বাংলাদেশের প্রথম তিন বছর
বাংলাদেশের প্রথম তিন বছর - ছবি : নয়া দিগন্ত
আমরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের লাউঞ্জে বসে লোকজনের যাওয়া-আসা লক্ষ করছিলাম। লাউঞ্জের কেন্দ্রস্থলে একটি ফোয়ারায় পানির ধারার কোমল শব্দ। এর পাশেই তিনটি পাখির খাঁচা। টিয়া পাখির তীক্ষ্ম আওয়াজ ছাপিয়ে আমি অনেক ভাষা শুনতে পাচ্ছি: জার্মান, রুশ, জাপানি, স্ক্যান্ডিনেভীয়, ডাচ, ফ্রেঞ্চ, হিন্দি এবং লন্ডনি টানে অস্ট্রেলিয়ান ইংরেজি থেকে আমেরিকান টানে কানাডীয় ইংরেজি পর্যন্ত বিভিন্ন টানের ইংরেজি। হোটেলের পার্কিং লটে বিভিন্ন সারিবদ্ধ আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতীক যুক্ত অনেক গাড়ি : দ্য লিগ অব দ্য রেডক্রস, ইউনিসেফ, ডব্লিউএইচও, এফএও কেয়ার, অক্সফাম এবং হলুদ রঙয়ের লাইসেন্স প্লেটসহ গাড়িগুলো ডিপ্লোমেটিক কোরের।
আমার এক রিপোর্টার বন্ধুর কাছে জানতে চাই, এইসব বিদেশী ঢাকায় কী করছে। ‘সবাই কোনো না কোনো ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ’, তিনি ব্যঙ্গ করে উত্তর দিলেন, ‘কৃষি, শিক্ষা, শিল্প, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা। যেকোনো একটি বিষয়ের কথা বলুন, তারা তা জানে। তারা কয়েক সপ্তাহের জন্য এখানে আসে, দীর্ঘ রিপোর্ট লেখে এবং চলে যায়। কেউ তাদের জ্ঞানগর্ভ থিসিস পড়ার তোয়াক্কা করে না। তাদের উপদেশের প্রয়োজন আমাদের নেই : আমাদের প্রয়োজন খাদ্য এবং অর্থ।’
১৯৭১ সালের গ্রীষ্মে তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল কলকাতায়, যেখানে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বর আক্রমণের শিকারে পরিণত হয়ে শরণার্থী হিসেবে এসেছিলেন। বোধগম্য কারণেই তিনি ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের কথাও তিনি উচ্ছ্বাসের সাথে বলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানপন্থী ভূমিকার জন্য তিনি নিক্সন প্রশাসনের নিন্দায় কোনো শব্দ উচ্চারণ করেননি। এক বছর পর ঢাকায় তার সাথে দেখা হলে তিনি ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশকে শোষণ করছে বলে অভিযোগ করেন এবং তার দেশের জন্য আমেরিকা যা করছে সে সম্পর্কে সপ্রশংস ছিলেন। এবার (ডিসেম্বর ১৯৭৪) তিনি স্মৃতিকাতর হওয়ার মতো ভারতীয়দের সম্পর্কে বলেন, তাদের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়েছিল যখন তিনি কপর্দকহীন শরণার্থী হিসেবে কলকতায় ছিলেন। দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তনের দিকে তার মনোযোগ আকর্ষণ করলে তিনি হাসেন; মুখে বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশীরা এমনই। যারা আমাদের অর্থ ও খাদ্য দেয়, তারা আমাদের বন্ধু; আর যারা দেয় না, তারা আমাদের শত্রু।’
তিনি এর ব্যাখ্যা করেন, ‘বিভিন্ন দেশের সাথে আমাদের একের পর এক কল্পিত মধুচন্দ্রিমা হয়েছে। প্রথমে ভারতীয়দের সাথে এবং পরে রুশদের সাথে। ওই দু’টির তেজ যখন কমে যায় তখন আমরা তাদের বিরুদ্ধে চলে যাই এবং আমেরিকানদের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব গড়ে তুলি। আমেরিকানরা তাদের হাত বন্ধ করলে আমরা পাকিস্তানিদের দিকে ফিরি। আমরা ঢাকায় ভুট্টোকে বিশাল অভ্যর্থনা দেই। তিনি আমাদেরকে একটা কানাকড়িও দেননি; অতএব পাকিস্তানের সাথে আমাদের সংক্ষিপ্ত মধুচন্দ্রিমারও অবসান ঘটে। এখন আমরা আমাদের ভিক্ষাপাত্র পাততে যাচ্ছি তেলসমৃদ্ধ আরব শেখদের দুয়ারে : ‘আল্লাহর ওয়াস্তে ভিক্ষা চাইতে!’ বিশ্ব যখন আমেরিকান দৃষ্টিভঙ্গির কাছে ধরা দেয় যে, বাংলাদেশকে সাহায্য করার মানে হচ্ছে অর্থ নর্দমায় নিক্ষেপ করা, তখন থেকে আমাদের আসল সমস্যা শুরু হয়েছে।’
