আবার জাপানে

৮ এপ্রিল। রোববার। ক্যাথে প্যাসেফিক ফ্লাইট নং সি এক্স ৫০৪। হংকং - নারিতা, টোকিও - ছবি : সংগৃহীত
প্রিয় শোয়েব,
মাত্র মিনিট পনেরো আগে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে হংকং-এর উদ্দেশে উড়াল দিয়েছি আমি আর শোভা। সাথে বাংলাদেশের বারজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। আমাদের মূল গন্তব্য জাপান। সেখানে ইউনিডোর আয়োজনে জাপানি বিনিয়োগ ও ব্যবসা ধরবার সভা সেমিনারে যোগ দেয়ার জন্য আমাদের এই যাত্রা। শোভা আর আমি যে এক সপ্তাহের সফরে জাপানে যাচ্ছি তা মনে হয় তোমার জানা নেই। আমারও মনে পড়ছে না তোমাকে জানিয়েছি কিনা। ইদানীং তোমার সাথে আমাদের সংযোগ সখ্য সমান তালে চলছে না বুঝতে পারি। তোমার আমার ব্যস্ততা বেড়েছে ঠিকই কিন্তু যোগাযোগটা কেন কমছে তার একটা বিচার বিশ্লেষণ বা হিসাব নিকাশ হওয়া দরকার।
এবার আমরা জাপানে যাচ্ছি দীর্ঘ আঠারো বছর বিরতির পর। ১৯৯৪ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত টানা ছ’বছর কূটনৈতিক চাকরিতে জাপানে বাণিজ্য দূতের দায়িত্বে ছিলাম। এরপর দেশে ফিরে মাঝখানে ১৮ বছর নানান ঘাটে ভিড়িয়েছি তরী, সেই তরীতে তুলেছি, ভরেছি অনেক অভিজ্ঞতার ফসল কিন্তু কখনো জাপানমুখো হতে পারিনি। এবার সম্পূর্ণ বেসরকারিভাবে, ব্যবসা বিনিয়োগ সন্ধানে একে খান গ্রুপের অ্যাডভাইজার হিসেবে, জাপান যাচ্ছি। সাথে শোভাও। শোভারও আমার মতন দীর্ঘ ১৮ বছর পর তার প্রিয় দেশে এই ব্যক্তিগত ভ্রমণ। আমরা বেশ চাঙ্গা, প্রফুল্ল। এই ১৮ বছরে শুধু বিথুন ইন্টার্নশিপ করার জন্য সনি করপোরেশনের সৌজন্যে মাঝে একবার জাপান সফর করার সুযোগ পেয়েছিল। ডেনমার্কের নভো নর্ডিক্স-এর চাকরিতে আদীবের জাপানে পোস্টিং হওয়ার কথা ছিল। পরে সে সম্ভাবনা অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে সমাপ্ত হয়।
১৮ বছরে নিশ্চয়ই জাপানে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ২০১১ সালের ১১মার্চ তোহকুতে এবং ১৩ এপ্রিল মিয়াগিতে পরপর দুটো বড় ভূমিকম্প এবং ১১ মার্চে সুনামি বা জলোচ্ছ্বাস জাপানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছে। ১৮ বছরে পাঁচজন প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তন হয়েছে। ২০০০ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ২৭,১৮০ মার্কিন ডলার, ১০ এপ্রিল ২০০০ তারিখে ১ ডলার সমান ১০৬.৭৬ জাপানি ইয়েন মিলত, জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ২.৩ শতাংশ। পক্ষান্তরে ২০১৮ সালে মাথাপিছু আয় ৪৭,৬০৭ ডলার, ১০ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে ১ ডলার সমান মিলেছে ১০৭.৫২ ইয়েন এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধি মাত্র ০.৪ শতাংশ।
