বাংলাদেশী কিংসলে
বাংলাদেশী কিংসলে - অন্য এক দিগন্ত
আরামবাগের অনুশীলন শেষে প্রায়ই একটি রেস্টুরেন্টে যেতেন এলিটা কিংসলে। সেখানে পরিচয় চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া ছোট্ট ফারিয়ানের সাথে। তার বাবা থেকেও নেই। বিচ্ছেদ হয়ে গেছে মা লিজার সাথে। ছেলের মাধ্যমেই কথা হয় লিজার সাথে। এরপর ফোন নম্বর দেয়া-নেয়া। কিন্তু নাইজেরিয়ান এলিটা বাংলা বুঝতেন না আর বাংলাদেশী লিজা বলতে পারতেন না ইংরেজি। দুই দেশের দু’টি প্রাণের মধ্যে সেতুবন্ধ করে দেয় সেই ফারিয়ান। মুখের কথা পুরোপুরি না বুঝলেও মনের ভাষা বুঝতে সময় লাগেনি কারো। ২০১২ সালের ২০ মে বিয়ের পর্বটা সেরে নেন দু’জন।
নাইজেরিয়ান ফুটবলার ও বাংলাদেশী মেয়ের গল্পটা সেখানেই শেষ হয়নি। মায়ার বন্ধনে বাঁধা পড়ে এলিটা কিংসলে মনেপ্রাণে বাংলাদেশী হতে চেয়েছেন। লিজার টানে ওই বছরই আবেদন করেন বাংলাদেশের নাগরিকত্বের। নানা নিয়মের ফাঁদে অপেক্ষা বাড়ে তার। ২০১৫ সালে খোদ বাফুফে চেয়েছিল এলিটা কিংসলে, ইসমাইল বাঙ্গুরা ও সামাদ ইউসিফকে নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করতে। নানা আলোচনা-সমালোচনায় সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়। বাঙ্গুরা, সামাদরা দেশ ছেড়ে নাইজেরিয়া পাড়ি জমিয়েছেন কত আগে। কিন্তু কিংসলে আশা ছাড়েননি। ২০১২ সালে করা তার সেই আবেদনে অবশেষে সাড়া দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির বছরে অগ্নিঝড়া মার্চে বৈবাহিক সূত্রে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন ৩২ বছর বয়সি কিংসলে। চাইলে এখন থেকে কোচ জেমি ডে জাতীয় দলে জামাল ভুঁইয়াদের সতীর্থও বানাতে পারেন তাকে।
এলিটা কিংসলেই প্রথম বিদেশী ফুটবলার, যিনি নাগরিকত্ব বদলে বাংলাদেশী হয়েছেন। ফিফায়ও ফুটবলার ‘ন্যাচারালাইজেশনের’ সুযোগ আছে। এ জন্য বেশ কিছু নিয়ম-কানুন মানতে হয়। পেশাদার ফুটবলে ৮০০’র বেশি গোলের দাবি করা জোসেফ বাইকন যেমন খেলেছেন তিন তিনটি জাতীয় দলের হয়ে। অস্ট্রিয়া, চেকোস্লাভাকিয়ার পর ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচটা খেলেছেন বোহেমিয়া অ্যান্ড মোরাভিয়ার হয়ে। সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার আলফ্রেদো দ্য স্তেফানোও খেলেছেন তিন দেশ আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়া ও স্পেনের জার্সিতে। রাইমুন্দো ওরসি ১৯২৭ সালে আর্জেন্টিনার হয়ে কোপা আমেরিকা জেতার পর ১৯৩৪ সালে ইতালির হয়ে জিতেন বিশ্বকাপ। ১৯৩৬ সালে আবারও আর্জেন্টিনায় ফিরে জাতীয় দলের হয়ে খেলেছিলেন তিনি!
লিওনেল মেসি, রবার্তো কার্লোসরাও দ্বৈত নাগরিক। লা লিগায় লাতিন কোটা থাকায় ছয় বছর স্পেনে থাকার সুবাদে দেশটির নাগরিকত্ব নিয়েছেন তারা। এই দুজনের মতো আরো অনেক লাতিন একই কারণে নিয়েছেন স্পেনের নাগরিক। তবে স্প্যানিশ ক্লাবে খেললেও জন্মভূমির হয়ে জাতীয় দলে খেলেন তারা।
এলিটা কিংসলের সেই সুযোগ নেই। কারণ বাংলাদেশের পাসপোর্ট পেতে তাকে বলা হয়েছিল নাইজেরিয়ার নাগরিকত্ব ছাড়তে। বিদেশী খেলোয়াড়দের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে খেলার কারণ একটাই, তা হলো সেই দেশ থেকে উন্নত মানের জীবনযাপনের নিশ্চয়তা পাওয়া। কিন্তু বাংলাদেশ এমন কি সুযোগ-সুবিধা দিতে পারবে যা বিদেশী খেলোয়াড়দের টানবে, যদি পতাকা বা জার্সির প্রতি টানই না থাকে! তাই জন্মসূত্রে পাওয়া নিজ দেশের নাগরিকত্ব বাতিল করতে রাজি ছিলেন না বাঙ্গুরা ও সামাদ। তবে নাইজেরিয়ার নাগরিকত্ব ছাড়ার কঠিন শর্তটা কিংসলে মেনে নিয়েছেন মনেপ্রাণে বাংলাদেশী হতে চান বলে, ‘নাইজেরিয়ায় আমার মায়ের সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম নাগরিকত্ব ছাড়া নিয়ে। মা বোঝান, ‘তুমি বাংলাদেশে থাকলেও আমার ছেলে নাইজেরিয়ায় আসলেও আমার ছেলে।’ যেখানে আমি সুখি হব সেই দেশে থাকতে বলেন তিনি। আর চাইলে তো বাংলাদেশের পাসপোর্টে নাইজেরিয়া যেতেই পারি। জš§ভূমির মায়া ছাড়তে তাই বেশি ভাবিনি আর। বাংলাদেশ অনেক আপন আমার কাছে। এখানে সংসার পেতেছি, সন্তান হয়েছে। দেশটাকে ছেড়ে যাবো কিভাবে?’
