টিকার রাজনীতিতে কে কোথায়?
ট্রাম্প মোদি ও বাইডেন - ছবি : সংগৃহীত
কোয়াড-টিকার ভালো-মন্দ বিচার
চীন না আমেরিকা- আমাদের জন্য কে ভালো- এনিয়ে আমাদের ব্যক্তিগত আগ্রহ, লাভালাভ অথবা ভালো-মন্দ বিচারবোধ থাকতে পারে। কিন্তু এটা ব্যক্তিগত বা সাবজেকটিভ বোধবিচার। আজকের আলোচনার বিষয়টার বিচার নৈর্ব্যক্তিক বা অবজেকটিক হতে হবে। তাতে এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটার সহজ সমাধান পাওয়া যেতে পারে।
করোনার টিকা জিনিসটা শেষ পর্যন্ত গরিব-বড়লোকের টিকা হয়েই হাজির হয়ে গেল। আবার একই সাথে তা গ্লোবালি এক ভুয়া এম্পায়ার আর উপযুক্ত এম্পায়ারের দাবি হিসাবে হাজির হয়ে গেল।
গরিব-বড়লোকের টিকা বলতে সর্বসাকুল্যে দুনিয়ায় ব্যবহৃত টিকাগুলো হলো একদিকে ফাইজার, মর্ডানা আর জনসন। অন্যদিকে - এস্টোজেনিকা, সিনোভ্যাক, সিনোফার্মা, স্পুটনিক, কোভ্যাক্সিন ইত্যাদি। এর মধ্যে প্রথম তিনটা - মানে ফাইজার, মর্ডানা, জনসন হল বড়লোকের টিকা। কারণ এর দাম অনেক বেশি আর এর চেয়েও বড় কথা হল এর সংরক্ষণের তাপমাত্রা রক্ষা করা খুবই কঠিন। এদের দাম ২০ থেকে ৩৩ ডলারের মধ্যে। আর সংরক্ষণ তাপমাত্রা (-১৫) থেকে (-৮০) ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে। যেখানে গরিব গোত্রের টিকাগুলোর প্রায় সবই ৪ ডলারের নিচে আর সংরক্ষণ তাপমাত্রা ২-৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। সাধারণের বুঝার ভাষায় বললে, বাসায় আমরা যে ধরণের কমন ফ্রিজ ব্যবহার করি (ডিপফ্রিজ না) সেটাই গরীবের ভ্যাকসিনগুলো সংরক্ষণের জন্য যথেষ্ট। আর বড়লোকের ভ্যাকসিন আমাদের মত দেশে যেখানে গরমের সময় তাপমাত্রা +৪০ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠে যাওয়ার সম্ভাবনা সেখানে সংরক্ষণ কঠিন। তাই বড়লোকের ভ্যাকসিন আমরা বিনা-পয়সায় পেলেও তা ঢাকাতেই ব্যবহার প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে। [এখানে ভ্যাকসিন বিষয়ে তথ্যগুলো বিবিসির ১০ এপ্রিলের আর ১৪ জানুয়ারির দুটি রিপোর্ট থেকে নেয়া ]।
তাহলে এটা পরিস্কার যে, আমাদের মত দেশকে এস্টোজেনিকা, সিনোভ্যাক, সিনোফার্মা, স্পুটনিক, কোভ্যাক্সিন - এসব গরীবদের টিকার মধ্যেই থাকতে হবে। এর মধ্যে এস্টোজেনিকা যুক্তরাজ্যে আবিস্কার হলেও এর ফর্মুলা ভারতে এনে তৈরির ফলে এর সস্তা ভার্সান কোভিশিল্ড পাওয়া যায়, যা বাংলাদেশকে বিক্রি করেছিল ভারত এবং এজন্য তারা আগাম বিনিয়োগ হিসাবে টাকা নিয়েও এখন আর টিকা দিচ্ছে না। আগামিতেও দেয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
এরপরের দুই টিকা সিনোভ্যাক, সিনোফার্মা চীনের তৈরি। দুটোই হু-এর নোটিশ বোর্ডে ৭৮-৯০% পর্যন্ত কার্যকর দেখা যায়। যার মধ্যে সিনোভ্যাক এর কার্যকারিতা পরে ব্রাজিলে কমে গিয়ে ৫০.৪% হয়েছিল, তবে ব্লুমবার্গ ইন্দোনেশিয়ায় ফল ৯৪-৯৮%, চিলিতে ৬৭% কার্যকারিতার কথা জানায়। আর সিনোফার্মা হু-এর তালিকায় ৭৯% কার্যকর হিসাবে উল্লেখ আছে এখনো। আবার, রাশিয়ান স্পুটনিক এখনো ৯১% কার্যকর বলে উল্লেখ রয়েছে।
খারাপ খবর হল ভারতের অপর টিকা কোভ্যাক্সিন ৭৮% পর্যন্ত কার্যকর দেখালেও এটা তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শেষ হবার আগেই বাজারজাত শুরু করেছে বলে অভিযোগ আছে বিবিসির রিপোর্টে। [What was the controversy around Covaxin?]
