ঐতিহাসিক আবুল ফজল
আবুল ফজল -
আবুল ফজল- বিশ্বখ্যাত ঐতিহাসিক। মোগল সম্রাট আকবরের নবরত্নের অন্যতম। তার প্রধানমন্ত্রী ও ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। খ্যাতিমান লেখক, ওয়াকেয়ানবিশ। দরবারের একজন প্রাজ্ঞ ও প্রত্যুৎপন্নমতি ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন মোগল শাহী দরবারের অত্যন্ত প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন রাজনীতিক। বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান, সমরনৈপুণ্য, বীরত্বে তিনি ছিলেন ঈর্ষণীয় খ্যাতির অধিকারী।
আবুল ফজলের পিতার নাম শেখ মোবারক। দাদা ছিলেন শেখ খিজির। তার পূর্বপুরুষগণ ছিলেন ইয়েমেনের অধিবাসী। শেখ খিজিরের অন্যতম পূর্বপুরুষ শেখ মূসা সিন্ধুর শিবিস্তানের রেল নামক স্থানের বাসিন্দা ছিলেন।
খিজির সেখান থেকে ভারতের নাগোরে এসে বসবাস শুরু করেন। নাগোর আজমীরের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। এই নাগোর ছিল আধ্যাত্মিক সুফিবাদের অন্যতম কেন্দ্র বা খানকাহ। ওই খানকাটি ছিল শেখ হামিদুদ্দীন নাগোরি প্রতিষ্ঠিত। তিনি ছিলেন আজমীরের বিখ্যাত সুফি সাধক খাজা শেখ মুহিউদ্দীন চিশতির খলিফা। শেখ খিজির নাগোরে হামিদুদ্দীনের দরগাহের কাছে বসত গাড়েন।
আবুল ফজলের পিতা শেখ মোবারক ১৫০৬ সালে সেখানে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি পিতামাতার প্রথম সন্তান ছিলেন না। তার আগেও বেশ ক’জন সন্তান জন্মগ্রহণ করে মারা যায়। এরপর তিনি জন্ম নিলে নাম রাখেনÑ মোবারক, মানে সৌভাগ্যবান। কিন্তু নামের বৈশিষ্ট্য তার প্রথম জীবনের অদৃষ্টে স্থায়ী হয়নি। পিতার আকস্মিক মৃত্যুতে সংসারে নেমে আসে নৈরাশ্য। পাশাপাশি রাজ্যে নেমে আসে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ। দেখা দেয় কালান্তক ব্যাধিÑ প্লেগ। এসব থেকে জীবন বাঁচাতে লোকজন অন্যত্র পালাতে থাকে। নাগোর অঞ্চল প্রায় জনশূন্যতায় পর্যবসিত হয়। মোবারক ও তার মাতা সেখানে টিকে থাকার চেষ্টা করেন। এই দুর্যোগের ভেতর দিয়েও মোবারকের মাতা তার সুশিক্ষার ব্যবস্থা করেন। তার প্রথম দিককার শিক্ষক ছিলেন শেখ আত্তান। অন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষক ছিলেন শেখ ফয়েজি, যিনি খাজা উবাইদুল্লাহ আহরারের শাগরেদ ছিলেন। এরপর শেখ মোবারক উচ্চতর শিক্ষার্জনের জন্য আহমদাবাদে গমন করেন। তিনি সেখানে শেখ আবুল ফজল গুজরানির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ওস্তাদজি তাকে পুত্রবৎ গ্রহণ করেন। তিনি সেখানে শেখ ওমর ও শেখ ইউসুফকেও শিক্ষক হিসেবে পান।
ওস্তাদজি ইউসুফ তাকে আগ্রায় যেতে আদেশ করেন এবং সেখানে একটি মাদরাসা স্থাপনের পরামর্শ দেন। গুরুর আদেশ অনুসারে মোবারক ১৫৪৩ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে আগ্রায় গিয়ে উপনীত হন। সেখানে যাওয়ার পর তথাকার আরেক ওস্তাদ শেখ আল আওয়াল বেলাওয়ালের পরামর্শে চারবাগ নামক স্থানে স্বীয় বসত নির্ধারণ করেন। যমুনার তীরে জায়গাটি গড়ে তুলেছিলেন মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবুর। মীর রাফিউদ্দিন সাফাভি স্থানটির নিকটেই বসবাস করতেন। তিনি পূর্বে সিরাজ নগরীর (যেটিকে আদিতে ইঞ্জু বলা হতো) অধিবাসী ছিলেন। মোবারক তারই এক জ্ঞাতি আত্মীয়াকে বিয়ে করে সংসারী হন।
