পৃথিবীতে নেমে আসা স্বর্গের শহর
পৃথিবীতে নেমে আসা স্বর্গের শহর - ছবি : সংগৃহীত
পবিত্র মসজিদ আল আকসা চত্তর আর পবিত্র শহর জেরুসালেম আজ রক্তাক্ত। ফিলিস্তিনিরা রক্ত দিচ্ছে আল আকসার জন্য, জেরুসালেমের জন্য। রক্ত ঝরছে গাজায়। জেরুসালেম ছেড়ে দেওয়া কার্যত অসম্ভব। তুরস্কের বিশিষ্ট কবি সেজাই কারাকোয়ের কথায়, এটি ‘স্বর্গে নির্মিত এবং পৃথিবীতে নেমে আসা শহর’ এটি ‘আল্লাহর শহর এবং সমস্ত মানবতার শহর’ সুতরাং এটি থাকতে হবে। যেখানে ইহুদিরা সমগ্র ফিলিস্তিনই দখল করে নিয়েছে, সেখানে মাত্র ১৪ একর জায়গার জন্য কেন এত অত্যাচার নির্যাতনের পরও ফিলিস্তিনের মুসলমানরা বারবার আল আকসা মসজিদের দিকে ধাবিত হচ্ছে?
রমজানের শেষ দিনগুলোতে, ইসরাইলি দখলদার বাহিনী আবারো মসজিদ আল-আকসা আক্রমণ শুরু করেছে। শতাধিক ফিলিস্তিনি আহত হবার এই ন্যাক্কারজনক ঘটনাকে তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রেসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের কাজ’ বলে বর্ণনা করেন। এর নিন্দা করেছেন অন্য মুসলিম দেশের নেতারাও।
গত ২ মে পূর্ব জেরুসালেমের শেখ জারাহ পাড়ায় কিছু ফিলিস্তিনি পরিবারকে জোর করে তাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্তের পরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ৭ মে ইসরাইলি পুলিশ তারাবির নামাজের সময় মুসল্লিদের উপর হামলা চালালে এর বিস্ফোরণ ঘটে। ১০ মে, ইসরাইলি ধর্মান্ধরা ‘জেরুসালেম দিবস’ উপলক্ষে নিরাপত্তা বাহিনীতে যোগ দেয়। আর একই সময় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এই ইস্যুটির কেন্দ্রে রয়েছে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের ‘ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর চুরি’ করার প্রচেষ্টা। ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে তা স্পষ্টভাবে দেখা গেছে। ইসরাইল শেখ জারাহর আশেপাশের অঞ্চলটিকে ফিলিস্তিনমুক্ত করতে চায়। গাজি সালাউদ্দিনের চিকিৎসকের নামে এর নামাকরণ করা। আর বাকি অংশ পূর্ব জেরুসালেম।
আল আকসার উপর আঘাত অথবা জেরুসালেম দখলের চেষ্টা ইসরাইলের এই প্রথম নয়। দেশটি ১৯৬৭ সালের পর থেকে পূর্ব জেরুসালেমকে 'ফিলিস্তিনমুক্ত' করার ধারাবাহিক নীতি অবলম্বন করেছে। এর অজুহাত দেয়া হচ্ছে ব্যক্তিদের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে তথাকথিত আইনী বিরোধ নিষ্পত্তি করা। ইহুদিদের তথাকথিত ‘সম্পত্তিতে’ অনুমিত প্রত্যাবর্তনের নামে ফিলিস্তিনি সম্পত্তি দখল ১৯৭২ সালে শুরু হয়েছিল এবং ১৯৯১ সাল থেকে তা বেড়েছে।
