প্রকাশনাসংক্রান্ত জরুরি সভা ও লাল মোরগের ঝুঁটি
প্রকাশনাসংক্রান্ত জরুরি সভা ও লাল মোরগের ঝুঁটি - ছবি : অন্য এক দিগন্ত
গল্পটা যে এভাবে পাল্টে যাবে কেউ ভাবেনি। সবকিছু গোলমাল করে দিলো গায়েব আলী। সে কোথাকার কোন লাল মোরগ নিয়ে এসেছে আর আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। আমরা সবাই মুগ্ধ হয়ে লাল মোরগের ঝুঁটি দেখতে দেখত তন্ময় হয়ে গেলাম। তখন কোথায় গেলো আমাদের প্রকাশনাসংক্রান্ত জরুরি সভা, কোথায় গেলো নাগরিক কর্তব্য বোধের আত্মম্ভরিতা! আমরা আশ্চর্য হয়ে লাল মোরগের ঝুঁটির প্রশংসা করতে লাগলাম এবং গায়েব আলী ঠিক সেসময়ই তার মোক্ষম অস্ত্রটি আমাদের উপর প্রয়োগ করলেন।
- এই মোরগের জাত আমি নিজে উদ্ভাবন করেছি।
- বলেন কি!
- হ্যাঁ, বিশ্বাস না হলে গুগলে সার্চ দিয়ে দেখেন।
প্রবীণ কবি বিজন দাশের কথার জবাবে এমনই উত্তর দেন গায়েব আলী। আমরা আরও অবাক হয়ে তার কথা যেন গিলতে থাকি। গায়েব আলী বলছেন...
সীমান্তের কাঁটাতারের কাছ থেকে আমি একটা পালক পেয়েছিলাম। হতে পারে সে পালকটি কোনো পাখির, মোরগের, অথবা মানুষেরও হতে পারে। সীমান্ত পার হওয়ার সময় তো মানুষ পাখিই হয়ে যায়, নাকি? অথবা যে মানুষ সীমান্ত মানে না তার তো ডানা থাকা অকল্পনীয় নয়, কি বলেন আপনারা?
আমরা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। গায়েব আলী আবার বলতে লাগলো,
ইন্দোনেশিয়ায় একটা মোরগের প্রজাতি আছে। কুচকুচে কালো। বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি, তাই দামটাও অনেক বেশি। অনেক মানে অনেক। বাংলাদেশের টাকায় কয়েক লাখ। আয়াম চেমানি বলে সে মোরগকে। এই মোরগের গোশত কালো। এটি এখন এতটাই দুর্লভ যে খোদ ইন্দোনেশিয়াতেই এটির দেখা তেমন পাওয়া যায় না।
আমরা আয়াম চেমানির কথা অনেকেই জানি। তাই আয়াম চেমানির প্রসঙ্গে আমাদের আগ্রহে ভাটা পড়ে। কিন্তু ভাটা পড়ে না গায়েব আলীর কথার প্রবাহে। তিনি টানা বলে যেতে থাকেন-
- সে দেশে হাতে গোনা কিছু খামারি এই মোরগ পালন করে। আয়াম চেমানির রক্ত বাদে চোখ, ঠোঁট, চামড়া, গিলা, কলিজাসহ দেহের আর সবই কালো। এরকম সর্বাঙ্গ কালো আর কোনো পশুপাখি পৃথিবীতে নাই।
- আমরা আমাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলি এবং নিজামউদ্দীন রাব্বি সিনিয়র সিটিজেন কবি আজফার আজিজকে নম্রভাবে জিজ্ঞাসা করে,
- আজফার ভাই, আসলে কি এইসবের কোনো মানে আছে?
