করোনাকালের মে দিবস
করোনাকালের মে দিবস - ছবি : নয়া দিগন্ত
যেকোনো সভ্যতা গড়ে তোলার নেপথ্য কারিগর তৃণমূলের প্রান্তিক মানুষ। তাদের শ্রম-ঘামে সভ্যতার ভিত্তিভূমি নির্মিত হয়। সত্য হলো, ঘাম আর রক্তের মিশ্রণে সভ্যতার নির্মাতা শ্রমিকশ্রেণী। কিন্তু সভ্যতার উন্নয়নের সুফল তাদের ভাগ্যে কমই জোটে। উচ্ছিষ্ট ও এঁটোকুটো। এই বঞ্চনার ইতিহাস প্রাচীন কাল থেকেই জারি আছে। একসময় যখন সভ্যতার ভিত ছিল দাস অর্থনীতি; সেই ফেরাউনি আমলে বনি ইসরাইলকে দাসে পরিণত করে তাদের কাছে থেকে জবরদস্তি শ্রম আদায় করা হতো। বিনিময়ে তাদের ছিল না কোনো মানবিক অধিকার। ঠিক তেমনিভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীতে শিল্পবিপ্লবের ঊষালগ্ন থেকে কল-কারখানায় শ্রম বিক্রি করা মানুষের শ্রমের কোনো মর্যাদা ছিল না। আর ভদ্রতার মুখোশধারী সমকালীন দুনিয়ায় শ্রমিকরা আজ যেটুকু অধিকার ও মর্যাদা পাচ্ছে তা-ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত। প্রতি বছর পয়লা মে বিশ্বব্যাপী যে শ্রমিক দিবস পালিত হয়, সেটিও জীবনের মূল্যে কেনা। এই দিবস নিয়েও বঞ্চনার ইতিহাস রয়েছে। শুরুতে পয়লা মে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হলেও তা থেকে শ্রমিক শব্দ মুছে ফেলা হয়েছে।
শ্রমিকের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে প্রেরণাদায়ী মে দিবস সারা বিশ্বের শ্রমিকসমাজের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। শিকাগোর হে মার্কেটে শ্রমিকদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে যে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছিল, সেই ধারাবাহিকতায় দেশে দেশে শ্রমিকশ্রেণী মে দিবসকে মুক্তির দিশারি হিসেবে গর্ব ও প্রত্যয়ের সাথে পালন করে আসছে। উন্নত দেশগুলোয় শ্রমিকরা তাদের অধিকার আরো সংহত করার আওয়াজ তোলেন এই দিনে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোয় মে দিবস দাবি ও অধিকার আদায়ের দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৮০টি দেশে পয়লা মে জাতীয় ছুটির দিন। অনেক দেশে বেসরকারিভাবে পালিত হয়।
ফিরে দেখা
উনিশ শতকে শিল্প বিপ্লব ইউরোপ থেকে ছড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রেও। শহর বা আশপাশের অঞ্চলে অপরিকল্পিতভাবে শিল্প-কলকারখানা গড়ে উঠছিল। গ্রাম থেকে কর্মসংস্থানের জন্য উঠে আসা মানুষ ঠাঁই নিচ্ছিলেন বেশির ভাগ ছোট ও মাঝারি কারখানায়- যেখানে মজুরি এবং শ্রমঘণ্টার কোনো বালাই ছিল না। কিন্তু সেই অনুপাতে ছিল না মজুরি। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন শ্রমিকরা। মাঝে মধ্যে ধর্মঘটও ডাকতেন তারা। ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে ওঠে। কল-কারখানা তখন গিলে খাচ্ছিল শ্রমিকজীবন। অসহনীয় পরিবেশে প্রতিদিন কাজ করতে হতো। সপ্তাহজুড়ে কাজ করে তাদের স্বাস্থ্য ভেঙে যাচ্ছিল। শ্রমজীবী শিশুরা হয়ে পড়েছিল কঙ্কালসার। তখন দাবি উঠেছিল, কল-কারখানায় শ্রমিকের পুরো জীবন কিনে নেয়া যাবে না। শ্রমিক সংগঠনগুলো শ্রমঘণ্টা কমিয়ে আনার দাবি জানাতে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় ১৮৮৬ সালে মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের সামনে শ্রমিকরা জমায়েত হয়েছিলেন কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে। এর অন্যতম ছিল আট ঘণ্টা কর্মপরিসর নির্ধারণ। অর্থাৎ তারা চাইছিলেন, সরকার সব কারখানায় শ্রমিকদের কাজের সময়সীমা বেঁধে দিক আট ঘণ্টা। অতিরিক্ত সময়-শ্রম দিলে শ্রমিকদের আলাদা পারিশ্রমিক দিতে হবে। তখন কারখানাভেদে শ্রমিকদের ১৬-২০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হতো।
পুলিশের উপস্থিতিতে প্রতিবাদ সমাবেশ চলছিল শান্তিপূর্ণভাবেই। কিন্তু বিপত্তি ঘটে অজ্ঞাত ব্যক্তির ছোড়া বোমায়। আচমকা ছুটে আসা ওই বোমা শ্রমিকদের দিক থেকে নিক্ষিপ্ত হয়েছে বলেই পুলিশের তাৎক্ষণিক ধারণা জন্মে। শুরু হয় শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ। বেধে যায় ভয়াবহ দাঙ্গা। পুলিশের গুলিতে শ্রমিক আর অজ্ঞাতনামার বোমায় পুলিশসহ সব মিলিয়ে ১০ থেকে ১২ জনের মতো মানুষ প্রাণ হারান। কথিত আছে, প্রকৃত মৃত্যু, বিশেষ করে মৃত শ্রমিকের সংখ্যা সরকারি হিসাবের অনেক গুণ বেশি! সংখ্যাটা যা-ই হোক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে শ্রমিকের মৃত্যুর ব্যাপারটা গোটা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল। এই রক্তপাতের পরে ধীরে ধীরে কর্মঘণ্টা আট ঘণ্টায় নামিয়ে আনা হয়। অন্তত ১২ জনের মৃত্যুর সাথে অসংখ্য হতাহত হওয়া দরিদ্র শ্রমিকরা সে দিন প্রতিবাদের ফলে দু’টি অর্জন নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। একটি ছিল দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণ আর অন্যটি হচ্ছে অতিরিক্ত কাজের মজুরি। প্রাপ্তিটা ভালোই ছিল বলা যায়। অন্তত তখনকার প্রেক্ষাপটে দেখলে নিজের পাওনাটুকু বুঝে পাওয়ার প্রতিশ্রুতি তো পেয়েছিলেন! কিন্তু সম্মান? শ্রমিকের প্রাপ্য সম্মানটুকু বুঝিয়ে দিতেই ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। ১৪ জুলাই শ্রমিক সম্মেলনে পয়লা মে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তবে এত কিছুর পরও একটা শ্রেণীর হয়তো শ্রমিকদের নামে কোনো দিবস পালন করতে লজ্জা হচ্ছিল। তাই দেখা যায়, পরবর্তী সময়ে এটিকে মে মাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে ‘মে দিবস’ নাম দেয়া হয়। সেই থেকে শ্রমিকের রক্তে অর্জিত দিবস থেকে মুছে গেল শ্রমিক শব্দটি! আজো সেটিই চলছে।
১৮৯০ সালে ইউরোপে দ্বিতীয় ইন্টারন্যাশনালের উদ্যোগে প্রথম মে দিবস পালন করা হয়। তখন থেকে মে দিবসের স্বীকৃতি ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হতে থাকে। এটি প্রতি বছর পালনের রেওয়াজ ক্রমেই শক্ত ভিত পায়। ১৯০৪ সালে আমর্স্টাডামে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সোশ্যালিস্ট কনফারেন্সে সব দেশের সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক দলকে মে দিবস পালনের আহ্বান জানানো হয়। সম্মেলনে আট ঘণ্টার শ্রম দিবস ব্যবস্থা বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সোস্যালিস্টরা জানাতে থাকেন ১ মে কাজ বন্ধ রেখে আট ঘণ্টা শ্রম দিবস প্রতিষ্ঠার দাবি। সেখান থেকেই পয়লা মে শ্রমিক দিবসরূপে প্রতিষ্ঠা পেতে থাকে। অনেক দেশে মেহনতি মানুষ মে মাসের ১ তারিখকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালনের দাবি জানায়। বহু দেশে এটি কার্যকর হয়। বাংলাদেশে দিনটি যথাযথভাবে পালিত হয়। ভারতে প্রথম মে দিবস পালিত হয় ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে।
