প্রবাসীদের কষ্টের টাকা যেসব খাতে ব্যয় হয়
প্রবাসীদের কষ্টের টাকা যেসব খাতে ব্যয় হয় - ছবি : সংগৃহীত
ঈদের আগে বাংলাদেশে প্রবাসী আয়ে আবারো রেকর্ড হয়েছে। রিজার্ভ বেড়েছে। তাতে অর্থনীতির চাকা সচল থাকছে। কিন্তু প্রবাসীদের পাঠানো টাকা কোথায় ব্যয় হয়? তাদের জীবনে কী ধরনের পরিবর্তন আসে? তারা কি বিনিয়োগ করতে পারেন?
ঈদের আগে প্রবাসীরা চলতি মাসের প্রথম আট দিনে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ৯১ কোটি ৯০ লাখ ডলার বা আট হাজার কোটি টাকা। ঈদের আগে সর্বশেষ এই তথ্য জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, এটা একটি নতুন রেকর্ড।
গত এপ্রিলে প্রবাসী আয় এসেছে ২০৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার। যা গত বছরের এপ্রিলের চেয়ে ৮৯.১১ শতাংশ বেশি। গত বছরের এপ্রিলে রেমিট্যান্স এসেছে ১০৯ কোটি ২০ লাখ ২৯ লাখ ৬০ হাজার ডলার।
চলতি বছরের মার্চে প্রবাসী আয় এসেছে ১৯১ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। এপ্রিলে এসেছে ১৭৮ কোটি ডলার।
বাংলাদেশের ইতিহাসে রেমিট্যান্সের এত প্রবৃদ্ধি আগে কখনোই হয়নি।এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। সর্বশেষ রিজার্ভ ৪৫.১ বিলিয়ন ডলারের নতুন রেকর্ড গড়েছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, এটা রেকর্ড না হিসাবের পরিবর্তন তা বলতে আরেকটু সময় লাগবে। আমার মনে হয় বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসা বেড়ে গেছে। হুন্ডি বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে সরকারের হিসাবে বাড়ছে। আগেও বৈধ এবং অবৈধ মিলিয়ে একই রেমিট্যান্স আসত। আর করোনায় তো অনেকে ফিরে এসেছেন, বিদেশে লোক যাওয়া অনেক কমে গেছে। তাহলে রেমিট্যান্স বাড়ে কীভাবে!
বাংলাদেশের এক কোটিরও বেশি লোক দেশের বাইরে থাকেন। বড় অংশটি থাকেন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। আর প্রধানত ১০টি দেশ থেকে প্রবাসী আয় সবচেয়ে বেশি আসে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান , কাতার, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইটালি ও সিংগাপুর- এই ১০টি দেশ থেকে মোট প্রবাসী আয়ের ৮৯ শতাংশ এসেছে।
প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছেন, অর্থনীতির চাকা সচল রাখছেন। কিন্তু তারা সরাসরি এই অর্থ কী কাজে লাগাচ্ছেন।
অর্থনীতিবিদ এবং প্রবাসীদের নিয়ে যারা কাজ করেন তারা বলছেন, এপর্যন্ত যত গবেষণা হয়েছে তাতে দেখা গেছে প্রবাসীরা দেশে যে টাকা পাঠান তার বড় একটি অংশ ভোগ বিলাসেই ব্যয় হয়। আর বিনিয়োগ বলতে যা হয়, তা হলো জমিজমা কেনা, ঘরবাড়ি বানানো ও ফ্ল্যাট কেনা। প্রবাসী আয়ে এমন কোনো বিনিয়োগ হয় না যার মাধ্যমে কর্মসংস্থান হয়।
ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান জানান, সিলেট অঞ্চলে দেখা যায় প্রবাসীরা কোটি কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি তৈরি করেন। কিন্তু সেই বাড়িতে তাদের কেউ থাকেন না। আবার কুমিল্লা, টাঙ্গাইল, মুন্সিগঞ্জে জমিজমার দাম অনেক বেশি। কারণ ওই অঞ্চলে প্রবাসীরা যে টাকা পাঠান তা দিয়ে তাদের স্বজনেরা জমি কেনেন। এর বাইরে ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা, বিলাসিতা ও নানা ধরনের পণ্য ও সেবা কিনতে তাদের পরিবারের সদস্যরা প্রবাসী আয় খরচ করেন। কিন্তু তাদের সন্তানরা যে সবাই ভালো শিক্ষিত হন তাও নয়। কারণ তারা দেশের বাইরে থাকায় তাদের সন্তানদের দেখাশোনার তেমন কেউ থাকে না।
