উয়ারী-বটেশ্বর : সুপ্রাচীন এক জনপদের সন্ধানে
উয়ারী-বটেশ্বর : সুপ্রাচীন এক জনপদের সন্ধানে - ছবি : সংগৃহীত
কোনো সুউচ্চ রাজপ্রাসাদের চিহ্ন নেই। রাজকীয় ইমারতও নেই। কেবলই ঘরোয়া কিছু তৈজসপত্র, গৃহস্থালির ব্যবহার-সামগ্রীর কিছু নিদর্শন। বেশ কিছু মুদ্রার ভগ্নাংশ, দুর্গ-দেওয়ালের অংশবিশেষ। এই তো। এক স্তর মাটির গর্ভে পাওয়া এসব সামগ্রী যা সাধারণ দৃষ্টিতে প্রায় মূল্যহীন- আর তাই হইচই ফেলে দিলো ইতিহাসের মানুষের ভেতরে।
হইচই ফেলারই কথা। কারণ এসবের মধ্য দিয়ে ঠিক হরপ্পা-মহেনজোদারোর মতো প্রাচীন জনপদের সন্ধান পাওয়ার পথ খুলে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই ঘটনাটি প্রত্নতত্ত্ববিদ আর ইতিহাসের নিবিড় অনুসন্ধানী মানুষদেরও দারুণভাবে আকর্ষণ করল। বাংলাদেশ ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অনেক প্রাচীন স্থাপত্যকীর্তির সন্ধান মিললেও সেগুলোতে রাজা, রাজধানী আর রাজকীয় কায়-কারবারের ছাপ রয়েছে। কিন্তু বছর দু-আড়াই হাজার বছর আগের সাধারণ মানুষের জীবনধারা ও প্রতিপার্শ্ব কেমন ছিল- তার একটা চিত্র ও আবহের আভাস মেলে এই উয়ারী-বটেশ্বরে।
২.
২০২০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বর্তমান লেখকের উদ্যোগে এই মাটিচাপা ইতিহাসের সন্ধানে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার মতো কিছু দেখা গেল না। তবে কিছু নমুনা ও কাঠামো দেখে এবং কিছু লিখিত বিবরণ পাঠ করে এর গুরুত্ব অনুধাবন করা গেল। বলা হয়েছে, এখানকার প্রাপ্ত প্রাচীন নমুনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়। সেখানে এর কার্বন-১৪ পরীক্ষার দ্বারা এই বলে সিদ্ধান্ত জানানো হয় যে, এই অঞ্চলের সভ্যতা গড়ে উঠেছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ অব্দের দিকে।
রাজধানী ঢাকা থেকে ৭০-৭৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলা পেরিয়ে বেলাব উপজেলার গভীর-গহীন সবুজে আবৃত গ্রামগুলো অতিক্রম করে সেই উয়ারী-বটেশ্বরে পৌঁছানো গেল। রাস্তাগুলো বেশির ভাগই পাকা ও মসৃন বলে অটোরিকশায় চলাচল দ্রুত ও অপেক্ষাকৃত আরামদায়ক হয়েছে। এখানকার সাধারণ মানুষজনও বেশ সহজ-সরল ও সহযোগী মনের বলেই মনে হলো। ইতিহাস না জানলেও এসব নিয়ে যে বিস্তর নাড়াচাড়া চলেছে- তা তারা এরই মধ্যে জেনেছে।
উয়ারী-বটেশ্বরের মূল স্থাপনাটি খননের পর ঢেকে দিয়ে ওপরে তার রেপ্লিকা বা অনুকৃতি রাখা হয়েছে। স্থানটিতে কিছু অনুকৃতি ছাড়াও ছবি ও বিলবোর্ডের সাহায্যে এগুলোর প্রত্নতাত্ত্বিক পরিচিতি ও ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। একে উন্মুক্ত জাদুঘরের রূপ দেয়া হয়েছে।
৩.