হাস্যকর বিষয় হলো, ইসরাইলের আদালত ব্যবস্থা শুধুমাত্র ইহুদিদের সম্পত্তি সম্পর্কিত আইনী দাবী করার অনুমতি দেয়। ফিলিস্তিনিরা জর্ডান থেকে অটোমান-যুগের দলিলপত্র এবং নথি উপস্থাপন করেও আদালতে হেরে যায়। ইসরাইলি আদালতগুলি আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অধিকৃত অঞ্চল পূর্ব জেরুসালেমের বাসিন্দাদের উপর কোন এখতিয়ার রাখে না। কিন্তু জবরদস্তিমূলকভাবে সেটিই তারা করেছে।
তথাকথিত আদালতের রায়গুলোর উপর ভিত্তি করে শেখ জারারাহে ৩৮ ফিলিস্তিনি পরিবারকে নির্বাসিত করার কাজটি জেরুসালেমের ইসরাইলি ইহুদিকরণ নীতির সর্বশেষতম কাজ। ইহুদিকরণ হলো এই অঞ্চলের বিভিন্ন মানুষ ও ধর্মের মধ্যে হাজার হাজার বছরের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে মুছে ফেলার একটি প্রচেষ্টা। জেরুসালেমে ইহুদিরাই একমাত্র বাস করবে তা নিশ্চিত করাই এর উদ্দেশ্য।
ইসরাইলের সম্প্রসারণবাদের নীতি বারবার মুসলিম বিশ্বের চোখের মণি আল-আকসা মসজিদকে লক্ষ্য করে। ১৯৬৯ সালের প্রথম দিকের আক্রমণগুলির মধ্যে একটি ঘটনায় একজন অস্ট্রিয়ান ইহুদিবাদী মসজিদে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। এটি ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) ভিত্তি গড়ে তুলেছিল, যা দুর্ভাগ্যক্রমে এখন খণ্ডিত এবং মূলত অনেকটাই অকার্যকর হয়ে আছে।
আল-আকসা মসজিদে অন্যান্য হামলার মধ্যে রয়েছে, ১৯৯০-এর আল-আকসা গণহত্যা, আরিয়েল শ্যারনের আল-আকসা মসজিদের চারপাশের কিছু অংশ দখলের চেষ্টা এবং মসজিদটির নিচে ও তার আশপাশে টানেল ও খননকাজ খনন করার ঘটনা।
যারা আজ ইসরাইলের নিষ্ঠুর নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করে চলেছে, তারা জায়নবাদীদের দ্বারা আল-আকসা মসজিদ দখলের অপচেষ্টার বিরোধিতা করেছে। ফিলিস্তিনি মহিলা এবং পুরুষ যারা মসজিদে পাহারা দিয়ে দাঁড়িয়েছেন, তারা জেরুসালেমের ইহুদিকরণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। তারা মহা প্রতিরোধ গড়ে
তুলে এবং তাদের বাড়িঘর ত্যাগ করতে অস্বীকার করে। এই রমজানে আবারো তারা আল-আকসা মসজিদটি রক্ষার জন্য জীবন দিয়েছে।
দুর্ভাগ্যক্রমে, তেল আবিবের সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে সমর্থন দেবার মতো বড় কোনো শক্তি নেই। ইসরাইল জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবসমূহকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে এবং আরব সরকারগুলো স্পষ্টত ফিলিস্তিনি ও জেরুসালেমের স্বার্থের বিষয় পরিত্যাগ করেছে। পশ্চিমা সরকারগুলির ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশে ইসরাইলের সম্প্রসারণবাদের কাজে প্রভাব পড়ছে না। বর্তমান দখলদারিত্বের পরও তাদের সমর্থন অব্যাহত রয়েছে। মুসলিম দেশগুলো খণ্ডিত এবং দাঁতবিহীন হয়ে পড়ায় ওআইসির বা আরব লিগের পক্ষে আল আকসার প্রতিরোধকারীদের পক্ষে কাজ করাও
সম্ভব হচ্ছে না।