আবার প্রবাসী আয়ের ওপর ভিত্তি করে একটি গ্রুপ গড়ে উঠেছে তারা কোনো কাজকর্ম করেন না। তারা প্রবাস থেকে পাঠানো অর্থে বসে খান। প্রবাসী আয়ের একটি অংশ অবশ্য ছোট খাট ব্যবসা বা দোকান পাটে কাজে লাগানো হয়।
ফলে প্রবাসীরা ২০-২৫ বছর পর ফিরে এলে তাদের নিজের সম্পদ বলে সবার যা থাকে ওই বাড়িঘর ও জমিজমা। তাও আবার মালিকানা নিয়ে সমস্যা হয়। কারণ দেখা যায় দেশে থাকা আত্মীয় স্বজন তা নিজেদের নামে করেন।
বিআইডিএস-এর অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ মনে করেন, প্রবাসী আয় এই দেশে তাদের স্বজনেরা যদি ভোগ বিলাসে ব্যবহার করেন তাতে সমস্যা নাই। কারণ ভোগের মাধ্যমে অর্থনীতি সচল থাকে। পণ্যের চাহিদা বাড়ে উৎপাদন বাড়ে। অর্থনীতি সচল থাকে। এখন বাংলাদেশে যে ইলেকট্রনিক সামগ্রীর বিশাল বাজার হয়েছে, কারখানা হয়েছে এর পেছনে রয়েছে প্রবাসী আয়ের ভোগ ব্যয়।
তিনি বলেন, এই করোনার মধ্যে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ দেশের বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে আর্থিকভাবে সক্ষম রেখেছে। তা না হলে সরকারে পক্ষে তাদের সহায়তা করা সম্ভব ছিল না। আর ঈদের আগে প্রবাসীরা বেশি রেমিট্যান্স পাঠান। তার কারণ হলো যাতে তাদের স্বজনরা ভালোভাবে উৎসব করতে পারেন। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের জন্য ব্যয় অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি জানান, তবে এখন একটি অংশের প্রথম কয়েক বছর যায় ধারের টাকা শোধ করতে । বিদেশ যাওয়ার সময় তারা ঋণ করেন। তারপর দেশে থাকা পরিবারের খরচ মেটাতেই টাকা চলে যায়। আর পরিবারকে ভালো রাখতেই তো বিদেশে যান।
তবে তিনি মনে করেন, প্রবাসী আয়ের বিনিয়োগ হওয়া উচিত। সেটা হলে দেশে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এাজন্যই প্রবাসীরা এখন সরাসরি বন্ড কেনার সুবিধা দেয়া হয়েছে। এই স্থায়ী আমানতও এক ধরনের বিনিয়োগ। আর তাদের কিন্তু আয়ের ওপর প্রণোদনাও দেয়া হচ্ছে নানা ধরনের। কিন্তু তারা যেহেতু দেশে থাকেন না তাই জমিজমা কেনা আর ঘরবাড়ি বানানো ছাড়া অন্য কোনো বিনিয়োগের কথা তারা ভাবতে পারেন না।
শরিফুল হাসান মনে করেন, এজন্য প্রবাসীদের জন্য আলাদা ইকোনমিক জোন করা দরকার। বিনিয়োগের নিরাপত্তা পেলে হয়তো তারা বিনিয়োগ করবেন। এই দুই বিশ্লেষক মনে করেন, প্রবাসীদের মধ্যে বংশ পরম্পরায় বিদেশে যাওয়ার একটি প্রবণতা আছে। বাবার পর ছেলে যান। এর একটি কারণ হলো ভোগ বিলাসে অর্থ ব্যয় হওয়ার পর তাদের হাতে কিছু থাকে না। আবারো ছুটতে হয় প্রবাসে। যদি বিনিয়োগমুখী করা যায় তাহলে হয়তো তাদের জন্য নতুন আরেকটি সম্ভাবনা তৈরি হবে।
আর পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রবাসীরা তো সাধারণ মানুষ। তাই তারা প্রচলিত বিনিয়োগে গেলে রাজনৈতিক ও প্রচলিত পরিস্থিতির কারণে টিকতে পারেন না। তার মার খান, পুঁজি হারান। আমার পরিচিত অনেকে বিনিয়োগ করে পথে বসেছেন। তার চেয়ে তারা জমিজমা ও ঘরবাড়ি কেনা, ভালো খাওয়া, চিকিৎসা ও শিক্ষার দিকে নজর দিয়েছেন। এটাও তো উন্নয়ন। উন্নয়ন মানে ভালো থাকা। এভাবে যদি তারা ভালো থাকেন খারাপ কী?
সূত্র : ডয়চে ভেলে