নেপালে ক্ষমতার লড়াইয়ে জয়ী হচ্ছেন কে পি অলি?
কে পি অলি - ছবি : সংগৃহীত
নেপালি কংগ্রেস-মাওবাদী কেন্দ্র জোট সরকার গঠনের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যাওয়ায় বিদায় হতে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী কেপি অলির সামনে আবার ক্ষমতায় থেকে যাবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। নতুন পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে ‘গেম অফ থ্রোনসে’ বিজয়ী হয়ে উঠতে শুরু করেছেন চীনপন্থী হিসেবে পরিচিত সিপিএন-ইউএমএল প্রধান কে পি অলি।
জনতা সমাজবাদীর মহান্থ ঠাকুর-রাজেন্দ্র মহাতোর নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠী সমর্থন দিতে অস্বীকৃতি জানানোতে দুই বিরোধী দল নেপালি কংগ্রেস-মাওবাদী কেন্দ্র একটি জোট সরকার গঠনের দাবি জানাতে প্রয়োজনীয় ভোটগুলো নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। নতুন জোট সরকার গঠনের দাবি জানানোর জন্য রাষ্ট্রপতির দেয়া সর্বশেষ সময় ছিল বৃহস্পতিবার রাত ৯টা। এই সময়সীমা কয়েক ঘন্টা আগে শেষ হয়ে গেছে।
শেষ হওয়া সময়সীমার মধ্যে ক্ষমতাসীন সিপিএন-ইউএমএলের অসন্তুষ্ট নেপাল-খানাল গোষ্ঠী তাদের পদত্যাগটি এগিয়ে না আসার কারণে এনসি-মাওবাদী কেন্দ্র জোটের সরকার গঠনের আশা ভেঙে গেছে। তারা দীর্ঘ দিন ধরে ইউএমএল চেয়ার অলির সাথে দর কষাকষির চিপ হিসেবে পদত্যাগের কথাটি বলে আসছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে পি শর্মা অলি বৃহষ্পতিবার ভোরে একটি জরুরি স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডেকেছেন যাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাধব কুমার নেপাল, সুরেন্দ্র পান্ডে, ভীম রাওয়াল ও ঘনশ্যাম ভূসালের উপর সদস্যপদ স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অলির সরকারের সর্বোচ্চ কার্যনির্বাহী পদ বজায় রাখার ব্যাপারে প্রতিকূল পরিস্থিতি এড়াতে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। পরে, অলি ও নেপাল বুধনীলকণ্ঠে ঘন্টার পর ঘন্টা দলীয় ঐক্য রক্ষার সাথে সম্পর্কিত পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেছেন। রাজেন্দ্র মাহাতো-মহন্ত জনতা সমাজবাদী পার্টির ঠাকুর গোষ্ঠী উভয় পক্ষের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা সংগ্রহের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সাথেও কে পি অলি যোগাযোগ রাখেন। অভিযোগ করা হয়েছে যে তাদের উপর অন্য পক্ষ কোনোরকম প্রভাব রাখতে না পারার জন্য ১৩ জন সংসদ সদস্যকে গোপন অবস্থায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
নিজ দল এবং অন্যান্য দলের সাথে বেশ কয়েক দফা বৈঠক শেষে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সংসদের দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তি নেপালি কংগ্রেস বলেছে যে তারা সরকার গঠনের দাবি পেশ করছে না। সংবিধানের ৭৬ (২) অনুচ্ছেদে কংগ্রেস এবং নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী কেন্দ্র) রাষ্ট্রপতির কাছে একটি জোট সরকার গঠনের দাবিতে খ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের সমর্থন পাবার চেষ্টা করছিল।
সোমবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভান্ডারী প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি সংসদে আস্থা ভোটে হেরে যাবার প্রেক্ষিতে পরবর্তী বড় দলগুলোকে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭৬ (২) অনুযায়ী তিন দিনের মধ্যে সরকার গঠনের দাবি করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
নেপাল কংগ্রেসের একজন নেতা জানিয়েছেন, দলের সভাপতি শের বাহাদুর দেউবা তার দলের সদস্যদের বলেছেন, 'জনতা সমাজবাদী পার্টির মহান্থ ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন দল আমাদের সমর্থন করতে অস্বীকার করার পরে নেপালি কংগ্রেসের নেতৃত্বে জোট সরকার গঠনের সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে।'