আজফার আজিজ ভাই এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন,
আছে।
আমি সাথে সাথে সুর মেলালাম,
অবশ্যই আছে। শোনো রাব্বি, আমার একটি কবিতার লাইন আছে এমন, ‘তৃষ্ণার্ত পর্বতের প্রতি জলকণা বুকে ফিরিয়ে দেয় নদী।’ কোনো কিছুই অর্থহীন থাকে না। সবকিছুই মূল্যায়িত হয়। কোনো না কোনো সময় হয়।
আজফার আজিজ ভাই আমার কথায় মিলিয়ে বললেন,
এই দেখো না, আমি কতো আগে লিখেছি বইগুলো। অথচ এগুলোর সংস্করণ কিন্তু এখনও পাঠকের দাবি। একটি তো আমাজনে এখনো পাওয়া যাচ্ছে। কিন্ডেল এবং হার্ড, দুটোই।
অথচ এই আজফার আজিজ ভাই-ই প্রথমে আমাকে ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন,
এসব করে লাভ কী? আল্টিমেটলি এর ফলাফল কী?
আমি একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলেছিলাম,
সাংস্কৃতিক ভাষায় যা আগুন, তা কিন্তু নিশ্চয়ই জলে ওঠার অধিকার রাখে।
আজফার ভাই আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
কিন্তু যা কিছু আগুন, তা তো জ্বলন্তই।
আমি বললাম,
আগুন তো নিভে আছে ভাই।
বুধবার বিকেল না হতেই কবি এ কিউ আশিক আমাকে মেসেঞ্জারে মনে করিয়ে দিলেন, আজ কিন্তু আপনার আসার কথা।
আমিও কালবিলম্ব না করে উনাকে নিশ্চিত করলাম। মোবাইল থেকে মেসেঞ্জারে লিখলাম, হ্যাঁ আশিক ভাই, আজ আসবো। একটু আগে আগেই চলে আসবো, পাঁচটার দিকে। দয়া করে ফ্রি থাকার চেষ্টা করবেন। না হলে আমার ফিরতে একটু সমস্যা হয়।
কথামতো বিকেল পাঁচটার আগ থেকেই চকবাজারে অপেক্ষা করতে থাকে কবি এ কিউ আশিক। আমার যেতে একটু দেরি হয়। মুরাদনগর থেকে সিএনজি এবং বাস, আবার বাস থেকে নেমে সিএনজিতে শহরে। এতো ঝামেলার মধ্যে দু’চার দশ মিনিট, কিংবা আধা ঘণ্টা এক ঘণ্টাও বিলম্ব হওয়া অস্বাভাবিক না। কিন্তু আমার তেমন বেশি দেরি হয় না। পাঁচটা পঁচিশেই আমি শহরে চলে যাই। শাসনগাছা থেকে চকবাজারের সিএনজিতে না উঠে আমি উঠি কান্দিরপাড়ের সিএনজিতে। আহা, কতদিন ধরে কুমিল্লার প্রাণকেন্দ্রটি দেখি না। কান্দিরপাড় নেমে আমার চোখ আনন্দে নেচে ওঠে। যুগের অধিককাল এ কান্দিরপাড় আমার আত্মীয়। আমি তাকে কী করে ভুলে থাকি!
কান্দিরপাড় নেমে টাউন হলের ভেতর একপাক ঘুরে সাত্তার খানের বিপরীত মার্কেট থেকে দুয়েকটি প্রয়োজনীয় জিনিস কিনি। এর মধ্যে আশিক ভাই আবারও ফোন করেন, কই ভাই?
আমি একটু কান্দিরপাড় নেমেছি। দুই মিনিট লাগবে। এখনই আবার চকবাজারের সিএনজিতে উঠবো।
আশিক ভাই কিছুটা মনক্ষুণœ হলেন মনে হলো। বললেন, তাহলে কান্দিরপাড়ই থাকেন। আমি আসতেছি।
আমি কি যেন বলতে গিয়েও পারলাম না। লাইন কেটে গেল। একা একা আবার পুবালি চত্বরে ফিরে আমাদের আড্ডার অভয় ঘর অলৌকিক ভবনের ছাদে উঠে এলাম। জানতাম, এখানে এলে কাউকে না কাউকে পেয়ে যাবো আর আমার একাকিত্বও কেটে যাবে। যথারীতি অলৌকিক ভবনের সরু সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠেই পেলাম শ্রদ্ধাভাজন কবি আজফার আজীজ ভাইকে। তবে তিনি ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছেন। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে শেষে নিজামউদ্দীন রাব্বিকে ফোন দিলাম,
- তুই কই, রাব্বি?
- আমি তো কান্দিরপাড়।
- আমিও তো কান্দিরপাড়।
- কস কী? কই আছস?
-অলৌকিক ভবনের ছাদে আছি। তুই চলে আয়, এখানে আজফার আজিজ ভাইও আছেন।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজামউদ্দিন রাব্বি এসে হাজির। আমি আজফার ভাই ও রাব্বি গিয়ে বসলাম শাহজাহানের চেম্বারে। সেখানে শাহজাহান নেই, কিন্তু চেম্বারটা আমাদের জন্য সবসময় খোলা। রাব্বি তার হাতের ছোট্ট প্যাকেটটি খুলতে শুরু করলো। আমরা দেখলাম, তার প্যাকেট থেকে উঁকি দিয়ে বেরুচ্ছে বেথুন ফল। বললাম,
- দারুণ জিনিস তো! কোথায় পেলি?
- হুম, দারুণ। তবে খেতে যেমন দারুণ, তেমনি এটি সংগ্রহ করতে গেলে কাটার আঘাতও কম সহ্য করতে হয় না। এটি আর এখন তেমন পাওয়া যায় না।
কথার মোড় ঘুরিয়ে দিলেন আজফার ভাই। সরাসরি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
- আচ্ছা, তুমি যে অনুষ্ঠানগুলো করছো, কেনো করছো?
এমন একটি প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। অপ্রস্তুত অবস্থা কাটাতে বুঝেও না বোঝার ভান করে বললাম,
- কোন অনুষ্ঠান?
- ওই যে, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে ধর্ষণের প্রতিবাদে যে অনুষ্ঠান করছো।
- ও আচ্ছা, সেটি তো একটি জাতীয় প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করা আজফার ভাই। একজন লেখক হিসেবে আমি আমার অবস্থান থেকে প্রতিবাদ জানিয়েছি।
- বুঝলাম, কিন্তু আল্টিমেটলি এসবের ফলাফল কী?
আমার মুখে তাৎক্ষণিক আর কোনো উত্তর যোগায় না। কারণ, ফলাফল যে শূন্য তা আমরা এতো দিনে সবাই কমবেশি নয়, খুব বেশি করে বুঝে গেছি। তবুও বললাম,
- আমাদের শিল্পীত প্রতিবাদ, হে আগুন জ্বলে ওঠো।
তখন আজফার ভাই ব্যাপারটিকে একটু সহজ করে দেন। বলেন,
- আগুন তো জ্বলছেই
আমরা ভাবলাম, চেম্বার থেকে বেরিয়ে ছাদে গিয়ে এই নির্মল সন্ধ্যায় বেথুনগুলো খাওয়া যেতে পারে। ছাদে উঠে দুটি বেঞ্চিতে বসলাম। রাব্বি একটি কাঁচি দিয়ে থোকা থেকে বেথুন ছাড়াতে থাকে। তখনই আশিক ভাইয়ের ফোন আসে,
- আরিফ ভাই, কই আপনে?