তার মানে দাঁড়ালো দুনিয়াতে অন্য যত ভ্যাকসিন আবিস্কৃত হয়ে থাকুক না কেন, বাংলাদেশের জন্য ‘পাওয়া সম্ভব’ এবং ‘উপযুক্ত’ ভ্যাকসিন বলতে বাকি থাকল চীনা সিনোভ্যাক, সিনোফার্মা (এটা বেশি উপযুক্ত) আর রাশিয়ান স্পুটনিক।
এদিকে আবার ‘পাওয়া সম্ভব’ আর ‘উপযুক্ত’ হলেও আরো কথা আছে। তা কিনতে আমাদের অর্থনৈতিক সামর্থ আছে কিনা? এছাড়া যদি নিজে উৎপাদন করে নিতে হয় তাহলে কী হবে?
এম্পায়ার (empire) ধারণাটা এ প্রসঙ্গে বুঝা জরুরি। ইংরাজিতে এম্পায়ার (empire) বলে একটা শব্দ আছে যার মূল বা রুট অর্থ এক বিরাট ভুখণ্ড বা কয়েকটা দেশজুড়ে ভুখণ্ড যা কোন একক শাসকের অধীনে পরিচালিত। বাংলায় এটাকেই আমরা ‘সাম্রাজ্য’ শব্দ দিয়ে চিনি। তবে এই শব্দ দিয়ে অটোমান সাম্রাজ্য (১২৯৯-১৯১৮) থেকে শুরু করে রাশিয়ান জার সাম্রাজ্য (১৭২১-১৯১৭), ব্রিটিশ সাম্রাজ্য (১৬০০-১৯৪৫) ইত্যাদি চিহ্নিত করার পাশাপাশি অনেকে বিশেষত কমিউনিস্টরা আজকের আমেরিকাকে (১৯৪২-চলমান) ‘সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা’ বলে থাকে। যেখানে সাম্রাজ্য শব্দের সবখানেই কমন বৈশিষ্ট্য বা মানে হল, কয়েকটা দেশজুড়ে বা বিরাট ভুখণ্ড যাতে পরিচালিত হয় একক শাসন কর্তৃত্বে। তবে ১৯৪২ সালের পর থেকে সাম্রাজ্য বলতে ধারণায় বদল আসতে থাকে। অন্তত আর সরাসরি অন্য দেশ থেকে আসা শাসক উপস্থিত থেকে শাসন করা বুঝানো বন্ধ হতে থাকে।
তাই ১৯৪২ সালের আগের শাসনগুলো ছিল মূলত কলোনি বা দখলি শাসন আর ওদেশ থেকে লুট করে ওদেশের অর্থনৈতিক উদ্বৃত্ব সম্পদ শাসকের দেশে পাচার করা বুঝাত। ১৯৪২ এর পর থেকে বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সেই সুযোগই আর বাস্তবে থাকেনি। কারণ কলোনি বা দখলি শাসন আইনত নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
তবে ১৯৪৫ সালের পরে মূলত প্রত্যেকটা দেশ ইন্ডেপেন্ডেন্ট ধরে নিয়ে তাদের পরস্পরের মধ্যে দুনিয়াজুড়ে এক বাণিজ্য বিনিময় সম্পর্ক শুরু হয়, যেটা একেবারেই নতুন এক গ্লোবাল ইকোনমিক অর্ডার বা নিয়ম শৃঙ্খলা। এটা আমেরিকার নেতৃত্বে চালু হয়েছিল এবং এখনও আছে প্রায় ৭৫ বছরের বেশি সময় ধরে, যাতে আমেরিকার আধিপত্য এখন আবার শেষের দিকে। কারণ আমেরিকার হারানো প্রভাবের জায়গা দখল করার উপযুক্ত হয়ে উঠে আসছে চীন।
