বিপন্ন মানবজাতি
বিপন্ন মানবজাতি - ছবি : সংগৃহীত
নারীর ক্ষমতায়ন মানবজাতির জন্য কতটা ক্ষতিকর তার প্রমাণ মিলতে শুরু করেছে। সেই সাথে রয়েছে ভোগবাদী পাশ্চাত্য জীবন দর্শনকে সহায়তা দেয়ার জন্য আবিষ্কৃত জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। এ দু’টি কারণে মানবজাতির বিকাশের ধারা তথা জন্মহার ক্রমেই কমে যাচ্ছে। পৃথিবীর অনেক জনপদ হয়ে পড়ছে বিরান। সেখানে ফিরে আসছে অরণ্য। বর্ধিত সংখ্যা নিয়ে বন্যপশুরা সেসব জায়গায় আবার অবাধে বিচরণ করতে শুরু করছে।
নারীর স্বভাবসম্মত ভূমিকার পরিবর্তন এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি যে মানবসভ্যতার জন্য ভয়ানক হতে পারে সে বিষয়ে দুনিয়ার দার্শনিক ও সমাজ চিন্তকরা আশঙ্কা ব্যক্ত করে আসছিলেন বেশ আগে থেকেই। কিন্তু নারীর ক্ষমতায়ন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধের স্লোগানের মধ্যে যারা অর্থনৈতিক ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ খুঁজে পেয়েছিল তাদের উচ্চকণ্ঠের নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল দার্শনিক ও সমাজচিন্তকদের সতর্কবাণী।
‘ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ’ নামক পুস্তকে সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী ১৯৩৫ সালে এ বিষয়ে আলোকপাত করেন। তিনি লিখেছিলেন, ইউরোপে যন্ত্র আবিষ্কারের পর গড়ে ওঠা বড় বড় কারখানায় ব্যাপক উৎপাদন শুরু হয় এবং গ্রামের অধিবাসীরা দলে দলে চাষাবাদ ছেড়ে শহরের পথ ধরে। ফলে গ্রামাঞ্চল জনশূন্য হয়ে পড়ে এবং নতুন নতুন শহর গড়ে ওঠে। এসব শহরে সীমাবদ্ধ জায়গায় লাখ লাখ লোক একত্র হয়। এতে প্রাথমিকভাবে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হলেও পরে অর্থনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। জীবন সংগ্রাম কঠোর হয়ে পড়ে। আবাসস্থল সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ে এবং ভাড়া বেড়ে যায়। উপার্জনকারী মানুষ পরিবারে খাবার লোকের সংখ্যা বৃদ্ধিকে ভীতির চোখে দেখতে থাকে। প্রত্যেকটি লোক নিজের উপার্জন শুধু নিজেরই প্রয়োজনে খরচ করতে এবং অন্যান্য অংশীদারের সংখ্যা যথাসম্ভব কমাতে বাধ্য হয়। এ অবস্থায় নারীরাও নিজের ব্যয়ভার নিজে বহন করতে বাধ্য হয় এবং পরিবারের উপার্জনশীলদের মধ্যে তাদেরও শামিল হতে হয়। সমাজের পুরনো প্রথা অনুযায়ী পুরুষের উপার্জন করা ও নারীদের গৃহকর্মে নিযুক্ত থাকার কর্মবণ্টন ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়। নারীরা অফিস ও কারখানায় কাজ খুঁজে নেয়।
আর জীবিকা উপার্জনের দায়িত্ব গ্রহণের পর সন্তান জন্মদান ও তার প্রতিপালনের স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করা তার পক্ষে আর সম্ভব হয় না। তিনি আরো লেখেন, ‘আধুনিক বস্তুতান্ত্রিক সভ্যতা এমন পরিবেশ সৃষ্টি করে যে, প্রত্যেকেই নিজ নিজ আরামের জন্যে বেশি পরিমাণ সামগ্রী সংগ্রহ করার পক্ষপাতী এবং একের রিজিকে অন্য কেউ অংশীদার হবে তা কেউ মোটেই পছন্দ করে না।’ পশ্চিমের ভোগবাদী জীবনদর্শন নারীদের গর্ভধারণ ও সন্তান প্রতিপালনের দায়িত্ব গ্রহণের মানসিকতা কিভাবে ধ্বংস করছে সে তথ্যও তিনি তুলে ধরেছেন। এ প্রসঙ্গে পশ্চিমের চিন্তাবিদদের বক্তব্যও তিনি উদ্ধৃত করেছেন। তার মধ্যে রয়েছেন পল লিন্ডসে নামক একজন লেখক। তিনি ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত ‘সোস্যাল প্রোবলেমস’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘শিল্পভিত্তিক সমাজের মানুষ জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও উর্বরতা সম্পর্কে অত্যন্ত ভ্রান্ত ধারণার শিকারে পরিণত হয়েছে। এমন কি এখন যৌনসম্পর্ক স্থাপনকে সন্তান জন্মানোর সম্ভাবনা থেকে পৃথক করে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ যৌনযন্ত্রের আসল উদ্দেশ্য এখন সন্তান জন্মদান নয়, বরং আনন্দ উপভোগ বলে পরিগণিত হচ্ছে।’
ইংরেজ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল ১৯৫১ সালে প্রকাশিত তার ‘প্রিন্সিপলস অব সোস্যাল রিকনস্ট্রাকশন’ গ্রন্থে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে সমাজের উচ্চশ্রেণীর লোকদের সংখ্যা হ্রাস নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি লেখেন, ‘একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা ও নৈতিক মানদণ্ড পরিবর্তিত না হলে সকল সভ্য দেশে পরবর্তী দুই তিন স্তরের বংশধরদের নৈতিকমান নিকৃষ্টপর্যায়ে পৌঁছবে এবং সভ্য লোকের সংখ্যা শোচনীয়ভাবে হ্রাস পাবে।’ তার উদ্বেগ অবশ্য সভ্য লোকদের অর্থাৎ ইউরোপের মানুষ কমে যাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ফরাসি দার্শনিক হাক্সলিও একই ধরনের মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন। এসব লেখক, চিন্তাবিদরা এমন সময়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেন যখন ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব দুনিয়াজুড়ে খুব গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার ফল দেখা দিতে শুরু করেছিল। কিন্তু পৃথিবী তাদের উদ্বেগকে গুরুত্ব দেয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করেনি।
অবশ্য ১৭৯৮ সালে ম্যালথাসের তত্ত্ব প্রকাশের পর বহু বছর ধরে মনে করা হচ্ছিল যে, অতিরিক্ত জনসংখ্যা আমাদের কালের মারাত্মক সঙ্কট। তত্ত্ব প্রকাশের ২০০ বছর পরে ১৯৯৮ সালে স্ট্যানফোর্ডের জীববিজ্ঞানী পল এবং অ্যান এহরিচ তাদের বেস্ট সেলিং গ্রন্থ ‘দ্য পপুলেশন বোম্ব’-এ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, শিগগিরই পৃথিবীর লাখ লাখ মানুষ না খেতে পেয়ে মৃত্যুবরণ করবে। সেই থেকে, আসন্ন বিপর্যয়ের বিষয় কল্পনা করে নব্য-ম্যালথুসিয়ান পরিবেশ আন্দোলনের কিছু অংশ ভয়ানক চিৎকার চেঁচামেচি করছিল। এর পক্ষে সম্প্রতি ডেভিড অ্যাটেনবরো ‘লাইফ অন আওয়ার প্ল্যানেট’ নামের একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেন। যে সময় এহরিচরা তাদের ভবিষ্যদ্বাণী প্রকাশ করছিলেন, তখন বিশ্ব জনসংখ্যা বৃদ্ধি একেবারে শীর্ষে ছিল। সে সময়ে বছরে জনসংখ্যা ২.১ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বিশ্বের জনসংখ্যা এসময় ৩.৫ বিলিয়ন থেকে বেড়ে ৬.৬৭ বিলিয়ন হয়েছিল। তবে এখন সে বৃদ্ধির হার হ্রাস পেয়েছে এবং সে হার যথেষ্ট আশঙ্কাজনক। নারীর ক্ষমতায়নের অগ্রগতি এবং গর্ভনিরোধের ব্যবস্থাদির উন্নতি ঘটায় ও সহজলভ্য হওয়ায়, বিশ্বজুড়ে কোথাও কোথাও জন্মহার নি¤œমুখী এবং কোথাও রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখন অনেক দেশেই নারীদের মাথাপিছু ২.১ জনের চেয়েও কম শিশু রয়েছে। এটা হলো জনসংখ্যার স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে ন্যূনতম হার।
জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান হ্রাস বিশ্বের ধনী দেশগুলোর জন্য, বিশেষত জাপান এবং জার্মানিতে বড় ধরনের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছর দক্ষিণ কোরিয়ায় জন্মদানের হার ছিল নারীপিছু ০.৮৪। সন্তানের জন্মদানের হার বাড়ানোর জন্য সরকারের ব্যাপক প্রচার ও প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তা বাড়ছে না। এ বছর থেকে সেখানে ২ মিলিয়ন সন্তান গ্রহণেচ্ছু দম্পতিকে আগের বেনিফিট পেমেন্টের উপর আরও নগদ বোনাস ১,৩২০ ডলার দেয়া হচ্ছে। তবু আশানুরূপ ফল মিলছে না।
ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসেও সন্তান জন্মের হার নাটকীয়ভাবে হ্রাস পাচ্ছে। ২০১২ সালে যেখানে মহিলা প্রতি ১.৯ জন শিশু ছিল, তা ২০১২ সালে হয়েছে মাত্র ১.৬৫৫। ২০২০ সালের জন্য জাতীয় পরিসংখ্যান অফিসের তথ্য অনুযায়ী এটি এখন ১.৬ হতে পারে। যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের থেকে সর্বনিম্ন হার। স্কটল্যান্ডে সমস্যাটি আরও মারাত্মক। সেখানে ২০১২ সালের হার ১.৬৭৬৭ থেকে কমে ২০১৮ সালে ১.৩৭৩৭ এ দাঁড়িয়েছে।
থাইল্যান্ড এবং ব্রাজিলসহ মধ্যম আয়ের দেশগুলোতেও এ সমস্যা ক্রমবর্ধমান। ইরানে মহিলাপ্রতি ১.৭ সন্তান জন্ম দেয়ার হার সরকারের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে দেশের সরকার সম্প্রতি ঘোষণা করেছে যে সরকারি ক্লিনিকগুলো আর কাউকে গর্ভনিরোধক কোনো কার্যক্রমে সহায়তা করবে না বা ভ্যাসেক্টোমি করবে না। মেয়েদের সন্তান জন্ম দেয়ার হার হ্রাসের বিশ্বব্যাপী এ প্যাটার্ন দেখে জাতিসঙ্ঘ এখন বিশ্বাস করে যে, মানবসন্তানের সংখ্যা হ্রাসের আগেই আমরা কয়েক দশকের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির শেষ দেখব।
গত বছর ল্যানসেটে প্রকাশিত একটি প্রভাবশালী গবেষণায় ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল যে, প্রত্যাশার তুলনায় অনেক আগে ২০০০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা সর্বোচ্চ ৯.৭৩ বিলিয়নে পৌঁছেছিল। ২১০০ এর মধ্যে এ সংখ্যা ৮.৭৯ বিলিয়নে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জন্মহার কমে যাওয়ার জন্য এই গবেষণার লেখকরা যেসব কারণ উল্লেখযোগ্য হিসেবে দেখিয়েছেন সেগুলো হলো অর্থনৈতিক, সামাজিক, পরিবেশগত এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবসমূহ। তারা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, স্পেন, ইতালি এবং ইউক্রেনসহ বিশ্বের ২৩টি দেশ এই শতাব্দী শেষের আগে তাদের জনসংখ্যা অর্ধেকের চেয়ে কিছু বেশি দেখতে পাবে। চীন দম্পতি প্রতি এক সন্তান নেয়ার বিতর্কিত নীতি গ্রহণ করেছিল জনসংখ্যার বৃদ্ধির গতি কমাতে, এখন ২০১৬ সালে সে নীতির ইতি ঘটলেও জন্মহার বৃদ্ধির কোনো আশা দেখছে না। আগামী বছরগুলোতে জন্মহার কমতেই থাকবে এবং ২১০০ শতাব্দীর শেষ নাগাদ তার জনসংখ্যা আনুমানিক ৪৮ শতাংশ হ্রাস পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এটি আরও স্পষ্টতর হচ্ছে, ভবিষ্যতে যেসব প্রত্যাশা করা হয়েছিল তার থেকে খুব আলাদা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। তা হবে এক অন্য ধরনের সঙ্কট, বৃদ্ধ বয়সী জনগোষ্ঠী সঙ্কুচিত অর্থনীতিকে আরও বেশি চাপের মধ্যে ফেলে দেবে।