শেখ মোবারক বড় আলেম ছিলেন। ধর্ম ও দর্শন বিষয়ে তিনি ব্যাপক অধ্যয়ন করেন। এসব বিষয়ে তিনি বিশেষ বুৎপত্তি অর্জন করেন। ধর্মীয় শাস্ত্র বিষয়ে তার অত্যধিক জ্ঞানগত বুৎপত্তির কারণে লোকের কাছে তিনি পথভ্রান্ত আলেম হিসেবে প্রতিভাত হন। তিনি আগ্রায় একটি মাদরাসা স্থাপন করে তাতে শিক্ষাদান কাজ চালাতে থাকেন। তার বাগ্মিতার কারণে অনেক জ্ঞানীগুণীদেরই আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন। তাদের মাঝে ঐতিহাসিক আবদুর কাদের বাদাউনীও ছিলেন। তিনি তার সুন্নি মত ত্যাগ করে শিয়া মতবাদ গ্রহণ করেণ। তার এই ভিন্ন আঙ্গিকের ধর্মশিক্ষাদানের প্রয়াস অচিরেই বাধার সম্মুখীন হয়। মূলধারা অনুসারী আলেমগণ তার ধর্মমতের তীব্র সমালোচনা শুরু করেন। ফলে তার এই মাদরাসার কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হন।
ইতোমধ্যে শেখ আবুল ফয়েজের জন্ম হয়। যিনি কালে ফয়েজি বা ফৈজি নামে খ্যাত হন। তার জন্মের চার বছর পরে জন্ম নেন শেখ আবুল ফজল। আবুল ফজলের জন্ম হয় ১৫৫১ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ জানুয়ারি। উভয় ভ্রাতার বাল্যের প্রাথমিক শিক্ষার্জন হয় পিতার নিকট। তারা দু’জনেই ছিলেন যথেষ্ট মেধাবী। তার মাঝে আবুল ফজল ছিলেন প্রখর স¥ৃতিশক্তি ও বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। দু’জনেই আরবি, ফারসি ভাষায় ব্যুৎপন্ন হন। আবুল ফজল আরবি ভাষা বিষয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। পাঁচ বছর বয়ঃকাল থেকেই তিনি লিখতে পড়তে সক্ষম হন। তার পিতা তাকে ধর্মবিজ্ঞান বিষয়ের সব শাখায় শিক্ষাদান করেন। ধর্মের এ সমুদয় শাখাকে একত্রে ‘মানকুলাত’ বলে।
আবুল ফজল এতটাই প্রত্যুৎপন্নমতি ছিলেন যে, একবার ইস্পাহানি অভিধানের প্রান্তভাগের বেশ খানিক অংশ উইয়ে খেয়ে ফেলে। এতে অভিধানটি পাঠের অনুপোযোগী হয়ে পড়ে। কীটদষ্ট অভিধানটির পাঠোদ্ধার মানসে আবুল ফজলের কাছে আনা হয়। তিনি চেষ্টা করে উইয়ে খাওয়া শব্দশুরুর দিকে যথাযথ বর্ণ সংযোজন করে অভিধানটি আদিরূপে পাঠোপযোগী করে ফেলেন। পরে অন্য কোথাও থেকে ওই অভিধানটির একটি কপি সংগ্রহ করে তুলনা করে দেখা হয়। তাতে দেখা যায়, আবুল ফজল দুই-একটি ছোটখাটো ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় হুবহু পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন।
আবুল ফজলের বিশ বছর বয়ঃক্রমের আগেই আরবি ও ফারসি ভাষায় দক্ষতা অর্জিত হয়। ধর্মশাস্ত্র, তর্কবিদ্যা, অলঙ্কার শাস্ত্রে জ্ঞানলাভ হয়। ভারত ও বিশ্ব ইতিহাসে বিপুল জ্ঞানের অধিকারী হন। ভূগোল ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কেও জ্ঞানার্জন করেন।
আবুল ফজলের জেষ্ঠ্য ভ্রাতা ফৈজি স্বীয় যোগ্যতাগুণে মোগল সম্রাট আকবরের দরবারে অন্যতম সভাসদের মর্যাদা লাভ করেন। তিনি সেখানে রাজকার্যের পাশাপাশি সাহিত্যচর্চাও করতেন। তিনি ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনীর পাশাপাশি কাব্যচর্চাও করতেন। তিনি সেখানে রাজকবির মর্যাদা লাভ করেন। তার এইসব অতিরিক্ত শিল্পগুণের কারণে তার প্রতি আকবর যারপরনাই সন্তুষ্ট ছিলেন।
জেষ্ঠ্যভ্রাতা ফৈজির অনুরোধে আবুল ফজলকেও আকবর তার দরবারের অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দে মোগল দরবারে আসেন। তাকেও একজন সম্মানিত সভাসদের মর্যাদা দান করেন। তার যোগ্যতা ও প্রজ্ঞায় অল্প কিছু দিনের ভেতরেই সম্রাটের প্রিয়পাত্রে পরিণত হন।