সে যাক, কিন্তু ১৯৪৫ সালের পরের আমেরিকান নেতৃত্বের গ্লোবাল অর্ডারের মধ্যে গরিব দেশগুলো কলোনিমুক্ত অর্থে স্বাধীন হয়ে যায় বটে কিন্তু নিজ নিজ অর্থনীতি কার্যকরভাবে চালানোর উপযুক্ত অর্থে স্বাধীনভাবে তারা টিকে থাকতে পারছিল না। এর মূল কারণ, আগের দু’শ' বছর ধরে বাংলাদেশের মতো দেশ থেকে এমন সম্পদ লুট আর পাচার হয়েছে যে তার কিছু অংশ কোনো শর্তে আবার ফিরিয়ে না আনতে পারলে এসব স্বাধীন দেশ না খেয়ে মরবে। আর এ কাজেই বিরাট ভূমিকা রেখে এসেছে আমেরিকা। আমেরিকার এই ভূমিকাটা মন্দের ভাল বলা যায়। তবে কথাটাকে এভাবে বলতে হবে যে, এটা গরিব দেশকে সাহায্য করতে, তার একটা ভায়াবল অর্থনীতির জন্য করা বিনিয়োগ ঠিক নয়। এটা উলটা, মূলত আমেরিকার হাতে জমে যাওয়া বিনিয়োগহীন বিপুল সম্পদের হিল্লা করার জন্য, গরিব দেশে বিনিয়োগের সুযোগ খুঁজে বের করা হয়েছিল। আর সেটা করতে গিয়ে আগে গরীব দেশে প্রায় না সুদে বা অনুদানে (আসলও ফেরত দিতে হয় না যেখানে) অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছিল। যাতে আমাদের অর্থনীতি যত সচল হবে ততই আমরা ন্যুনতম চার পার্সেন্টের উপরে সুদ দিয়ে আরও বড় বড় বিনিয়োগ নেবার যোগ্য হই। তাদেরকে সরাসরি ব্যবসা বিনিয়োগ করতে দিতে পারি এমন যোগ্য অর্থনীতির দেশ হই। এভাবে সারা দুনিয়া জুড়ে গ্লোবাল বাণিজ্য বিনিময়, দুনিয়ার আরো কোনে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই অর্থে আমেরিকার এই ভূমিকাটা মন্দের ভাল। কারণ আমাদের অর্থনীতি ক্রমশ তুলনামূলকভাবে ভাল হবার কিছু সম্ভাবনা এখানে আছে। কমিউনিস্টদের শোষণতত্ব অনুসারে আমেরিকা যে শোষক এটা অবশ্যই তাতে ভুলে যাবার দরকার নেই। কিন্তু আমরা কী সেজন্য আমেরিকাকে গালমন্দ করে না খেয়ে বসে থাকব? নাকি এই গ্লোবাল অর্থনীতির ভিতরেই আমার জন্য যেসব তুলনামূলক সুবিধা জেগে উঠতে দেখা যাবে সেগুলোর সুযোগ নিয়ে স্ট্রাগল করে উঠে আসার চেষ্টা করব? এই হল সেই লড়াই। আর অবশ্যই আমেরিকান সম্পর্কে কমিউনিস্টদের শোষণতত্ব অস্বীকার বা না ভুলেই তা করা সম্ভব।