বাংলাদেশের সঙ্কট দীর্ঘদিন আগে থেকেই শুরু হয়েছে বলে মনে হয় এবং এখন তা বহুগুণ বেড়ে গেছে। আল্লাহ ও মানুষের হাত দেশের বিরুদ্ধে চলে গেছে। বাংলায় একটি কথা চালু আছে যে, চারটি জিনিসকে যেন বিশ্বাস না করা হয় : ‘নখরসহ পশু, সুন্দরী নারী, নদী এবং অস্ত্রসহ পুরুষ’। এই চারটির মধ্যে শেষ দু’টি নিয়ে বাংলাদেশে তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে : ‘নদীর খামখেয়ালিপনা এবং সশস্ত্র ব্যক্তিদের স্বেচ্ছাচারিতা’। দেশটির বেশির ভাগই সমতল এবং অসংখ্য নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন, যে নদীগুলো তেমন কোনো সতর্কতা ছাড়াই ফুঁসে ওঠে এবং প্রায় নিয়মিতভাবে ফসল ধ্বংস করে, শান্ত-নিথর জনপদ ভাসিয়ে নেয়। নদীর পানি কমে গেলে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সূর্যের খরতাপ কর্দমাক্ত জলাভূমিকে করে তোলে কঠিন, ইটের মতো শক্ত, যেখানে চাষাবাদ করাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার মতো খরাও আসে নিয়মিত। গত তিন বছরে বাংলাদেশ সবগুলো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। ১৯৭৪ সালের বসন্তকালের বন্যা গত ২০ বছরের মধ্যে যেকোনো সময়ের বন্যার চেয়ে অনেক বেশি বিধ্বংসী ছিল, যে বন্যায় দেশের ১৯টি জেলার মধ্যে ১৭টি প্লাবিত হয়েছিল।
যাদের হাতে অস্ত্র তারা জনগণের দুর্দশা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রথমে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তারা সমগ্র জনগণের ওপর হামলে পড়ে; হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণ করে। ভয়ে-আতঙ্কে এক কোটি মানুষ ভারতে পালিয়ে যায়। ভারত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে; তাদেরকে আধুনিক অস্ত্র দিয়ে বাংলাদেশে পাঠায়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যায়। মুক্তি বাহিনীর গেরিলাদের সমর্থনপুষ্ট হয়ে ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাজ সংক্ষিপ্ত করে দিয়েছে। কিন্তু পিছু হটা পাকিস্তানিরা ব্রিজ ও রাস্তা উড়িয়ে দিয়েছে, রেললাইন তুলে ফেলেছে, নৌযানগুলো ডুবিয়ে দিয়ে বন্দুরগুলোতে মাইন বসিয়েছে। তাদের পরিত্যক্ত বিপুল পরিমাণ অস্ত্র মানুষের হাতে পড়েছে। ১৯৭১ সালে বাঙালিদের হত্যা করেছে পাকিস্তানিরা। এরপর থেকে বাঙালিরা বাঙালিদের হত্যা করছে।
পাকিস্তানিরা বাংলাদেশকে ধ্বংস্তূপে পরিণত করেছে। অভূতপূর্ব বিজয়ের উচ্ছ্বাসের জোয়ারে দেশের আসল সমস্যা ইতোমধ্যে বিস্মৃত হয়েছে। ফাঁসির কাষ্ঠ থেকে অল্পের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ষা পাওয়া এবং বিজয়ীর বেশে তার স্বদেশ ফেরা তাকে পরিণত করেছে কিংবদন্তির বীর, মুক্তিযোদ্ধা, ত্রাণকর্তা, পিতৃপুরুষ বঙ্গবন্ধু হিসেবে- সবকিছু তার একের মধ্যে। তিনি যখন ঢাকায় ফিরে আসেন, জনতা পরমোল্লাসে মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তুলে এমনভাবে তাকে বরণ করে নেয়, যা বাংলাদেশ অতীতে আর কখনো দেখেনি।
বাংলাদেশের জনগণ আশা করেছিল, তাদের বঙ্গবন্ধু অলৌকিক কিছু প্রদর্শন করবেন। তিনি তার কাজ শুরু করেন। এক কোটি শরণার্থী তাদের বাড়িঘরে ফিরে আসে এবং তাদেরকে পুনর্বাসিত করা হয়। ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্রিজগুলো পুননির্মাণ করা হয়। রেললাইন পুনঃস্থাপিত হয়, রাস্তা সংস্কার করা হয়; নদীপথ খুলে দেয়া হয় নৌ চলাচলের জন্য; বন্দরগুলো থেকে মাইন ও ডুবে থাকা জাহাজ অপসারণ করা হয়। কিন্তু এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, ভারত এবং রাশিয়া নতুন প্রশাসনকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল।