- অলৌকিক ভবনের ছাদে আছি। আপনি চলে আসেন।
আশিক ভাই বললেন,
- একটু নিচে নামেন, পার্সোনালি কয়েকটা কথা বলমু, তারপর একসাথে আবার ছাদে যামু।
নিচে নামতেই আশিক ভাই গায়েব আলীকে নিয়ে উপস্থিত হলেন। আমাকে গায়েব আলীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন,
- ইনি গায়েব আলী, আমার শ্বশুরবাড়ির এলাকার মানুষ। উনি একজন অসাধারণ উদ্ভাবক। আপনি উনাকে নিয়ে ছাদে যান, আমি একটি কাজ সেরে আসছি।
আমি গায়েব আলীকে নিয়ে ছাদে যাই। দেখি ততক্ষণে অগ্রজ কবি বিজন দাসও এসেছেন। গায়েব আলীকে নিয়ে সেখানে ঢুকতে রাব্বি, আজফার আজীজ ভাই ও বিজন দাস সবাই বিস্ময় নিয়ে নতুন মানুষটিকে দেখলো। আমি বললাম,
- ইনি গায়েব আলী। অসাধারণ একজন উদ্ভাবক। আশিক ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ির এলাকার মানুষ।
উপস্থিত সবাই আবার গায়েব আলীর দিকে নিরীক্ষকের দৃষ্টিতে তাকায়। রাব্বি কৌতূহলী কণ্ঠে বলে ওঠে,
- তো কী কী উদ্ভাবন করলেন, সম্মানিত গায়েব আলী সাহেব?
গায়েব আলী একগাল হেসে বললেন,
- আমাকে সম্মানিত বলার দরকার নেই, সাহেবও বলার দরকার নেই। আমি নিতান্ত সাধারণ একজন মানুষ। সীমান্তের কাছাকাছি আমার বসবাস। শুনলাম আপনারা বিজ্ঞজন, তাই আপনাদের সাথে দেখা করতে এলাম। তবে শুধু দেখা করতে নয়, কিছু দেখাতেও এসেছি আমি। এই দেখেন...
বলে সে তার হাতের বড়সড় খাঁচার উপর থেকে কালো পর্দাটি সরিয়ে ফেললেন। সন্ধ্যার অন্ধকারে আমরা দেখলাম একটি চমৎকার মোরগ খাঁচাটির ভেতর বসে আছে। নিজামউদ্দিন রাব্বি তার মুঠোফোনের ফ্লাসলাইট জ্বালতেই আমাদের মুখ-চোখ চড়কগাছ হয়ে গেলো। এত টকটকে লাল মোরগ আমরা এর আগে আর কখনোই দেখিনি। আজফার ভাইও নিরঙ্কুশ প্রশংসা করলেন মোরগটির। তখন গায়েব আলি তার মোরগের আসল বিশেষত্ব আমাদের কাছে তুলে ধরেন। দেখান যে, এই মোরগের পা থেকে মাথার ঝুঁটি পর্যন্ত সবকিছু লাল এবং তারুণ্যের টকটকে রক্তের মতো লাল। তিনি দেখান যে, লাল মোরগটির ঝুঁটিটিই সবচেয়ে আকর্ষণীয়, তিনি বলেন,
- ঝুঁটি যেন ঝুঁটি নয়, যেন রক্তের গম্বুজ।
আমরা সবাই অপলক চোখে এর ঝুঁটির দিকে তাকিয়ে থাকি, আমরা যারপরনাই অবাক। তখন গায়েব আলী জানান, এ প্রজাতির মোরগটি তিনি নিজে আবিষ্কার করেছেন এবং পৃথিবীতে একমাত্র উনার কাছেই এটি পাওয়া যাবে। তখন তিনি আমাদের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেন,
- গুগলে সার্চ দিয়া দেখেন, পৃথিবীতে কোথাও আর এমন অদ্ভুত সুন্দর মোরগ খুঁজে পাবেন না।