দুটি বিরোধী দলের অবশ্য স্পষ্টভাবেই প্রয়োজনীয় সংখ্যার অভাব ছিল এবং জোট সরকার গঠনের জন্য তাদের ৩২ জন ভোট নিয়ন্ত্রণকারী জনতা সমাজবাদী পার্টির সমর্থন প্রয়োজন ছিল। জনতা সামজবাদী বিভক্ত হয়ে মহাঁথ ঠাকুর-রাজেন্দ্র মাহাতোর নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠী অলিকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে, কংগ্রেস-মাওবাদী কেন্দ্র জোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে।
কংগ্রেস ও মাওবাদী কেন্দ্রের সংসদে যথাক্রমে ৬১ এবং ৪৯ ভোট রয়েছে। তাদের জোট সরকার গঠনের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে বলে দাবি করার জন্য আরো ৩২টি ভোটের প্রয়োজন ছিল। কংগ্রেস-মাওবাদী কেন্দ্র আশা করছিল যে ইউএমএলএর মাধব নেপাল অংশটির প্রায় ২০ জন সংসদ সদস্য পদত্যাগ করবেন। এতে
সংসদ সদস্য কমে ২৫১-এ নেমে আসবে আর সরকার গঠনের ম্যাজিক সংখ্যাটি ১২৬-এ নেমে আসবে। সেক্ষেত্রে, জনতা সমাজবাদী পার্টির উপেন্দ্র যাদব গোষ্ঠী ১৫ ভোট এবং সংসদে অন্য তিনটি দলের যেকোনো একটি ভোট পেয়ে কংগ্রেস-মাওবাদী কেন্দ্রের নতুন সরকার গঠনের সুযোগ ছিল।
নেপাল কংগ্রেসের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ শরণ মাহাত স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেছেন, 'জনতা সমাজবাদী পার্টির মহান্থ ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠী অলিকে সমর্থন করতে চেয়েছে এবং মাধব নেপালও পদত্যাগের ব্যাপারে
কোনো সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং নতুন সরকারের কাছে দাবি জানানোর মতো পরিস্থিতি ছিল না। উপেন্দ্র যাদব আমাদের সমর্থন করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন তবে তিনি প্রয়োজনীয় এমপির সংখ্যা আনতে পারেননি।'
বিরোধী দলগুলো জোট সরকার গঠনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হওয়ার সাথে সাথে অলি এখন সংসদে সর্বাধিক সদস্যবিশিষ্ট এক দলের নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর পদ দাবি করতে পারেন। অলির সিপিএন-ইউএমএলে সংসদে ১২১টি আসন রয়েছে। এর মধ্যে ভিন্ন মত পোষণকারী মাধব নেপালের গ্রুপটির সাথে বোঝাপড়ার জন্য তাদের দলের সদস্য পদ স্থগিত করার আদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ইউএমএল ঐক্যবদ্ধ থাকলে সমাজবাদী পার্টির মহান্থ ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠীর সমর্থন নিয়ে কে পি অলি সরকার গঠন করতে পারবেন।
সোমবার প্রধানমন্ত্রী অলির আস্থা ভোটের সময় ঠাকুর-মাহাতো গোষ্ঠীর সদস্যরা ভোটদান থেকে বিরত ছিলেন। উপেন্দ্র যাদব-বাবুরাম ভট্টরাই দলের সদস্যরা তার বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। এটি ছিল একই দলের মধ্যে থেকেই বিপরীত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের একটি অপ্রত্যাশিত অনুশীলন।
রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভান্ডারীর দেয়া সময় ধীরে ধীরে শেষ হয়ে আসার সাথে সাথেই অনুমান করা যায় যে অলি এই গেম অফ থ্রোনসে বিজয়ী হয়ে উঠতে শুরু করেছেন।
নেপালে সরকার গঠনের এই প্রতিযোগিতায় দৃশ্যত স্থানীয় দলগুলোর মধ্যে নানা মেরুকরণের চেষ্টা চলছে। তবে অন্তরালে প্রতিযোগিতা চলছে দেশটির প্রভাব বিস্তারকারি দুই প্রতিবেশী শক্তি ভারত ও চীনের মধ্যে। অলি সরকার গঠনের পর চীনা প্রভাব একদিকে অনেক বেড়ে যায়, অন্যদিকে ভারতের সাথে নেপালের ক্রমাগতভাবে সংঘাতমুখর সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। ইউএমএল’র অভ্যন্তরীণ বিরোধ এবং মাওবাদী কেন্দ্রের প্রধান পুষ্প কুমার দহলের সাথে অলির ক্ষমতার দ্বন্দ্বের পেছনে ভারতের গোপন প্রভাব সক্রিয় বলে ধারণা করা হয়।
ফলে কে পি অলির আবার সরকার গঠন করার সাফল্যের মানে একভাবে বলা যায় চীনা স্বার্থের বিজয় হয়েছে। অবশ্য সংসদে চূড়ান্তভাবে আস্থা ভোটে জয়ের আগ পর্যন্ত সেটি বলা যাচ্ছে না। তবে সরকার গঠনে সফল যদি অলি নাও হন তবে রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবি ভান্ডারি এবার সাংবিধানিকভাবেই সরকার ভেঙ্গে দিতে পারবেন। আর এতে আরেকটি সাধারণ নির্বাচন নেপালের জন্য অনিবার্য হয়ে উঠবে বর্তমান সংসদের দু’বছর মেয়াদ বাকি থাকতেই। সেটিও যদি বাস্তবে দেখা দেয় তবে তা হবে অলি বিরোধী তথা ভারতীয় লবির এক রকম পরাজয়।