শেখ মুজিবুর রহমান দেশকে একটি নতুন সংবিধান দেন। যদিও দেশের জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ মুসলিম, তিনি ভারতের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বাংলাদেশকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ঘোষণা করেন, যেখানে হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিষ্টান সংখ্যালঘু জনগণ সমান অধিকার ভোগ করবে। ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে তার দল আওয়ামী লীগ একচ্ছত্র জয়লাভ করে, অর্থাৎ পার্লামেন্টের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৭ আসনে (সংরক্ষিত মহিলা আসনসহ ৩১৫ আসনের মধ্যে ৩০৭ আসন) জয়ী হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছিল, ‘সোনার বাংলা’র পুনরাবির্ভাবের জন্য সবকিছু প্রস্তুত।
কিন্তু বাংলা ‘সোনার বাংলা’য় পরিণত হতে পারেনি। শান্তি ও সমৃদ্ধির স্বপ্ন শিগগিরই পর্যবসিত হয়েছে ক্ষুধার্ত উন্মত্ত মানুষ এবং লুটেরাদের লাগামহীন দৌরাত্ম্যের দুঃস্বপ্নে। তাছাড়া বাংলাদেশের কুখ্যাত দুটি শত্রু- খেয়ালি নদনদী এবং অস্ত্রধারী মানুষ- দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতি এবং অযোগ্য প্রশাসন বিভেদ সৃষ্টির গতি ত্বরান্বিত করেছিল।
বাংলার এই অংশে সহিংসতা অনেকটাই জাতিগত। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঐতিহ্য দীর্ঘ। কিন্তু বাংলাদেশের জন্মের সাথে অসন্তুষ্ট মানুষের সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সহিংতার মাধ্যমে দ্বন্দ্ব নিষ্পত্তির চেষ্টা অতি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকার জন্য পুরস্কৃত হওয়ার আশা করেছিলেন। তাদের মধ্যে যারা চাকরি অথবা ঠিকাদারি লাভে অসমর্থ হয়েছে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের নিজেদের ছোট ছোট গ্রুপ সৃষ্টি করেছে। রাজনীতিতে ভাগ দিয়ে বা ঘুষ দিয়ে তারা যা হাসিল করতে পারেনি, তারা তা পেতে চেষ্টা করছে চোরাকারবার বা দস্যুবৃত্তির মাধ্যমে। প্রাইভেট বাহিনী দ্রুত গড়ে উঠছে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের এখন সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবী আছে। দেশের বিভিন্ন অংশে মস্কোপন্থী ও পিকিংপন্থী (মাওবাদী দলের সংখ্যা আধা ডজন) কমিউনিস্ট পার্টি লক্ষ্যণীয়ভাবে তৎপর। এসব কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে ‘পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি’ নামে একটি দল চট্টগ্রাম বন্দর এলাকা এবং ঢাকার আশপাশে নাশকতামূলক কাজের সাথে জড়িত বলে জানা গেছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের নিজস্ব বড় আকৃতির একটি প্রাইভেট বাহিনী গড়ে তুলেছে। শেখ মুজিবুর রহমানের আছে তার রক্ষী বাহিনী। তার ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি যুবলীগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাদের দু’জনের মধ্যে, অর্থাৎ মামা ও ভাগ্নের কমান্ডে ৪০ হাজার থেকে এক লাখ সশস্ত্র ভলান্টিয়ার আছে বলে শোনা যায়।
প্রশাসন ‘দুষ্কৃতিকারী’, ‘অসামাজিক’ শক্তিকে দোষারোপ করছে এবং দেশের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির কারণে জনগণ ‘স্বাধীন বাংলাদেশের’ অভ্যুদয়ের বিরোধিতা শুরু করেছে। বিরোধী দল সবকিছুর জন্য সরকারের ওপর দোষ চাপাচ্ছে। মাওবাদী সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘হলিডে’র সম্পাদক এনায়েতুল্লহ খান বলেন, ‘এই অরাজকতার প্রধান কারণ প্রশাসন, সহিংসতা এবং আইনের প্রতি ক্ষমতাসীন দলের গুণ্ডা-বদমাশের প্রচণ্ড রকমের অশ্রদ্ধা।’ প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপগুলোর সংঘর্ষ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। গত বসন্তকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চারজন ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে। গত ক্রিসমাস এবং একটি মুসলিম ধর্মীয় উৎসব ছিল একই সময়ে, তখন গোলাম কিবরিয়া নামে একজন পার্লামেন্ট সদস্যসহ আওয়ামী লীগের তিনজন সদস্যকে বিভিন্ন মসজিদে নামাজরত অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে। গত তিন বছরে পুলিশ তিন হাজারের অধিক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা দেশে বিরাজমান সহিংস পরিস্থিতির মতোই চরম দুর্দশাগ্রস্ত। ১৯৭১ সালের প্রায় পুরো সময় কেটেছে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে। কৃষিজমির বিরাট অংশেই কোনো চাষাবাদ হয়নি; কলকারখানাগুলো ছিল বন্ধ অথবা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশ এমন এক মায়ের গর্ভে জন্ম নিয়েছে, যে মায়ের স্তন শুকিয়ে গেছে।
এই শিশুকে ক্ষুধাজনিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছে প্রধানত ভারত এবং কিছু পরিমাণে হলেও সোভিয়েত রাশিয়া। বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রথম তিন বছরের মধ্যে এমন কোনো নজির নেই যে প্রশাসন একটি বারের জন্য জনগণের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে। অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম লাগামহীনভাবে বেড়েছে এবং বর্তমানে দ্রব্যমূল্য মানুষের নাগালের বাইরে। তিন বছরে বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য চালের দা বেড়েছে তিনগুণ। একমাত্র ভৌগোলিক প্রতিবেশী ভারতের সাথে তুলনা করা যৌক্তিক। ঢাকায় এক প্লেট ভাতের দাম কলকাতার দামের চেয়ে তিনগুণ বেশি। ঢাকায় এক কিলোগ্রাম লবণের দাম ডলারের হিসেবে তিন থেকে চার ডলার। রান্নায় ব্যবহার্য মরিচের গুড়ার মূল্য প্রতি কিলোগ্রাম ১৫ ডলার। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এক বোতল কোমল পানীয় কিনেছি এক ডলারে- এক পেগ ডিউটি ফ্রি স্কচ হুইস্কির জন্য একই মূল্য পরিশোধ করেছি।
দুই দেশের মধ্যে জিনিসপত্রের মূল্যের এই ব্যবধানের পরিণতি ছিল মাঠ, পাহাড় ও জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বিস্তৃত প্রহরাবিহীন এবং প্রায় সীমানা চিহ্ন শূন্য আড়াই হাজার মাইলের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তজুড়ে চোরাচালানের ব্যাপক বিস্তার। ভারত থেকে পাচার হতো পাট, চাল ও মাছ এবং বিনিময়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার হতো বস্ত্রজাত ও বিলাস পণ্য। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল চোরাকারবার। চোরাকারবার দমনের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছিল।
বাংলাদেশের প্রধান শিল্প ছিল পাটশিল্প। পাট থেকেই সর্বোচ্চ পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হতো। জাতীয়করণকৃত পাটকলগুলোর উৎপাদন এখন পর্যন্ত স্বাধীনতা-পূর্ব পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেনি। টেক্সটাইল, চিনি এবং শিপিংয়ের মতো জাতীয়করণকৃত অন্যান্য শিল্পের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ব্যাংকগুলোর লালবাতি জ্বালানোর অবস্থা এবং তারা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণদানে অনিচ্ছুক।
জনসংখ্যার চাপও বেড়ে চলেছে। স্বাধীনতার তিন বছরে জনসংখ্যা সাত কোটি থেকে সাত কোটি ৬০ লাখে উন্নীত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া স্টেটের আয়তনের সমান বাংলাদেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গমাইলে এক হাজার ৩৬০Ñ যা জাপানের প্রতি বর্গমাইলে জনঘনত্বের দ্বিগুণ। প্রতি মিনিটে তিনজন করে বাংলাদেশী জন্মলাভ করে। ফ্যামিলি প্ল্যানিং বোর্ডের ডাইরেক্টর আমিনুল ইসলাম স্বীকার করেন যে, তার কর্মসূচি স্থবির হয়ে গেছে এবং মহিলাদের মধ্যে যারা পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণের জন্য পরামর্শ নিতে আসে তাদের বেশিই ভাগই আসে ‘জনসংখ্যার পরিসংখ্যানে ক্ষতিসাধনের পর, যখন তারা সাত, আট অথবা ৯টি সন্তানের জন্ম দিয়ে ফেলেছে।’
বাংলাদেশের প্রথম অগ্রাধিকার হচ্ছে দেশের জনগণের জন্য খাদ্য সংস্থান করা। তারা তাদের নিজস্ব চাহিদা অনুযায়ী খাদ্যশস্য উৎপাদন করতে পারেনি। খাদ্য উৎপাদন প্রয়োজনের তুলনায় ২৫ শতাংশ কম। বৈদেশিক সাহায্যের বেশির ভাগই ব্যয় হয় বিদেশ থেকে খাদ্য কিনতে। সার, উন্নত মানের বীজ, কীটনাশক এবং কৃষি সরঞ্জাম কেনার জন্য বৈদেশিক মুদ্রার খুব কমই অবশিষ্ট থাকে। এসবের সংস্থান হলে পর্যায়ক্রমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব হতে পারে। ভবিষ্যতে আরো দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বাংলাদেশীদের ক্ষুধা নিয়ে কাটাতে হবে। গত বছর শেখ মুজিবুর রহমান স্বীকার করেছেন, জনগণ, যারা ন্যূনতম পরিমাণে খাবার খেয়ে বেঁচে থাকার কথা ভাবত এখন তারা অনাহারে কাটানোর মুখোমুখি হয়েছে- বিশ্বের দেশগুলো যদি এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ কোনো উদ্যোগ না নেয়, তাহলে মানবিক দুর্যোগ এত ভয়াবহ হতে পারে, যার নজির ইতিহাসে নেই।’
বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতা অর্জন করে তখন ধারণা করা হয়েছিল যে, দেশটির পায়ের ওপর দাঁড়াতে দেড়শ’ কোটি ডলার সহায়তা প্রয়োজন। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে দুশ’ কোটি ডলার সহায়তা করা হয়েছে, তা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক অবস্থা আগের মতোই ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে।
ভারত স্বয়ং নিদারুণভাবে একটি দরিদ্র দেশ এবং স্পষ্টত তার নিজের বোঝা বহনে অক্ষম। সোভিয়েত রাশিয়া বাংলাদেশের ওপর আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় নিক্সন প্রশাসনের কট্টর সমালোচক ছিলেন, তিনি সাহায্যের জন্য এখন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ফিরে তাকাতে বাধ্য হয়েছেন। আমেরিকান সরকার সাড়া দিয়েছে বিপুল অঙ্কের ডলার নিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। এরপর আমেরিকানরাও উপলব্ধি করেছে যে, বাংলাদেশ একটি ‘আন্তর্জাতিক তলাবিহীন ঝুড়ি’ (ড: কিসিঞ্জারের বক্তব্য অনুযায়ী) এবং স্বল্প উৎসাহ প্রদর্শন করছে।
শেখ মুজিবুর রহমানের আশাবাদে নৈরাশ্যের সৃষ্টি হয়েছে এবং সাহায্যের জন্য তিনি তার সাবেক নিপীড়ক পাকিস্তানিদের দিকে ফিরেছেন। শুভেচ্ছার প্রমাণ হিসেবে তিনি ভারতকে অনুমতি দিয়েছেন সব পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীকে মুক্তি দিতে এবং এমনকি গণহত্যার অভিযোগে আটক ১৯৫ জন সামরিক অফিসারকে ক্ষমা করেছেন। ১৯৭৪ সালের জুন মাসে মি: ভুট্টো ঢাকা সফরে গেলে বাংলাদেশীরা তাকে উচ্ছ্বসিত আবেগে অভ্যর্থনা জানায়।
বিনিময়ে শেখ মুজিবুর রহমান ‘কিছু’ আশা করেছেন। এই ‘কিছু’ ছিল সম্পদের সমান অংশ (আনুমানিক চার শ’ বিলিয়ন ডলার)। মি: ভুট্টো এ ব্যাপারে আলোচনা করতে অস্বীকৃতি জানান। এখন শেখ মুজিবুর রহমান তেল-সমৃদ্ধ আরব শেখদের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়েছেন। মনে হয়, বিদেশ থেকে সাহায্য লাভ করাই তার পররাষ্ট্র নীতির প্রধান কাজে পরিণত হয়েছে।
অনুবাদ : আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
(চলবে)