ভারতের উত্থান-পতনের স্বরূপ অনুসন্ধান জরুরি

সাইফুল খান | May 07, 2021 08:57 am
ভারতের উত্থান-পতনের স্বরূপ অনুসন্ধান জরুরি

ভারতের উত্থান-পতনের স্বরূপ অনুসন্ধান জরুরি - ছবি : সংগৃহীত

 

ঘটমান বর্তমান এবং অতি সাম্প্রতিককালের ভারতকে সচেতন ও নির্মোহভাবে পাঠ করা কেন জরুরি তাই নিয়েই নাতিদীর্ঘ আলাপ। ভারতের অবস্থান যদি সুদূর আফ্রিকা কিংবা বসফোরাসের ওপারের ইউরোপে নয়তো আটলান্টিক পাড়ি দেয়া আমেরিকাতে অথবা দৃষ্টিসীমার বাইরের দূরপ্রাচ্যে হতো, তাহলে আলাপের প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োজনীয়তা ছিলই না। আমরা তিনদিকে পরিবেষ্টিত সাবেক ভারতীয়। তাই ভূকৌশলগত, জাতিগত ও রাজনৈতিক কারণে ভারতের উত্থান-পতনকে আমাদের খুব কাছে থেকে অনুভবের আদলে দেখে ক্রিটিক্যালি এনালাইসিস করতে হবে। ঘটমান গল্পে আবেগের যোজন-বিয়োজন ঘটিয়ে যা প্রচার করা হবে, সেটাকে সংবাদ হিসেবে দেখা গেলেও আগামীর জন্য কোনো মেসেজ থাকবে না।

ভারতের রাজনৈতিক অবস্থান জন্মগতভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। আমেরিকার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও গ্লোবাল অর্ডারে অবস্থান চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে। আমেরিকা তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে চীনকে। ভারত এখানে আমেরিকার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যপূরণের পারপাস সার্ভার। ভারত কখনোই চীনের সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। এখনো সেই অবস্থানে ভারত আসতে পারেনি। আর আসার সম্ভাবনা আরো প্রায় ২০ বছর পিছিয়ে গেল।

ভারতের অন্যতম আভ্যন্তরীণ সমস্যা চরম জাতিবিদ্বেষী রাজনীতি। বিগত ১০ বছরে ভারত জাতি ও ধর্মবিদ্বেষের রাজনীতিকে পুঁজি করে সফলতা দেখিয়েছে। মুসলমান, দলিত, শিখ, নীচু বর্ণের হিন্দুদেরকে বাদ দিয়ে কিভাবে নয়া ভারত গঠিত হবে এবং উল্লেখিত জাতিসত্ত্বার রাজনৈতিক ভবিষ্যত কী হবে তা নিয়ে শাসক দল বিজেপি কোনো পরিষ্কার অবস্থান নিতে পারেনি। সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে একের পর এক দাঙ্গা বেঁধেছে। ভারতের আভ্যন্তরীণ দাঙ্গার প্রভাব উপমহাদেশে মুহূর্তেই ছড়িয়ে যায় তাই এ অঞ্চলে ভারত খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক দেশ।

পশ্চিমবঙ্গের ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে পর্যন্ত বিজেপি ভারতকে একটি কট্টর হিন্দুত্ববাদী দেশে পরিণত করতে পেরেছে বলে বিশ্বাস করত। এখানে পাঠকের জ্ঞাতার্থে বলে রাখি, হিন্দুত্ববাদের নামে যা চালানো হচ্ছে তা মোটেও হিন্দুত্ববাদ নয়। আসলে মোদিবাদ বা বিজেপিবাদ তথা আরএসএসের উগ্রপন্থার গায়ে হিন্দুত্ববাদের লেভেল লাগিয়ে ইমোশনালি ব্লাকমেইলের রাজনীতি করছে বিজেপি। বিজেপির তথাকথিত হিন্দুত্ববাদের বলি হয়েছে আসামের হিন্দুরা। গো-রাজনীতির চর্চা ভারতকে আধুনিক জমানায় এক পশ্চাৎপদ রাষ্ট্রে রূপান্তরের অন্তর্ঘাতী অভিযাত্রাকে নির্দেশ করেছে। করোনার প্রথম ঢেউয়ে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের গোবর, গো-চনা আর মন্ত্রের ব্যবহার মিসাইলম্যান খ্যাত আব্দুল কালামের বিজ্ঞানের অভিযাত্রায় শামিল হওয়া ভারতকে কৌতুককর পরিস্থিতির মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। নোট বাতিল, গালওয়ান ভ্যালিতে চীনের কাছে সামরিক বাহিনীর মার খেয়ে নিশ্চুপ থাকা, কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নিয়ে কাশ্মিরকে অগ্নিগর্ভ ও আরো অনিরাপদ করা, পাকিস্তানে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালাতো গিয়ে পাইলটের ধরা পড়া, ছোট্ট নেপালের চোখ রাঙানি সহ্য করা, কোয়াডের সদস্য হয়েও মার্কিন নৌবহরের ভারতের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনে বিনা অনুমতির প্রবেশের বিরুদ্ধে নমনীয় অবস্থান তথা মনিব বিরাগভাজন না হয়, এমন জায়গা থেকে বিবৃতি দেয়া ভারতের আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক দুর্বল অবস্থানকে পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত করে।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালীন কুম্ভমেলার বিশাল আয়োজনে শাসকদলের নেতাকর্মীদের ঘটা করে শামিল হওয়া জনসাধারণকে করোনা সচেতনতা থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। এ নিয়ে খোদ ভারতীয়রা প্রশ্ন তুলেছেন, এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিধানসভার নির্বাচন ও নির্বাচনী জনসভার ঢল। এর ফলে ভারতের ভয়াবহ করোনার ঢেউ অপটিমাম লেভেলে পৌঁছে গেছে। বিবিসিসহ পশ্চিমা মিডিয়া বলছে, ভারত করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা যা বলছে বাস্তবে এই সংখ্যা পাঁচগুণের বেশি। মে ও জুন-জুলাই মাসে এই সংখ্যা নাকি আরো বাড়বে। ইতিমধ্যেই শশ্মান সঙ্কট, অব্যবস্থাপনা, চরম অক্সিজেন সঙ্কট, করোনার টিকা নকল, আইসিইউ বাণিজ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় খবর এসেছে। যদিও আভ্যন্তরীণ মিডিয়া সরকারের পক্ষে মৌনব্রত পালন করাকেই উত্তম মনে করছে। অথচ ভারতীয় ব্যবসায়ীরা দেশের এই ক্রান্তিকালে দেশপ্রেমের শিকে ছিঁড়ে চার্টার্ড বিমানে করে পাড়ি দিচ্ছেন নিরাপদ গন্তব্যে।