আমরা তখন তার কথা মগ্ন হয়ে শুনি এবং এক পর্যায়ে তিনি যখন আমাদেরকে আয়াম চেমানির গল্প শোনাতে থাকেন তখন আমরা সাময়িক মনোযোগ হারিয়ে ফেলি এবং নিজামউদ্দীন রাব্বি আমাদের পূর্বের কথার রেশ ধরে জানতে চায়, সাংস্কৃতিক প্রতিবাদের সত্যিই কোনো মানে আছে কি না? কিন্তু গায়েব আলী তো গায়েব আলী। তার প্রতি মনোযোগ বিচ্ছিন্ন রাখা কঠিন। তিনি আবারও গলা খাকারি দিয়ে শুরু করেন-
- ডানা গজালেই তো মানুষ সীমান্তকে অগ্রাহ্য করতে পারে। তাছাড়া আর কিভাবে মানুষ রাষ্ট্র নামক কারাগার থেকে মুক্তি পাবে? একমাত্র পাখির কোনো কারাগার নেই। তো আমি যে কথাটি বলছিলাম যে, আমি একটি পালক পেয়েছিলাম সীমান্ত থেকে। ঠিক সীমান্তের সেই যায়গাটি থেকে যেখানে আমার ভাইয়ের লাশ পড়েছিলো বলে লোকমুখে শুনেছি। কিন্তু যখন আমি লাশ আনতে গেলাম, সেখানে কোনো লাশ পেলাম না। কোনো রক্তের দাগও না। শুধু কয়েকজোড়া বুটের চিহ্ন সেখানে পড়ে আছে। আমি মাটিতে শুয়ে ভাইয়ের শরীরের গন্ধ নিতে চাইলাম। নাহ! মাটিটা পর্যন্ত খুঁড়ে নিয়ে গেছে বিএসএফের সদস্যরা। তখন, ঠিক কতক্ষণ পর জানি না, আমি মাটি থেকে মাথা তুলে দেখতে পেলাম টকটকে লাল রঙের একটি পালক পড়ে আছে সেখানে। আমি আগেই বলেছি, পালকটি কোনো পাখির হতে পারে। হতে পারে কোনো ঈগলের। আমার ভাই যখন লাশ হয়ে এখানে পড়েছিলো তখন হয়তো সে ঈগল এসেছিলো লাশের চোখ উপড়ে নিতে। হয়তো নিয়েও গেছে, অথবা নিতে পারেনি, তার আগেই চলে এসেছে বিএসএফ সদস্যরা। আমি উঠে পালকটি তুলে নিলাম। বুকের কাছে খুব যত্ন করে রেখে দিলাম।
- তারপর সেই পালক থেকে এই অদ্ভূত সুন্দর মোরগটির জিনকোড আবিষ্কার করলেন, তাই তো?
প্রশ্ন করলেন আজফার ভাই। গায়েব আলী বললেন,
- অত সহজে না। বলছিলাম আয়াম চেমানির কথা। ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে এর উৎপত্তি। এ রকম সর্বাঙ্গ কালো আর কোনো পশুপাখি পৃথিবীতে নেই। এজন্য স্থানীয়রা বিশ্বাস করে যে আয়াম চেমানি হলো জাদুর মোরগ। এই মোরগের নাকি ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে। আর এই লোকবিশ্বাসের কারণেই আয়াম চেমানির দাম প্রায় আকাশছোঁয়া।
এমন সময় কবি এ কিউ আশিক এসে হাজির হন এবং বিলম্বের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। আমি বলি,
- আশিক ভাই, আজ আমার দেরি হয়ে গেছে। আর বেশি দেরি করলে হয়তো ফেরার গাড়ি পাবো না। তাই প্রকাশনাসংক্রান্ত যে বিশেষ মিটিং আজ হবার কথা ছিলো তা আপাতত স্থগিত থাকুক। আজ বরং গায়েব আলীর এই রক্তরং মোরগের গল্পটা শুনেই বিদেয় হই।
তখন গায়েব আলী আবার বলতে শুরু করে,