এখন এই যে আমাদের মত দেশের অর্থনীতিতে আমেরিকার (তার নিজের স্বার্থে) সাহায্য আমরা পাচ্ছি বা আমেরিকা সাহায্য করছে - এটাই আমেরিকার ‘ইতিবাচক এম্পায়ার ভূমিকা’। যেমন ধরা যাক আমাদের ১৯৮৮ সালের বন্যা। আমেরিকা প্রায় না সুদে বা অনুদানে অবকাঠামো খাতে আরো ঋণ-বিনিয়োগ না করলে আমরা হয়ত উঠে আসতেই পারতাম না বা কষ্ট হতো, অথবা ঘুরে দাঁড়াতে দেরি হতো। আবার আমেরিকার দিক থেকে ঐ নতুন অবকাঠামো খাতে ঋণ-বিনিয়োগটা সেসময় না করলে তাদেরই আগের দেয়া কোন ঋণ-বিনিয়োগ আমরা ফেরত দেবার যোগ্য থাকতাম না হয়তো। তাই এটা ছিল আমাদের আগে তাদেরই মৌলিক স্বার্থ।
এই হলো সেই এম্পায়ারেরই সামগ্রিক নেতিবাচক সত্ত্বেও কিছু ইতিবাচক ভূমিকা, তবে সেটাও এম্পায়ারের স্বার্থেই। এটাই গত প্রায় ৭৫ বছরের আমেরিকার কিছু ইতিবাচক ভূমিকাও। কিন্তু এটাই আবার গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের নেতৃত্বে যখন পালাবদল ঘটে আর তাতে নতুন যে নেতা আসে তাকেই এই দান-অনুদানে খরচের দায় নিতে হয়। অর্থাৎ ইতিবাচক এম্পায়ার রোল নিতে হয়। চীন এখন সে রোল নিচ্ছে ক্রমশ।
ঠিক যেমন শুরুতে রাজাও খাজনা, ট্যাক্স, সেলামি বা পুণার্হ ইত্যাদি নানান নামে চাঁদা তোলে। কিন্তু প্রজাদের জন্য এর কিছুই খরচ করে না। কিন্তু কোন সাম্রাজ্যের সম্রাট তিনিও আরও বেশি চাঁদা তুলেন হয়ত। কিন্তু ওর বিরাট অংশ তিনি সিভিল ইউটিলিটি মানে পাবলিকের জন্য রাস্তাঘাট, নিরাপত্তা বা পানির ব্যবস্থা নির্মাণে ব্যয় করেন। এজন্য এম্পায়ার রাজার চেয়ে অনেক বেশি কাম্য - তারা দু’জনেই জোর করে বসা শাসন ক্ষমতা হলেও এর মধ্যে মাত্রার পার্থক্য রয়েছে।
সার কথা হলো, পজিটিভ এম্পায়ারের ভূমিকা বলে একটা ব্যাপার আছে। গ্লোবাল অর্থনীতির নেতা আমেরিকা এতদিন সে দায় ও ভূমিকা পালন করেছে, অকাতরে অর্থ ব্যয় করেছে আরও সুবিধা পাবার জন্য। এখন গ্লোবাল নেতাগিরি ঢলে পড়লে নেতার সবার আগে যে সামর্থে টান পড়ে তা হল - এই ‘পজিটিভ এম্পায়ারের খরচ করার ভূমিকা’। আর ঠিক ততটাই যেন নতুন বা আসন্ন গ্লোবাল নেতাও ঐ ভূমিকাটা পালনের যোগ্য হয়ে উঠে। অর্থাৎ চীন সেই ‘পজিটিভ এম্পায়ারের দায় ও ভূমিকা’ নেবার অনেক যোগ্য এখন!
