বাবরির পর ‘জ্ঞানবাপী মসজিদ’

নাদিম আবদুল কাদির | May 05, 2021 04:23 pm
বাবরির পর ‘জ্ঞানবাপী মসজিদ’

বাবরির পর ‘জ্ঞানবাপী মসজিদ’ - ছবি সংগৃহীত

 

কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ বলেছেন, ‘তুমি লক্ষবার সন্তোষ প্রকাশ করলেও কবে শেষ হবে জালিমের ষড়যন্ত্র।’ মজলুম জাতি যতই সন্তোষ ও মেনে নেয়ার আচরণ প্রকাশ করুক না কেন, জালিমের জুলুমের মানসিকতা কখনো শেষ হবে না। বাবরি মসজিদের পর জ্ঞানবাপী মসজিদের বিষয়টিও ফয়েজ আহমদ ফয়েজের এই পঙ্ক্তির বাস্তব ব্যাখ্যা যেন। সুপ্রিম কোর্ট বাবরি মসজিদের স্থলে যখন হিন্দু সম্প্রদায়ের ভগবান রামের মন্দির নির্মাণের ফায়সালা দিয়েছিলেন, তখন সাধারণ মুসলমান দুঃখ ও কষ্টের এক মর্মান্তিক পরিস্থিতি অতিক্রম করা সত্ত্বেও এটা ভেবে নিজেদের মনকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন যে, মুসলমানদের রক্তে রঞ্জিত একটি উপাখ্যান শেষ হলো। কিন্তু তারা কি এটা জানতেন যে, ‘তুমি লক্ষবার সন্তোষ প্রকাশ করলেও কবে শেষ হবে জালিমের ষড়যন্ত্র?’

বারানসীর (বেনারসের) জ্ঞানবাপী মসজিদও একেবারে বাবরি মসজিদের মতোই ষড়যন্ত্রের টার্গেটে পড়েছে। এটিও ধীরে ধীরে বাবরি মসজিদের পরিণামের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভারতে মন্দিরের জন্যও তেমনি আবেগ, উত্তেজনা ও সাম্প্রদায়িকতার পরিবেশ সৃষ্টির পূর্ণ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে, যেভাবে বাবরি মসজিদের ব্যাপারে হয়েছে। এখন ধীরে ধীরে কিছু কথা জনগণের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হবে। তন্মধ্যে সর্বপ্রথম হবে মসজিদের পরিবর্তে ‘অবকাঠামো’ পরিভাষা ব্যবহার। এরপর এই ‘অবকাঠামো’ শব্দের সাথে ‘বিতর্কিত’ জুড়ে দেয়া হবে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে এ বিষয়ে বিতর্কিত বলতে কিছু নেই। অন্য কারো মালিকানার ওপর মিথ্যা দাবি করার দ্বারা সেটা ‘বিতর্কিত মালিকানা’ হয়ে যায় না। তবে মিথ্যা দাবিদারদের সফলতার প্রথম ধাপ জনগণের মাথায় এ কথা ঢুকিয়ে দেয়ার মাঝে রয়েছে যে, উল্লি­খিত মালিকানা ‘বিতর্কিত’। বাবরি মসজিদের ক্ষেত্রে ‘বিতর্কিত অবকাঠামো’ ব্যবহারের ষড়যন্ত্র এ পরিমাণ সফল হয়েছিল যে, কিছু মুসলিম সাংবাদিক ও কলামিস্ট পর্যন্ত তার ফাঁদে পড়ে বেশ কিছু স্থানে ‘অবকাঠামো’ শব্দ লিখতেন। জ্ঞানবাপী মসজিদের ব্যাপারেও এমনটাই হচ্ছে।