জনসংখ্যা হ্রাসের ফলে দুনিয়ার বাস্তব অবস্থা কেমন হবে? এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই প্রবণতাটি দেখতে পাওয়া দেশ জাপানের অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে আলোর দিশা হতে পারে। ইতোমধ্যে সেখানকার সব ঘরবাড়িতে বসবাসের মতো মানুষ খুব কমে গেছে। প্রতি আটটি ঘরের মধ্যে একটি এখন খালি পড়ে রয়েছে। জাপানি ভাষায় এসব শূন্য ভবনকে বলা হয় ‘আকিয়া’- ভূতের বাড়ি। গ্রামাঞ্চলে প্রায়ই দেখা যায়, অনেক বাড়ি পরিত্যক্ত এবং মেরামতের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এগুলো প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবির মতো দাঁড়িয়ে আছে এবং জনপদের পরিধি কমে যাওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে। মালিকদের মৃত্যুর পর অনেক খালি বাড়ি ‘আকিয়া’ হয়ে গেছে। হয়তো তাদের উত্তরাধিকারীরা কোনো শহরে বসবাস করছে। কিন্তু এসব বাড়ির মালিকানার দাবি নিয়ে তারা কখনও আসে না। এ কারণে মালিকবিহীন এসব অবকাঠামো স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ধ্বংস করতেও পারছে না।
অনেক জাপানি শহর কর্তৃপক্ষ নতুন বাসিন্দাদের আকর্ষণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। বাড়ি সংস্কারের ব্যয়ে সরকার থেকে ভর্তুকি দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এমনকি তরুণ দম্পতিদের নতুন বাড়ি দেয়ার সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছে। কিন্তু দেশটির জনসংখ্যা ২০৪৯ সাল নাগাদ ১২৭ মিলিয়ন থেকে ১০০ মিলিয়ন বা তার চেয়েও কমে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। ফলে ভূতের বাড়ির সংখ্যা বাড়তেই থাকবে এবং ২০৩৩ সালের মধ্যে সমগ্র জাপানি আবাসন কোয়ার্টারগুলোর এক তৃতীয়াংশ আর হিসাবের মধ্যে থাকবে না।
গ্রামীণ জনসংখ্যা হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে, পুরনো ফসলের ক্ষেত এবং অবহেলিত উদ্যানগুলো বন্যপ্রাণীরা পুনর্দখল করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এশিয়ান কালো ভল্লুকের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। কারণ ক্ষেত থেকে উৎপন্ন বাদাম তোলার এবং গাছে পাকা ফল পাড়ার কোনো মানুষ নেই। প্রাণীগুলোর খাবারের চাহিদা পূরণ হচ্ছে সেখান থেকে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নে ২০৩০ সালের মধ্যে ইতালির আকারের এলাকা জনশূন্য হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ২১০০ সালের মধ্যে স্পেনের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি নিঃশেষ হবে। ইতোমধ্যেই স্পেনের পৌরসভাগুলোর তিন-চতুর্থাংশ মানুষ কমে গেছে। পিকচারস্কু গ্যালিশিয়া এবং ক্যাসিটেলা ওয়াই লিওন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোর অন্যতম। এলাকা দু’টোর বেশির ভাগ বসতি ধীরে ধীরে বাসিন্দাশূন্য হয়ে গেছে। তিন হাজারেরও বেশি ভুতুড়ে গ্রাম এখন সম্পূর্ণভাবে পরিত্যক্ত হওয়ার মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এস্টেট এজেন্সির হয়ে গ্যালিশিয়ান কান্ট্রি হোমস পরিচালনা করেন এমন একজন ব্রিটিশ প্রবাসী মার্ক অ্যাডকিনসন বলেন, তার খাতায় ‘এক হাজারেরও বেশি’ পরিত্যক্ত গ্রামের নাম রয়েছে এবং তার স্টাফরা নিয়মিত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে রছে পরিত্যক্ত সম্পত্তিগুলোর মালিকদের খোঁজে চিঠি রেখে আসছে। এটা করা হচ্ছে এই আশায় যে, একদিন হয়তো তাদের খোঁজ মিলবে। তিনি বলেন, আমি ৪৩ বছর ধরে এখানে আছি। এ সময়ে পরিস্থিতির বেশ পরিবর্তন হয়েছে। তরুণরা গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে এবং বাবা-মা বৃদ্ধ হয়ে হাসপাতালের কাছাকাছি ফ্ল্যাট নিচ্ছেন। কেউ যখন আর গাড়ি চালাতে পারেন না, তখন তিনি পাহাড়ে আটকে পড়তে চান না, তার মন্তব্য।
জাপানের মতো অন্যান্য দেশেও প্রকৃতি ইতোমধ্যে প্রতিশোধ নিচ্ছে। মাদ্রিদের ইউনিভার্সিটি অব আলকালের পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হোসে বেনায়াসের মতে, ১৯০০ সাল থেকে স্পেনের অরণ্যের পরিমাণ বাড়তে বাড়তে তিনগুণ হয়েছে। ভূমির ব্যবহারকারী কমে যাওয়ায় বনভূমির পরিমাণ ৮ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশে বিস্তৃত হয়েছে। ক্রমহ্রাসমান জনসংখ্যা জমি বিসর্জন ত্বরান্বিত করেছে। কারণ কম মানুষকে খাওয়াতে কম জমি আবাদ করলেই চলে। ফ্রান্স, ইতালি এবং রোমানিয়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বনভূমি সম্প্রসারণের হার বেশি দেখা যাচ্ছে। পুরনো কৃষিক্ষেতগুলো প্রাকৃতিকভাবে গাছপালায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে। এ প্রবণতা ইঙ্গিত করে যে, এই ধরনের বনায়ন কমপক্ষে ২০৩০ সাল অবধি চলবে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিপুল সংখ্যক গ্রামের পরিত্যক্ত হওয়া ইউরোপে বৃহদাকার মাংসাশী প্রাণীদের পুনরুত্থানে অবদান রেখেছে। গত দশক ধরে লিংস, উলভারাইনস, বাদামি ভালুক এবং নেকড়ের মত প্রাণীর সংখ্যা বেড়েছে। স্পেনে আইবেরিয়ান নেকড়ের সংখ্যা ৪০০ থেকে বেড়ে দুই হাজারে দাঁড়িয়েছে। তাদের অনেকগুলোকে গ্যালিশিয়ার ভুতুড়ে গ্রামে চরে বেড়াতে দেখা গেছে। তারা বন্যশূকর এবং হরিণ শিকার করে। যাদের সংখ্যাও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। গ্যালিশিয়ায় দেড়শ বছরের মধ্যে গত বছর প্রথমবারের মতো একটি বাদামি ভালুকের উপস্থিতি শনাক্ত করা গিয়েছিল।
ভবিষ্যতের একটি দৃশ্যকল্প সম্ভবত এমন হতে পারে যে, বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধি শীর্ষস্থান স্পর্শ করার পর এখন ছোট ছোট জনগোষ্ঠী শহুরে কেন্দ্রগুলোতেই কেবল ভিড় করছে। শহরের সীমার বাইরে কেবল বন্যপশুদের রাজত্ব চলবে।
এ অবস্থা আমাদের জন্যও চরম হুঁশিয়ারি হতে পারে। আমাদের দেশে এখনও নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা বা নারীর ক্ষমতায়নের নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘যাহারাল ফাসাদা ফিল বাররি অল বাহরি বিমা কাছাবাত আইদিন নাছ’ অর্থাৎ জলে স্থলে যত বিশৃঙ্খলা অশান্তি তা মানুষের হাতের অর্জন। সত্য এই যে, মানবজাতি আল্লাহ নির্ধারিত প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা পরিবর্তন করতে গিয়ে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তাতে কেবল নিজেদের সর্বনাশের রাস্তাই পরিষ্কার করেছে। আমরা যদি এসব কর্মনীতি সংশোধন করে প্রাকৃতিক নিয়মে ফিরে না আসি, তাহলে কেবল অন্ধকার ভবিষ্যতই আমাদের অনিবার্য পরিণতি হতে পারে।