মনে পড়ছে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনের সময় উপলব্ধি করেছিলাম বিশ্বের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থানগত গুরুত্ব ও এর অস্তিত্ব সম্পর্কে অন্যের কাছ থেকে একটা স্বচ্ছ উপস্থাপনা, বিবেচনা আদায় করা বিশেষ জরুরি। জাপানের অধিকাংশ লোক ভালো করে জানে না বাংলাদেশ কোথায়। বাংলাদেশের নাম হয়তো জানে, তবে তাও হয়তো ভালো কোনো কারণে নয়। তারা বাংলাদেশকে জানে প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত, দারিদ্র্যপ্রপীড়িত, নানান সমস্যায় আকীর্ণ, অহরহ রাজনৈতিক ফ্যাসাদ লেগে আছে এমন একটি দেশ হিসেবে। তবে এর ভৌগোলিক অবস্থান, এর সম্ভাবনা ও সৌন্দর্য স¤পর্কে এদের জ্ঞান বড় সীমিত। সে জ্ঞান বাড়াবার উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা বাংলাদেশকেই উপলব্ধি করতে হবে।
জাপানিরা এখনো এশিয়া মহাদেশের বাসিন্দা হিসেবে নিজেদের অবস্থানকে যতটা বিবেচনা করে তার চেয়ে তারা এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশ হিসেবে নিজেদেরকে ভাবতে ভালোবাসে। আর এই এশীয় প্রশান্ত সাগরীয় অঞ্চল বলতে তাদের বিবেচনায় পশ্চিমে বড় জোর ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, চীন পূর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, দক্ষিণে অস্ট্রেলিয়া আর উত্তরে কোরিয়া ও রাশিয়ার সীমান্ত বোঝায়। আধুনিক জাপানির অভিজ্ঞানে এশিয়ার সীমানা পূর্বে মিয়ানমার পর্যন্ত। ঢাকার জাপানি দূতাবাসের মিনিস্টার মি. কুরোদা ১৯৯৪ সালে আমার জাপান যাত্রার প্রাক্কালে ঢাকায় ব্রিফিং করার সময় আমাকে যথার্থই বলেছিলেন, ‘ভেবো না বাংলাদেশ এশিয়া মহাদেশের একটি দেশ বলেই জাপানের কাছ থেকে প্রতিবেশী হিসেবে আলাদা আত্মীয়তা আশা করা যাবে।’ আমি তাকে ব্যাপারটা একটু খোলাসা করতে বলায় তিনি যা ব্যাখ্যা করলেন তা হলো, জাপানিদের মতে এশিয়ার বর্তমান পূর্ব প্রান্ত হলো বাংলাদেশ-বার্মা সীমান্ত। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে চট্টগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশে আরব বণিকদের আগমন ঘটে। এতদঞ্চল থেকেই ইসলামের প্রচার শুরু হয় এবং ক্রমান্বয়ে ইসলামের প্রভাবেই, তাদের ধারণা, ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধ মতাবলম্বীদের সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে। এর পূর্বর্তন কালে হিন্দুদের সাথে এবং পরবর্তীকালে মুসলমানদের প্রভাবে বৌদ্ধরা হয় ধর্মান্তরিত হয়, না হয় সুমাত্রা, জাভা, বার্মা, শ্যামদেশ বা থাইল্যান্ড প্রস্থান করে। সেই থেকে বাংলাদেশ ভারত বা পাকিস্তান এবং তার পরের এশিয়ার অন্যান্য দেশকে জাপানিরা মনে করে মূল এশিয়া থেকে খারিজ হয়ে যাওয়া আরব (মধ্যপ্রাচ্য) গ্রুপের দেশ।
জাপানে ঠিক তেমনটি দেখলাম এখানকার সরকারি দলিল এবং অনেক পরিসংখ্যান বইয়ে এশিয়ার দেশ হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশের উল্লেখ বড় গৌণ আকারে। জাপানিরা বাংলাদেশকে এশিয়ায় তার শরিক দেশ হিসেবে মনে করে না। বাংলাদেশ এই মুহূর্তে জাপানের কাছ থেকেই বেশি বৈদেশিক সাহায্য পায়, পাকিস্তানও পায়, নেপাল ভারত শ্রীলঙ্কাও পায়। জাপানি বিনিয়োগ এসব দেশগুলোতে এখন যথেষ্ট যাচ্ছে, তবে তার কারণ ও প্রেক্ষাপট অবশ্যই ভিন্ন।
