মুসলিমদের বিরুদ্ধে কেন এমন আচরণ করছে শ্রীলঙ্কা
শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী রাজাপাকসা - ছবি : সংগৃহীত
১৩ মার্চ শ্রীলঙ্কার জননিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী শরৎ বীরাসেকারা ঘোষণা করেন, সরকার দেশে বোরকা পরিধান এবং এক হাজারেরও বেশি ইসলামী স্কুল নিষিদ্ধ তথা বন্ধ ঘোষণা করবে। মন্ত্রীর বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে জানানো হয়, তিনি বলেছেন ‘বোরকা’ ধর্মীয় চরমপন্থার প্রতীক এবং ‘জাতীয় নিরাপত্তার ওপর এর সরাসরি প্রভাব পড়ে।’ এই সংবাদ প্রকাশের পর আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিবৃতি প্রদান করে এবং জাতিসঙ্ঘের ধর্মীয় স্বাধীনতা-বিষয়ক বিশেষ রিপোর্টিয়ার আহমদ শাহেদ ও একই সাথে শ্রীলঙ্কায় নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত এই খবরের প্রতিবাদ জানান। তিনদিন পর সরকার নিজের মন্ত্রী বীরাসেকারার বক্তব্য থেকে সরে আসে।
মন্ত্রিপরিষদের মুখপাত্র কেহেলিয়া রামবুকভিলা ঘোষণা করেন- এই সিদ্ধান্তের জন্যে ‘আরো সময় প্রয়োজন’ এবং আলাদা আলোচনার মাধ্যমেই বিষয়টি এগিয়ে নেয়া হবে। বোরকা নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দিয়ে মুসলিমদেরকে ক্ষুব্ধ করা এবং তাদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। মুসলিমরা এটাকে তাদের সম্প্রদায়ের ওপর অপর একটি আঘাত হিসেবে মনে করছেন। গত কয়েক মাসে সরকার চরমপন্থা দমনের নামে কয়েকটি বিতর্কিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ভয়ভীতি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে এবং আইনের শাসন ও রীতিনীতিকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে।
শ্রীলঙ্কা ১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে দেশটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি বৌদ্ধ এবং হিন্দু ও খ্রিষ্টান তামিল সংখ্যালঘুদের মধ্যে গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা লেগেই ছিল। দেশটির জনসংখ্যার ৭০ শতাংশই হচ্ছে সিংহলি এবং ১২ শতাংশ তামিল। শ্রীলঙ্কায় সেনাবাহিনী ও লিবারেশন টাইগারস অব তামিল ইলামের (এলটিটিই) মধ্যে যুদ্ধ চলাকালে মুসলিমদের মতো অন্যান্য সংখ্যালঘুও উগ্র জাতীয়তাবাদী সিংহল গ্রুপের নিপীড়নের শিকার হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় জনসংখ্যার প্রায় ৯ শতাংশ মুসলিম।
২০০৯ সালে দেশটিতে সিংহলি ও তামিলদের মধ্যকার গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটলে বুদু বালা সেনা (বিবিএস) ও বৌদ্ধভিক্ষু গালাবোদ আথিথি জ্ঞানাসারার পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিমবিরোধী আন্দোলন শুরু করা হয়।
বুদুবালা সেনা হচ্ছে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দ্বারা পরিচালিত একটি চরমপন্থী বৌদ্ধ জঙ্গি গ্রুপ। তারা কথিত ‘চরমপন্থী মুসলিমদের’ হুমকি বলে মনে করে। তাদের ‘চরমপন্থী মুসলিম’দের সংজ্ঞায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরাই পড়েছে। তাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী যারা প্রতিদিন নামাজ আদায় করে তারা ‘চরমপন্থী’। বড় বড় সমাবেশ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিদিন হিংসা ও ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিয়ে সারা দেশে তাদের হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধের পর মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিবিএস হিংসা বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়ার কারণে ক্ষুদ্র মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর ২০১৪, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে প্রচণ্ড হামলা চালানো হয়। তারা মিয়ানমারেও একই ধরনের গ্রুপের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াতে থাকে।
