করোনা টিকায় আদার পুনাওয়ালার বাজিমাত
আদার পুনাওয়ালা -
ভারতের কোভিড টিকা উৎপাদনের সাফল্যের পেছনে কৃতিত্বের দাবিদার মূলত এক ব্যক্তি, আদার পুনাওয়ালা। তার সংস্থা সিরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া পৃথিবীর সর্ববৃহৎ টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান।
গত বছরের মাঝামাঝি সময় তার পরিবারের সদস্যরা ভাবতে শুরু করেন পুনাওয়ালার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কোভিড-১৯-এর টিকা কার্যকর হবে কিনা তা জানার আগেই তিনি নিজের কোটি কোটি ডলার অর্থ ব্যয় করে এই টিকা উৎপাদনের ব্যাপারে একটা ফাটকা খেলেন।
জানুয়ারি মাসে কোভিডের প্রথম টিকা, যেটি উদ্ভাবন করছিল অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা, সেটি উৎপাদনের দায়িত্ব দেয়া হয় ভারত সরকারকে। এখন মি. পুনাওয়ালা তার সংস্থায় প্রতিদিন ২৪ লক্ষ ডোজ টিকা তৈরি করছেন।
"আমি ভেবেছিলাম এই চাপ এবং যে মাথা খারাপ করে দেবার মত অবস্থা, আমরা টিকা তৈরি করার পর তার অবসান ঘটবে," তিনি বলেন। "কিন্তু আসল চ্যালেঞ্জটা হল সবাইকে খুশি রাখতে পারা।"
তিনি বলছেন, টিকার উৎপাদন তো রাতারাতি বাড়িয়ে ফেলা সম্ভব নয়।
"এর জন্য সময়ের দরকার," পুনাওয়ালা বলেন। "মানুষ মনে করছে যে সিরাম ইনস্টিটিউট ম্যাজিক দেখাতে পারে। হ্যাঁ, আমরা যে কাজ করি তাতে আমরা দক্ষ ঠিকই, কিন্তু আমাদের হাতে তো যাদুর কাঠি নেই।"
তবে অন্যদের তুলনায় তিনি এখন সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন। কারণ গত বছর মার্চ মাসে তিনি নতুন কারখানা ভবন তৈরি করেন এবং অগাস্ট মাসে সেখানে রাসায়নিক ও টিকা রাখার জন্য কাঁচের ভায়াল মজুত শুরু করেন।
টিকা উৎপাদন প্রক্রিয়ার সময় তৈরি টিকার পরিমাণে অনেকটাই হেরফের হতে পারে এবং প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক কিছুই গোলমাল হতে পারে।
"এটা একদিকে যেমন বিজ্ঞান, অন্যদিকে তেমনি একটা শিল্প," বলেন আগাথ দ্যেমারে।
যেসব টিকা প্রস্তুতকারক এখন উৎপাদন শুরু করছেন, তাদের ভ্যাকসিন তৈরি করে উঠতে বেশ কিছু মাস সময় লাগবে। এবং ভাইরাসের নতুন ধরনগুলো মোকাবেলা করতে যদি বুস্টার ডোজের প্রয়োজন হয়, সেটার ক্ষেত্রেও একই সমস্যা হবে।
কোভ্যাক্স কি টিকার বিলি ব্যবস্থা তরান্বিত করতে পারবে?