তোমাকে লিখতে লিখতে কখন যে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি মনে নেই। হঠাৎ অ্যানাউন্সমেন্ট শুনে জেগে উঠলাম। আর আধা ঘণ্টার মধ্যে আমরা হংকংয়ে অবতরণ করতে যাচ্ছি। এখন ভোর ৬টা ৫০। হংকংয়ে ৭টা ৩৫-এ নেমেই দৌড় দিতে হবে ৯টা ৫ এ উড্ডয়নের জন্য এক পায় খাড়া জাপানের নারিতাগামী ক্যাথে প্যাসিফিক ফ্লাইটের জন্য।
হংকং এয়ারপোর্টে নামলেই বাংলাদেশী যাত্রীদের আলাদা করে একত্রে জড়ো করে প্রত্যেকের ডাবলিউ টিভি বা উইদাউট ট্রানজিট ভিসা স্টিকার লাগিয়ে দেয়া হয়, একধরনের বিশেষ নিয়ন্ত্রণে তাদের সিকিউরিটিজ চেক করিয়ে ট্রানজিট গেটের দিকে পাঠানো হয়। সেবার শোভা আর আমিসহ ছয়জন বাংলাদেশ পাসপোর্টধারী যাত্রী ভ্যানকুভার থেকে হংকংয়ে অবতরণ করে দেখলাম আমাদের নাম লেখা বোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবলাম আমাদের জামাই আদরে রিসিভ করতে কেউ এলো নাকি। পরে দেখি আমাদেরকে অনেকটা আসামির মতো আলাদা করে গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। একপর্যায়ে প্রতিবাদও করেছিলাম। তাদের ধারণা আমরা এয়ারপোর্ট থেকে ভেগে যেতে পারি। যাহোক এবার আমরা অনেকে। খুব একটা খারাপ লাগার আগেই তড়িঘড়ি করে আমাদের ট্রানজিট ফ্লাইট ধরার পথে নিয়ে গেল। যাক টোকিওগামী প্লেনে চেপে হাঁফ ছাড়লাম।
তুমিতো জান, আজ আমরা যে জাপানের পথে উড়ছি সেই জাপানের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমার আগ্রহ বরাবরই বেশি। ‘জাপানে বাংলাদেশের বাণিজ্য দূতের ডায়রি’ গ্রন্থে আমি ইতোমধ্যে বিস্তারিত লিখেছি। জাপানের নিকট অতীতের ইতিহাস খুব একটা সুখকর নয়। চীন, কোরিয়া, ফিলিপাইন ইন্দোনেশিয়া থাইল্যান্ড প্রভৃতি অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করে জাপান প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পূর্ব ও উত্তরকালে বিগত ও বর্তমান শতাব্দীতে এশীয় পরাশক্তি হিসেবে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে তার আর্থিক শক্তি তেমন না থাকলেও আধিপত্যবাদী চেতনায় এটি ছিল জার্মানির সমগোত্রীয় এবং এর খেসারত তাকে দিতে হয় দু দুটো বড় বিশ্বযুদ্ধে। দুটি বিশ্বযুদ্ধেই বড় মার খায় জাপান। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এমন মার খায় যে বিদেশীরা এখন জাপানিদের দোমো দোমো বলে বিনয়ে মাথা নোয়ানোকে মাত্র দু’টি আনবিক বোমার শিক্ষা বলে ব্যঙ্গ করে। ১৯৪৫ এর সেপ্টেম্বরে টোকিওতে যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ডি ম্যাকআর্থার (১৮৮০-১৯৬৪) এর কাছে জাপানের আত্মসমর্পণ বিংশ শতাব্দীতে জাপানের জন্য শিল্প এবং আর্থ-সামাজিক পটপরিবর্তনের এক বড় মাইলফলক। ম্যাকআর্থার ১৯৪৫-৫১ সালে তার প্রশাসনিক সময়ে জাপানিদের যুদ্ধাভিমুখী আধিপত্যবাদী মনোভঙ্গিকে সুকৌশলে সম্পূর্ণ পাল্টিয়ে, ‘যুদ্ধ নাস্তি’ বা সামরিক জজবা থেকে তওবা পড়িয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে দিয়ে যান। তাদের নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী গড়া হবে না এবং প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রই যাবতীয় কিছু দেখাশুনা করবে এই শর্তে ঘটে তার সার্বিক স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার প্রাপ্তি। জাপানকে তাই আমেরিকার এক সুবিনীত সুসজ্জিত সুরক্ষিতা পুতুল ভাবা হয়।