ভারত ভ্যাকসিনের রাজনীতিকে কাজে লাগাতে চেয়েছিল। এখন নিজেই চরম ভ্যাকসিন সঙ্কটে। অথচ বন্ধু দেশ আমেরিকা ভারতের এই চরম বিপদে টুঁ শব্দটি করছে না।

মিডিয়ায় শক্তিমান ভারত, মিডিয়ার কল্যাণে বৈশ্বিক মানসে মোহমায়া সৃষ্টি করতে পারার ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে আইপিএল চালু রেখেছিল। আন্তর্জাতিকভাবে যাতে করোনা মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের কান্না আইপিএলের ঝালরে ঢাকা পড়ে। সেটাও আর সম্ভব হলো না।

বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, তামিলনাড়ুতে সরকারি দল পরাজিত হয়ে পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হয়েছে। নির্বাচনী জনসভায় ইংরেজি আর হিন্দির মিশেলে কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্য না বোঝায় বক্তব্যের উত্তেজক মুহূর্তে যখন হাততালি পাবার কথা তখন জনতার নীরবতা ইলেকট্রনিকস মিডিয়ায় চরম হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে। আঞ্চলিক নেতারা এই ঘটনার উদ্ধৃতি দিয়ে বলছে, অতিথি পাখির মতো আসা এমনতর রাজনীতিকেরা জনগণের প্রয়োজন অনুভবের যোগ্যতা রাখে না।

এত কিছুর পরও বিজেপির অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছে বলা যাবে না। আঞ্চলিক পরাজয় হলেও সামগ্রিক বিবেচনায় কংগ্রেসের উপরে বিজেপিই আছে। আর এটাই অখণ্ড ভারতের জন্য বড় ভয় ও অনিরাপত্তার আতঙ্ক। বিজেপি কেন্দ্রে থাকলে ভারতের প্রদেশভিত্তিক দলগুলো ধীরে ধীরে শক্তিমান হয়ে উঠবে যা আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদকে উস্কে দেবে।

উপমহাদেশে প্রায় একঘরে থাকা ভারতে যদি কখনো ওরকম পরিস্থিতি সত্যিই তৈরি হয় চীন আর পাকিস্তান অন্তত ওই সুযোগটা নিতে ভুল করবে না।

তবে বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ ভারতের এহেন চরম বিপদে করোনার দূরত্ব বজায় রেখেই আমাদের সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের একটা গুরুত্বপূর্ণ স্ট্যান্ড আমাদের একমুখীতার ট্যাবু ভেঙে দিয়েছে। সেটা হলো, বাংলাদেশের বিপদের সময়ে ভারত যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য রফতানি বন্ধ করে দেয় তখন বাংলাদেশ আমদানির নয়া দিগন্ত উন্মোচন করে। ভারতের কৃষক, অনেক কোম্পানি বাংলাদেশে রফতানি করার উদ্দেশ্যে অনেক পণ্য উৎপাদন করে। তাই আমরা শুধু তাদের ওপর নির্ভরশীল বিষয়টি তা নয় ইন্ডাস্ট্রি টিকিয়ে রাখতে চাইলে বাংলাদেশের বাজার তাদের ধরে রাখতেই হবে। নাহলে বাধ্যতামূলক দীর্ঘস্থায়ী বিকল্প খুঁজতে হবে তাদের, যদিও চীন সারা দুনিয়ার বাজার দখল করে বসে আছে।

ভারতের ওপর আমরা নির্ভরশীল আদতে কথাটা সত্যি নয়। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ভারতের ১০ লাখ লোক বাংলাদেশে কাজ করে। এছাড়া এ দেশীয় বাজারের ওপর ভারতের অর্থনীতির অনেক বড় অংশ নির্ভরশীল। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, বৈশ্বিক মহামারীতে বিপর্যস্ত, ধারাবাহিক নিম্নমুখী জিডিপির ভারতকে এ দেশীয় সুবিধাবাদী মিডিয়ার চোখে না দেখে বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ভারতের স্বরূপ অনুসন্ধানের পৌরষ জাগ্রত করা জরুরি।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us