মে দিবস ও শ্রমিক অধিকার
মে দিবস, শ্রমিক দিবস, আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস যে নামেই ডাকা হোক না কেন শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদার স্বীকৃতির স্মারক পয়লা মে। অতিরিক্ত কষ্টের প্রতিবাদ করেছিলেন শ্রমিকরা। দিয়েছেন রক্ত। অবশেষে সভ্য দুনিয়া মানতে বাধ্য হয় আট ঘণ্টার শ্রম শুধু শ্রমিকের নয়, কর্মজীবী সবারই জরুরি। তবে দিবসকেন্দ্রিক আনুষ্ঠানিকতায় তর্জন-গর্জনে শ্রমিক অধিকারের কথা বলা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। শ্রমিক বঞ্চনা দেশে দেশে এখনো জারি আছে।
দিনটি সম্পর্কে রচনা বা পরীক্ষার প্রশ্নোত্তরে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি নিতে হয়। কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষের অনেকে জানেন না এর তাৎপর্য। পয়লা মে কেন সরকারি ছুটি। এক দিকে শ্রমিকের শরীর থেকে ঘাম ঝরে। চোখে অশ্রু। অন্য দিকে শ্রমিকনেতা নামে বিশাল বিত্তবৈভব। দিবসটির তাৎপর্য-উদ্দেশ্য-বিধেয় তাদের কাছে ভিন্ন। মতলবেও ভিন্নতা। মে দিবসের নামে শ্রমিকদের ধোঁকা দেয়া হচ্ছে অহরহ। ন্যায্য পাওনার জন্য এ দিন শুধু শ্রমিকরা আন্দোলন করবেন কেন?
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিশুশ্রমের ভয়াবহতা বেশি। যদিও শিশুশ্রম আইনগতভাবে স্বীকৃত নয়। এক হিসাবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে শিশুদের এক-তৃতীয়াংশ শিশু শ্রমে নিয়োজিত। দারিদ্র্যসহ নানা কারণে শিশুরা শ্রমে নামছে। যেনতেন নয়, অত্যন্ত অমানবিক তথা ঝুঁকিপূর্ণ কাজও কারানো হচ্ছে তাদের দিয়ে। জড়ানো হচ্ছে অপরাধমূলক ও অনৈতিক কাজেও। এ ছাড়া বাংলাদেশে নারী শ্রমিকরা ভুগছেন বঞ্চনায়। সেটি বেশি রফতানি খাতের সর্বোচ্চ স্থানে অবস্থানকারী তৈরী পোশাক শিল্পে। শ্রমিক বা মে দিবসে এগুলোকে প্রতিপাদ্য করা হয় না।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সর্বোচ্চ খাত গার্মেন্টস শিল্প। প্রবাসীদের বড় একটি অংশ অন্য দেশে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে দেশকে নিয়ে যাচ্ছেন উন্নয়নের পথে। তাদের প্রতিপাদ্যের বাইরে রেখে এ দিবস পালন তামাশা ছাড়া কিছুই নয়। দিবস হিসেবে শ্রমিকদের কাছে এটি মহান। সংগ্রামের দিন হিসেবে, সৌহার্দ্য ও সৌভ্রাতৃত্বের দিনও। কিন্তু বিশ্বায়নের যুগে এর তাৎপর্য সবার জন্য এক নয়। এর পেছনে বিভিন্ন দেশে এবং বিশ্বজুড়ে পুঁজি ও শ্রমিক শ্রেণীর হাল অবস্থা ও শক্তির সমীকরণটি বিবেচনায় নিতেই হয়। দীর্ঘ দিন সমাজতান্ত্রিক, কমিউনিস্ট এবং কিছু উগ্রবাদী সংগঠন নিজেদের দাবি জানাতে মে দিবসকে মুখ্য দিন হিসেবে বেছে নেয়। অন্য দিকে দিনটিকে সরাসরি অগ্রাহ্য করার ঘটনাও রয়েছে। গণমাধ্যমের তথ্যে জানা গেছে, খোদ আমেরিকায়ই দিনটির গুরুত্ব হারাতে বসেছে। ঐতিহাসিক ‘হে মার্কেটে’র গুরুত্বের কথা মার্কিনিদের অনেকে জানেনই না। পয়লা মে পালনও হয় না আমেরিকা ও কানাডায়। যে স্থানের নাম বিশ্ববাসীর মুখস্থ, সেই ‘হে মার্কেট’ সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই শিকাগোর লোকজনের।