মি. পুনাওয়ালা বলছেন, তিনি প্রথমে ভারতের জনগণের জন্য টিকা সরবরাহ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এবং এরপর তার তালিকায় রয়েছে আফ্রিকা। সেখানে কোভ্যাক্স নামে এক প্রকল্পের মাধ্যমে টিকা সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তার সংস্থা।
বহু দরিদ্র দেশ টিকা পাবার জন্য কোভ্যাক্স প্রকল্পের ওপর নির্ভর করছে। এটি একটি আন্তর্জাতিক উদ্যোগ যারা করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন বিশ্বের সবগুলো যাতে পায় তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে।
এই কোভ্যাক্স প্রকল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তাদের সাথে আরও আছে ভ্যাকসিন বিষয়ে বৈশ্বিক জোট গ্যাভি এবং মহামারির প্রস্তুতিতে উদ্ভাবনী কার্যক্রম বিষয়ক জোট কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনিশিয়েটিভ বা সেপি।
কোভ্যাক্স তাদের কার্যক্রমের আওতাধীন দেশগুলোতে জনসংখ্যার ২০% টিকা দেয়ার মতো পর্যাপ্ত ডোজ পৌঁছে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এই কর্মসূচির মাধ্যমে প্রথম ভ্যাকসিন পায় পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গানা ২৪শে ফেব্রুয়ারি তারিখে।
কোভ্যাক্সের পরিকল্পনা এবছরের শেষ নাগাদ পৃথিবীর দেশগুলোকে ২০০কোটি ডোজ টিকা পৌঁছে দেয়া।
তবে ইতোমধ্যেই, বহু দেশ নিজস্ব উদ্যোগে আলাদাভাবে টিকা নিয়ে দেন-দরবার চালানোর ফলে কোভ্যাক্সের পরিকল্পনা একটা ধাক্কা খেয়েছে।
আদার পুনাওয়ালা বলেন, আফ্রিকার প্রায় প্রত্যেকটি দেশের নেতা স্বাধীনভাবে নিজেরা টিকা পাবার জন্য তার সাথে যোগাযোগ করেছেন।
তবে কোভ্যাক্স আদৌ তার লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে বলে আগাথ দ্যেমারে এবং ইকোনমিস্ট ইন্টালিজেন্স ইউনিট খুব আশাবাদী নন। সব কিছু পরিকল্পনা মাফিক এগোলেও কোভ্যাক্সের লক্ষ্য হলো একটি দেশের জনসংখ্যার মাত্র ২০ থেকে ২৭%কে এ বছর টিকার আওতায় আনা।
"তাদের উদ্যোগ পরিস্থিতি অল্পই বদলাতে পারবে, তারা অবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে পারবে না," বলছেন আগাথ দ্যেমারে।
ইকোনমিস্ট ইন্টালিজেন্স ইউনিট-এর পক্ষে দেয়া তার পূর্বাভাসে মিজ দ্যেমারে বলেছেন, কোনো কোনো দেশ সব মানুষকে ২০২৩ সালের মধ্যে তো পুরোপুরি টিকা দিয়ে উঠতে পারবেই না- হয়ত কখনই পারবে না। তাছাড়া, সমস্ত জনগোষ্ঠীকে টিকা দেয়া সব দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নাও হতে পারে, বিশেষ করে যেসব দেশে জনসংখ্যার একটা বড় অংশ তরুণ এবং যেখানে খুব বেশি সংখ্যায় মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে না।
অবশ্য এধরনের পরিস্থিতিতে ঝুঁকির অন্য একটা দিক রয়েছে। সেটা হল ভাইরাস যদি ছড়ানোর সুযোগ পায়, তাহলে তা চরিত্র পরিবর্তন করবে এবং মানুষের মাধ্যমে অন্য দেশে গিয়ে পৌঁছবে। ভ্যাকসিন প্রতিরোধ করার ক্ষমতাসম্পন্ন নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হওয়া অব্যাহত থাকবে।
তবে, সবকিছুই কিন্তু নেতিবাচক নয়। টিকা তৈরি হচ্ছে আগের যে কোন সময়ের তুলনায় দ্রুত। কিন্তু তারপরেও পৃথিবীর ৭৭০ কোটি মানুষকে প্রতিরোধী টিকা দেয়া বিশাল একটা চ্যালেঞ্জ। এতবড় চ্যালেঞ্জ অতীতে কখনও আসেনি।
আগাথ দ্যেমারে মনে করেন সরকারগুলোকে তাদের জনগণের কাছে স্বচ্ছ হতে হবে। বাস্তবে কী সম্ভব সে বিষয়ে মানুষকে সত্য কথা জানাতে হবে : "যেকোনো সরকারের পক্ষেই এটা বলা খুবই কঠিন হবে যে, 'না - ব্যাপক পরিসরে মানুষকে টিকা দেবার লক্ষ্য অর্জন করতে আমাদের আরো বেশ কয়েক বছর সময় লাগবে।' কোনো সরকারই একথা বলতে চাইবে না।"
সূত্র : বিবিসি