‘উয়ারী-বটেশ্বর সভ্যতা’ বাংলাদেশে মহাস্থান গড়ের প্রায় সমসাময়িক বলে অনুমিত। সিন্ধু সভ্যতার অনুবর্তী হরপ্পা-মহেনজোদারো সভ্যতা প্রায় চার হাজার বছরের পুরনো। আর উয়ারী-বটেশ্বর প্রায় আড়াই হাজার বছরের বলে দাবি করা হয়ে থাকে। তবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার সময় এখনো আসেনি। উয়ারী-বটেশ্বর নামক গ্রাম দু’টি বেলাব উপজেলায় হলেও এর বিস্তার পাশর্^বর্তী শিবপুরসহ বিস্তীর্ণ এলাকায়। চারপাশে এমন পৃথক কিছু দৃষ্টিগোচর হয় না যে, এই এলাকাকে কোনো প্রাচীন নগরী ও সাধারণ কোনো শহর বলে ধরা যাবে। বিচ্ছিন্ন কিছু নিদর্শন ও অনাবিষ্কৃত স্থাপনা কেবল আভাস দিতে পারে। আশপাশে এমন পঞ্চাশটির মতো জায়গা পাওয়া গেছে। এসবের মধ্যে রয়েছে, টঙ্গীরটেক, রাঙ্গারটেক, সোনারুতলা, কেন্দুয়া, মরজাল, চণ্ডীপাড়া, পাটুলি, জয়মঙ্গল, হরিসাঙ্গন, যোশর, কুন্ডাপাড়া, গোদাশিয়া, আব্দুল্লাহ নগর প্রভৃতি। এসব স্থানকে প্রাচীন বসতি চিহ্নিত বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে স্বল্প-মূল্য পাথরের পুঁতি, কাঁচের পুঁতি, লৌহনির্মিত প্রত্নবস্তু, ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রাসহ আরো অনেক ধরনের নিদর্শন পাওয়া যায়। কিছুকাল আগে এক সীমিত আকারের প্রত্নতাত্ত্বিক খনন থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের সন্ধান মিলেছে। এগুলির মধ্যে রুলেটেড মৃৎপাত্র, উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্র, পাথরের ফ্লেক, চিলতা এবং সার অংশ, লৌহবস্তু এবং লোহা গলিয়ে তৈরি বল জাতীয় বস্তু, মাটির দেয়ালের অংশ এবং পোড়ানো কার্যক্রমের চিহ্ন খুবই গুরুত্ব বহন করে। এ ছাড়াও পাথর ও কাঠের হাতকুঠার, বাটালি, তীরের ফলক ইত্যাদি পাওয়া গেছেÑ যা প্রাগৈতিহাসিক বা প্রস্তর যুগের বলে ধারণা করা হয়।
৪.
আলোচ্য সেই জনপদ ইতোমধ্যে ‘উয়ারী-বটেশ্বর সভ্যতা’ হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে। বৃহত্তর ঢাকার অংশ সেই উয়ারী-বটেশ্বর এখন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল। নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলা থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত উয়ারী এবং বটেশ্বর গ্রাম দু’টি ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রার প্রাপ্তিস্থান হিসেবে দীর্ঘ দিন থেকে পরিচিত। প্লাইস্টোসিন যুগে গঠিত মধুপুর গড়ের পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত এ গ্রাম দু’টিতেই নিবিড় অনুসন্ধান ও সীমিত প্রত্নতাত্ত্বিক খননে আবিষ্কৃত হয়েছে আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন দুর্গনগর। এটি যে বরাবরই একটি সুপ্রাচীন জনপদ তাতে ইতিহাসবিদদের দ্বিমত নেই- যা প্রাচীন ব্রহ্মপুত্র নদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ আবুল কালাম মোহাম্মদ জাকারিয়ার মতে, গ্রাম দু’টির পশ্চিম, উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর দিকে যে নিম্ন বিলভূমি আছে, সেগুল যে এককালে ব্রহ্মপুত্রের খাত ছিল, তাতে সন্দেহ নেই। এককালে এবং তা খুব সম্ভব অনেক প্রাচীনকালে ব্রহ্মপুত্রের একটি বিরাট প্রবাহ এ স্থানের পাশ দিয়ে প্রবাহিত ছিল। আশরাফপুরের কাছ দিয়ে এখনো আড়িয়াল খাঁ নামে যে মৃতপ্রায় প্রাচীন নদীটি বয়ে যাচ্ছে, তাও ছিল এককালে ব্রহ্মপুত্রেরই একটি বিরাট প্রবাহ। খুব সম্ভব আড়িয়াল খাঁর সাথে সংযুক্ত ছিল ব্রহ্মপুত্রের সেই লুপ্ত প্রবাহটি।
৫.