মে দিবস আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাওয়ায় বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে অবশ্য আমূল পরিবর্তন এসেছে। মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের ওপর এ দিবসের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। শ্রমিকদের দৈনিক কাজের সময় ১৬ ঘণ্টা থেকে নেমে আসে আট ঘণ্টায়। বিশ্বের সব দেশের শ্রমিকরা এর মাধ্যমে তাদের শ্রমের উপযুক্ত মর্যাদা পেতে শুরু করেন। অধিকার আদায়ে এগিয়ে যান সামনে। মেহনতি মানুষ মুক্তি পেতে শুরু করেন তাদের শৃঙ্খলিত জীবন থেকে। বিশ্বের ইতিহাসে সংযোজিত হয় সামাজিক পরিবর্তনের আরেকটি নতুন অধ্যায়। তবু বলা যায়, পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় শ্রমিকের অবস্থান এখনো ন্যায্যতা থেকে বহু দূরে।
বিশ্ব ইতিহাসে মে দিবস শ্রমজীবী সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচনার দিন। শ্রেণিবৈষম্যের বেড়াজালে যখন তাদের জীবন বন্দী ছিল, তখন মে দিবসের প্রতিষ্ঠায় খুলে যায় শৃঙ্খল। আস্তে আস্তে লোপ পেতে লাগলো সমাজের শ্রেণিবৈষম্য। পুঁজিবাদের দুর্বল দিকগুলো পুঁজি করা অবৈধ অর্থলোভীদের আগ্রাসী দংশন থেকে রেহাই পেল কোটি কোটি শ্রমিক। বৈষম্য ও শোষণমুক্ত একটি সমাজ বিশ্বকে উপহার দিলো এই মে দিবস। মালিকপক্ষের সাথে শ্রমিকের যে উঁচু-নিচু সম্পর্ক ছিল, শুধু মে দিবসের স্বীকৃতির ফলেই তাতে ব্যবধান কমে আসে।
ঐতিহাসিক মে দিবসের তাৎপর্যপূর্ণ অবদান আজকের শ্রমিক শ্রেণীকে আগলে রেখেছে। যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামী চেতনা এখন শ্রমজীবীদের ভূষণ। রক্তঝরা ১ মে এখন সবার কাছে অবিচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জোর সংগ্রামের শপথ গ্রহণের দিন। সামনে এগিয়ে যাওয়ার মূলমন্ত্র। মে দিবসে সব শ্রমজীবী মানুষ তাদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আরো সুদৃঢ় করার মাধ্যমে উন্নয়নমুখী পরিবর্তন সূচনার অঙ্গীকারের প্রয়াস পায়। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ। এ দেশে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা লাখ লাখ। তাই আমাদের সরকার ও শিল্পমালিকরা মিলে শ্রমিকের নিরাপত্তা ও শতভাগ বেতন নিশ্চিত করবেন, এটাই মে দিবসের চাওয়া।
ভিন্নরূপে মে দিবস
বাংলাদেশে প্রায় সাত কোটি শ্রমজীবী মানুষ রয়েছেন। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মরত শ্রমিকরাই দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। তাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমে বেড়েছে জাতীয় প্রবৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার। কিন্তু সেই তাদেরই এখন ঘোর দুর্দিন। সেখান থেকে উদ্ধারে সরকারি-বেসরকারি কোনো পর্যায়েই তেমন তৎপরতা নেই। এমন একটি প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও এবারের মে দিবসের আগমন সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে।