সারকথায় আমরা কেউ সাবজেকটিভ বা ব্যক্তি অর্থে আমেরিকাকে না চীনকে পছন্দ করি তাতে কিছুই যায় আসে না। আমেরিকাকে না চীন কাকে কার উপরে বেশি ভালোবাসি সেই সাবজেকটিভ বিচার উপরে তুলে রাখতে হবে। বরং এদের মধ্যে কে এখন ‘পজিটিভ এম্পায়ারের দায় ও ভূমিকা’ নেবার যোগ্য - এই ব্যাপারটা অবজেকটিভভাবে নির্ধারিত হচ্ছে। সেদিকটায় তাকাতে হবে। কে বেশি যোগ্য বা উপযুক্ত সেই অবজেকটিভ বাস্তবতাকে মানতে হবে, একমাত্র সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা তা না করতে পারলে সেটা ভাঁড়ামো মানে আমাদের আমেরিকান (ভারতীয়) ভাঁড়ের ভূমিকায় নামা হবে।
তাহলে? দুনিয়া এখন কোভিড-১৯ ভাইরাসের কবলে পড়ে হাসপাস করছে। কে কতদিন আর কীভাবে বাঁচে তা অজানা। গ্লোবাল অর্থনীতি ক্রমশ দেবে গিয়ে ঢলে পড়ছে। গ্লোবাল অবকাঠামো ব্যাংকগুলো তা ঠেকাতে চেষ্টায় নানান উদ্যোগ নিয়েই যাচ্ছে। সবারই একই লক্ষ্য রিকভারি- মানে ক্ষতি সামলে আবার জেগে উঠার চেষ্টা। অর্থাৎ ভাইরাসের উপরে আধিপত্য বিস্তার করা, অন্তত কিছু প্রতিরোধ ব্যবস্থা খাড়া করা। সোজা কথায় ব্যাপক হারে উপযুক্ত টিকা বিতরণ হতে পারে একটা প্রতিরোধ ব্যবস্থা। কিন্তু গাফিলতি, যোগ্যতা, পরিকল্পনায় মারাত্মক ত্রুটির কারণে টিকাকরণে যতই দেরি হচ্ছে ভাইরাস ততই নিজেকে আরেক রূপ বা ভেরিয়েন্টে হাজির করার সুযোগে দুর্দমনীয় হয়ে উঠছে। অর্থাৎ দ্রুত ও একসাথে সবাইকে (অন্তত ৭০ ভাগ) টিকা দিয়ে শেষ করাই একমাত্র জিতবার পথ।
আর এখানেই গ্লোবাল নতুন বা পুরানা নেতার একটা ‘পজিটিভ এম্পায়ারের ভূমিকা’ নেয়ার আছে, যা খুবই গুরুত্বপুর্ণ। আবার তা আসলে একটা মাপক, কে দুনিয়ার যোগ্য নেতা। আর কার দিন ফুরিয়েছে। কারণ, প্রচুর পরিকল্পনার ব্যাপার এখানে আছে। আগে বিনিয়োগের প্রয়োজন। যেমন গবেষণায় বিনিয়োগের ব্যাপার তো আছেই। সেই সাথে এরপর ঐ লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন এবং সুষ্ঠুভাবে টিকা বিতরণে বিনিয়োগ ও টেকনিক্যালিটির একটা ব্যাপার আছে। এখন একটা ওপেন কোশ্চেন করা যাক একাজে গ্লোবাল নতুন বা পুরানা নেতার একটা ‘পজিটিভ এম্পায়ারের ভূমিকা’ নেয়াতে কে বেশি যোগ্য?