এখানকার বর্তমান অধিবাসীদের অবস্থান শ’দেড়েক বছরের বেশি নয় বলে আবুল কালাম জাকারিয়ার অভিমত। এর বেশির ভাগ অধিবাসী পাঠান উপাধিধারী। এরা মুর্শিদাবাদ অঞ্চল থেকে ব্রিটিশ আমলের প্রথম দিকে এখানে এসেছিলেন বলে জানা যায়। এর আগে এ স্থান বহুকাল ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিল। স্থানীয় আধিবাসীদের কাছ থেকে জানা যায়, এক সময়ে কামরূপের কোন রাজার প্রশাসনিক কেন্দ্র এখানে ছিল। মৌর্য আমলের অসংখ্য মুদ্রা প্রমাণ করে যে এ স্থানে সে সময়ে একটি সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। লোহার হাত কুড়াল প্রাপ্তি প্রমাণ করে, এরও আগে এখানে সভ্য মানুষের বসবাস ছিল। এখানে এযাবৎ যেসব খননকাজ করা হয়েছে তা কেবল প্রাথমিক ধারণাই দিতে পারছে। ব্যাপক খনন ও অনুসন্ধান চালানো হলে হয়তো এ স্থানের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে সঠিক ও বিস্তারিত ধারণা পাওয়া সম্ভব হবে।
৬.
ওয়ারী-বটেশ্বর গ্রাম দু’টির অধিকাংশ স্থানজুড়ে প্রাচীন বসতি ছিল। এ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী গ্রাম যেমন- রাঙ্গারটেক, সোনারুতলা, কেন্দুয়া, মরজাল, চণ্ডীপাড়া, পাটুলি, জয়মঙ্গল, হরিসাঙ্গন, যোশর, কুণ্ডাপাড়া, গোদাশিয়া এবং আব্দুল্লাহ নগরেও প্রাচীন বসতির চিহ্ন পাওয়া যায়। উয়ারী দুর্গনগরীর নিকটবর্তী এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত অর্ধশতাধিক প্রতœস্থানের প্রতœবস্তু বিচারে ধরে নেয়া যায় যে, অধিবাসীরা ছিল কৃষিজীবী এবং এদের উৎপাদিত উদ্বৃত্ত ফসল নগরে বসবাসরত ধনিক, বণিক, পুরোহিত, কারিগর ও রাজকর্মচারীদের খাদ্য চাহিদা পূরণ করত। উয়ারী-বটেশ্বরের অধিবাসীরা উন্নত প্রযুক্তির সাথে পরিচিত ছিল। তারা ধাতু গলিয়ে মুদ্রা তৈরি করার প্রযুক্তি জানতো এবং পুঁতির সাথে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে অলঙ্কার তৈরি করতে পারত। উত্তরাঞ্চলীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্রের সাথে এ নগরীর সংস্কৃতির সম্পর্ক রয়েছে। কারণ উপমহাদেশে দ্বিতীয় নগর সভ্যতার প্রত্নস্থানগুলোতে উত্তরাঞ্চলীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্র পাওয়া যায়। উয়ারী-বটেশ্বরে নব্য প্রস্তর যুগের হাতিয়ারও আবিষ্কৃত হয়েছে। এ অঞ্চলের বিস্তৃত এলাকাজুড়ে উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্র প্রাপ্তি মৌর্য সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির সাক্ষ্য বহন করে। তা ছাড়া নরসিংদীর পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদ ও আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরে দুর্গনগরীর সন্ধান পাওয়ার পাশাপাশি মুদ্রাতাত্ত্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে বলা হচ্ছে, আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন এই জনপদের মানুষ কেবল কৃষিকাজই করেনি, দুর্গনগরীও তৈরি করেছিল। এতে নদীবন্দরও ছিল। এর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পাদিত হতো।
সমসাময়িককালে ভারতীয় উপমহাদেশের ১৬টি বিখ্যাত জনপদের নাম জানা গেলেও উয়ারী-বটেশ্বরের আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন নগরটির নাম এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। মনে করা হচ্ছে, গ্রিক ইতিহাসবিদ টলেমি বর্ণিত সৌনাগড়াই এই উয়ারী-বটেশ্বর। এই জনপদগুলো ছিল এক একটি পৃথক রাষ্ট্র। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ অব্দে মৌর্য আমল চলমান ছিল। বর্তমান বাংলাদেশ অংশের ইতিহাস এযাবৎ মৌর্য যুগের সম্রাট অশোকের সময় থেকে অবহিত হওয়া যায়।
৭.