বৈশ্বিক মহামারী করোনা গোটা পৃথিবীকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। দুনিয়ার সব দেশেই স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত। ইতোমধ্যে দেশে দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষ সবচেয়ে কষ্টে পড়েছেন। অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। সামনে অনেকের চাকরি হারানোর শঙ্কাও দেখা দিয়েছে। তবে গত বছরের চেয়ে এবার শ্রমিকরা আরো বেশি মলিন মুখে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। শ্রমজীবীরা স্বাস্থ্যঝুঁঁকির কারণে সেভাবে কাজে যেতে পারছেন না। বেকার হয়ে বসে আছেন দিনমজুররা। বেঁচে থাকার যুদ্ধ করছেন প্রতিদিন। করোনায় দেশের অনানুষ্ঠানিক খাতের সোয়া পাঁচ কোটি শ্রমজীবীর জীবন-জীবিকা হুমকিতে। রিকশাচালক, গাড়িচালক, দিনমজুর, কৃষিশ্রমিক, দোকানদার, ফুটপাথের ছোট ব্যবসায়ী, এমন খেটে খাওয়া কর্মজীবীরা এখন দুর্বিপাকে। সুদিন ফেরার আশায় অধীর অক্ষোয় তারা। পোশাক কারখানা খুললেও সেখানকার শ্রমিকরাও আছেন স্বাস্থ্য ও চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে।
বিপুলসংখ্যক নতুন দরিদ্র
করোনার অভিঘাতে ইতোমধ্যে দেশে দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছেন। আগের আরো দুই কোটি ৪২ লাখ যোগ করলে সংখ্যাটা দাঁড়ায় পাঁচ কোটির মতো। দেশের মোট জনসংখ্যা যদি ১৭ কোটি ৮০ লাখ ধরা হয়, তাহলে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছেন। একই সাথে করোনার কারণে বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী বেকার হয়ে ঘরে বসে আছেন। কাজ না থাকায় তাদের আয়ের উৎসও বন্ধ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ (২০১৭) অনুযায়ী, দেশের ৮৫ শতাংশ কর্মজীবী অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। এরাই হলো দিন এনে দিনে খাওয়া মানুষ। দেশের মোট ছয় কোটি আট লাখ লোক মজুরির বিনিময়ে কোনো-না-কোনো কাজে আছেন। এর মধ্যে পাঁচ কোটির বেশি অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। যেখানে কাজের কোনো নিশ্চয়তা নেই। অনেকটা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করেন তারা। অন্যরা আনুষ্ঠানিক খাতের। করোনায় তাদের জীবিকাও হুমকিতে।
অনানুষ্ঠানিক খাতে শ্রমজীবী লোকের মধ্যে কৃষি খাতে আছেন দুই কোটি ৩০ লাখ ৪৮ হাজার নারী-পুরুষ। শিল্প খাতে এক কোটি ১১ লাখ ৬৮ হাজার মানুষ কাজ করেন। সেবা খাতে আছেন এক কোটি ৭০ লাখ। করোনাকালে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উৎপাদন খাত, যা অর্থনীতিতে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করছে। লাখ লাখ কারখানা শ্রমিক বেকার বসে আছেন। বিবিএসের উৎপাদন শিল্প জরিপ ২০১৯-এর প্রাথমিক ফল অনুযায়ী, দেশে ছোট, বড়, মাঝারি ও অতি ক্ষুদ্র মিলিয়ে ৪৬ হাজার ২৯১টি কারখানা আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছোট কারখানার সংখ্যা ২৩ হাজার ৫৫৭। দেশজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট এসব কারখানায় কাজ করেন ১১ লাখ ২৭ হাজার ৮৪১ জন শ্রমিক।