- বলছিলাম, সীমান্ত থেকে পালকটি আমি কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। বুকের কাছে চেপে ধরে আমি সেই পালকটি বাড়িতে নিয়ে আসি। আমার বিশ্বাস হয় যে, এই পালকটি হতে পারে আমার ভাইয়েরও, যে সীমান্ত অতিক্রমের সময় বিএসএফের গুলিতে নিহত হয় এবং বিএসএফ জওয়ানরা তার লাশটি পর্যন্ত নিয়ে যায়। আমি একটি পরিষ্কার শাদা কাপড় দিয়ে পালকটি জড়িয়ে রাখি। পরদিন সকালবেলা আবিষ্কার করি, এ পালক কোনো সামান্য পালক নয়। এর মধ্যে হয়তো লেগে আছে আমার ভাইয়ের সীমান্ত ডিঙানোর পাখি হৃদয়ের স্পিরিট। এই ভাবনার পর থেকেই পালকটি নিয়ে গবেষণা শুরু করি এবং একসময় আয়াম চেমানি সম্পর্কে জানতে পারি। আর সেই আয়াম চেমানির জিনকোড বিশ্লেষণ করে ও সীমান্তে পাওয়া পালকের ডিএনএ মিলিয়ে দীর্ঘ আটবছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর তৈরি করি এই রক্তবর্ণের বিশেষ মোরগ। এর বিশেষত্ব হলো, এর গায়ে, ভেতরে বাহিরে একটিই রং। অন্য কোনো রঙের ব্যবহার এতে নেই। এর পিত্ত থেকে শুরু করে যকৃত, হাড়, মাথার মগজ সবই রক্তের মতো লাল। আর এই লাল হলো আমার সীমান্ত পাড়ি দিতে চাওয়া ভাইয়ের রক্তের দ্রোহের প্রতীক।
আমরা তন্ময় হয়ে গায়েব আলীর গল্প শুনছিলাম, কি যেন কি কারণে আমরা সবাই নির্বাক হয়ে গেলাম। একসময় নীরবতা ভেঙে আজফার ভাই উঠে দাঁড়ান। কিছু না বলে নিঃশব্দে অলৌকিক ভবনের ছাদ থেকে নেমে যান। আমরা ঠায় বসে আছি। সবাই যেন বরফের মতো জমে গেছি অথবা পাথরের মতো জড় হয়ে গেছি গায়েব আলীর উদ্ভাবনের গল্পে। এক সময় প্রবীন কবি বিজন দাসও উঠে পড়লেন এবং চোখ মুছতে মুছতে নীরবে প্রস্থান করলেন। আমি আর রাব্বি নিচে নেমে এলাম। অলৌকিক ভবনের নিচে দুলালের চায়ের দোকানের সামনে এসে আমরা দাঁড়ালাম। এমন সময় সেখানে এলো রম্যকার এসএএম আল মামুন। মামুন আমাদেরকে নানা কথা জিজ্ঞেস করছিলো, বিশেষ করে আমার এতদিন পর কুমিল্লায় আসা নিয়ে তার উচ্ছ্বাস ও কৌতূহলের শেষ নেই। কিন্তু গায়েব আলীর গল্পের ঘোর তখনও আমাদেরকে এতো বেশি তন্ময় করে রেখেছে যে, আমি মামুনের কোনো কথার জবাব দিতে পারলাম না।
নীরবে হাত মিলিয়ে আবার চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ইতোমধ্যে গায়েব আলী আর আশিকও অলৌকিক ভবনের ছাদ থেকে নেমে এলো এবং নিঃশব্দে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালো। আমরা চায়ের অর্ডার করতে যাবো এমন সময় অগ্রজ কবি রুবেল কুদ্দুস এলেন। আমাকে অনেকদিন পর দেখে খুবই স্নেহময় সুরে কুশল জিজ্ঞেস করলেন। আমি শ্রদ্ধার সাথে দুয়েক কথায় উনার প্রশ্নের জবাব দিলাম। উনিও বুঝলেন, সবাই যেরকম নিশ্চুপ, নিশ্চয়ই কোনো একটি বড়সড় ঘটনা ঘটে গেছে এর মধ্যে। দুলাল চা বানিয়ে সবাইকে পরিবেশন করলো। স্বচ্ছ কাপের ভেতর ইস্পাহানি স্পেশাল ব্লেন্ডের রং চা তারুণ্যের টগবগে রক্তের মতো উষ্ণতা ছড়াতে লাগলো। আমি, নিজামউদ্দিন রাব্বি এবং কবি এ কিউ আশিক একযোগে তাকালাম গায়েব আলীর মুখের দিকে।