বারানসীর নিম্ন আদালতের ব্রাহ্মণ বিচারপতি আশুতোষ তেওয়ারি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মাধ্যমে জ্ঞানবাপী মসজিদের সার্ভে করার নির্দেশ দিয়ে বিষয়টিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছেন। এ নির্দেশ দিতে গিয়ে বিচারপতি সংবিধান এবং ওই আইনেরও কোনো পরোয়া করেননি, যেখানে বলা হয়েছে, ‘১৫ আগস্ট, ১৯৪৭ সালে কোনো ধর্মীয় স্থান, সেটা যে ধর্মেরই হোক না কেন, তার কোনো পরিবর্তন করা যাবে না।’ ১৯৯১ সালে কংগ্রেস সরকার এই আইন এমন সময় প্রণয়ন করেছিল, যখন বাবরি মসজিদ বিষয়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের আন্দোলন চরমে ছিল। কংগ্রেস সরকার বাবরি মসজিদের মামলার কারণে সঙ্ঘ পরিবারের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে শুধু বাবরি মসজিদ পর্যন্ত আটকে রাখতে এবং এই ষড়যন্ত্রকে আরো ছড়িয়ে পড়াকে প্রতিহত করতে এই আইন প্রণয়ন করেছিল।

কংগ্রেস তার ইতিহাসে যে কয়েকটি ভালো কাজ করেছে, এই আইন তার মধ্যে অন্যতম। নরসিমা রাওয়ের নেতৃত্বাধীন সরকার ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আইনটি প্রণয়ন করেছিল, অর্থাৎ বাবরি মসজিদ শাহাদতের প্রায় এক বছর আগে। ওই আইন অনুযায়ীÑ ১৫ আগস্ট, ১৯৪৭ সালে ভারতে অবস্থিত কোনো ধর্মীয় স্থান, সেটা যে ধর্মেরই হোক না কেন, তার কোনো পরিবর্তন করা যাবে না। ওই স্থান ওই ধর্মের হিসেবেই গণ্য হবে। তবে কংগ্রেসও বাবরি মসজিদকে এই আইনে অন্তর্ভুক্ত করার সাহস করতে পারেনি। তাদেরও হিন্দু ভোট ব্যাংক হারিয়ে যাওয়ার ভয় ছিল। এ জন্য বাবরি মসজিদ মামলাকে এই আইন থেকে বাইরে রাখা হয়।

এই আইনে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানসমূহকে আলাদা রাখা হয়েছে। তবে পাশাপাশি এটাও স্পষ্ট করে দেয়া হয় যে, ওই সব স্থানকে প্রতœতাত্ত্বিক স্থান হিসেবে গণ্য করা হবে, যা ১৯৫৮ সালের সার্ভেতে উল্লেখ করা থাকবে। জ্ঞানবাপী মসজিদ কোনোভাবেই প্রতœতাত্ত্বিক স্থান নয়। বারানসীর ওই বিচারপতির কি এত গুরুত্বপূর্ণ আইন জানা নেই? অথচ এই আইন অধিকাংশ মিডিয়ারও সৌন্দর্য বর্ধন করছে। বিচারপতির আসনে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি কীভাবে দেশের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন ভুলে যেতে পারেন? মূলত ‘তেওয়ার জি’র এই আইন ভালো করেই জানা আছে। এতদসত্ত্বেও তিনি আইনের ল্যাবেল লাগিয়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে মসজিদের পর্যবেক্ষণ করা, অতঃপর তার প্রতিবেদন তৈরির নির্দেশ দিয়ে বিষয়টিকে আরো ‘বিতর্কিত’ বানানোর বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। এর দ্বারা বিষয়টি নতুনভাবে সবার নজরে আসবে, জনগণের মাঝে আলোচনার বিষয়ে পরিণত হবে, অতঃপর ধীরে ধীরে এই বিষয়টিও চরমভাবে বিস্ফোরিত হবে একেবারে বাবরি মসজিদের মতো।