ইসরাইলকে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য করতে নতুন বৈশ্বিক/আঞ্চলিক ব্যবস্থা না আসা পর্যন্ত আল-আকসা মসজিদ এবং জেরুজালেমে প্রতিরোধের শক্তিটিকে অবশ্যই বাঁচিয়ে রাখতে হবে। নতুন বিন্যাসের যে প্রক্রিয়া চলছে তা অচিরেই একটি অবয়ব নিতে পারে। এতে মুসলিম দেশগুলো আবার শক্তি অর্জন করতে পারে। এ সময় না আসা পর্যন্ত প্রতিরোধ টিকিয়ে রাখতে হবে। যেটি ফিলিস্তিনি অবিরাম রক্ত ঝরানোর মাধ্যমে জেরুসালেম পশ্চিম তীর ও গাজায় করে যাচ্ছে।
কেন আল-আকসা এত গুরুত্বপূর্ণ
আল-আকসা ফিলিস্তিনের মধ্যে একটি ছোট এলাকা, কিন্তু প্রতীকীভাবে এটি ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংঘর্ষের একটি বড় অংশ ।
আল-আকসা একটি ৩৫-একর যৌগিক চক্রের মধ্যে রূপার আস্তরণযুক্ত মসজিদের নাম। জেরুসালেমের পুরাতন শহর, যা জাতিসঙ্ঘ সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কোর দ্বারা একটি বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। এটি তিন ইব্রাহিমী ধর্মের (মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান) জন্য গুরুত্বপূর্ণ ।
মুসলমানদের জন্য ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান আল-আকসা মসজিদ। সপ্তম শতকের কাঠামো এটি যেখানে নবী মুহাম্মদ সা: মেরাজের দিন বেহেশতে যাত্রা করেছিলেন। কম্পাউন্ডের পশ্চিম প্রাচীর ইহুদীদের কাছে ওয়ালিং প্রাচীর নামে পরিচিত, দ্বিতীয় গির্জার শেষ অবশিষ্ট বলে মনে করা হয়। মুসলিমরা এটাকে আল-বুরাক প্রাচীর হিসেবে উল্লেখ করে এবং বিশ্বাস করে যে এখানে নবী মুহাম্মদ সা: আল-বুরাকে আরোহণ করে আসমানে উঠে আল্লাহর সাথে কথা বললেন । ১৯৬৭ সাল থেকে, জর্ডান এবং ইসরাইল সম্মত হয় যে ইসলামী ট্রাস্ট, চক্রের
ভিতরে বিষয় নিয়ন্ত্রণ করবে, কিন্তু ইসরাইল বাহ্যিক নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ করবে । অমুসলিমদের সাইটে ঘুরতে যাওয়ার সময় অনুমতি দেয়া হবে।
পবিত্র শহর জেরুসালেমে রয়েছে হযরত ইব্রাহিম আ: এবং মূসা আ:সহ অসংখ্য নবী রাসুলের কবর। এখানেই আল্লাহর মহানবী রাসুল সা: সকল নবী রাসুল এবং ফেরেস্তাদেরকে নিয়ে নামাজ পড়ছিলেন মেরাজ রাতে। সেই জামাতের ইমাম ছিলেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: আর এই জামাতে শরিক ছিলেন নবী রাসুলগণ। পবিত্র
আল আকসা মসজিদের নির্মাণের সাথে জড়িয়ে আছে হজরত আদম এবং সুলাইমান আ: এর নাম। এর সাথে জড়িয়ে আছে খলিফা হজরত উমর রা: এর সেই বিখ্যাত উটের বিরল ঘটনা। এর সাথেই জড়িয়ে আছে সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর অসংখ্য স্মৃতি। এই মসজিদের পাথরের গায়ে লেখা রয়েছে সম্পূর্ণ সূরা ইয়াসিন। এই মসজিদের জন্য হজরত সোলাইমানের নির্দেশে জ্বিনরা পাথর উত্তোলন করে আনে গহীন সাগরের তলদেশ থেকে। যা কিনা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না।