মিডিয়া : ভারতীয় স্টাইল, যেভাবে ভেসে গেল কংগ্রেস ও রাহুল
মিডিয়া : ভারতীয় স্টাইল - ছবি : সংগৃহীত
সংবাদপত্র, নিউজ চ্যানেল, পত্রিকা, ডিজিটাল নিউজ প্ল্যাটফর্ম সবই হলো ব্যবসা, নিখাদ ব্যবসা৷ আর পাঁচটা ব্যবসার মতো এখানেও মন্ত্র একটাই, প্রডাক্ট বেচতে হবে৷ বিজ্ঞাপন পেতে হবে৷ লাভের কড়ি ঘরে আনতে হবে৷ ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর জন্য কেউ বড় আকারে খবরের কাগজ করেন না৷ সাংবাদিকতাও নয়৷ তবে অন্য ব্যবসার সঙ্গে ফারাকটা হলো, মিডিয়া জনমত গঠন করতে পারে, কোনো একদিকে ঘুরিয়ে দিতে পারে, যেটা আর পাঁচটা ব্যবসা পারে না৷ আর তাই কর্পোরেট, রাজনৈতিক নেতাদের নজর পড়েছে মিডিয়ার উপর৷ এই সব কর্পোরেটের কাছে মিডিয়া প্রধান ব্যবসা নয়, এটা হলো সহায়ক ব্যবসা৷
এখন ভারতের মিডিয়ার জগতে বাস্তব ছবিটা হলো, বেশিরভাগ মিডিয়া সংস্থার মালিক হয় কর্পোরেট বা রাজনৈতিক নেতা৷ ভারতে নিউজ টেলিভিশনের সব চেয়ে বড় চেইন হলো টিভি১৮৷ প্রায় প্রতিটি প্রধান ভাষায় টিভি১৮-র নিউজ চ্যানেল আছে৷ তার মালিক মুকেশ আম্বানির গোষ্ঠী রিলায়েন্স৷ নিজেদের টিভি চ্যানেল ছাড়াও প্রচুর মিডিয়া গোষ্ঠীর শেয়ার কিনে রেখেছে আম্বানির রিলায়েন্স৷
দিল্লির অন্যতম প্রধান ইংরাজি সংবাদপত্র হিন্দুস্তান টাইমস, যার মালিক বিড়লা শিল্পগোষ্ঠীর শোভনা ভারতীয়া৷ উত্তর প্রদেশে তাদের বড় কারখানা আছে৷ তার ও তার স্বামী অনেক শিল্প সংস্থার মালিক৷
দেশের অন্তত ছয়টি ভাষায় খবরের কাগজ, পত্রিকা, নিউজ টেলিভিশন চ্যানেল, পডকাস্ট, ডিজিটাল নিউজ, অনলাইন গানের প্ল্যাটফর্ম, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট মিলিয়ে বিশাল ব্যবসা বেনেট কোলম্যান অ্যান্ড কোম্পানির, যার মালিক জৈন পরিবার৷ তারা এখন সংবাদপত্র জগতের সব চেয়ে বড় কর্পোরেট সংস্থা৷ তবে তাদের কাছে সংবাদপত্রের ব্যবসাই প্রধান৷ এছাড়া তারা শিক্ষা সংস্থার মালিক৷
হিন্দি সংবাদপত্রের জগতে অন্যতম বড় নাম দৈনিক জাগরণ, যার মালিক বিজেপি-র এমপি ছিলেন৷ তাদেরও সুগার মিলসহ অন্য নানা ধরনের ব্যবসা আছে৷ পাইয়োনিয়ারের সাবেক সম্পাদক ও সাবেক মালিক চন্দন মিত্র বিজেপি-র এমপি ছিলেন, পরে অবশ্য তিনি তৃণমূলে যোগ দেন৷ ওড়িশায় সাবেক মুখ্যমন্ত্রী নন্দিনী শতপথির ছেলে তথাগত শতপথি কিছু দিন আগে পর্যন্ত বিজেডি-র এমপি ছিলেন৷ তিনি একটি সংবাদপত্র চালান৷ দক্ষিণ ভারতের এক মুখ্যমন্ত্রীর পরিবার একটি বড় সংবাদপত্র গোষ্ঠীর মালিক৷
তামিলনাড়ুতে ডিএমকে নেতা মুরোসলি মারান রাজ্যের প্রধান টিভি নেটওয়ার্কের মালিক৷ সাবেক কংগ্রেস এমপি রাজীব শুক্লার স্ত্রী অনুরাধা প্রসাদ নিউজ ২৪-এর মালিক৷ তিনি আবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদের বোন৷ ইন্ডিয়া নিউজের মালিক আবার কংগ্রেস নেতার ছেলে৷ মহারাষ্ট্রের লোকমতের মালিক কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত৷