পেছনের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ১৯৩০-এর দশকে মুহম্মদ হানিফ পাঠান নামের একজন স্কুল শিক্ষক প্রথম উয়ারী-বটেশ্বরের প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব জনসমক্ষে তুলে ধরেন। হানিফ পাঠান সেখান থেকে ২০-৩০টি মুদ্রা সংগ্রহ করেন। এগুলো ছিল বঙ্গভারতের প্রাচীনতম রৌপ্যমুদ্রা। এ বিষয়ে তৎকালীন সাপ্তাহিক মোহাম্মদী পত্রিকায় ‘প্রাচীন মুদ্রা প্রাপ্তি’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশিত হয়। হানিফ পাঠান এবং তার ছেলে হাবিবুল্লা পাঠান তখন থেকে এই এলাকার বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান সংগ্রহ ও গবেষণার কাজে হাত দেন। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দ হাবিবুল্লাহ উয়ারীর পার্শ্ববর্তী বটেশ্বর নামক গ্রামের স্থানীয় শ্রমিকদের ফেলে যাওয়া দু’টি ত্রিকোণাকার ও এক মুখ চোখা লৌহ নির্মিত অস্ত্র সংগ্রহ করেন। এ বিষয়ে হানিফ পাঠান ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের দৈনিক আজাদ পত্রিকার ৩০ জানুয়ারির রবিবাসরীয় সংখ্যায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল, ‘পূর্ব পাকিস্তানে প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা’।
১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে উয়ারী গ্রামের একজন কৃষক মাটি খননকালে রৌপ্য মুদ্রার একটি ভাণ্ড পান। ওই ভাণ্ডে প্রায় চার হাজারের মতো মুদ্রা ছিল। ওজন ছিল প্রায় ৯ সের। পরে জাড়ু নামে ওই কৃষক মুদ্রাগুলো আশি টাকা সের দরে জনৈক রৌপ্যকারের কাছে বিক্রি করে দেন। এই তথ্যটুকু ছাড়া এই মুদ্রাগুলোর কোনো নমুনা পাওয়া যায়নি। ১৯৭৪-১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে হাবিবুল্লাহ পাঠান ঢাকা জাদুঘরের অবৈতনিক সংগ্রাহক ছিলেন। এই সময় তিনি এই অঞ্চলে প্রাপ্ত ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা, পাথরের গুটিকা, লৌহ কুঠার ও বল্লম জাদুঘরে প্রদান করেন।
১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে উয়ারী গ্রামের শাহাবুদ্দিন মাটির নিচ থেকে ব্রোঞ্জের তৈরি ৩৩টি পাত্র উদ্ধার করেন। এই পাত্রগুলো মাত্র ২০০ টাকায় এক ভাঙারির কাছে বিক্রি করে দেন শাহাবুদ্দিন। এই নমুনাগুলোও চিরতরে হারিয়ে যায়। এরপর হাবিবুল্লাহ পাঠান প্রাচীন প্রত্নসামগ্রী খুঁজে দেয়ার জন্য স্থানীয় শিশু-কিশোরদের নিয়োগ দেন। এই সূত্রে তিনি বিষ্ণুপট্ট, ব্রোঞ্জের তৈরি ধাবমান অশ্ব, উচ্চমাত্রায় টিনমিশ্রিত পাত্র, শিব, নৈবেদ্য পাত্র, রেলিক ক্যাস্কেট (জবষরপ পধংশবঃ)-এর ভগ্নাংশ, পাথরের বাটখারা, নব্যপ্রস্তর যুগের বাটালি, লৌহকুঠার, বল্লম, পাথরের তৈরি সিল, ত্রিরত্ন, কচ্ছপ, হস্তী, সিংহ, হাঁস, পোকা, ফুল, অর্ধচন্দ্র, তারকা, রক্ষাকবচ (অসঁষধঃব), পোড়ামাটির কিন্নর, সূর্য ও বিভিন্ন জীব-জন্তুর প্রতিকৃতি, রিংস্টোন, ব্রোঞ্জের গরুড়, কয়েক সহস্র স্বল্প মূল্যবান পাথর ও কাচের গুটিকা ইত্যাদি সংগ্রহ করতে সমর্থ হন।
৮.