অবশ্য বিজেপি এখন পর্যন্ত এ বিষয়ের সাথে জড়িত হয়নি এবং এখন পর্যন্ত এটা নিয়ে কোনো রাজনীতি করেনি। তবে এটার কোনো নিশ্চয়তা নেই যে, ভবিষ্যতে তারা এটা নিয়ে রাজনীতির খেলা খেলবে না। হতে পারে, তারা এ বিষয়টিকে বর্তমানে হিমাগারে রেখে ওই সময়ে ব্যবহারের পরিকল্পনা রেখেছে, যখন তাদের এ বিষয়টির সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দেখা দেবে। বাবরি মসজিদের শাহাদতের সময় বিজেপির মঞ্চ থেকেই স্লোগান উঠেছিল- ‘ইয়ে তো আভি ঝাঁকি হ্যায়, কাশি মথুরা বাকি হ্যায়- অর্থাৎ এটা তো কেবল একটা ধাক্কামাত্র, কাশি মথুরা তো রয়েই গেছে।’ এছাড়া ১৯৯১ সালে যখন পার্লামেন্টে ‘ধর্মীয় স্থানসমূহ সংরক্ষণ’ আইনের বিল উত্থাপন করা হয়েছিল, তখন বিজেপি ওই আইনের চরম বিরোধিতা করেছিল। অর্থাৎ বিজেপি ‘হিন্দু-মুসলিম’ বিষয়টিকে শুধু বাবরি মসজিদ পর্যন্ত সীমিত রাখার পরিকল্পনায় ছিল না। আইনের বিরোধিতা মূলত এ তারই বহিঃপ্রকাশ ছিল।

এবার আওরঙ্গজেবের ব্যাপারে কিছু কথা বলা দরকার। জ্ঞানবাপী মসজিদের ব্যাপারে এ কথা বলা হয়, সম্রাট আওরঙ্গজেব মন্দির ধ্বংস করে সেখানে মসজিদ নির্মাণ করেছেন। এখানে একটি প্রশ্ন রয়েছে, যদি মন্দির ধ্বংস করারই প্রয়োজন হয়ে থাকে, তাহলে তিনি মন্দিরের একটি অংশকেই কেন ধ্বংস করলেন এবং অবশিষ্ট অংশকে মন্দির হিসেবে কেন রেখে দিলেন? ইতিহাসবিদ ড. বিশ্বম্ভর নাথ পাণ্ডে ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত এলাহাবাদ মিউনিসিপ্যালিটির মেয়র ছিলেন। তখন তার কাছে জমিসংক্রান্ত একটি বিচার আসে। দু’জন পূজারী মন্দিরের জন্য এই জমির মালিকানার দাবিদার ছিল। ড. বিশ্বম্ভর নাথ উভয়কে তাদের দাবির পক্ষে দলিল-প্রমাণাদি উপস্থিত করতে বললেন। তাদের মধ্যে একজন আওরঙ্গজেবের ফরমানের দলিল দস্তাবেজ তার সামনে পেশ করল।