মুসলিমদের ওপর জঘন্য হামলা চালানোর পরও শ্রীলঙ্কার স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বিবিএস এবং একই ধরনের অন্য গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সহিংসতার জন্য তারা মুসলমানদেরকে দায়ী করে আসছে। ২০১৯ সালে আটজন আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী খ্রিষ্টানদের ইস্টার সানডের দিনে সারা দেশে চার্চ, হোটেল এবং অন্যান্য স্থাপনায় বোমা হামলা চালানোর পর মুসলিমবিরোধী ঘৃণা ও বিদ্বেষ আরো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনার ব্যাপারে দেশের নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি অংশের অবহেলা ও গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতার প্রমাণ রয়েছে। যাই হোক না কেন, ঘটনার পরপরই মিডিয়ায় যেভাবে সেটা প্রচার করা হয়েছে এবং সরকারের নীতি যেভাবে আলোচিত হয়েছে তাতে মুসলিম জনসংখ্যাকেই প্রাথমিকভাবে টার্গেট করা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা স্থানীয় মুসলিমদেরকে উগ্রবাদী করে তোলার জন্যে মুসলিমবিরোধী আন্দোলনগুলোর ভূমিকার কথা কদাচিৎ উল্লেখ করে থাকেন। মে মাসে দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর প্রতিশোধমূলক হামলা চালানো হয়। বোমা হামলার সন্দেহভাজনদের গ্রেফতার করার জন্য সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করে। তখন থেকে কয়েকজন বিশিষ্ট মুসলিমকে সরকার টার্গেট করেছে। অথচ তাদের কোনো ভুল কাজের তেমন আইনগত দলিল প্রমাণ নেই। ২০২০ সালের এপ্রিলে পুলিশ হেজাজ হিজবুল্লহ নামক একজন আইনজীবীকে গ্রেফতার করে। হামলাকারীদের সহায়তা দিয়েছেন বলে সন্দেহ করে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর ২০২০ সালের একই প্রেক্ষাপটে আহনাফ জাযিম নামক একজন তরুণ মুসলিম কবিকে আটক করা হয়। সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর সাবেক নেতা হাজুল আকবরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কোনো অভিযোগ দায়ের করা ছাড়াই তাকে দ্বিতীয়বার গ্রেফতার করা হল।
ইস্টার সানডেতে হামলার ঘটনার পর সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক পার্লামেন্ট সেক্টরাল ওভারসাইট কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ১৪টি ক্ষেত্রে সুপারিশ পেশ করে। এসব সুপারিশের মাধ্যমে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। এসব সুপারিশের ভিত্তিতেই বোরকা নিষিদ্ধ এবং ইসলামী স্কুল বন্ধ ঘোষণা করাসহ সম্প্রতি আরো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। মার্চ মাসের প্রথম দিকে সরকার ঘোষণা করে, দেশে আমদানি করা সব ইসলামী বইয়ের ব্যাপারে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে। এর কিছুদিন পর সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ আইনের ছদ্মাবরণে, কথিত উগ্রবাদী ধর্মীয় আদর্শের আমূল সংস্কারের লক্ষ্যে ইসলামপন্থীদের গ্রেফতার করার জন্য বিধিবিধান তৈরি করা হয়। এসব ছাড়াও সরকার দেশের মুসলমানদেরকে ভীতি প্রদর্শনের জন্যে অন্যান্য পথ খুঁজতে থাকে। ২০২০ সালের বসন্তকালে শ্রীলঙ্কায় যখন কোভিড-১৯ মহামারী ছড়িয়ে পড়ে তখন সরকার কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া লোকদের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে শবদাহের নীতি আরোপ করে এবং মুসলমানদের লাশ তাদের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী কবর দেয়ার অনুমতি দানে অস্বীকৃতি জানায়। তারা জরুরি গণস্বাস্থ্য পরিস্থিতিতে মুসলিম ধর্মীয় রীতি অনুসারে লাশ দাফনের আহ্বান জানানোকে ‘সেকেলে’ এবং ‘উপজাতীয়’ মনোবৃত্তি বলে বর্ণনা করেছিল। দেশে-বিদেশে সরকারি পদক্ষেপের নিন্দা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সমাহিত করার নিরাপত্তার ওপর জোর দিয়ে গাইড লাইন প্রদান করা সত্ত্বেও প্রায় এক বছর শ্রীলঙ্কা সরকার এ সিদ্ধান্তে অটল থাকে। আন্তর্জাতিক চাপের কারণে কেবল সম্প্রতি লাশ দাফন করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক এলিটরা দেশটির সংখ্যালঘুদেরকে অব্যাহতভাবে অশুভ শক্তি বা দানব হিসেবে চিত্রিত করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করে আসছেন। এই ধরনের অপপ্রচার ও ধর্মীয় শত্রুতা উসকে দিয়ে তারা নির্বাচনে জয়লাভের কৌশল অবলম্বন করেন। ২০০৯ সালে গৃহ যুদ্ধ অবসানের পর যখন তামিলদের বিরুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে সরকার প্রশংসা লাভ করেছিল- তখন অন্য সব সংখ্যালঘুর, বিশেষভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে নতুন করে হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়া হয়।