দীর্ঘ দিন পর ১৯৯৬ সাল থেকে উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপের কাজ সম্পন্ন করা হয়। ইতঃপূর্বে গ্রাম দু’টিতে কৃষকের জমি চাষ ও নালা কাটা, গৃহস্থের বর্জ-গর্ত তৈরি ও মাটি কেটে স্থানীয়দের ঘরবাড়ি নির্মাণের জন্যও গর্ত করে মাটি সংগ্রহের ফলে অনেক প্রত্নবস্তু উন্মোচিত হয়। আরো পাওয়া যায় বিচিত্র স্বল্প মূল্যবান পাথর ও কাচের পুঁতি, রৌপ্য মুদ্রা। এ যাবৎ প্রত্নতাত্ত্বিক খননে উয়ারী প্রত্মস্থলে আবিষ্কৃত হয়েছে ৬০০ মিটারী ৬০০ মিটার আয়তনের চারটি মাটির দুর্গ-প্রাচীর। দুর্গ প্রাচীরের ৫-৭ ফুট উঁচু ধ্বংসপ্রাপ্ত কিছু অংশ এখনো টিকে আছে। এ ছাড়াও দুর্গের চার দিকে রয়েছে পরিখা (যদিও কালের ব্যবধানে তাতে মাটি ভরাট হয়েছে)। ভরাট হলেও পূর্বপ্রান্তের পরিখার চিহ্ন এখনো দৃশ্যমান। দুর্গের পশ্চিম, দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রায় ৫.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ, ২০ মি. প্রশস্ত ও ১০ মি. উঁচু ‘অসম রাজার গড়’ নামে একটি মাটির বাঁধ রয়েছে। সম্ভবত এটি দ্বিতীয় দুর্গ প্রাচীর হিসেবে উয়ারী দুর্গনগরের প্রতিরক্ষার কাজ করত। ভারতের নাগার্জুনক- হলো এরকম দ্বিস্তরবিশিষ্ট দুর্গ প্রাচীরের আরেকটি উদাহরণ। বীর মাউণ্ড, হস্তিনাপুর, রাজগৃহ, কৌশাম্বী, বৈশালী প্রভৃতি স্থানেও একটি দুর্গকে ঘিরে আরেকটি দুর্গ গড়ে উঠেছে।
এতসব প্রাচীন নমুনা সংগ্রহের সূত্রে দেশের প্রতœতাত্ত্বিক গবেষকরা উৎসাহিত হয়ে ওঠেন। ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগে শুরু হয় খননকাজ। এই খননকাজে নেতৃত্ব দেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান। দলের উপনেতা ছিলেন মিজানুর রহমান। আর এতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন সে সময়ের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীরা। সেই সাথে উল্লেখ করার মতো ছিল স্থানীয় জনগণের সহযোগিতা। পরে এই কাজের জন্য সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতার হাত বাড়িয়ে দেয় মুঠোফোন কোম্পানি গ্রামীণ ফোন। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ৯ জানুয়ারি খনন কাজে প্রথমবারের মতো আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা দিতে এগিয়ে আসে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়। বর্তমানে এই প্রতœতাত্ত্বিক খনন ক্ষেত্রটি ‘উয়ারী-বটেশ্বর’ নামেই পরিচিত।
প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে এই অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয় প্রাচীন দুর্গ-নগর, বন্দর, রাস্তা, পার্শ্ব-রাস্তা, পোড়ামাটির ফলক, স্বল্প-মূল্যবান পাথর, কাচের পুঁতি এবং উপমহাদেশের প্রাচীনতম ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা। এই খনন ক্ষেত্রে পাওয়া গেছে উল্টো-পিরামিড আকৃতির স্থাপত্যকর্ম। প্রাথমিকভাবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা ছিল এই দুর্গটি প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরনো। এই অঞ্চলে প্রাপ্ত কিছু বস্তুর কার্বন-১৪ পরীক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে ধারণা করা হয় উয়ারীর বসতির সময় ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ অব্দ। উল্লেখ্য, উয়ারী গ্রামে ৬৩৩ মিটার দীর্ঘ বাহুবিশিষ্ট বর্গাকৃতি গড় ও পরিখা পাওয়া গেছে। আরেকটি বহির্দেশীয় (৬ কিলোমিটার দৈর্ঘবিশিষ্ট) গড় ও পরিখা সোনারুতলা গ্রাম থেকে শুরু করে বটেশ্বর হানিয়াবাইদ, রাজারবাগ ও আমলাব গ্রামের ওপর দিয়ে আঁড়িয়াল খাঁ নদের প্রান্তসীমা পর্যন্ত বিস্তৃত। এটিকে স্থানীয় লোকজন ‘অসম রাজার গড়’ বলে থাকেন। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ-এপ্রিলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের খননের সূত্রে উয়ারী গ্রামে আবিষ্কৃত হয় ১৮ মিটার দীর্ঘ, ৬ মিটার প্রশস্ত ও ৩০ সেন্টিমিটার পুরু একটি প্রাচীন পাকারাস্তা। রাস্তাটি নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে ইটের টুকরা, চুন, উত্তর ভারতীয় কৃষ্ণ মসৃণ মৃৎপাত্রের টুকরা, তার সাথে রয়েছে ল্যাটারাইট মাটির লৌহযুক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরা। ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান এটিকে আড়াই হাজার বছরের পুরনো বলে দাবি করেছেন। এ সম্পর্কে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক দিলীপ কুমার চক্রবর্তীর অভিমত, এত দীর্ঘ ও চওড়া রাস্তা এর আগে পুরো গাঙ্গেয় উপত্যকায় দ্বিতীয় নগরায়ণ সভ্যতায় কোথাও আবিষ্কৃত হয়নি। গাঙ্গেয় উপত্যকায় দ্বিতীয় নগরায়ণ বলতে সিন্ধু সভ্যতার পরের নগরায়ণের সময়কে বোঝায়। ফলে যেটি আবিষ্কৃত হয়েছে বলা হচ্ছে তা তধু বাংলাদেশেই নয়, সিন্ধু সভ্যতার পর ভারতবর্ষের সবচেয়ে পুরনো রাস্তা হিসেবে বিবেচনায় আসে।
৯.
শুধু উয়ারী-বটেশ্বর নয়, এর অদূরবর্তী স্থানগুলোতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন মিলেছে। বেলাব উপজেলা ছাড়িয়ে পাশের শিবপুর উপজেলার জয়নগর ইউনিয়নের কামরাব ধুপিরটেক গ্রামে বৌদ্ধ পদ্মমন্দির আবিষ্কৃত হয়েছে। এই বৌদ্ধ পদ্ম মন্দিরটির স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য দেব খড়গের স্বাক্ষর অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে সপ্তম দশকের বলে অনুমতি হয়। ধারণা করা হয়, প্রায় ২৫০০ বছর আগে এই জায়গায় বৌদ্ধদের পদ্ম নামে একটি মন্দির ছিল। এর ৭০ সেমি. দীর্ঘ ও ৭০ সেমি. প্রস্থবিশিষ্ট ইটের দেয়াল পাওয়া গেছে। যোশর ইউনিয়নের টঙ্গিরটেক নামক স্থানে রয়েছে প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। এটির কিয়দংশ উদ্ধারের পর সংরক্ষণের জন্য টিনের চালা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। জয়মঙ্গল পাহাড়ি গ্রামে আবিষ্কৃত হয়েছে গুপ্তযুগের স্বর্ণমুদ্রা। আশরাফপুরে আবিষ্কৃত হয় সপ্তম শতাব্দীর মহারাজাদের খড়গদের তাম্রলিপি এবং অষ্টধাতুর নির্মিত বৌদ্ধ নিবেদন স্তূপ। কুমরাদী গ্রামে লালমাটি এবং প্রাচীন পুরাকীর্তির নমুনা সুলতানি আমলের স্থাপত্যশৈলীর এক উজ্জ্বল নিদর্শন। প্রাচীন ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা নদী হাড়িদোয়ার পশ্চিম তীরে অবস্থিত কুমারটেক এলাকার প্রায় ১০-১২ হাত মাটির নিচ থেকে প্রাচীন মৃৎপাত্র, ভগ্নটুকরা এবং মাটির তৈরি ছোট ছোট গোলা পাওয়া গেছে।
১০.
মূল উয়ারী-বটেশ^র স্পটের কেয়ারটেকারের দায়িত্বে আছেন আনোয়ারা খাতুন নামের এক গৃহবধূ। এই জমির মালিকানা তাদেরই পরিবারের। তিনি জানালেন, বিভিন্ন সময়ে এখানে ‘বড় বড়’ মানুষেরা আসেন গাড়ি নিয়ে। মাঝে মাঝে পুলিশও এসে দেখে যায়। তবে এই স্থানটি সরকারিভাবে এখনো অধিগ্রহণ করা হয়নি। ফলে জমির মূল্য বা কোনো ভাড়া সেভাবে তারা পাচ্ছেন না। বোঝা গেলো, বিষয়টি দীর্ঘ দিন ‘ঝুলে’ আছে। কোনো সুরাহা হচ্ছে না।
তথ্যসূত্র :
১. আবুল কালাম মোহাম্মদ জাকারিয়া : বাংলাদেশের প্রতœতত্ত্ব, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ১৯৮৪।
২. বাংলাপিডিয়া, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি।
৩. বিভিন্ন ওয়েবসাইট।
৪. লেখকের নোট।