মহামারীর অজুহাতে চাকরিচ্যুতি
মহামারীর কারণে কোনো শ্রমিককে চাকরিচ্যুত কিংবা কোনো কারখানা বন্ধ না করার সরকারি নির্দেশনা থাকলেও অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে। কারখানা লে-অফ ঘোষণা করা হচ্ছে। অথচ এই সময় মালিকদের উচিত ছিল খানিকটা উদার হয়ে নাগরিক দায়িত্ব এবং শিল্পের ভবিষ্যৎ বিকাশের প্রয়োজনেই নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষের জীবিকার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা এবং তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। পরিবার-পরিজনসহ সব অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা অর্ধাহারে-অনাহারে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। অথচ ঠিকই মালিকপক্ষ সরকারের কাছে থেকে প্রণোদনার অর্থ আদায় করে নিয়েছে। আরো আদায়ের ফন্দি-ফিকির করছে।
ঢাকাসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোয় লাখ লাখ গৃহকর্মী কাজ করতেন। এখন তাদের ৬৬ শতাংশের কাজ নেই। এসব শ্রমিকের উপার্জনেই তাদের পরিবারের জীবিকা নির্বাহ হতো। কাজও বন্ধ, বেতনও বন্ধ। এসব মানুষের জন্য সামাজিক সুরক্ষায় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সাহায্য সহযোগিতা নেই বললেই চলে। মহামারী যেহেতু বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে, সে কারণে প্রবাসী শ্রমিকরাও কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। অথচ লাখ লাখ শ্রবাসী শ্রমিক হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল ও সমৃদ্ধ করছেন। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে প্রবাসী শ্রমিকদের সাহায্য ও তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গুরুত্ব দিচ্ছেন তেমন খবর চোখে পড়েনি।
সরকার দেশব্যাপী নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে যে ত্রাণ বিতরণ করেছে এবং করছে, তা টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট নয়। তা ছাড়া এসব ত্রাণসামগ্রী বিলিবণ্টনে অনিয়মের বিষয়টি প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমে আসছে।
শ্রমজীবী মানুষই হলো সব সৃষ্টি-উৎপাদনের মূল কারিগর। তাই শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষা ও বিকাশের স্বার্থে এবং মহামারী-পরবর্তী সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবেলার স্বার্থে শ্রমিক, কর্মচারী, মেহনতি মানুষ যাতে পরিবার-পরিজনসহ খেয়েপরে বাঁচতে পারে এবং তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিশ্চয়তা থাকে সেটি সবচেয়ে জরুরি। সে কারণে সব অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সাহায্য সহযোগিতা করা সময়ের দাবি। কারণ এসব শ্রমিক টিকে থাকলেই দেশের শিল্প ও অর্থনীতি টিকে থাকবে।
এমতাবস্থায় শিল্পকারখানা রক্ষার স্বার্থে শ্রমিকদের অধিকার ও তাদের সুরক্ষায় শিল্পমালিকদেরই উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে। সরকারকেও দেশ ও শিল্পের স্বার্থে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিতে হবে।