আকবরের দাক্ষিণাত্য অভিযানের পূর্বে ফৈজিকে তথাকার শাসকদের নিকট দূতস্বরূপ প্রেরণ করেন। তাদের বশ্যতা স্বীকারের আহ্বান জানাতেই তাকে সেখানে প্রেরণ করা হয়। আবুল ফজলও দরবারে থেকে সম্রাটকে নানা বিষয়ে সুপরামর্শ দানে কৃতজ্ঞভাজন হন। তিনিও বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নিয়ে স্বীয় নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রাখেন। সম্রাটও তার সমরনৈপুণ্যে তুষ্ট হয়ে তাকে ‘চার হাজারি মনসনদারি’ প্রদান করেন। আসীর অভিযানকালে বিজ্ঞজনোচিত ভূমিকার কারণে আবুল ফজলকে খান্দেশ তথা দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়। কালে তিনি সম্রাটের প্রধানমন্ত্রিত্বে আরূঢ় হন।
আবুল ফজলের সাহিত্যকৃতি কালোত্তীর্ণ হয়েছে। বঙ্গভারতের একজন পথিকৃৎ ইতিহাসবিদ হিসেবে তিনি অমর হয়ে আছেন। তার রচিত বৃহদাকৃতির দু’টি ঐতিহাসিক গ্রন্থ রয়েছে। গ্রন্থদ্বয় হচ্ছে : ‘আকবরনামা’, ও ‘আইন-ই-আকবরী।’ এ গ্রন্থ দু’টি উত্তরকালের ইতিহাসবিদদের নিকট অনুসরণীয় অন্যতম আকরগ্রন্থের মর্যাদা লাভ করেছে। এ দু’টি গ্রন্থ ছাড়াও ‘রুক্কাত-ই-আবুল ফজল’ নামক ব্যক্তিগত পত্রসঙ্কলন গ্রন্থও রয়েছে। তার আরো একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘ইনশা-ই-আবুল ফজল বা মাকতুবাতে আল্লামি।’ এটি হচ্ছে, দাপ্তরিক চিঠিপত্রের সঙ্কলন।
মোগল সম্রাট আকবরের প্রিয় বন্ধু, প্রধানমন্ত্রী, দরবারের নবরতেœর অন্যতম, খ্যাতিমান এই ঐতিহাসিকের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। ঘাতক হস্তে করুণভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। আর ওই হত্যার ছক তৈরি করেছিলেন সম্রাট আকবরের জেষ্ঠ্য পুত্র শাহজাদা সেলিম। সম্রাট আকবরের ঘনিষ্ঠ সুহৃদ এই পণ্ডিত ব্যক্তিকে হত্যায় যুবরাজ সেলিমের এই জিঘাংসু মনোবৃত্তির পেছনে ছিল রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ। সেলিমের মনে হচ্ছিল, এই আবুল ফজলের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণেই তিনি সিংহাসনে এখন পর্যন্ত আসীন হতে পারছেন না। তার এই খায়েশ পূরণের পথে এই মন্ত্রীটাই যত বাধা। কারণ তার পরামর্শ ছাড়া সেলিমের পিতা সম্রাট আকবর এক কদম হাঁটেন না। তাই ক্ষমতায় বসতে হলে, পথের এই কাঁটাকে ছলেবলে, কৌশলে সরিয়ে ফেলতে হবে। সে অনুযায়ীই আবুল ফজলের হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হয়।
বাদশাহ আকবর ১৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে জরুরি পরামর্শের জন্য আবুল ফজলকে দাক্ষিণাত্য থেকে আগ্রায় তলব করেন। যুবরাজ সেলিম তার কূটপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এই সময়টাকেই বেছে নেন। আবুল ফজল যখন দাক্ষিণাত্য থেকে আগ্রা অভিমুখে আসছিলেন, তখন পথিমধ্যে বুন্দেলখণ্ডের রাজা সেলিমের চক্রান্ত বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেন। রাজা বীর সিং বুন্দেলার নির্দেশে একদল ঘাতক সরাইবীর ও অন্ত্রির মধ্যবর্তী স্থানে আবুল ফজলের ওপর হামলা চালায়। উপর্যুপরি আঘাতে ১০১০ হিজরির ৭ রবিউল আউয়াল তারিখে পণ্ডিতপ্রবর আবুল ফজলের জীবনপ্রদীপ নিভে যায়। হত্যার পর তাকে অন্ত্রিতেই সমাহিত করা হয়।
সবচেয়ে বিস্বস্ত ও প্রিয়তম সুহৃদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের কারণে ভারত-সম্রাট আকবর হৃদয়ে প্রচণ্ড আঘাত পান। ভয়ানক শোকে কাতর হয়ে তিনি তিন দিন পর্যন্ত পানাহার ও কারো সাথে আলাপচারিতা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেন। ঘটনার পটভূমিতে তারই জেষ্ঠ্যপুত্র সেলিমের চক্রান্তের কথাটাও তার কর্ণগোচর হয়। তিনি এতটাই মনোক্ষুণœ হন যে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, সেলিমের যদি সিংহাসনের প্রতি এতটাই লোভ ছিল তো, আবুল ফজলকে কেন, আমাকেই হত্যা করলে পারত। তাহলেই তো তার গোপন অভিলাষ পূর্ণ হতো।