ম্যাকআর্থার সাহেব জাপানিদেরকে একটা সংস্কারকৃত (জবভড়ৎসবফ) শাসনতন্ত্র দিয়ে তাদের যুদ্ধংদেহী মনোভাবকে শিল্প-ব্যবসা-বিনিয়োগ-বাণিজ্যাভিমুখীকরণে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। শাসনতন্ত্রে যুদ্ধ নাস্তি (জবহঁহপরধঃরড়হ ড়ভ ধিৎ) ধারা বলবৎ করে সমগ্র জাপানি জাতিকে যেন তওবা পড়ানো হলো এই বলে যে, আমরা জীবনে আর যুদ্ধের নাম করব না, যুদ্ধে যাব না, সামরিক বাহিনী পুষব না, প্রতিরক্ষা সামগ্রীর আমদানি রফতানিতে থাকব না, মোদ্দা কথা আমাদের অভিধানে প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত কোনো শব্দ থাকবে না। জাপানিরা স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে সুস্থ মাথায় এটা মেনে নেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তার আগেরকালে সামরিক প্রযত্নে পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় অশেষ যন্ত্রণাভোগের কারণে। রাষ্ট্রের উগ্র মনোভাবের বিকৃত বহিঃপ্রকাশে আধিপত্যবাদী আগ্রাসী আচরণের জবাবে বিদেশী আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে ধনসম্পদ ধূলিসাৎ হওয়াসহ মানসম্মান সব খোয়ানোর নিদারুণ মর্মযাতনা সইতে হয় তাদের। অর্ধ শতাব্দীকাল পার করেও এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরাশক্তি পর্যায়ে উন্নীত হয়েও, এমনকি শিল্প-বাণিজ্য-বিনিয়োগক্ষেত্রে আমেরিকাকে অতিক্রম করে তাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ার হিম্মৎ অর্জন করেও জাপানিরা শাসনতন্ত্রে ওই অসম্মানজনক অধ্যায়ের অবসান কামনা করে না।
জেনারেল ডগলাস ম্যাকআর্থার শুধু শাসনতন্ত্র সংস্কার করেই জাপানি জীবন সাধনায় পরিবর্তন প্রয়াসী হননি, তিনি জাপানিদেরকে কোরিয়া যুদ্ধের (১৯৫০-৫৩) বদৌলতে আমেরিকার ব্যবসা ধরতে ও পুঁজি বিনিয়োগের অবারিত সুযোগও দিয়ে যান। যার ফলে পঞ্চাশের দশকে জাপানে রাতারাতি গড়ে ওঠে শিল্প। অতি বিশ্বস্ত বিনয়ী জাপানিরা কঠোর পরিশ্রম ও ব্যবসায়ী কৌশল অবলম্বন করে হঠাৎ করে আর্থ বাণিজ্য ও বিনিয়োগে হয়ে ওঠে অতিশয় করিৎকর্মা। ষাটের দশকেই এতদঞ্চলে এবং আশির দশক থেকে সে নিজেই আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। আশি, নব্বইয়ের দশক থেকে আমেরিকার সাথে ট্রেড তার অনুকূলে। আমেরিকার সাথে তার বাণিজ্য যুদ্ধ ঠাণ্ডা যুদ্ধের মতো, কিন্তু সে তো আসলে আমেরিকার বাগদত্তা। যেন কাবিননামার শর্ত তাকে মানতে হয়। দেশের ভেতরে আমেরিকার সাথে তার অবস্থান নিয়ে নিত্য সমালোচনা হচ্ছে- সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী কেনজাবুরো (১৯৩৫-) বলছেন, ‘জাপান বরাবরই ভুল করছে; জাপান হিরোসিমায় বোমায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া মানবতার সাথে বেঈমানি করছে।’ বিশ্লেষকরা বলছেন, জাপানকে তার এশীয় শরিক দেশগুলোর সাথে আরো সখ্য গড়ে তুলতে হবে। অর্থাৎ তাকে আমেরিকার বলয় থেকে বেরিয়ে আসার সাহস অর্জন করতে হবে। জাপান যত চীন, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানে যায় আমেরিকা তত সেখানে আসে। আর আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এই প্রেক্ষাপটে সেবার (১৯৯৫ সালে) জাপানে যখন উদযাপিত হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত আণবিক বোমায় ধ্বংসযজ্ঞের ৫০তম বার্ষিকী তখন জাপানে বসেই আমেরিকা উদযাপন করল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাদের বিজয়ের অর্ধশত বার্ষিকী। এ নিয়ে জাপানিদের আত্মগ্লানিতে ভুগতে ও ভাবতে দেখলাম, তবে ততটা সরবে নয়। আর জাতিসঙ্ঘ, যার ভূমিকা ইদানীং সবচেয়ে বেশি প্রশ্নের সম্মুখীন, সে উদযাপন করল তার সুবর্ণ জন্মজয়ন্তী। এমন সময় আমি জাপানে। দেখার, শোনার ও শেখার মতো অনেকগুলো বিষয় বটে।
আমরা এখন জাপানের আকাশে। পাইলট ঘোষণা করলেন, আর ২০ মিনিটের মধ্যে নারিতা বিমানবন্দরে অবতরণ করব আমরা। টোকিওতে তাপমাত্রা ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর স্থানীয় সময় দুপুর গড়িয়ে ২টা ৫ মিনিট।
নারিতায় নেমে মনটা অন্যরকম উৎফুল্ল হয়ে উঠল। আগে আমরা কূটনীতিক হিসেবে ইমিগ্রেশনে সহজে সসম্মানে পার পেতাম। এবার জনগণের কাতারে দাঁড়িয়ে ইমিগ্রেশন পার হতে হবে। সে সময় সাধারণ যাত্রীদেরকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ ও প্রশ্নের উত্তর দিয়ে জাপানে ঢুকতে হতো। এখন যদি আমাদেরকে অতশত প্রশ্ন করা হয় কিভাবে জবাব দেবো এসব ভাবছি। কিন্তু দেখলাম, না এখন এমআরপি পাসপোর্ট হাতের ছাপ চোখের ছবি পর্যন্ত সবই তাদের সিস্টেমে আছে। সুতরাং আমাদেরকে তা মিলিয়ে তেমন কোনো প্রশ্ন না করে ছেড়ে দিলো একটা সুন্দর স্টিকার পাসপোর্টে লাগিয়ে দিয়ে। এয়ারপোর্ট হলে যেয়ে হাতে আধুনিক মোবাইল ফোনে ফটো তোলার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। জাপানি কর্মকর্তা বললেন নো ফটো। আমাদের ততক্ষণে ওয়েলকাম টু জাপান লেখা সুন্দর ডিজিটাল বিলবোর্ডের ছবি তোলা শেষ। হোয়াটস অ্যাপে পাঠাব ভাবছি। কিন্তু ফ্রি ওয়াইফাই নেই। ভাবলাম আধুনিকতায় জাপানিরা এগিয়ে থাকলেও নিরাপত্তার প্রশ্নে সতর্কতা সুলভ কিপটেমি তাদের এখনো আছে।
নিয়মকানুনের কড়াকড়ি আগের মতোই। জাপানি কাস্টমসকে ব্যাখ্যা দিয়ে তারপর যেতে হবে। ওদের কোয়ারেন্টিন আইন খুব কড়া। মনে আছে একবার ওসাকায় সচিব আনিসুল হক চৌধুরী ও ফয়সাল আহমদ চৌধুরীকে আমি রিসিভ করতে গিয়েছিলাম। ওনাদের হাতে দু’টি গোলাপজাম ছিল- ব্যাংকক এয়ারপোর্ট থেকে কিনেছিলেন। জাপানি কাস্টমস বড় কেতাব বের করে এইচএস কোড মিলিয়ে বলল এটা ‘দামে’ মানে জাপানে আনা নিষেধ। ওনারা বললেন, আমরা তাহলে এখানে বসে খেয়ে যাই। কাস্টমস কর্মকর্তা জানালেন, না, তা-ও হবে না। এবার ভাবলাম জাপানি কাস্টমস যদি বেশি ঝামেলা করে তাহলে বলব কি না আমি বাংলাদেশের কাস্টমস ডিপার্টমেন্টের (মানে এনবিআরের) চেয়ারম্যান ছিলাম। যাক সে সব কিছুই বলতে হয়নি। কাস্টমস কেন জানি সদয় ছিলেন আমাদের প্রতি।
(অসমাপ্ত)