প্রথমত, আগের ডোনান্ড ট্রাম্প তো নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে স্বীকারই করেননি যে এটা একটা মহামারি ও সমস্যা। মাত্র এ বছরের শুরুতে বাইডেন ক্ষমতায় আসার পরে এটা আমেরিকানদের জন্যই প্রথম ও উপযুক্ত মনোযোগ পায়। বলা বাহুল্য, গ্লোবাল রোল দূরে থাক আমেরিকা নিজ জনগণের প্রতিই ঠিকমতো মনোযোগ দেয়নি। বরং ভাইরাসকে দুনিয়ায় বিস্তার লাভ করতে যেন পরোক্ষে সাহায্য করেছে।
এরপর বাইডেন কথিত কোয়াডের মিটিং ডাকলেন। সদস্যরা সবাই বিশেষ করে ভারত লাফিয়ে উঠে এখানে প্রধান নায়কের ভাব ধরে। চীনের বিপরীতে ভারত যেন গ্লোবাল নতুন নেতার একটা ‘পজিটিভ এম্পায়ারের ভূমিকা’ নেওয়ার বেশি যোগ্য- খামোখা এই ভন্ড হামবড়া ভাব নেয়। বাইডেন যতই পরিষ্কার করে বলার চেষ্টা করছিলেন তিনি মূলত দ্রুত কেবল আমেরিকান নাগরিকদেরকে টিকাকরণের জন্যই এসেছিলেন যাতে এখাতে জাপানি বাড়তি বিনিয়োগে ভারতের টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা তিনি আমেরিকানদের জন্য কাজে লাগাতে পারেন। কিন্তু ততই চীনকে পরাজিত দেখানো আর বাস্তব হোক না হোক চীনের চেয়ে ভারত যোগ্য দেখানোতেই দিল্লি চাপাচাপি শুরু করে। আর ভারত এর এক মুখরোচক নাম দেয় - ‘টিকা কূটনীতি’। যা অবাস্তব তো বটেই প্রয়োজনীয়ও ছিল না। শেষে বাইডেন মিথ্যা হলেও কোয়াডের হয়ে এশিয়াকে টিকাদাতা হিসাবে হাজির হবার মিথ্যা কথা দিতে রাজি হয়ে ঐ সভা শেষ করেন।
আজকের বাস্তবতা হলো, আমেরিকা ভারতের টিকা পায়নি বা নেয়নি। তবে বাইডেন নিজেই অন্যান্য উৎস থেকে টিকা সংগ্রহ বাড়াতে সক্ষম হন। আর এদিকে ভারত আমাদের দেশের বেক্সিমকোর মাধ্যমে ভারতীয় টিকা পেয়ে যাচ্ছে সাথে নগদ লাভও হচ্ছে এই মিথ্যা বাস্তবতা খাড়া করে। এতে আমাদের চীনা টিকা ও লাইসেন্স পাওয়া ভন্ডুল করে দিতে তারা সমর্থ হয়। কারণ আমরা সময়মতো সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। আর এখন ভারতের জন্য কঠিন বাস্তবতা হলো, বিদেশের কাউকেই তার টিকা দেয়ার সামর্থ নেই। তারপরেও ভারতের নিজ জনগোষ্ঠির সবাইকে টিকা দিতে প্রায় দু’বছরে পারবে কিনা সন্দেহ। যার মানে নিজ জনগোষ্ঠীকেই টিকাকরণ করতে ভারতের সামর্থ নেই। তাই ভারত ইতোমধ্যেই বাইরে থেকে টিকা আমদানির অনুমতি দিয়েছে। তাহলে এই ভারত আমেরিকা এবং বাংলাদেশসহ সারা এশিয়াকে টিকা কূটনীতিতে ছেয়ে ফেলার যে হুঙ্কার- এটা কেন দিয়েছিল? এতেই প্রমাণ হয়, গ্লোবাল নতুন বা পুরানা নেতার একটা ‘পজিটিভ এম্পায়ারের ভূমিকা’ নেওয়ার কাজটা ভারত বুঝে বলে আমাদের মনে করার কারণ নেই।
তাহলে ঐ পরিস্থিতিতে এরপর মানে টিকা বা টাকা ফেরত কোনোটাই না পেয়ে বাংলাদেশের কোথায় যাওয়ার বাকি ছিল? আমেরিকার কাছে?
আগেই বলেছি, টিকা উৎপাদন গরিব-বড়লোক বলে ভাগ হয়ে আছে। আমেরিকায় উৎপাদিত টিকা বিনা পয়সায় দিলেও আমাদের কাজে লাগানো কঠিন। তবু, আমাদের প্রায় ১৩ লাখ একডোজ নেয়া গ্রহিতা বিপজ্জনক অবস্থায় আছে। কারণ ভারত তাদের জন্য দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেয়নি, আবার কখনও দিবে সে সম্ভাবনাও নেই। আবার অন্য উৎস থেকে আমেরিকার হাতে প্রায় ৫ কোটি এস্টোজনিকা মানে আমাদের মতো একই টিকা থাকার কথা। সেখান থেকে মাত্র ঐ ১৩ লাখ ডোজ আমরা চেয়েছিলাম কিন্তু আমেরিকাও কোনো সাড়া শব্দ করেনি।
তাহলে এখন চীন ভরসা ছাড়া আমাদের টিকা পাবার উপায় কী? এটাই সবচেয়ে কঠিন বাস্তবতা। আর এই দুরাবস্থায় আমাদেরকে ফেলেছে ভারত ও তার হামবড়া ভাব! অতএব টিকা পেতে হলে আমাদের আগের লোভ ও ভুল সিদ্ধান্তের জন্য চীনের কাছে গিয়ে সরি বলে আবার তাকে রাজি করানো ছাড়া উপায় কী? বিনিয়োগ ও টেকনিক্যালিটি ইত্যাদি সবকিছুতেই আমাদের ঘাটতি আছে। আর ঠিক বিপরীতে চীনের সেই এম্পায়ারের দায় ও ভূমিকা নেয়ার সামর্থ আছে। এটাই বাস্তবতা।
অনেকের মনে হতে পারে, আমরা স্পুটনিক টিকা পাবার চেষ্টা করতে পারি। এটাও বাস্তবতার খবর না নিয়ে কথা বলা। রাশিয়ার আর কাউকে টিকা উৎপাদন করে দেবার সক্ষমতা নেই। তাদের কারখানা ওভার অকুপায়েড। এছাড়া দিতে পারলেও সে টিকার দাম পড়বে ১৫ ডলারেরও বেশি কারণ তাদের উৎপাদন খরচ বেশি। এছাড়া কৌশলগত দিক থেকে চীন না করে দিলে সে টিকা দিবার সিদ্ধান্ত রাশিয়া আর নিবে না। তাদের কৌশলগত সম্পর্ক এরকমই। আর বাস্তবতা হলো, লাইসেন্সের নিশ্চয়তার প্রসঙ্গে, চীনের হাতে (চীনা সরকারি নিয়ন্ত্রণে চীনা প্রাইভেট কোম্পানি) বাংলাদেশে উৎপাদনের জন্য রাশিয়া সহজেই লাইসেন্স দিতে রাজি হবে। নইলে নয়। কাজেই আগামী চার মাস নিয়মিত চীনে তৈরি টিকার সাপ্লাই পাওয়া আর ঐ চার মাসের মধ্যে বাংলাদেশে নিজেদের অন্তত দু/তিনটা প্রাইভেট কোম্পানিকে টিকা উৎপাদনে যোগ্য করে সাজিয়ে দিয়ে তাদের দিয়ে নিজ উৎপাদন যোগাড় ইত্যাদিতে চীনকে রাজি করতে পারলেই একমাত্র টিকা দ্রুত পাওয়া সম্ভব।
তাহলে সোজা কথা চীনের এই গ্লোবাল এম্পায়ার ভূমিকাটাই আমাদের জন্য কাম্য ও মুখ্য। এখন চীন যদি আমাদের কাছে বিনিময়ে নিশ্চয়তা চায় যে আগের মত আমাদের আবার পা পিছলাবে না? ভারত বা আমেরিকার কাছে লোভে ফাঁসবো না আমরা- চীন সেই গ্যারান্টি যদি চায় তাহলে কী হবে? এমনিতেই সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে চীন সে নিশ্চয়তা আমাদের কাছে চাইতেই পারে। এটা তার অধিকার।
এখন প্রথমত, বিচার করেন আমাদেরকে চীনের কাছে ফিরে হাত জোড় করে অনুরোধ করার ভূমিকায় দাঁড় করালো কে? ভারতে মিথ্যা আশ্বাস ও প্রফিটের শেয়ারের লোভ। আর সেই সাথে কোয়াড, টিকা কূটনীতি এসব মিথ্যা বোলচাল। অথচ গ্লোবাল নেতার একটা ‘পজিটিভ এম্পায়ারের ভূমিকা’ নেয়া- এই মুরোদ তো আমেরিকাসহ কোয়াডের কারই আমরা দেখলাম না!