রাজাপাকসে পরিবার- ২০০৫ সাল থেকে ২০১৫ সালের নির্বাচনে পরাজয় বরণ না করা পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক দৃশ্যপটে প্রভাব বিস্তার করে এবং তারা ওই সময়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে দিয়ে অপপ্রচার অব্যাহত রেখেছিল। ২০১৫ সালের পর রাজা পাকসের নতুন দল দ্য শ্রীলঙ্কা পোদুজানা পেরামুনা (এসএলপিপি) সিংহলি জাতি গোষ্ঠীর সাথে উগ্রবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং মুসলিমবিরোধী আন্দোলনের হর্তাকর্তাদের নিয়ে তাদের কর্মকাণ্ড শুরু করে। মুসলিম ব্যবসায়ীরা সিংহলি উদ্যোক্তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছেন এবং মুসলিমরা সিংহলিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ভেঙে দেয়ার ষড়যন্ত্র করেছে অথবা একটি সন্ত্রাসী হুমকি সৃষ্টির জন্য কাজ করে যাচ্ছে বলে তারা মিথ্যা প্রচারণা চালায়।
বর্তমান প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে সংখ্যালঘুবিরোধী এবং নিরাপত্তার ব্যাপারে বাগাড়ম্বরপূর্ণ প্রচারণা চালিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন। সিংহলি বৌদ্ধদের ব্যাপক সমর্থন পেয়ে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তিনি তার ভাই সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেন। এরপর থেকে এ পর্যন্ত প্রতিটি সুযোগেই তিনি সংখ্যাগুরু সিংহলিদের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত এবং কথিত ইসলামী চরমপন্থা দমনের নামে মুসলিমবিরোধী নীতিকে এগিয়ে নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই প্রেক্ষাপটে বোরকা নিষিদ্ধ করা, কোভিড-১৯ মহামারীতে মৃত্যুবরণকারী মুসলিমদের দাফন করার অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানানোর মতো ঘটনা ঘটে। শ্রীলঙ্কায় দুর্নীতি, অর্থনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে সরকার বেকায়দায় রয়েছে। সরকারের জনপ্রিয়তা কমতে থাকলে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তাদের তৎপরতা আরো বেড়ে যাবে, এটাই এখন স্বাভাবিক। কিন্তু সরকারের মুসলিমবিরোধী নীতি বুমেরাং হতে পারে। গত মার্চে শ্রীলঙ্কা সরকার জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার পরিষদে (ইউএনএইচআরসি) পরাজিত হয়েছে। মানবাধিকার পরিষদ শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের সময় যে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছিল, তার তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করার জন্যে মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ হাই কমিশনারকে ক্ষমতা দিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করেছে। কয়েকটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ ভোটদানে বিরত থাকায় সেখানে প্রস্তাবটি পাস হয়েছে। মুসলিম দেশগুলো শ্রীলঙ্কা সরকারকে সমর্থন না দেয়ায় তারা ভোটে পরাজিত হয়। প্রস্তাবে কোভিড-১৯ এর পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিমদের সাথে সরকারের আচরণ এবং অব্যাহতভাবে সংখ্যালঘুদের কোণঠাসা করার কথা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশনের প্রস্তাবটিকে অবশ্যই স্বাগত জানাতে হবে। এটা একটা ভালো অগ্রগতি। শ্রীলঙ্কায় সংখ্যালঘুদের ভবিষ্যত ভালো নয়। দীর্ঘ ১০ বছরের ভয়াবহ যুদ্ধের পর দেশটিতে অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণের কোনো প্রমাণ দেখা যাচ্ছে না।
লেখক : ফারজানা হানিফা, কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ও সমাজ বিদ্যা বিভাগের প্রধান। আল জাজিরা থেকে
ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার