রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব

হারুন জামিল | May 09, 2021 01:51 pm
রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব

রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব - ছবি : নয়া দিগন্ত

 

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব পুরনো। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশের কাছ থেকে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম অনুযায়ী পৃথক দু’টি রাষ্ট্রের বুনিয়াদ কায়েম হয়েছিল। যাকে সোজা কথায় দ্বি-জাতি তত্ত্ব বলা হয়ে থাকে। সে সময় তৎকালীণ পূর্ব বাংলার লোকেরা তাদের বহু দূরের ফারসি ও উর্দুভাষী মুসলমানদের সাথে বসবাস করার ইচ্ছা পোষণ করেছিল শুধু ধর্মের কারণেই। যদিও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকশ্রেণীর শোষণের কারণে তাদের অচিরেই মোহ ভঙ্গ হয়।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের বুনিয়াদ কায়েম করেছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মচর্চা কতটুকু করতেন তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ছিলেন পাশ্চাত্য ভাবধারায় শিক্ষিত। ব্রিটেনে লেখাপড়া করা ব্যারিস্টার। কিন্তু এটাই সত্য যে, তিনি ধর্মের ভিত্তিতে জাতি রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা। তার ধর্ম পালনের বিষয়টি ইতিহাস বিবেচনায় নেয়নি। বরং বিবেচিত হয়েছে যে, তিনি এ উপমহাদেশের কোটি কোটি মুসলমানের স্বপ্ন পূরণের মহানায়ক। পাকিস্তান থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আজকের বাংলাদেশ। অনেকে বলে থাকেন, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দ্বি-জাতি তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ঐতিহাসিক বিচারে এ কথা সঠিক নয়। দ্বি-জাতি তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হওয়ার যুক্তি সঠিক হতো যদি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সময়ে প্রসঙ্গটি উঠত। বস্তুতপক্ষে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের শ্রেণিচরিত্র ঠিক রাখলে এবং বাঙালিদের প্রতি তাদের মানসিকতার পরিবর্তন দেখালে আজ হয়তো পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে শাসকদের কারণে। শোষণের মানসিকতার কারণে। সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ।

আওয়ামী লীগ তার রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে; কিন্তু কখনোই তারা এ কথা বলেনি যে, তাদের রাজনীতি ধর্মের বিরোধী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবদ্দশায় কখনো ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন এমন প্রমাণ নেই। বরং তিনি যে একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান এ কথা সব সময়ই বলেছেন। রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে আশ্রয় হিসেবে নেয়ার বিষয়টি বাংলাদেশে বহু বছর ধরেই চলে আসছে। ধর্ম নিয়ে যারা বিতর্ক তৈরি করেন এরা ধর্মবিরোধী এমন একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী, যারা সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন। এরা এ দেশের সমাজ মানসে বড় কোনো প্রভাব রাখে না। পরাশ্রয়ী এই রাজনৈতিক দুষ্টরা ধর্ম নিয়ে কটাক্ষ করা এবং এ নিয়ে বিভেদের বীজটি কৌশলেই জিইয়ে রাখেন। এরা সুযোগ বুঝে সব সময়ই ধর্মকে আঘাত করেন। এরা নিজেদের উদার বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করলেও বাস্তবে এরা সবচেয়ে বেশি অনুদার। ভাবনাচিন্তায় উগ্র। এদের মন-মস্তিষ্ক আচ্ছন্ন থাকে অন্যের অনিষ্ট চিন্তায়। তুরস্কে কামাল আতাতুর্কের শাসনামলে রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে নির্বাসনে পাঠানোর যাবতীয় ব্যবস্থা করা হয়। মসজিদে আজান দেয়া নিষিদ্ধ করা হয়। ইসলামী পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যবহারের ওপর পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। কিন্তু এই আধুনিককালে এসে আমরা কী দেখি? তুরস্ক থেকে ধর্ম নির্বাসনের সে প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি।

বরং বিপুল শক্তি ও পরিবর্তনের চরিত্র নিয়ে তুরস্কে আবারো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটেছে। আসলে ধর্মবিশ্বাস মানুষের হৃদয় উৎসারিত। এর সাথে জড়িত থাকে ব্যক্তির চেতনা। বেঁচে থাকার অফুরন্ত প্রাণশক্তি। তার কৃষ্টি-কালচার তার খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি। এটিকে নির্মূল করা যায় না। খাটো করে দেখারও কোনো অবকাশ নেই। ধর্মের কোনো অপব্যবহার কেউ করলে সেটি তার ব্যক্তিগত বিষয়। সেটি ব্যবহারিক বিষয়। কিন্তু এতে তার অন্তর্নিহিত শক্তিকে খাটো করা যায় না। ১৯৪৭ সালে এক কাপড়ে ঘর ছেড়ে বহু মানুষ তৎকালীন পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। আবার পাকিস্তান থেকে বহু মানুষ পাড়ি জমিয়েছিল তৎকালীন ভারতবর্ষে। সে ইতিহাস করুণ হলেও এটাই সত্য যে, ভারত বিভক্তির মূল রচিত হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। সে বিভক্তি এখনো চলমান। বিশাল ভারতবর্ষে ধর্মের প্রভাব সমাজ মানসে ব্যাপক। সেখানে হিন্দুত্ববাদী চেতনার যে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তারা ভারতের ঐক্যের ভিত্তি হিসেবে কিন্তু ধর্মকেই ব্যবহার করছে। ভারতের বহুত্ববাদের যে চিরায়ত সমাজ তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদী চেতনা নিয়ে এই একবিংশ শতকে নতুন এক প্রশ্ন তুলে ধরছেÑ তাহলো ধর্মই তাদের প্রাণ। ধর্মই তাদের রক্ষাকবচ।

বাংলাদেশেও ধর্মের প্রভাব অত্যন্ত গভীর। আমাদের এখানে রাজনীতির বিরাট একটি স্রোত তৈরি হয়েছে ধর্মীয় চেতনা থেকে। সুফি-দরবেশ এবং ইসলামের একনিষ্ঠ প্রচারকরা এখানকার সমাজ মানসে বহু বছর আগে থেকে ইসলামের যে বীজ বপন করেছেন তা এখানকার সমাজব্যবস্থাকে একটি যূথবদ্ধ ভিত্তি দান করেছে। এর শেকড় অনেক গভীরে। আটপৌরে নাগরিক জীবনে আরাম আয়েশে মত্ত বিচ্ছিন্ন যে শক্তি মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনের চেষ্টা করেন এরা কখনোই সমাজের মূল স্রোতের কাছে পাত্তা পায়নি। মানুষ এদেরকে বিচ্ছিন্ন জীব হিসেবেই মূল্যায়ন করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে এখনো আলেম-ওলামা শ্রেণীর কথার মূল্য অনেক বেশি। নিজের জীবনে ধর্মচর্চা করেন না এমন কাউকে বড় কথা বলতে দেখলে মানুষ বিরক্ত হয়। তার কথা গুরুত্ব বহন করে না। এ দেশে বহু কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী মানুষ ছিলেন এবং আছেন যারা প্রচণ্ড মানবিক, সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ। মানবকল্যাণে তাদের আত্মত্যাগ অপরিসীম। কিন্তু তাদের নিয়ে সমাজের মানুষ কতটুকু আলোচনা করেন? তাদের প্রভাবই বা কতটুকু? এই শ্রেণীর লোকেরা কখনোই নিজের সমাজ গোষ্ঠীর কাছে তেমন গুরুত্ব পায়নি। যতটুকু পাওয়ার কথা ছিল। ধর্মের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিই বিপুল মানুষের কাছে তাদেরকে অগ্রহণযোগ্য করে রেখেছে। কয়েকখানা লাল কেতাব পড়ে সমাজ পরিবর্তনে এদের কথা তাই মানুষ বিশ্বাসই করে না। মিছিল-স্লোগানে মুখর ক্ষুদ্র তরুণ যুবগোষ্ঠী এভাবেই একসময় পতিত বুর্জোয়া শ্রেণীর সবচেয়ে বড় ধারক হয়ে ওঠে। আদর্শচ্যুত এই তরুণদেরই একটি অংশ রাজনীতির ময়দানে নেপথ্যে কলকাঠি নাড়তে থাকে।

কয়েক বছর আগে ময়মনসিংহের এক এলাকায় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কাস্তে মার্কা নিয়ে মাঠে নামেন একজন। মাঠে নেমেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী বুঝতে পারেন যে, তার প্রতিদ্বন্দ্বী বেশ শক্ত। তিনি কৌশলে শুধু এটুকু প্রচার করতে থাকেন যে, তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর রাজনৈতিক বিশ্বাস যাই থাকুক তিনি আসলে একজন নাস্তিক। ব্যস। আর যায় কোথায়! দলমত নির্বিশেষে তারা সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে নেমে পড়েন এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থীই জয়ী হন। রাজনীতিতে ধর্মের এই প্রভাব খাটো করে দেখার উপায় নেই। এটাই বাস্তব যে, যুক্তি কিংবা ঐতিহাসিক প্রয়োগের দিক থেকে হেরে গিয়ে একশ্রেণীর লোক বরাবরই রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিয়ে মাঠ গরম করা কিংবা বিচ্ছিন্নভাবে ধর্মকে আঘাত করেছে। এই চেষ্টা অতীতেও বহুবার হয়েছে; এখনো চলছে। কিন্তু এর পরিণাম কখনো শুভ হয়নি। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন হয়েছিল ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বর মাসে। কাবুলের রাস্তায় হাজার হাজার সোভিয়েত সৈন্য নামানো হয়েছিল সেখানকার কমিউনিস্ট সরকারকে রক্ষায়। শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন বলেছিল তাদের সৈন্যরা আফগানিস্তানে ছয় মাস থাকবে। সেই ছয় মাস বছর গড়িয়েও শেষ হয়নি। এর পরিণতিতে রক্তাক্ত হতে থাকে আফগানিস্তান। করুণ পরিণতির সেই অধ্যায় আজো বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে সেখানকার জনগণ। নতুন করে ধর্মীয় অনেক গ্রুপ তৈরি হয়েছে। কার্যত তারাই এখন আফগানিস্তানের মূল রাজনীতির শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। বহুধাবিভক্ত আফগান সমাজ থেকে ধর্মের সেই ভিত্তিমূল কিন্তু আজো উপড়ে ফেলা যায়নি। বরং তা আরো গতি লাভ করেছে। ৪২ বছর পর দেখা যাচ্ছে আফগানিস্তান থেকে কমিউনিস্টদের বিদায় ঘটেছে। কিন্তু ধর্মীয় ভাবধারা নির্মূল হয়নি।

বাংলাদেশে আশির দশকের আগে ধর্মীয় গ্রুপগুলোর বিরাট একটি অংশ মনে করতেন, ইসলামে রাজনীতি হারাম। মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুরের নেতৃত্বাধীন কওমি ধারার আলেমরা এর সমর্থক ছিলেন। তারা সব সময়ই রাজনীতি থেকে দূরে থাকতেন। লাখ লাখ আলেম এই সিলসিলা মেনে চলতেন। আলেমদের মধ্যে সাধারণ শিক্ষায়ও উচ্চশিক্ষিতদের একটি অংশ রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন এবং এটা অপরিহার্য বিবেচনা করতেন। এই দুই ধারার মধ্যে পার্থক্য সত্ত্বেও সমাজে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আলেমদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী প্রভৃতি দল ইসলামী জীবনাদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে একাত্ম হওয়া এবং সে সংগ্রামে শামিল হওয়াটাকে কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করে। পক্ষান্তরে সবচেয়ে প্রাচীন দল মুসলিম লীগ ধর্মীয় আদর্শের লালন-পালন কিংবা চর্চার চেয়ে চেতনাগত পরিচয়টাকে মুখ্য বিবেচনা করে রাজনীতি করতে থাকে। এরই মধ্যে মুসলিম লীগ থেকে প্রগতিশীল একটি ধারা তৈরি হয় যারা প্রথমে আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং পরে আওয়ামী লীগ নামে নতুনভাবে কাজ শুরু করে। আওয়ামী লীগ বরাবরই সাধারণ মানুষের সমস্যা এবং সামাজিক অসঙ্গতির বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করতে থাকে। পাকিস্তান আমলে দলটির বিস্ময়করভাবে উত্থান ঘটতে থাকে। ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলেও ভেতরে ভেতরে যে তার ক্ষয় শুরু হয়েছে সে দিকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সাথে যুক্তদের কোনো ভ্রƒক্ষেপই ছিল না। পরিণতি যা হওয়ার তাই হয়েছে। আওয়ামী লীগে বিস্ময়করভাবে তরুণশ্রেণী যুক্ত হতে থাকে। এর বড় একটি অংশ বাঙালি জাতীয়তাবাদকে উপজীব্য করে গড়ে ওঠার পাশাপাশি সেখানে বামপন্থায় উদ্বুদ্ধ তরুণশ্রেণীরও সমাবেশ ঘটতে থাকে। চতুর এসব বামপন্থী বাংলাদেশে নিজেদের আদর্শ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে না পেয়ে এ জন্য এ দেশের ধর্মীয় প্রভাবকেই দুষতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে এ দেশে ধর্মীয় রাজনীতির প্রবক্তারাই তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছেÑ আওয়ামী লীগে র‌্যাডিকাল রাজনীতির যে শ্রেণিচরিত্র সেখানে বিস্ময়করভাবে বামপন্থীদের সমাবেশ ঘটেছে। আওয়ামী লীগের ট্রাডিশনাল রাজনীতিবিদরা যে উদার শ্রেণিচরিত্রের হয়ে থাকেন এরা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। অনুপ্রবেশকারী এসব ব্যক্তির প্রভাব যখনই বেড়েছে তখনই দলটির পলিসিতে পরিবর্তন ঘটেছে। এভাবেই আওয়ামী লীগ তার রাজনীতির উদার চরিত্রটি বিসর্জন দিতে বসেছে, যা বর্তমানে সুষ্পষ্টভাবে দৃষ্টিগোচর হয়।

আশির দশকে রাজনীতিকে হালাল ও অপরিহার্য ঘোষণা দিয়ে কওমি ধারার আলেমদের বৃহৎ অংশ নতুন দল গঠন করেন। দেশের রাজনীতিতে এ ঘটনা আলোড়ন তুললেও রাজনীতির স্বাভাবিক জটিল নিয়মের মারপ্যাঁচে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার সে স্বপ্ন অধরাই রয়ে যায়। দীর্ঘ এ যাত্রাপথে আলেমদের মধ্যেও এ নিয়ে বিভক্তি কম হয়নি, যা এখনো বিদ্যমান। ২০১০ সালে কওমি মাদরাসায় শিক্ষিত আলেমদের সমন্বয়ে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে হেফাজতে ইসলাম আত্মপ্রকাশ করে। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর দারুল উলুম মাদরাসার প্রধান আল্লামা আহমদ শফীর নেতৃত্বেই এ সংগঠনটি গড়ে ওঠে।

সংগঠনের মূল লক্ষ্য ঘোষণা করা হয় ইসলামবিরোধী যাবতীয় তৎপরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো তথা ইসলামকে হেফাজত করা। ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকায় হেফাজত মহাসমাবেশ আহ্বান করে আলোচনায় আসে। ১৩ দফা দাবিতে তাদের ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচি আকস্মিকভাবে অবস্থান কর্মসূচিতে রূপ লাভ করে। সে দিন এক রক্তাক্ত পরিণতিতে এর সমাপ্তি হয়। এরপর দীর্ঘ দিন হেফাজত অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তবে তারা বিভিন্ন ইস্যুতে সভা-সমাবেশ-প্রতিবাদ করতে থাকে। হেফাজত একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হওয়ায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে তাদের প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সখ্য গড়ে ওঠে। হেফাজতের বিভিন্ন পদবিতে আছেন একই সাথে অন্য দলও করেন এমন লোকের সংখ্যা অনেক। হেফাজতের বিধিবদ্ধ কোনো নিয়মেও এমন করা যাবেনা এ কথা বলা নেই। হেফাজত ইসলামকে রক্ষায় একটি সম্মিলিত প্লাটফরম হওয়ায় যে কারো পক্ষেই সেখানে ভূমিকা রাখা সম্ভব। বাস্তবে হয়েছেও তাই।

সম্প্রতি হেফাজতকে নিয়ে আলোচনা এবং দেশের রাজনীতিতে নতুন যে বিতর্ক শুরু হয়েছে সেখানে ধর্মীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে একটি অবস্থান স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আমাদের স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশে আসেন। এটা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য। কিন্তু সমাজের একটি অংশের আপত্তি তো থাকতেই পারে। গণতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ পন্থায় কারো আগমনের প্রতিবাদ হওয়াটা স্বীকৃত। অনেক রাষ্ট্রেই তা হয়ে থাকে। কিন্তু সেই প্রতিবাদ সহিংসতায় পরিণত হলে সরকারের উচিত নিরপেক্ষভাবে তা উদঘাটন করা। এ ঘটনা নিয়ে ঢাকা চট্টগ্রামসহ অনেক জায়গায় যে সহিংসতা হয়েছে তা নিয়ে কিন্তু জনমত দ্বিধান্বিত। আরো পরে এটা নিয়ে এখন যা ঘটছে সেটি সেই দ্বিধাকে আরো অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে এটিকে উপলক্ষ করে একটি শ্রেণীকে বশে আনতেই সবকিছু ঘটেছে কি না। তবে এর সবচেয়ে বাজে যে দিকটি সামনে আসছে তাহলো ব্যক্তিবিশেষের চরিত্র হননের যে তৎপরতা চলছে সেটি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। রাজনীতিতে এই নোংরামি চলতে থাকলে ভবিষ্যতে তা খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। যেখান থেকে অনেক ভালো মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বলতে দ্বিধা নেই, বাংলাদেশে এখন রাজনৈতিক কোনো কার্যকর তৎপরতা নেই। করোনা মহামারীতে সরকার কিংবা বিরোধী কেউই স্বস্তিতে নেই। বাদানুবাদের মধ্যেই রাজনৈতিক তৎপরতা সীমিত হয়ে পড়েছে। ভয়ভীতির রাজনীতি মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ বাধাগ্রস্ত করছে। কিন্তু এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে, ভিন্নমতের মানুষ এখানে নেই। সেই মত কতটুকু প্রকাশিত হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু ভিন্নমতকে কখনোই উপড়ে ফেলা যায় না। সরকারের সাথে শাপলা চত্বরের ঘটনার পর হেফাজতের একটি প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সখ্য গড়ে ওঠে। একটি সমঝোতার ভিত্তিতে উভয়পক্ষ চলতে থাকে। সেই সখ্যের মাঝে সন্দেহ অবিশ্বাস তৈরি হওয়ায় হেফাজতকে নিয়ে নতুন এই গেম প্ল্যানের আয়োজন বলেই রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এই পরিকল্পনায় সবচেয়ে বেশি সক্রিয় দেখা যাচ্ছে রাজনীতিতে ধর্মের অবস্থানকে যারা কখনোই বরদাশত করেনি তাদেরকেই। এরা বরাবরই সুযোগসন্ধানী।

জনগণের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন এই গোষ্ঠী যাদের ওপরই ভর করুক না কেন এরা কারোই স্থায়ী বন্ধু নয়। মনে রাখতে হবে এখনকার সময়ে প্রচারণার গুরুত্ব যেমন আছে ঠিক তেমনি মুহূর্তের মধ্যে পাল্টা প্রচারণাও তৈরি হয়ে যায়। এ দেশে ধর্মীয় রাজনীতির শেকড় বহু দূর বিস্তৃত। এর প্রভাবও ব্যাপক। প্রোপাগান্ডা দিয়ে হয়তো সাময়িক স্বস্তি অনুভূত হতে পারে; কিন্তু একবার যদি এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যায় কাউকে নির্মূল করা কিংবা বিনাশ করতেই সব আয়োজন তবে বিপুল শক্তি নিয়েই আবার তা একদিন ফিরে আসবে। ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে এভাবেই আমরা দেখেছি। হেফাজত এখনো একটি অরাজনৈতিক শক্তি। রাজনীতিতে তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চেতনা। এ দেশের মানুষের বেশির ভাগের যে ধর্মীয় চেতনা হেফাজত তারই প্রতিনিধিত্ব করে। সে চেতনা অবিনাশী। দেশের ইসলামী রাজনৈতিক শক্তিগুলো আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ভূমিকা নিয়ে বরাবরই একটা অস্বস্তিদায়ক অবস্থায় থাকেন। হেফাজতের কিন্তু সে অস্বস্তি নেই। সত্যিই মানুষের কাছে যদি এটা প্রতীয়মান হয় যে, হেফাজত জুলুমের শিকার; তাহলে শত প্রচারণা আর চরিত্র হননের প্রচেষ্টাও কিন্তু তখন আর কাজে আসবে না। কেননা ব্যক্তিকে হয়তো শক্তি দিয়ে নির্মূল করা যায়। আদর্শিক চেতনা কোনো দিন শেষ করা যায় না।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us