যুগে যুগে কাসিদা
যুগে যুগে কাসিদা - অন্য এক দিগন্ত
‘আ গায়া অ্যায় সায়েমো মাহে মোবারক আ গায়া/
ছা গায়া সারি ফিজা পার নূর বানকার ছা গায়া
অর্থাৎ-
‘এসে পড়েছে হে রোজাদারগণ,
মোবারক মাস এসে পড়েছে/
সমস্ত প্রকৃতি আলোকস্বরূপ ছেয়ে গেছে।’
রমজান মাসে শেষরাতে পুরান ঢাকায় পাড়ার অলিতেগলিতে ঘুরে ঘুরে উর্দু, ফার্সি, বাংলা ভাষায় মধুর সুরে গজল গেয়ে বেড়ায় একদল মানুষ। রাত জেগে মানুষকে গান শোনানো এ দলের উদ্দেশ্য নয়। বরং কাসিদা বা ইসলামী গজল গেয়ে রোজাদারদের সাহরি খাওয়ার আহ্বান জানিয়ে মানুষের গভীর ঘুম ভাঙ্গানোই এদের পবিত্র উদ্দেশ্য। তবে রমজানের সাহরি খাওয়ার জন্য কেবল কাসিদা বা গজল গাওয়া হয় না। কাসিদা রচিত হয়েছিল প্রিয়জনের প্রশংসা, কোনো বিষয় এবং উৎসবকে কেন্দ্র করে।
কাসিদা ফার্সি শব্দ। শব্দটির অর্থ হচ্ছে কবিতার ছন্দে প্রিয়জনদের প্রশংসা করা। শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ ক্বাসাদ থেকে। ক্বাসাদ অর্থ পরিপূর্ণ। ‘ক্বাসাদ’ পরবর্তীতে ফারসি শব্দ ‘কাসিদা’য় রূপান্তর হয়। এক কথায় যে কবিতায় প্রিয়জনের প্রশংসা করা হয় তাকে কাসিদা বলে। রমজান মাসে কাসিদায় রমজানের তাৎপর্য ও গুরুত্ব, আল্লাহ, রাসুলের সা: প্রশংসা, কেয়ামত, হাশর, আখেরাত ও ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরা হয়।
কাসিদা রচনাকারীকে বলা হয় ‘কাসেদ’। প্রত্যেক কাসিদাওয়ালার একটি কাফেলা বা দল থাকে। কাফেলার দলনেতাকে বলা হয় ‘সালারে কাফেলা’। ‘কাফেলা’ এবং ‘সালারে কাফেলা’ সারা রাত জেগে থাকে গান গাওয়ার জন্য। সাহরির সময় হলেই তারা কাসিদা গাওয়ার জন্য কাফেলা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ঢাকার অলিতেগলিতে। আজকের ঢাকায় আমরা যে গজল বা কাসিদা গাওয়ার রূপটি দেখতে পাই এটি শুধু বাংলা, আরবি, উর্দু, ফারসি, হিন্দি ভাষার মিশ্রণে গজল গাওয়া নয়। এর উৎস পেতে হলে আমাদের খুলতে হবে ইতিহাসের পাতা।
কাসিদার জন্ম দশম শতাব্দীতে পারস্য তথা ইরানের কবিদের হাতে। তখন কবিরা ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্যে কাসিদা লিখতেন। ফেরদৌসির ‘শাহনামা’ মহাকাব্যের চেয়ে একটু ভিন্ন ঢঙে প্রথম কাসিদা লেখেন কবি রুদাকি। তখন কাসিদা লেখা হতো প্রশস্তিগাথা, শোকগাথা, নীতিকথা ও আত্মজীবনীমূলক। গজনীর সুলতান মাহমুদের দরবারে ছিলেন চারশত কবি। তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন ফাররোখি। কবি আনওয়ারিকেও শীর্ষস্থান দেয়া হয়। কবি নাসির খসরুর কাসিদায় দর্শনতত্ত্ব, আল্লাহতত্ত্ব, এবং নৈতিকতা মিলেমিশে একাকার ছিল, এজন্য বিশেষ খ্যাতিও লাভ করেন তিনি। আবু সীনা কাসিদা লিখতেন কেবল দর্শনতত্ত্ব নির্ভর। লিখতেন কবি আসজাদিও।
