পাগল হয়ে যেতেন, আবার অনেকে জীবন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করতেন।

প্রথম যে বন্দীকে আন্দামানে দ্বীপান্তর করা হয়েছিল উনি হচ্ছেন হায়দরাবাদের মক্কা মসজিদের ইমাম মৌলবি আলাউদ্দিন হায়দার। তিনি সিপাহী বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশ রেসিডেন্সি আক্রমণের নেতা ছিলেন। ব্রিটিশেরা এই আক্রমণের জন্য প্রথম যাকে ফাঁসিতে ঝোলায়, তার নাম তুররুম খান। ১৮৫৮ সালের ১০ মার্চে জেলার বা কারা পরিদর্শক জেপি ওয়াকারের তত্ত্বাবধানে ১০ জন সিপাহী বিদ্রোহীকে এখানে দ্বীপান্তর করা হয়।

ব্রিটিশরাজের একমাত্র গভর্নর জেনারেল লর্ড মেয়োকে এই আন্দামানেই হত্যা করেছিল শের আলী। শের আলীকে অন্য আরেক হত্যার দায়ে আন্দামানে দ্বীপান্তর করা হয়েছিল। লর্ড মেয়ো আন্দামান পরিদর্শনে এলে শের আলী লর্ড মেয়োকে পিছন থেকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেন। লর্ড মেয়োকে হত্যার দায়ে শের আলীর ফাঁসি হয়। ফাঁসিতে ঝোলার আগে শের আলী বলেন, 'ভাইসকল, আমি তোমাদের সকলের শত্রুকে হত্যা করেছি, আর তোমরা সাক্ষী থাকো যে আমি একজন মুসলমান।' এরপর কলেমা পড়তে পড়তে তার ফাঁসি কার্যকর হয়।

এখানে দণ্ডপ্রাপ্ত একজন বাঙালি মুসলমান নারীও ছিলেন। তার নাম রাজিয়া। কোন কারণে তাকে দ্বীপান্তর করা হয়েছিল আমার জানা নেই। কেবল নামটা পেয়েছি, আর যেহেতু এখানে বন্দীদের সবাই বিপ্লবী ছিল তাই ধরে নেয়া যায় যে রাজিয়া বিপ্লবী ছিলেন।

১৮৫৮ থেকে ১৮৯৩ সাল পর্যন্ত এখানে দ্বীপান্তরিত রাজবন্দীদের জন্য তেমন কোনো কারাগার নির্মাণ করা না হলেও এটা ছিল বন্দীদের জন্য ওপেন কারাগার। কিন্তু কয়েক দশকে নিষিদ্ধ বন্দীদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়লে পোর্ট ব্লেয়ারে তাদের থাকার জন্য একটি উচ্চ-সুরক্ষাসম্পন্ন কারাগার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশরাজ। ১৩ বছর ধরে বন্দীরা নিজের হাতে নিজেদের জন্য এই ভয়ানক এই কারাগার তৈরি করতে বাধ্য হয়। কারাগারের নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯০৬ সালে।

কারাগারের নাম সেলুলার জেল, একে এমনভাবে বানানো হয় যেন বন্দীরা একে অপরের সংস্পর্শে আশা তো দূরের কথা মুখ পর্যন্ত দেখতে না পারে, এখান থেকে কোনো অবস্থাতেই যেন পালাতে না পারে। সেলুলার জেলের বিশাল তিনতলা কাঠামোর কেন্দ্রে আছে একটি লম্বা ওয়াচ টাওয়ার, যাকে ঘিরে ছিল সাতটি দীর্ঘ সঙ্কুচিত লম্বা উইং, প্রতিটি উইংসে একক আয়রন-গেটেড ইন্ডিভিডুয়াল সেলের সংখ্যা ৬৯৩। একেকটা সেলের আয়তন ৪.৫ মিটার বাই ২.৭ মিটার। এখন কেবল তিনটি উইং এখনো টিকে করেছে, বাকিগুলো ভূমিকম্পে ভেঙ্গে পড়েছে অথবা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে।

কারাগারের এসব কক্ষে বন্দীদের ওপর অমানবিক আচরণ করা হতো। সেলগুলোতে বায়ু চলাচলের জন্য কেবল একটি করে ছোট জানালা ছিল। ডানাগুলোতে আলো দেয়ার ব্যবস্থা ছিল না, ছিল না কোনো বেসিক টয়লেট। এর জন্য বন্দীদের দুটি মাটির পাত্র সরবরাহ করা হতো। একটি খাবার গ্রহণের জন্য এবং একটি টয়লেট হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। নিজেদের প্রশ্রাব পায়খানা সাথে রেখেই তাদের খাওয়া দাওয়া ঘুম যেতো হতো। বর্ষাকালে প্রতিটি কক্ষে পানি ঝরত একটু একটু করে, স্যাঁতেস্যাঁতে এই আবহাওয়ায় অনেক বন্দী অসুস্থ হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যেত।

বন্দীরা তাদের অবস্থানের উন্নয়ন আর চিকিৎসার জন্য বিদ্রোহ পর্যন্ত করেছিল বেশ কয়েকবার। কিন্তু তেমন কোনো লাভ হয়নি। এরপর একসময়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আন্দামান জাপানিদের হাতে এসে পড়লে সেখানে নেতাজি সুভাষ ঘোষ স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেন। পরে ফের আন্দামান ব্রিটিশদের হাতেই ফিরে যায়।

বিপ্লব কোনো সময় সহজ হয় না। ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীরা আন্দামানে যে ভয়াবহতার মুখোমুখি হয়েছিল তাদের অনেকেই ভারতের স্বাধীনতার মুখ কোনো দিন দেখেননি। তাদের অনেকের নাম আজ কেউ জানে না। কোনো কোনো জনগোষ্ঠীর নাম ইচ্ছা করে নেয়া হয় না কোনো সংবাদ কিংবা লেখালেখিতে। কিন্তু তাই বলে তাদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি।

'আহ কেয়া ইয়ে উম্মিদো পে ডালা পানি
জিন্দেগি ভার হামে ভেজ কে কালাপানি।'
- রামপ্রাসাদ বিসমিল


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us