জাস্ট কল্পনা করেন। ঈদের পরের ঢাকায় আক্রান্ত লোকের সংখ্যা যদি বেড়ে যায়, সেইসাথে ভারতীয় ধরণের ভাইরাস যদি ছড়িয়ে যায়? এদিকে দেশে ইতোমধ্যে টিকা পাওয়া লোকের সংখ্যা যেখানে দু-তিন পার্সেন্টের মতো তখন ঐ পরিস্থিতিতে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াব?
আমাদের অতিউৎসাহী প্রো-ইন্ডিয়ান-আমেরিকান লোকজন আমেরিকার কাছে নালিশ নিয়ে গিয়েছিল যে ‘কোয়াড’ এ বাংলাদেশের অংশগ্রহণ চীন ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে যথেষ্ট খারাপ করবে বলে চীন মন্তব্য করেছে। আর এতে আমেরিকান প্রতিক্রিয়া হলো ‘চীনের রাষ্ট্রদূত যে মন্তব্য করেছেন, তার ওপর নজর আছে যুক্তরাষ্ট্রের’। বাস এখানেই শেষ। তাহলে আমরা টিকা পাব কী করে? সেটা কী আমেরিকা বা ভারত অথবা এই অতিউৎসাহী প্রো-ইন্ডিয়ান-আমেরিকানদের আছে? এনিয়ে তাদের বক্তব্য কি? আমরা শুনি না।
ব্যাপারটা হল, বাংলাদেশ চীনের কাছে ফিরে টিকা চাইতে যাচ্ছে এমনই খারাপ অবস্থায় যখন চীনের কাছে আমাদের কোনো পজিটিভ ইমেজ নেই। কারণ আমরা চীনের আগের অফার কোন সদুত্তর ছাড়াই এর অবজ্ঞা, অপব্যবহার করেছি। কাজেই চীন আমাদের আগের আচরণের বিরুদ্ধে এবার নিশ্চয়তা তো চাইতেই পারে!
আর এ ঘটনাকে বিবিসি রিপোর্ট করেছে এভাবে, ‘এ ধরনের ছোট গোষ্ঠী বা ক্লাবে যুক্ত হওয়াটা ভালো না।
বাংলাদেশ এতে যুক্ত হলে তা আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যথেষ্ট খারাপ করবে’। আর প্রো-ইন্ডিয়ান-আমেরিকান লবিস্টরা এটাকে ব্যাখ্যা করছে ‘চীনা হুমকি’ হিসেবে। অথচ বিবিসির রিপোর্টে ‘হুমকি’ বলে কোনো শব্দই নেই। এর মানে এটা লবিস্টদের উস্কানি দেবার জন্য ব্যবহৃত নিজস্ব শব্দ ও ব্যাখ্যা।
কেউ কেউ লিখছেন তারা নাকি বিস্মিত হয়েছেন। আর আমরা তাদের আচরণ দেখে বিস্মিত হচ্ছি। তারা টিকা পাবার কোনো পাল্টা উৎস বা প্রপোজাল কি দিয়েছে? একমাত্র অবজেক্টিভ চোখেই কোয়াড, টিকা পাওয়া ইত্যাদির ভালো-মন্দ বিচার করার মতো যদি আমাদের অবশিষ্ট কিছু যোগ্যতা থেকে থাকে তবেই হয়তো আমরা এ যাত্রায় পার পেতে পারি!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com