পূজারী বলল, আওরঙ্গজেব এই জমি মন্দিরের জন্য প্রদান করেছিলেন। এছাড়া নগদ অর্থ এবং বাড়তি কিছু জমিও দিয়েছিলেন। যাতে মন্দিরের খরচাদি ওই বাড়তি জমি থেকে পূরণ করা যায়। বিশ্বম্ভর নাথ তৎকালীন বিখ্যাত কংগ্রেস নেতা স্যার তেজ বাহাদুর সাপরুকে ওই দস্তাবেজগুলো দেখান। কেননা সাপরু ফার্সি জানতেন। সাপরু ওই দস্তাবেজগুলোকে সঠিক বলে অভিহিত করেন। বিশ্বম্ভর নাথ ওই পূজারীর পক্ষে মন্দিরের রায় দিয়ে দিলেন। কিন্তু এরপর বিশ্বম্ভর নাথ আওরঙ্গজেবের পক্ষ থেকে মন্দিরগুলোকে দেয়া দানগুলো নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এরপর তিনি যে তথ্য প্রকাশ করেছেন, তা অবাক করে দেয়ার মতো বিষয়। বিশ্বম্ভর নাথ তার গবেষণাকে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছেন। তার নাম রাখেন ‘আওরঙ্গজেব’। ওই গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, আওরঙ্গজেব তার শাহি কাফেলা নিয়ে বাঙ্গালার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলেন। ওই কাফেলায় সৈন্যদের সাথে কয়েকজন হিন্দু রাজাও ছিলেন। যাত্রাপথে তারা যখন বেনারস পৌঁছলেন, তখন হিন্দু রাজারা আওরঙ্গজেবের কাছে আবেদন জানালেন, এই স্থানে কয়েক দিনের জন্য অবস্থান করুন। এটা আমাদের, হিন্দুদের পবিত্র শহর। অবস্থান করলে আমরা এখানে গঙ্গা স্নানও করতে পারব এবং ভগবানের দর্শনও লাভ করতে পারব। আওরঙ্গজেব এ আবেদন মেনে নিলেন। এখানে ছাউনি ফেলা হলো। কাফেলার হিন্দু লোকজন দর্শন লাভ ও স্নানে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ওই সময় হিন্দু রাজাদের রানীরা গঙ্গা স্নানের জন্য পাল্কিতে চড়ে গঙ্গার তীরে পৌঁছলেন। স্নানের পর তারা ‘বিশ্বনাথ মন্দিরে’ দর্শন লাভের জন্য গেলেন এবং সেখান থেকে নিজ নিজ পালকিতে চড়ে ফিরে এলেন। তবে তাদের মধ্যে ‘গাছ’-এর রানী ফিরে আসেননি। সময় গড়িয়ে যেতেই বিষয়টি নিয়ে অস্থিরতা বাড়তে থাকে। রানীকে অনেক খোঁজা হলো, কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না।

হিন্দু রাজারা আওরঙ্গজেবের কাছে গিয়ে সব খুলে বললেন। আওরঙ্গজেব এ ঘটনা শুনে অস্থির হয়ে পড়লেন। তিনি রানীকে খুঁজে বের করতে শাহী ফরমান জারি করলেন। রানীকে খুঁজতে চিরুনি অভিযান চলল। অবশেষে মন্দিরের ভূগর্ভস্থ ঘর থেকে রানীর লাশ উদ্ধার করা হলো। রানীকে যৌন নিপীড়নের আলামত পাওয়া গেল। হিন্দু রাজারাও এটা জানলেন যে, এসে মন্দিরে এই ঘৃণ্য কর্ম দীর্ঘ দিন ধরেই চলে আসছে। হিন্দু রাজারা আওরঙ্গজেবের কাছে আবেদন জানালেন, মন্দিরের এই অংশকে ধ্বংস করে দেয়া হোক যাতে অপর মন্দিরগুলো এ ধরনের অপকর্মকারীদের জন্য শিক্ষা নিতে পারে। এরপর মন্দিরের এই অংশকে ধ্বংস করে দেয়া হয় এবং এখানে একটি শাহী ছাউনি বা ক্যাম্প বানানো হয়। এই ক্যাম্পের সৈন্যদের নামাজ আদায়ের জন্য মন্দিরের পাশে মসজিদ নির্মাণ করে দেয়া হলো। আওরঙ্গজেবের যদি মন্দির ধ্বংস করাই উদ্দেশ্য থাকত, তাহলে তিনি পুরো মন্দিরকেই ধ্বংস করতেন। যেমনটা ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২ করসেবকরা বাবরি মসজিদের সাথে করেছিল। সুতরাং জ্ঞানবাপী মসজিদ ধ্বংস করে তৈরি করা হয়নি। বরং অভিশপ্ত স্থান ধ্বংস করার পর তার পাশে সেটা নির্মিত হয়েছে।

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক উর্দুটাইমস ১১ এপ্রিল,
২০২১ থেকেভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব

ahmadimtiajdr@gmail.com

* লেখক: ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us