ধারণা করা হয়, কাসিদার প্রথম ধরনটা হচ্ছে ‘বসন্তের কবিতা’। ফার্সিতে যাকে বলে ‘বাহারিয়াহ’। অপর ধরনটি হচ্ছে ‘খাজানিয়াহ’ বা শরতের কবিতা। কাসিদা লেখা প্রকৃতির বর্ণনা দিয়েই শুরু হতো। তার সাথে মৌসুম, প্রাকৃতিক দৃশ্য বা মজার দৃশ্যকল্প জুড়ে দেয়া হতো। আর ‘তাখাল্লাস’ বা স্মৃতিকাতর অংশে কবি নিজের লেখক নাম ধরেই লেখা শুরু করতেন। শেষ অংশে থাকত কেন কবিতাটা লেখা হয়েছে সে উদ্দেশ্যের কথা। এছাড়াও আরো কয়েক ধরনের কাসিদার কথা রয়েছে। ফার্সি কাসিদার বৈশিষ্ট্য হলো অন্ত্যমিলে। শুরু থেকে শেষে একই অন্ত্যমিল থাকবে। তবে মাত্রা ভিন্ন হতে পারে। কাসিদার গড় দৈর্ঘ্য ৬০-১০০ লাইনে শুরু হয়ে ২০০ লাইনের দীর্ঘ কাসিদাও লেখা হতো। তবে ১০০ লাইন ছাড়িয়ে লিখতেন পারস্যের কবিরা।
আরবের লেখক ইবনে কুতাইবাহ আরবি কাসিদাকে তিনটি অংশে বিভক্ত করেছেন। তার রচিত নবম শতকের বই আন-শিরা ওয়া আন শুয়ারায় কাসিদার গঠনতন্ত্রের তিনটি অংশ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম অংশকে বলা হয় নসিব, যেখানে স্মৃতিকাতরতা প্রাধান্য পায়। দ্বিতীয় অংশকে বলা হয় ‘তাখাল্লাস’ যেখানে জীবনযাত্রার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হয়। আর তৃতীয় অংশকে বলা হতো ‘হিজা’। হিজা মূলত অন্যের প্রতি ব্যঙ্গার্থে ব্যবহৃত হতো।
পারস্য ও আরবি গঠনতন্ত্র থেকে বেরিয়ে ১৪ শতকের দিকে কাসিদা থেকে গজল রচনার হিড়িক পড়ে যায়। কেননা ততদিনে ফার্সিতে কাসিদার কদর কমতে থাকে। ফলে বন্দনামূলক উর্দু গজলের চর্চা শুরু হয়। কাসিদার প্রথম অংশকে ঘষামাজা করেই দৃশ্যকল্প ও মিষ্টি ভাষা দিয়ে এসব গজল সহজেই লেখা হত। গজল কাসিদার চেয়ে ছোট ও সহজে বোধগম্য হওয়ায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে মানুষের মাঝে।
মোগলদের দাফতরিক ভাষা ফার্সি হওয়ায় বাংলায় ফার্সি ভাষায় কাসিদার আগমন হয়। পূর্ববঙ্গে মোগল সেনাপতি মির্জা নাথানের ‘বাহারিস্তান-ই-গায়বি’তে কাসিদার প্রাচীন তথ্য পাওয়া যায়, ‘কোনো বিষয়ের প্রশংসা করে রচিত হতো কাসিদা। বিশেষ বিশেষ উৎসবকে আরো বর্ণময় করে তোলার জন্যই লেখা হতো কাসিদা’। ইসলাম খান চিশতির সঙ্গে ১৬০৮ সালে মোগল নৌবহরের সেনাপতি হিসেবে বঙ্গে এসেছিলেন মির্জা নাথান। তিনি সামরিক অভিযানে গিয়েছিলেন যশোরে। সেখানে আস্তানায় এক বিশাল আনন্দোৎসবের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে কবিরা নিজেদের লেখা কবিতা বা কাসিদা পরিবেশন করেন। সবার অনুরোধে যশোরের আবহাওয়া নিয়ে স্বরচিত কাসিদা আবৃত্তি করেন কবি আগাহি।