কর্পোরেটের হাতে, রাজনৈতিক নেতার হাতে মিডিয়ার মালিকানা থাকা মানে, ক্ষমতায় যে দল থাকবে, সেই দলের হয়েই সেই সব মিডিয়া কথা বলবে৷ কর্পোরেটের পক্ষে অসুবিধাজনক কোনো খবর দেখানো বা ছাপা হবে না, হলেও গুরুত্বহীনভাবে হবে৷
বছর কয়েক আগে দেশের অন্যতম প্রধান ইংরেজি টিভি চ্যানেল থেকে আমার বন্ধু অকাল অবসর নিল৷ ইনপুট এডিটরের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে৷ কেন? বন্ধুর যুক্তি, ‘আর পারছিলাম না৷ মানসিক চাপ এতটাই প্রবল হচ্ছিল যে, তার প্রভাব শরীরের উপর পড়ছিল৷’ কেমন মানসিক চাপ? বন্ধুর ব্যাখ্যা, ‘ফতোয়া ছিল, দিনের আসল খবর অসুবিধাজনক হলে দেয়া যাবে না৷ অন্য চাঞ্চল্যকর খবরের খোঁজ করতে হবে৷’ দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এই চাপ নেয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি৷ তাই অবসর৷ এখন তার আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে, কিন্তু মানসিক দিক দিয়ে পুরো চাঙ্গা৷
খবরের কাগজ বা চ্যানেল চালাতে প্রচুর অর্থ লাগে৷ আর সেই অর্থ আসে বিজ্ঞাপন থেকে৷ ১২ পাতার একটা রঙিন খবরের কাগজের প্রতিটি কপির জন্য অন্ততপক্ষে ছয়-সাত টাকা খরচ হয়৷ তা বিক্রি হয় চার টাকায়৷ হকারদের কমিশন বাদ দিয়ে হাতে থাকে দুই টাকা ২০ পয়সার মতো৷ ফলে ক্ষতি ছাপিয়ে লাভ করতে গেলে বিজ্ঞাপন চাই৷ ভারতে বেসরকারি বিজ্ঞাপন তো আছেই৷ আর আছে বিপুল পরিমাণে সরকারি বিজ্ঞাপন৷ কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের বিজ্ঞাপন৷ অভিযোগ, যে সরকারের বিরুদ্ধে লেখালিখি হবে বা টিভিতে খবর হবে, সেই সরকার বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয়৷ এটা না কি মোটামুটি সব সরকারের ক্ষেত্রেই সত্যি৷ রাহুল গান্ধী কেঁদে ভাসিয়ে দেন, কংগ্রেসের খবর টিভিতে দেখানো হয় না বলে৷ খবরের কাগজে ছাপা হয় না বলে৷ তিনি একটা সময় প্রতিটি সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করতেন, বিজেপি ও কেন্দ্রীয় সরকারের চাপে না কি এই অবস্থা৷ তিনি স্লোগান দিলেন, ডরো মত৷
কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের পর দেখা গেল, তার স্লোগান এবং তিনি দুটিই ভেসে গেছে৷ লক্ষীলাভের পিছনে না ছুটলে বাঁচবে কেমন করে? বাণিজ্যে বসত করে লক্ষ্মী৷ সেই বাণিজ্য করতে গেলে সরকারি বিজ্ঞাপন দরকার৷ কর্পোরেটের স্বার্থ, রাজনৈতিক দলের স্বার্থ দেখা দরকার৷ এই চক্র থেকে মিডিয়ার বেরিয়ে আসা কঠিন, প্রায় অসম্ভব৷
সূত্র : ডয়চে ভেলে