স্বামীর এমন আত্মত্যাগের কথা বলতে গিয়ে আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন তার স্ত্রী লিজা, ‘আমার আগের সংসারের একটা ছেলে আছে। ওকে দেখে এলিটা আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন। আমাদের নিজেদের একটা মেয়ে হয়েছে। এলিটা এখন দুই সন্তানের বাবা। আর আমাদের জন্য তিনি অনেক বড় আত্মত্যাগ করেছেন। বৈবাহিক সূত্রে নাগরিকত্ব পেতে হলে তাকে নাইজেরিয়ার নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করতে হতো। তিনি সেটা করেছেন বলেই এ দেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন।
২০১৬ সালে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা এক ক্লাবের সঙ্গে প্রায় চুক্তি করে ফেলেছিলেন কিংসলে। সে সময়ই অন্য এক ক্লাবের সভাপতি প্রতিশ্রুতি দেন, তার ক্লাবে খেললে বাংলাদেশের নাগরিকত্বের আবেদন পাশ করিয়ে দেয়ার। মোটা অঙ্কের চুক্তির প্রস্তাব ফেরাতে দ্বিতীয়বার ভাবেননি তিনি। বাংলাদেশ তার কাছে কতটা এই একটা উদাহরণই বলে দেয় সেটা। অবশেষে নাগরিকত্বের কাগজপত্র হাতে পেয়ে ৩২ বছর বয়সী স্ট্রাইকার এখন স্বপ্ন দেখছেন জাতীয় দলের হয়ে খেলার, ‘এ দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার আগে সেভাবে বাংলা শেখার আগ্রহ ছিল না। এখন শিখব ভালোভাবে, তবে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত আমি গাইতে পারি। আমার মেয়ের কাছ থেকে শিখেছি জাতীয় সঙ্গীত। বাংলাদেশের জার্সি গায়েও গাইতে চাই আমার সোনার বাংলা গানটা। তার আগে নিজেকে আরো উন্নত করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, নিজেকে প্রমাণ করে আমি জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন পূরণ করতে পারব।’ জাতীয় দলের কোচ জেমি ডেও ইতিবাচক, ‘ঘরোয়া ফুটবলে পারফরম করতে পারলে তিনি অন্যদের মতোই জাতীয় দলে খেলবেন।’
কিংসলে বাংলাদেশে পা রাখেন ২০১১ সালে। আরামবাগ, মুক্তিযোদ্ধা ও বিজেএমসি ক্লাবের হয়ে মেঘে মেঘে বেলা গড়িয়েছে অনেক। প্রথম শেখ কামাল গোল্ডকাপে চট্টগ্রাম আবাহনীর হয়ে ধারে খেলেছিলেন তিনি। ফাইনালে কিংসলের জোড়া গোলেই ইস্টবেঙ্গলকে ৩-১ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আবাহনী। মাঠে তার গোল করার ক্ষমতা সবার জানা। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় গুণ, অন্যান্য আফ্রিকান ফুটবলারের মতো কোনো অভিযোগ নেই। ক্লাব কর্মকর্তা থেকে দর্শকদের সবাই সম্মান করেন ভদ্র ফুটবলার হিসেবে।
সবশেষ লিগে আরামবাগের হয়ে ৫ ম্যাচে করেছিলেন ৫ গোল। এরপর নাগরিকত্ব বদলের কাগজ নিয়ে দৌড়ঝাঁপে নতুন মৌসুমে কোনো ক্লাবের সঙ্গে চুক্তি করতে পারেননি। তবে মধ্যবর্তী দলবদলে নাম লিখিয়ে ফেলেছেন বসুন্ধরা কিংসে। যদিও নিজে আগে থেকে ঘোষণাটা দিতে চান না কিংসলে, ‘আমি একটি দলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। ক্লাব থেকে এখনো কোনো ঘোষণা আসেনি বলে আমিও সেটা বলতে পারব না। আগামী ছয় মাস আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।’