ঐতিহাসিক কাল থেকে কাসিদা গাওয়ার রীতি চালু ঢাকায়। এশিয়াটিক সোসাইটির ঢাকা কোষ বইতে নবাবি আমলে মহল্লার সর্দারদের কাসিদার প্রতি পৃষ্ঠপোষকতার কথা পাওয়া যায়। তবে পুরান ঢাকায় কবে থেকে কাসিদা গাওয়া শুরু হয় এ সম্পর্কে তেমন তথ্য পাওয়া যায় না। স্বাধীনতার পর ঢাকায় কাসিদা তেমন ঘটা করে আয়োজনও হতো না। তবে মাঝে মধ্যে কিছু লোক ব্যক্তি উদ্যোগে নিজ বাড়িতে কাসিদা শোনার আয়োজন করতো। তিন পর্বে বিভক্ত ঢাকার কাসিদার ‘চান রাতি আমাদ’ হলো প্রথম পর্ব। এই পর্বে কাসিদা গেয়ে রমজানকে স্বাগত জানানো হয়। দ্বিতীয় পর্বকে বলা হয় ‘খোশ আমদেদ’ বা ‘সদা’। রমজানে মধ্যভাগ পর্যন্ত তার গুরুত্ব উল্লেখ করা হয়। তৃতীয় পর্বকে বলা হয় ‘আল বিদা’। যা রমজানকে বিদায় জানিয়ে গাওয়া হয়।
এভাবে পুরান ঢাকার কাসিদা গাওয়ার জন্য গড়ে ওঠে দুটি দল। প্রথম দলের নাম ছিল ‘সুব্বাসি’ বা ‘সুখবাসী’। এরা ঐতিহ্যের উর্দু আর ফার্সি চর্চা করে কাসিদা গাইতো। দ্বিতীয় দলের নাম ছিল ‘কুট্টি’। এরা বাংলার সাথে উর্দু ও হিন্দি ভাষা মিশিয়ে কাসিদা গাইত। আবার উর্দু ও ফার্সিতেও গাইত। এই দু’দলের হাত ধরেই ঢাকায় কাসিদার আরম্ভ বলে ধরে নেয়া হয়।
ঢাকায় শুধু মাহে রমজানেই নয়, ঈদুল ফিতর ও মহররম উপলক্ষেও কাসিদা রচনা করা হত। ১৯৯২ সালে ‘হোসনি দালান পঞ্চায়েত’ প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন কাসিদা দল নিয়ে গড়ে তোলা হয় প্রতিযোগিতা ও পুরস্কারের আয়োজন। এখনো সে প্রতিযোগিতা উর্দু রোডে ২০ রমজান রাত ১১টা থেকে শুরু হয়ে চলে সাহরির সময় পর্যন্ত। এছাড়া হোসনি দালান, কসাইটুলি, খাজে দেওয়ান, বংশীবাজার, মিটফোর্ডসহ কয়েকটি মহল্লায় চলে কাসিদা প্রতিযোগিতা। স্বাধীনতার আগে প্রতিযোগিতা হতো পুরান ঢাকার ৩০-৩১টি মহল্লায়। এখন মাত্র ১১টি মহল্লায় হয়। এসব মহল্লার কাসিদা গায়কদের মধ্যে বিখ্যাত কয়েকজন হচ্ছেন জুম্মন মিয়া, মঞ্জুর আলম, আবদুস সামাদ, মানিক চান, সৈয়দ ফাসীহ হোসেন।
যুগ যুগ ধরে কাসিদা বিভিন্ন রূপ পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান সময় পর্যন্ত গজলে পরিণত হয়। এর পরবর্তীতে কী রূপে কাসিদা আমাদের সামনে উপস্থাপিত হবে তা কেবল কালই বলে দেবে। তবে ঢাকার অলিতেগলিতে হ্যাজাক বাতি, ঢোল, টিনের ড্রাম, হ্যান্ড মাইক ও কুকুর তাড়ানোর লাঠি হাতে তরুণরা দল বেঁধে কাসিদা গাওয়ার সেই ঐতিহাসিক চিরচেনা রূপটি প্রায় বিলুপ্ত। তবুও পাড়ায় পাড়ায় যে কটি দল দেখা যায় তা আসলে কাসিদা গাওয়ার নামে ‘বিভ্রান্ত বিনোদনের চিল্লাফল্লা’ ছাড়া উত্তম কিছু নয়। কালের বিবর্তনে যান্ত্রিক কাসিদা বিনোদন হজম হয়ে গেছে ডিজিটাল পেটে। মানুষ এখন ঝুঁকে পড়েছে ফেসবুক, ইউটিউব, মোবাইল, ইন্টারনেট প্রভৃতি বিনোদন ভুবনে। তাই তো কাসিদার বদলে স্মার্টফোনের অ্যালার্ম শুনে সাহরি খাওয়ার জন্য জেগে ওঠে তাক্বওয়া ভরা মুমিন-মুসলিম।